মুহূর্তের জন্যে বেকারের দাঁতের বা অর্ধেক নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠলো। কিশোরের দিকে ফিরলো। তুমি কে?
হাসিটা ফিরিয়ে দিলো কিশোর। তোতলাতে লাগলো, কি-কি-কি-কি-কিশোর পাশা!
হ্যাঁ। এখন তা-ই। তখন কি ছিলে?
কি-কি-কি-কি-কিশোর পাশা। সব সময়ই আমি কি-কি-কি-কিশোর পাশা। কুঁচকে গেছে তার কপাল। একেবারে বুদ্ধ বনে গেছে যেন। গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে বহুবার দেখছে, বোকার ভাণ করে থাকলে অনেক ফল পাওয়া যায়।
বেকার যখন আবার জিজ্ঞেস করলো, পাগল সংঘে কিসের অভিনয় করতো, জবাবে কিশোর জানালো, বাবা-বাচ্চার। কথা আমার খুব বেশি ম-ম-ম-মনে থাকে না।
অবশেষে বেকারকেই কিশোরের পরিচয় করিয়ে দিতে হলো দর্শকদের কাছে। কিশোর পাশাই ছিলো মোটুরাম। অনেক দর্শকই স্বীকার করবেন, পাগল সংঘের প্রাণ ছিলো সে-ই। খুব বড় অভিনেতা।
পরিচয়ের পালা শেষ হলে বেকার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, কে কি কাজ করছে এখন।
আমি রিসিপশনিস্ট, নেলি জানালো। স্যান ফ্রানসিসকোর এক অফিসে।
নিশ্চয় খুব ভালো রিসিপশনিস্ট তুমি। লোকে অফিসে ঢুকে ওরকম সুন্দর একটা মুখ দেখে নিশ্চয় খুশি হয়। অনেক মিষ্টি হাসি নিশ্চয় উপহার পাও তুমি।
না, মাথা নাড়লো নেলি। দাঁত তোলার আগে রোগীর মুখের অবস্থা দেখেছেন? ওরকম করে রাখেমুখ।
কথার খেই হারিয়ে ফেললো বেকার। শুরু করার আগেই কথা থামিয়ে দিলো মেয়েটা। অন্য ভাবে চেষ্টা করে দেখলো সে, অভিনয় তো ভালোই করতে। একেবারে ছেড়ে দিয়েছো নাকি?
আমি অভিনয় ছাড়িনি, বরং অভিনয়ই আমাকে ছেড়েছে। দশবহুর বয়েসের পর থেকে নতুন আর কোনো ছবিতে অভিনয়ের অনুরোধ আসেনি আমার কাছে।
তারমানে তোমার মা-বাবা চেয়েছেন ইস্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখে তুমি সাধারণ জীবন যাপন করো…
আবার মাথা নাড়লো নেলি। না, তা তারা চায়নি। চাপ দিয়ে বার বার আমাকে ওরা অভিনয়ের দিকেই ঠেলে দিতে চেয়েছে। সাধারণ জীবন যাপন করার উপায় ছিলো না আমার।
কেন? সেকথা জিজ্ঞেস করার আগেই নেলি জবাব দিয়ে দিলো, লোকে আমাকে দেখলেই টিটকারি দিয়ে তো বটিসুন্দরী, বটিসুন্দরী। বহু বছর ওদের জ্বালায় রাস্তায় বেরোতে পারিনি আমি, ইস্কুলে তো আরও খারাপ অবস্থা। কি করতো, বলবো?
হাসিমুখে মাথা ঝাঁকালো বটে বেকার, কিন্তু তার চোখ দেখেই কিশোর বুঝলো, নেলি খুলে বলুক সেটা মোটেও চায় না সে।
নেলিও কললো না। বললো, যদি কখনও আমার বাচ্চা হয়, তাকে কর খোঁড়ার কাজ শিখতে বলবো রং, তবু অভিনেতা হতে দেবো না। কবর খোঁড়ার মাঝেও অন্তত কিছুটা শান্তি আর ভবিষ্যৎ আছে।
ভবিষ্যতের কথাই যখন বলছে, প্রসঙ্গ থেকে সরে যাওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করলো না বেকার, তখন তোমার নিজের কথাই বলো। কি করবে ভাবছো?
এই প্রথম তার দিকে তাকিয়ে হাসলো নেলি। টাকা জোগাড় করতে পারলে কলেজে ভর্তি হবো। এই সুন্দর চেহারা নিয়ে মহা অশান্তিতে আছি আমি। চেহারার চেয়ে মন আর মগজটা সন্দর হলে সেটা বরং আমার অনেক কাজে লাগবে।
তা লাগবে।
নেলির সঙ্গে আলোচনা শেষ করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বেকার। মড়ার খুলির দিকে ফিরলো। সে যদি ভেবে থাকে তার সাথে আলোচনাটা নেলির চেয়ে সহজ হবে, তাহলে ভুল করেছে। জানা গেল একটা মোটর গ্যারেজে মেকানিকের চাকরি
কিভাবে কি করে জানতে চেয়ে বেকার পড়লো বিপদে। মড়ার খুলি ঝাঁঝালো গলায় বললো, অন্যের গাড়ির নিচে সারাদিন চিত হয়ে পড়ে থাকি আমি। আমার নাকেমুখে টপ টপ করে ঝরে পড়ে পোড়া তেল। সারা গায়ে তেলকালি লেগে যায়। আঙুল, এমনকি নখের ভেতরে গ্রীজ ঢোকে। ওই আঙুল দিয়ে যখন র্যাঞ্চ ধরার চেষ্টা করি।
তাড়াতাড়ি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল বেকার। আবার কি অভিনয়ের জগতে ফিরে আসতে চাও? তুমিই বললে তুমি খুব ভালো অভিনেতা।
অভিনয়? ফুহ! আপনি জানেন, এই শহরে কতোজন অভিনেতা না খেয়ে মরতে বসেছে?
জানে না বেকার। আর জানলেও সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। আচ্ছা, তুমি কি কখনও নেলির মতো বিপদে পড়েছো? মানে, রাস্তায় জ্বালাতন করেছে লোকে?
ওরকম জ্বালায় পড়েনি একথা স্বীকার করতে বাধ্য হলো মড়ার খুলি। বললো, অভিনয় ছেড়ে দেয়ার পর আর মাথা কামালাম না। চুল গজিয়ে গেল। আমার বিখ্যাত কানদুটোও ঢেকে গেল চুলে। চেহারা এমন বদলে গেল, তখন হঠাৎ আমার নিজের মাও দেখলে চিনতে পারতো কিনা সন্দেহ। লোকে চিনতেও পারলো না, যন্ত্রণা থেকেও বাঁচলাম।
ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছে প্রশ্ন করে অহেতুক বিপদে পড়তে গেল না বেকার। ভারিপদের দিকে ফিরলো। সে জানালো, বেশির ভাগ সময়ই বেকার থেকেছে সে, কাজ পায়নি। তবে শিকারী কুকুর অবাক করলো বেকারকে। সে জানালো হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে।
বেকারের প্রশ্ন ছাড়াই সে বলে গেল, আমি একদিক থেকে ভাগ্যবান। আমার বাবা উকিল। তিনি কখনোই আমাকে অভিনেতা বানাতে চাননি। তার এক শাসালো মক্কেলের চাপাচাপিতেই ছেলেকেলায় আমাকে অভিনয় করতে দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর যখন বুঝলেন, এসব করে আমার ভবিষ্যৎই শুধু ঝরঝরে হবে, লাভ কিছু হবে না, আমাকে অভিনয়ের জগত থেকে ছাড়িয়ে এনে ইস্কুলে ভর্তি করে দিলেন।
বেকার জানতে চাইলো, অভিনয় ছেড়ে দেয়ার পর রাস্তায় বিপদে পড়েছে কিনা শিকারী কুকুর।