তোমার এই খাবারের চিন্তা মাথা থেকে নামাও তো, বিরক্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বলাই তো হল তুমি ভুলে না খেয়ে থাকলে ইঁদুরে খেয়েছে। ওই গাড়িটা কি চায় দেখা দরকার।
রবিন হাসল। হয়ত আরেক প্যাকেট লাঞ্চ চুরির সুযোগ খুঁজছে।
মনে হয় কিছু চায়, রবিনের কথা যেন শুনতেই পেল না কিশোর। দেখি।
রহস্যের গন্ধ পেয়েছে কিশোর, বুঝতে পারল অন্য দুজন। কি করে জানি পেয়ে যায় সে, অনেকবার দেখেছে রবিন আর মুসা। কখনও ভুল করে না। এখনও সেরকমই আচরণ করছে গোয়েন্দাপ্রধান।
মুসা, ইয়ার্ডের পেছনে চলে যাও, জরুরী কণ্ঠে বলল কিশোর। লুকিয়ে থেকে গাড়িটার ওপর চোখ রাখ। লাল কুকুর চার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি আমি আর রবিন। বেড়ার চারপাশে চক্কর দিয়ে আসব। রবিন, তুমি বাঁয়ে যাও, আমি ডানে যাচ্ছি। এতে সব দিক থেকেই নজর রাখতে পারব। মুসা, চলে যাও।
মাথা ঝাঁকাল মুসা। দেখল, তিন গোয়েন্দার গোপন প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে তার বন্ধুরা। সে-ও রওনা হল। জঞ্জালের স্তূপের আড়ালে আড়ালে চলে এল মেইন গেটের কাছে। বেড়ার আড়ালে থেকেই উঁকি দিয়ে দেখল, মার্সিডিজটা আগের জায়গাতেই রয়েছে। ভেতরে দুজন লোক। চট করে মাথা নিচু করে ফেলল সে। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল খোলা গেটের দিকে। উপুড় হয়ে পড়ে থেকেই ঘুরে তাকাল আবার।
এই যে, কিছু হারিয়েছ? সাহায্য করব?
ঢোক গিলল মুসা। গাট্টাগোট্টা একজন লোক। রোদে পোড়া চামড়া। হালকা স্যুট। তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাদামী কোঁকড়া চুল লোকটার। নীল চোখ। মুখে মোলায়েম হাসি। ইয়ার্ডের ভেতরে মুসাকে ওভাবে হামাগুড়ি দিতে দেখে যেন খুব মজা পাচ্ছে।
আমি…আমি…, নিজেকে বোকা বোকা লাগছে মুসার। ইয়ে-বল হারিয়ে ফেলেছি। সেটাই…খুঁ-খুঁজছি…
এদিকে তো কোনও বল দেখলাম না, লোকটা বলল।
তাহলে অন্য কোনও দিকে চলে গেছে হয়ত, ভোঁতা গলায় বলে উঠে দাঁড়াল মুসা।
হ্যাঁ, তা হতে পারে। লোকটার হাতে একটা লোক্যাল ম্যাপ। সেটা দেখিয়ে মুসাকে বলল, সাহায্য করবে একটু? হারিয়ে গেছি আমরা।
সবুজ মার্সিডিজের দরজা খুলে গেল। ভেতরে আরেকজন লোককে দেখতে পেল মুসা। সেদিকে ফিরে মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল রোদেপোড়া লোকটা, বোঝাতে চাইল দুজনেই হারিয়েছে। বলল, সেই তখন থেকে ঘুরে মরছি। বার বার একই জায়গায় ফিরে আসছি। পুরনো মিশনারিটা খুঁজছি আমরা।
লোকটার কথায় বিদেশী টান। ইংরেজিই বলছে তবে ইংরেজ নয় সেটা স্পষ্ট। তাহলে এই ব্যাপার! ভাবল সে। দুজন পথ হারানো টুরিস্ট। কিশোর পাশার রহস্য খোঁজায় তাহলে শুরুতেই ছাই পড়ল।
নিশ্চয় করব। ম্যাপটা নিয়ে দেখিয়ে দিল মুসা, কোস্ট হাইওয়ের কোন জায়গায় রয়েছে স্প্যানিশ মিশনটা। গোলমেলে রাস্তা। খুঁজে বের করাটা একটু জটিলই।
ঠিকই, মাথা ঝাঁকাল লোকটা। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
গাড়িতে গিয়ে উঠল লোকটা। চলতে শুরু করল সবুজ মার্সিডিজ। দৌড়ে এল কিশোর আর রবিন। গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোয়েন্দাপ্রধান।
টুরিস্ট, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা। লোকটার কাছে কিভাবে ধরা পড়ে গিয়েছিল জানাল। ইংরেজিই বলে, তবে অদ্ভুত টান।
পথ হারিয়েছে? হতাশ গলায় বলল কিশোর। আর কিছু না?
আর কি হবে? হাতে কোনও কেস নেই আমাদের যে পেছনে লাগবে।
গম্ভীর হয়ে আছে কিশোর। চিন্তিত। পথ হারাতেই পারে, যেহেতু বিদেশী, কিন্তু—
এর মাঝে আবার কিন্তু দেখলে কোথায়? ওরা পথ হারিয়েছে। ব্যস।
বাদ দাও, হাত নাড়ল রবিন। চল, ম্যাজিক মাউনটেইনে কখন কিভাবে যাব সেই আলোচনা করিগে।
হ্যাঁ, চল। মনে করিয়ে দিল মুসা। তবে তার আগে আমার খাবারেরও ব্যবস্থা কর। বড্ড খিদে পেয়েছে।
.
০২.
পরদিন সকাল সকাল উঠল রবিন। হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পড়ে তাড়াহুড়ো করে এসে রান্নাঘরে ঢুকল। গপগপ করে নাস্তা গিলছে, এই সময় খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন তার বাবা।
কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার মিলফোর্ড। জরুরী তদন্ত আছে মনে হয়?
না, বাবা। আজ আমরা ম্যাজিক মাউনটেইনে যাচ্ছি তো, তাই। হ্যানসনকে রোলস রয়েস নিয়ে আসতে বলা হয়ে গেছে। সময়মত হাজির হয়ে যাবে সে। ব্রিটিশ শোফার। খুব সময় জ্ঞান। তার কাছে লজ্জা পেতে চাই না।
ও, শিস দিয়ে উঠলেন মিস্টার মিলফোর্ড। তিনজন সম্ভ্রান্ত বিশিষ্ট ভদ্রলোক। ভাল।
একেবারেই কি অস্বীকার করতে চাও?
আরে না না, হাসলেন মিস্টার মিলফোর্ড। আসলেই তোমরা ভদ্র। রোলস রয়েসে চড়ে যাচ্ছ তো, সেজন্যেই সম্ভ্রান্ত আর বিশিষ্ট শব্দ দুটো যোগ করলাম।
বাবা, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাই। ডিনারের সময় ফিরব, মাকে বোলো। দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল রবিন।
রোদ উঠছে। সকালের প্রায় নির্জন রাস্তা দিয়ে দ্রুতবেগে সাইকেল চালাল। সে। ইয়ার্ডের গেট দিয়ে ঢোকার সময়ই দেখল অফিসের সামনে বারান্দায় একটা টুলে বসে রয়েছে মুসা। তাকিয়ে রয়েছে কালো বিশাল রোলস রয়েসটার দিকে। গাড়ি বটে একখান। মনে মনে আরেকবার তারিফ না করে পারল না রবিন।
গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা, ফিটফাট শোফারের পোশাক পরা একজন লোক। হ্যানসন। রবিনকে দেখে হাসল। গুড মর্নিং, রবিন।
গুড মর্নিং, জবাব দিল রবিন।