স্থির হয়ে গেল কিশোর। বাবা? কিন্তু তার তো বাবা নেই। সে অনেক ছোট থাকতেই মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সেটাই বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কথা বেরোল না মুখ দিয়ে।
পাঁজরে পিস্তলের খোঁচা খেল সে। ধমক দিল লোকটা, দেখ ছেলে, আর হুশিয়ার করব না।
তার পরেও থামল না কিশোর। বোঝানোর চেষ্টা করলই।
পিস্তলের খোঁচা না দিয়ে বরং এবার হেসে উঠল লোকটা। একেবারে বাবার মতই হয়েছে। একরোখা। তাই না, জন? হবেই। রক্তের দোষ।
থামাও ওকে ডেভ, সামনের সীট থেকে বলল অন্য লোকটা। ওরকম করতে থাকলে তো দম আটকেই মরে যাবে।
পেটালে পারি এখন। কথা তো শুনছে না।
হুঁ, মুশকিল। কোনও ক্ষতিও করা চলবে না। একটা মুহূর্ত নীরব রইল জন। সুস্থ অবস্থায় বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। নইলে লাভ হবে না আমাদের।
আবার হাসল ডেভ। স্যার মনটেরো যখন খবর শুনবে পিটারকে কিডন্যাপ করেছি আমরা, মুখখানা কেমন হবে দেখতে ইচ্ছে করছে এখনই। আমাদের কথা না শুনে পারবে না তখন।
সামনে ঝুঁকে ছিল, সীটে হেলান দিল কিশোর। স্যার মনটেরো? পিটার? বুঝে গেছে আসল ব্যাপারটা কি ঘটেছে। লোকগুলো তাকে অন্য কেউ বলে ভুল করেছে। এমন কেউ যার বাবা একজন নামী দামী ব্যক্তি, হোমড়া চোমড়া কেউ। টাকার জন্যে কিডন্যাপ করেনি। অন্য কারণ। হয়ত ব্ল্যাকমেল করবে। স্যার মনটেরো যে-ই হোন, তাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্য করবে। কিন্তু ভুল করে বসেছে ওরা। ভুল লোককে তুলে এনেছে। সেটাই ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করল।
পিস্তল দিয়ে খোঁচা মেরে তাকে আর চুপ করাতে চাইল না লোকটা। পাহাড়ী রাস্তার নিচে নেমে এসেছে গাড়ি। সমতল পথ ধরে জোরে ছুটছে এখন। তীক্ষ্ণ মোড় নিল আচমকা। আর্তনাদ করে উঠল চাকা। প্রায় ছিটকে গিয়ে সীটের কিনারে ধাক্কা খেল কিশোর। এই সময় শোনা গেল সাইরেন। পুলিশ! বাড়ছে সাইরেনের শব্দ। ক্ষণিকের জন্যে দম বন্ধ করে ফেলল সে। তাহলে পুলিশ আসছে, তাকে বাঁচাতে..কমে যেতে শুরু করল আবার সাইরেনের ওয়াও ওয়াও। মিলিয়ে গেল দূরে।
ধরে ফেলেছিল আরেকটু হলেই! বলল কিশোরের পাশে বসা লোকটা, ডেভ।
আমাদের পেছনে লেগেছে? সামনের লোকটার প্রশ্ন।
তাই তো। দেখলে না পর্বতের দিকে চলে গেল ওরা। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি জানল কি করে?
কি করে জেনেছে, কিশোর বুঝতে পারছে। রোলস রয়েসে টেলিফোন আছে। নিশ্চয় ফোন করেছে তার বন্ধুরা। কিন্তু লাভ হল না। পার পেয়ে গেল। কিডন্যাপাররা। ধরতে পারেনি পুলিশ। লোকগুলোকে এখন বোঝানো দরকার যে ওরা ভুল করেছে।
কিন্তু আরেকটা কথা মনে পড়তেই ঘামতে শুরু করল সে। ভয়ে। ভুল লোককে ধরে এনেছে ওরা, এবং সেটা এখনও জানে না। পিটার নামে একটা ছেলেকে দরকার ওদের, কিশোর পাশাকে নয়। পিটারকে মারবে না ওরা, তাহলে তার বাবার বিরুদ্ধে অস্ত্রটা হারাবে। কিন্তু ভুলটা যখন বুঝতে পারবে ওরা তখন কি করবে?
.
কাঁচা রাস্তা ধরে গর্জন করতে করতে ছুটে এল দুটো গাড়ি। একটা পুলিশের। অন্যটা শেরিফের। ধুলোর মেঘ উড়িয়ে এসে ব্রেক কষে থামল দুটোই। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। লাফিয়ে নেমে দৌড়ে এলেন কাউন্টির শেরিফ আর পুলিশ। চীফ ইয়ান ফ্লেচার।
ওদের দেখেছেন? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল রবিন।
ধরতে পেরেছেন ওদের? জানতে চাইল মুসা।
মাথা নাড়লেন চীফ। হাইওয়ের প্রথম ক্রসরোডটা ব্লক করে দিয়েছি আমরা। তারপর সোজা চলে এসেছি এখানে। গাড়িটা তো দেখলাম না। রেডিব্লকের কাছেও নেই।
তাহলে নিশ্চয় আমরা ব্লক করার আগেই বেরিয়ে গেছে, শেরিফ অনুমান করলেন। হাইওয়ের পাশের কোনও রাস্তায় নেমে যেতে পারে। বেশি দূর যেতে পারেনি নিশ্চয়। আরও লোক লাগাতে হবে আমাদের। দিকে দিকে খুজতে বেরিয়ে যাক।
এটা কাউন্টি এলাকা, ছেলেদেরকে বললেন চীফ। এখানে শেরিফের দায়িত্ব। তবে এরকম কেসে আমরা মিলেমিশেই কাজ করি। লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ ডিপাটমেন্টকে সতর্ক করে দিয়েছি।
এখন, শেরিফ বললেন। এখানে সূত্র খুঁজতে হবে আমাদের।
কিছু পাবেন বলে মনে হয় না, স্যার, রবিন বলল। এখানে বেশিক্ষণ থাকেনি কিডন্যাপাররা। সূত্র ফেলে যাওয়ার কথা নয়।
ঠিকই বলেছে সে। কাঁচা রাস্তার প্রতিটি ইঞ্চি খুঁজে দেখলেন শেরিফ আর চীফ মিলে। কিছুই পেলেন না।
অল রাইট। অবশেষে চীফ বললেন, এখানে থেকে আর লাভ নেই। থানায় চলে যাই। এফ বি আইকেই খবর পাঠাতে হবে।
হ্যাঁ, স্যার, ততটা আশা করতে পারছে না রবিন। এভাবে খুঁজে লাভ হবে। না। একটা গাড়ি খুব ছোট্ট জিনিস, তাই না?
হোক ছোট। পুরো কাউন্টি ঘিরে ফেলব আমরা। সমস্ত রাস্তা ব্লক করে দেব। ওদের বেরিয়ে যাওয়ার কোনও পথই খোলা রাখব না।
রোলস রয়েসে গিয়ে উঠল রবিন আর মুসা। একেবারে চুপ। হ্যানসন যখন পুলিশের গাড়িটাকে অনুসরণ করল তখনও কিছু বলল না, ওরা। নীরবে শুধু তাকাল একবার পরস্পরের দিকে। চোখে অস্বস্তি। একই কথা ভাবছে দুজনে।
রোডব্লক যে করা হবে কিডন্যাপাররাও নিশ্চয় জানে সেটা। কি করে বেরোতে হবে প্ল্যানট্যান করেই রেখেছে। বেরিয়ে যাবে। সাথে করে নিয়ে যাবে। কিশোরকে।
.
০৪.
থেমে গেল মার্সিডিজ।
থলের ভেতরে মুখ লুকানো। স্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্যে নাকের ডগার সমান ছোট একটা ফুটো কেবল। কিছুই দেখতে পারছে না কিশোর। অনুমানে বোঝার চেষ্টা করেছে কোন পথে কোন দিকে এগিয়েছে গাড়ি। কয়টা মোড় নিয়েছে মনে। রেখেছে। কান পেতে রয়েছে পরিচিত শব্দের আশায়। এমন শব্দ, যেটা থেকে বুঝতে পারে কোথায় রয়েছে। কিন্তু কোনও শব্দই নেই। শুধু শূন্য নীরবতা। কোথাও কোনও নড়াচড়া নেই। না মানুষের, না যানবাহনের, না সাগরের।