চুপচাপ শুয়ে থাক, কিশোর বলল।
জোর করে মুখে হাসি ফোঁটাল কুমালো। কি কি ঘটেছে আমি ঘুমানোর সময়? দারুণ কিছু মিস করেছি?
না, তেমন কিছু না। শুধু ডেংগুকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয়েছি আমরা। বিদায়? চলে গেছে, বোট নিয়ে। পোনাপে থেকে জাহাজ আর ডুবুরি নিয়ে আসবে।
বড় বড় হয়ে গেল কুমালের চোখ। বিশ্বাস করেছ ওর কথা? ফাঁকি দিয়েছে সে, ধাপ্পা দিয়েছে। ভয় দেখিয়ে তোমাদেরকে দিয়ে কাজ আদায় করতে চেয়েছে। দেখ, রাতের আগেই ফিরে আসবে আবার। আমাদেরকে এই অবস্থায় এখানে ফেলে যেতে পারে না সে।
আল্লাহ করুক, তাই যেন হয়, আশা করল মুসা।
কিন্তু যদি সত্যিই চলে গিয়ে থাকে, তাহলে পোনাপেতে পৌঁছতে অন্তত তিন দিন লেগে যাবে তার। জাহাজ আর ডুবুরি জোগাড় করতে কম করে হলেও এক হপ্তা। ভাল ডুবুরি মেলানো খুব কঠিন। দুই তিন হপ্তাও লাগতে পারে। তারপর আরও তিন-চার দিন লাগবে এখানে আসতে। তিন হপ্তায় এখানে আমাদের কি হবে বুঝতে পারছে না সে?
না পারার কোন কারণ নেই, কিশোর বলল। তবে ও-ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই তার।
এক হপ্তাও যদি লাগে আসতে, নিঃসঙ্গ পাথরগুলোর দিকে তাকাল কুমালো, কড়া রোদে যেন ঝলসাচ্ছে ওগুলো। গেছি আমরা। জানো কেন মানুষ নেই এটাতে?
না। কেন?
কারণ এখানে মানুষ বাস কতে পারবে না। কেউ কখনও চেষ্টা করেছে বলেও মনে হয় না। জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিস এখানে নেই। যা-ও বা কিছু ছিল, সব ধ্বংস হয়ে গেছে হারিক্যানে। এমনকি এখন পাখি পর্যন্ত থাকতে পারবে না এখানে। ল্যানে মাছ দেখিনি। মুসা যে নাম রেখেছে, মরা দ্বীপ, ঠিকই রেখেছে। এখানে থাকলে ক্ষুধায় ধুকে ধুকে মরতে হবে।
চোখ বুজে চুপচাপ যন্ত্রণা সহ্য করল কিছুক্ষণ কুমালো। তারপর আবার চেয়ে, হাসল। ওভাবে বলা উচিত হয়নি আমার। আসলে দুর্বল হয়ে পড়েছি তো, আবোলতাবোল…ভেব না, উপায় বের করেই ফেলব আমরা। বেঁচে যাব। কষ্ট করতে হবে আরকি, অনেক খাটতে হবে। এভাবে এখন শুয়ে থাকলে চলবে না আমার, জোর করে উঠে বসল কুমালো।
শুয়ে থাক! তীক্ষ্ণ হল কিশোরের কণ্ঠ। এই দেখ, কি কাণ্ড করেছ! আবার রক্ত বেরোতে শুরু করেছে। কোন ওষুধ নেই আমাদের কাছে।
কে বলল নেই? দুর্বল কণ্ঠে বলল কুমালো। ওষুধের বাক্সের ওপরই তো শুয়ে আছি। একটা নারকেলের কাণ্ডে মাথা রেখেছে সে।
এটা দিয়ে কি হবে?
দুরি দিয়ে বাকলটা চাছো। পাউডারের মত বেরোবে। ওগুলো জখমে লাগিয়ে। দাও। অ্যাসট্রিনজেন্ট, রক্ত পড়া বন্ধ করবে।
পচন ধরাবে না তো আবার?
আরে না না, যে কড়া রোদ। টেরিলাইজ করে দিয়েছে। একেবারে জীবাণুমুক্ত।
পলিনেশিয়ানদের ভেষজ জ্ঞানের কথা শুনেছে কিশোর। লতাপাতা, ঘাস, শেকড়, আর গাছপালা থেকে ওষুধ তৈরি করতে নাকি ওরা ওস্তাদ। অনেক জটিল রোগের সার্থক চিকিৎসা করে ফেলে। কিন্তু শুকনো নারকেলের কাণ্ডও যে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়, ভাবতে পারেনি।
তর্ক করল না সে। ছুরি দিয়ে চাছতে আরম্ভ করল। পাউডার জমল। ওগুলো নিয়ে জখমে রেখে শার্ট ছিঁড়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।
কুমালোর কপালে হাত দিয়ে দেখল রবিন। গরম। জ্বর উঠছে। অল্পক্ষণেই অস্থির হয়ে গেল কুমালো।
ছায়া দরকার, মুসাকে বলল কিশোর। ছায়ায় নিয়ে রাখতে হবে এখন ওকে।
যতদূর চোখ যায়, পুরো চীফটায় চোখ বোলাল ওরা। ছায়া নেই কোথাও। ওদের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করছে যেন শুধু রুক্ষ পাথর।
এক জায়গায় কাছাকাছি হয়ে জন্মেছিল কিছু নারকেল গাছ, কাণ্ডগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে এখন। সামান্য ছায়া আছে ওখানে। সেখানেই কুমালোকে শুইয়ে দিল। ওরা। এমন কিছু ছায়া নয়, রোদের আঁচ ঠেকাতে পারছে না, তবু নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। সূর্য সরার সাথে সাথে ছায়া সরছে, কুমালোকেও সরাতে হচ্ছে।
এভাবে হবে না, কিশোর বলল। ছাউনি-টাউনি একটা কিছু তৈরি করতেই হবে।
তিক্ত হাসল মুসা। কোন ভরসা নেই।
কিন্তু নেই বলে বসে থাকল না। পুরো দ্বীপটায় খুঁজে দেখতে চলল ছাউনি বানান মত কিছু পাওয়া যায় কিনা।
বিড়বিড় করে কথা বলতে লাগল কুমালো। শোনার জন্যে প্রায় তার মুখের কাছে কান নিয়ে যেতে হল কিশোর আর রবিনকে।
কুমালো বলছে, কিশোর, আমার কথায় দুশ্চিন্তা কোরো না। বাড়িয়েই বলেছি। কোন না কোনভাবে টিকে যাবই আমরা। বেশিদিন তো নয়। এক কি দুহপ্তা, বড়জোর তিন। ডেংগু আসবে। আসতেই হবে তাকে। মুক্তার লোতে। সে
এলে অবশ্য আশা নেই আমাদের, কোন জাহাজ আসে না এদিকে। অসুবিধে নেই। ডেংগুই আসবে। আর আসতে কষ্ট হবে না তার, দ্বীপটার অবস্থান তো জানাই আছে।
া, কুমালো, কিশোর বলল। এখন ঘুমানর চেষ্টা কর তো একটু।
ওদেরকে ভয় পাওয়াতে চাইল না কিশোর। সে কেবল একলা জানে, ডেংগু কখনও ফিরে আসবে না। আসতে পারবে না।
বোটে লগবুক আছে। সেটার রীডিং অনুসরণ করবে ডেংগু। তাকে ফকি দিতে চেয়েছিল কিশোর। কিন্তু নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়েছে এখন। শুধু সে
একা নয়, আরও তিনজনকে নিয়ে পড়েছে।
লগবুকের রীডিং অনুসরণ করে একশো মাইল দূরে চলে যাবে ডেংগু। কিছুতেই বুঝতে পারবে না পার্ল ল্যাগুন কোথায় আছে। হয়ত খুঁজবে। যথাসাধ্য চেষ্টা করবে দ্বীপটা খুঁজে বের করার। পাওয়ার সম্ভাবনা হাজারে এক, হয়ত বা লাখে। মাসের পর মাস, সারা বছর ধরে খুঁজলেও হয়ত বের করতে পারবে না। কয়েক মাইলের মধ্যে চলে এলেও চোখে পড়বে না, কারণ দ্বীপটা সমুদ্র সমতল থেকে মাত্র দশ ফুট উঁচু, তা-ও যেখানটায় সবচেয়ে বেশি। গাছপালা নেই। পানি থেকে আলাদা করে দ্বীপটাকে চেনা খুব কঠিন। সঠিক রীডিং জানা থাকলেই শুধু খুঁজে বের করা সম্ভব।