নিরাশ হয়ে ফিরে এল মুসা। বন্ধুদের জানাল, ঘর বানানর মত কিছুই পাওয়া যায়নি। মাছটার কথাও বলল।
দাঁড়াও দাঁড়াও, হাত তুলল রবিন। বইয়ে পড়েছি, সাইবেরিয়ার আমুর নদীর ধারেও মানুষ বাস করে। এমন কোন গাছপালা নেই ওখানে, যা দিয়ে ঘর বানানো যায়। তাই মাছের চামড়া দিয়ে ঘর বানায় লোকে।
হেসে উঠল মুসা। ওসব সীল-টীলের চামড়া দিয়ে বানায় আরকি। হাঙরের চামড়া দিয়ে কে বানাতে যাবে?
দোষ কি? বলল কিশোর। চল তো দেখি। আমার মনে হয় ব্যবস্থা একটা হয়ে গেল।
দানব মাছটাকে দেখতে এল ওরা।
আহা, কি সুন্দর মুখ, মুখ বাঁকিয়ে কিশোর বলল। সারা প্রশান্ত মহাসাগরে এত সরল মুখ আর নেই। মাছটার চামড়ায় হাত বোলাল সে। সিরিসের মত খসখসে। কাটা সহজ হবে না। তবে ছুরিটুরি ভালই আছে আমাদের। পেটের চামড়াটা তুলে নেব আমরা। মুসা, তুমি গলার কাছ থেকে শুরু কর। রবিন, তুমি লেজের কাছে, পাখনার ওপর থেকে। আমি পেটের দুই পাশ থেকে চিরছি।
ভীষণ শক্ত চামড়া। এমন সব জায়গা আছে, ছুরিই বসতে চায় না। সেসব জায়গায় প্রবাল পাথর দিয়ে ছুরির বাটে বাড়ি মেরে ফলা ঢোকাতে হচ্ছে।
দরদর করে ঘামছে কিশোর। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, কেটে ছাড়াতে পারলে ভালই হবে। যা শক্ত, নারকেল পাতার চেয়ে অনেক বেশি টেকসই হবে, একেবারে ক্যানভাস। অ্যাসবেসটসের চেয়েও বেশি টেকসই হবে।
অত টেকার দরকার নেই আমাদের, রবিন বলল। আরও অনেক কম টিকলেও চলবে। দুতিন হপ্তার বেশি তো থাকছি না আমরা এই দ্বীপে।
খচ করে কাটা বিঁধল যেন কিশোরের মনে। ওরা এখনও জানে না, কোনদিনই আর ফিরবে না ডেংগু। বলে দেবে? জানাতেই যখন হবে, দেরি করে লাভ কি? শুনে আগে থেকেই মনকে শক্ত করুক।
নিশ্চয়! হালকা গলায় বলল কিশোর। কিন্তু ধর, আর ফিরল না। তাহলে?
থেমে গেল মুসার ছুরি। আমাদের তাহলে কি হবে ভেবেছ?
কি আর হবে, বলল রবিন। মরব।
না, এত সহজে মরছি না, কিশোর বলল। বেঁচে যাবই। কোন না কোন উপায় নিশ্চয় হয়ে যাবে। চুপ করে না থেকে এখন যা করছি করি। এই, মুসা, ওই কোনাটা ভালমত ছাড়াও। বাপরে বাপ, কি মোটা চামড়া!
হাসল মুসা। গণ্ডারেরও এত মোটা কিনা সন্দেহ।
দুই ঘন্টা কঠোর পরিশ্রমের পর দম নেয়ার জন্যে থামল ওরা। চামড়া অর্ধেক ছাড়িয়েছে। এমনিতেই সাংঘাতিক দুর্গন্ধ ছিল, চামড়া ছাড়ার পর অসহ্য হয়ে উঠেছে। মাথায় যেন গরম হাতুড়ি পিটছে সূর্য। রোদের তেজ এড়ানর জন্যে চোখের পাতা প্রায় বুজে রেখেছে ওরা। শার্টের হাতা দিয়ে মুখ মুছল মুসা। টর্নিকেট, ব্যাণ্ডেজ, আর কপালে পট্টি দিতেই শেষ হয়েছে কিশোরের শার্ট। মুসারটার না দিয়েই মুখ মুছল।
এক গ্লাস পানি যদি পেতাম, মুসা বলল।
তাই তো! চমকে উঠল কিশোর। একবারও মনে হয়নি ও-কথা! ছাউনির চেয়েও বেশি দরকার পানি, খাবারের চেয়েও। থাক, কাজকর্ম এখন বাদ। বাকিটা কালও সারতে পারব। এখন চল, কুমালো কেমন আছে, দেখে, পানির খোঁজ করি।
ঘুমিয়ে আছে কুমালো। গায়ের ওপর থেকে সরে গেছে গাছের ছায়া। ধরাধরি করে তাকে সরাল কিশোর আর মুসা। পট্টি শুকিয়ে গেছে, ভিজিয়ে এনে আবার ওটা কপালে রাখল রবিন।
তারপর শুরু হল পানির খোঁজ। পানি পাওয়া যাবেই, জোর গলায় একথা একে অন্যকে শুনিয়ে রওনা হল ওরা। কিন্তু মনে মনে প্রত্যেকেই জানে, পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। রুক্ষ এই রোদেপোড়া প্রবালদ্বীপে কোথায় থাকবে মিষ্টি পানি?
হারিক্যানের সময় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে, কিশোর বলল। পাথরের মাঝে বড় গর্তটৰ্ত থাকলে আটকে থাকার কথা। রোদে নিশ্চয় সব শুকিয়ে যায়নি এখনও।
তীরের কাছে পাওয়া গেল একটা গর্ত, বেশ বড় গামলার মত। তাতে কিছু পানি আটকে রয়েছে। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে আঁজলা ভরে তুলে মুখে দিল মুসা। থু থু করে ফেলে দিল পরক্ষণেই।
দূর! লবণ!
বৃষ্টির পানি নয়, ঝড়ের সময় সাগরের পানিই উঠেছিল এখানে। আরও কিছু গর্ত পাওয়া গেল, তাতে পানির দাগ আছে, পানি নেই। শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই।
নারকেল গাছের গোড়াগুলোয় খুঁজে দেখল কিশোর।
নিশ্চয় ফল ছিল গাছে, রবিন বলল।
এক আধটা নারকেল পেলেও আপাতত চলত, বলল মুসা।
হ্যাঁ, কিশোর বলল। পানি তো হতই। খাবারও।
নারকেলের মিষ্টি পানি আর শাঁসের কথা ভেবে জিভে জল এল তিনজনেরই।
অনেক খুঁজল ওরা। কিন্তু একটা নারকেলও মিলল না।
মুশকিল হয়েছে কি, কিশোর বলল। নারকেল পানিতে ভাসে। ঝড়ের সময় যা পড়েছিল সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ঢেউ।
তাহলে? ভুরু নাচাল মুসা। এবার কি করব?
খুঁড়ব, বলে সৈকতের দিকে রওনা হল কিশোর। ভাটার সময় ল্যাগুনের পানি নেমে গেলে নাকি অনেক সময় কিনারে মাটির তলায় মিষ্টি পানি পাওয়া যায়। আচ্ছা, এই জায়গাটা কেমন মনে হয় তোমাদের? পা দিয়ে দেখাল সে, ঠিক এই পর্যন্ত ওঠে পানি। পা আরেকটু নিচের দিকে সরাল, এখানটায়?
আমার কাছে পাগলামি মনে হচ্ছে, বলল মুসা। নোনা পানির নিচে আবার মিষ্টি পানি থাকে কি করে?
কি করে থাকে, জানি না, রবিন বলল। তবে আমিও পড়েছি। আমার মনে হয় বিচিত্র কোন প্রাকৃতিক কারণে বৃষ্টির পানি জমেটমে থাকে আরকি।
বেশ, খুঁড়ি তাহলে, বলে চ্যাপ্টা একটা পাথর তুলে নিয়ে ওটাকে বেলচা বানিয়ে বালি খুঁড়তে শুরু করল মুসা।