বের কর ওকে, সামনের সীট থেকে বলল ড্রাইভার।
গাড়ির দরজা খোলার শব্দ শুনল কিশোর। শক্ত হাত চেপে ধরল তাকে। ঠেলে বের করল গাড়ি থেকে। মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিল। জুতোর নিচে ঝরা পাতা, ঘাস, আর কঠিন মাটি।
ব্যাগটা খুলে নাও। দেখে দেখে নিজেই হাটুক।
একটানে কিশোরের মাথার ওপর থেকে থলেটা খুলে নেয়া হল। ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে আসা আলো চোখ ধাধিয়ে দিল যেন তার। আলো সইয়ে নেয়ার জন্যে চোখ মিটমিট করল সে। মুখ থেকে খুলে নেয়া হল কাপড়।
এখন অনেকটা আরাম লাগছে, না? বলল গাট্টাগোট্টা লোকটা যার নাম ভেজ। খুলে দিলাম বলেই যে চিৎকার করবে তা হবে না। একদম চুপ থাকবে। নইলে…, কিশোরের চোখের সামনে এনে পিস্তলটা নাড়ল সে।
মাথা ঝাঁকাল শুধু কিশোর। কিছু বলল না। যখন থেকেই বুঝতে পেরেছে তার আসল পরিচয় জানালে মারাত্মক বিপদে পড়ে যাবে তখন থেকেই চুপ হয়ে। গেছে সে। কথা বলতেও ভয় লাগছে এখন। লোকগুলো তার ইংরেজি শুনে যদি বুঝে যায় যাকে ধরেছে সে পিন্টার নয়! কিশোরের কথায় লোকগুলোর মত টান। নেই। পিটার ওদের দেশের ছেলে হয়ে থাকলে একই রকম টান থাকার কথা। খুব সাবধান হতে হবে এখন তাকে। ছোট্ট একটা ভুলও মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে। পারে।
এক মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল ডেভ। তারপর ফিরল সঙ্গীর দিকে। ব্যাগ তো খুললাম।
আরও সহজ ভাবে শ্বাস নিতে পারল কিশোর। লোকগুলো তাকে চিনতে পারেনি এখনও কাজেই আপাতত নিরাপদ। দ্রুত চারপাশে তাকাল সে। পর্বতের গোড়ায় ওকের বন আর চাপারালের ঘন ঝোপের মাঝখানে আরেকটা কাঁচা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অপরিচিত জায়গা। রকি বীচের একশ মাইলের মধ্যে এরকম জায়গা অনেক আছে।
কিশোরকে হাঁটার নির্দেশ দিল জন, অর্থাৎ ড্রাইভার। ড়েভের চেয়ে লম্বা, পাতলা শরীর। কালো চুল। ছোট ছোট চোখ কোটরে বসা। চোখের কোণের চামড়ায় ভাজ। ডেভের মত একই রকম রোদে পোড়া। একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে দিচ্ছে, এমন কোনও দেশ থেকে এসেছে লোকগুলো, যেখানে ভীষণ গরম, রোদ খুব কড়া।
পথের পাশের ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে চলল ওরা। পঞ্চাশ গজ মত এগিয়ে ডানে ঘুরল। পর্বতের দিকে মুখ করে এগোল। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। শুধু ঘন, প্রায় দুর্ভেদ্য ঝোপ।
জন, তুমি আগে যাও, ডেভ বলল। ব্যাগগুলো নিয়ে যাও।
মাথা ঝাঁকাল ড্রাইভার। ব্যাগ মাটিতে নামিয়ে রেখে টেনে ঝোপ ফাঁক করল। বেরিয়ে পড়ল একটা সরু পায়েচলা পথ। তার ভেতরে দুটো ব্যাগ ঠেলে দিয়ে নিজেও ঢুকে পড়ল। গিলে ফেলল যেন তাকে ঝোপ।
এবার তুমি যাও, কিশোরকে আদেশ দিল ডেভ।
এক মুহূর্ত ঝোপটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। টেনে ফাঁক করল ঝোপের ডাল। ঢুকে পড়ল ভেতরে। হাত থেকে হঠাৎ ছুটে গেল চ্যাপারালের শক্ত ডাল। কাঁটাঝোপের আঘাত থেকে মুখ বাঁচাতে এক ঝটকায় হাত তুলে নিয়ে এল মুখের কাছে, ঢেকে ফেলল। লাফিয়ে পিছাতে গিয়ে গাছের গোড়ায় পা বেধে উল্টে পড়ে গেল। তাকে টেনে তুলল ডেভ। ঠেলে আবার ঢুকিয়ে দিল ঝোপের ভেতর।
ধমক দিয়ে বলল, এরকম চমকে দিলে কিন্তু ট্রিগারে চাপ লেগে যাবে আমার।
ঢোক গিলল কিশোর। সরু পথ ধরে যতটা সম্ভব জোরে হাঁটতে লাগল। তার পেছনেই লেগে রয়েছে ডেভ, হাতে পিস্তল। কিছুদূর এগোতেই আবার ঘন ঝোপ। পড়ল সামনে। পথটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তবে সামনের লোকটাকে দেখতে পাচ্ছে! ঝোপের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে।
তাকে অনুসরণ করল কিশোর। না দেখে ফেলতে গিয়ে পা আবার বেধে গেল। একটা শেকড়ে। পড়ে গেল উপুড় হয়ে। হাপাচ্ছে। উঠে পড়ল আবার পেছনের লোকটা তার গায়ে হাত দেয়ার আগেই।
লোকগুলোর কিছু হচ্ছে না। ঘন ঝোপের ভেতর দিয়ে এমন সাবলীল ভঙ্গিতে এগোচ্ছে, দেখলে মনে হয় জায়গাটা ওদের পরিচিত। আগেও এসেছে এখানে। ওদের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে যেন হিমশিম খাচ্ছে কিশোর। পথটাই দেখতে পাচ্ছে না। আরও দুবার আছাড় খেল। তারপর এসে ঢুকল পর্বতের গভীরে সরু একটা বক্স ক্যানিয়নে।
দুধারে পাহাড়ের উঁচু দেয়াল। এক দেয়ালের গা ঘেঁষে রয়েছে ছোট একটা পাথরের কেবিন। কেবিনের দরজা খুলল ওদের একজন। আরেকজন ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল কিশোরকে। আবার লাগিয়ে দেয়া হল দরজা।
নির্জন কেবিনে ঢুকে শুনতে পেল কিশোর, দরজায় তালা লাগানোর শব্দ।
.
থানায় এসেছে মুসা, রবিন, রাশেদ পাশা আর মেরিচাচী। দেয়াল ঘেঁষা একটা বেঞ্চে বসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে।
আমাদের ইমারজেন্সি সিগন্যালগুলো যদি সঙ্গে থাকত! আফসোস করল মুস্রা।
থাকবে কি করে? মনে করিয়ে দিল রবিন, ওগুলো তো মেরামতই হয়নি। তবে যোগাযোগের একটা না একটা উপায় বের করেই ফেলবে কিশোর।
কড়া চোখে শেরিফ আর চীফের দিকে তাকালেন মেরিচাচী। সারাদিনই। এখানে বসে থাকব নাকি? কিডন্যাপাররা তো আর খেলা করছে না যে হাসতে হাসতে এসে ধরা দেবে।
মাথা নাড়লেন চীফ। ভাববেন না। সব রকম চেষ্টাই করা হচ্ছে। পুরো শহর আর কাউন্টি এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছে। পালাতে পারবে না কিডন্যাপাররা। এসব কিডন্যাপিঙের কেসে খুব হুশিয়ার থাকতে হয় আমাদের। একটা ভুলচুক হলেই মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। কাজেই তাড়াহুড়া করে রিস্ক তো আর নিতে পারি না।
যা যা করার সবই করা হচ্ছে, শেরিফ বললেন। ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা, অরিগম, অ্যারিজোনার সমস্ত পুলিশ বিভাগকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এ বি আইকে খবর দেয়া হয়েছে। মেকসিকান অথরিটিকে জানান হয়েছে। টেলিটাইপ করে মার্সিডিজের লাইসেন্স নম্বর জানিয়ে দেয়া হচ্ছে প্রতিটি পেট্রল কারকে। পুলিশের ডিপার্টমেন্ট অভ দা মোটর ভেহিকলকেও জানানো হচ্ছে।