- বইয়ের নামঃ দি মার্ডার ইন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ নালন্দা
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
দি মার্ডার ইন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস
১. প্রথম পর্ব : ঘটনাপ্রবাহ
মার্ডার ইন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি
প্রথম পর্ব : ঘটনাপ্রবাহ
০১.
টরাস এক্সপ্রেসে একজন বিশিষ্ট আগন্তুক
সবেমাত্র ভোর পাঁচটা শীতের সকাল সিরিয়ায়। ঘুমের আমেজই কাটেনি ভালো করে। টরাস এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে আলেপ্লার প্ল্যাটফর্মের ধারে। তাতে রাজকীয় বন্দোবস্ত রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের সুবিধার জন্য। রান্নার ব্যবস্থা, খাবার জায়গা, শোয়ার জন্য বগি-কামরা আর দুটো কোচ।
ফরাসী সেনাবাহিনীর একজন লেফটন্যান্ট দাঁড়িয়ে ঠিক শোয়ার কামরার দরজার মুখে। একজন ছোটখাটো গুফেঁ মানুষেরর সঙ্গে ব্যস্তভাবে কথা বলছেন। শুধু গোলাপী নাকের ডগাটুকু ছাড়া মানুষের আপাদমস্তক গরম জামাকাপড়ে ঢাকা।
হাত পা যেন জমে যায়। আঃ, কি ঠান্ডা! যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বেরোতে আপত্তি জানাতে পারে কিন্তু নিজের কর্তব্য পালনে অতিমাত্রায় সচেতন ও তৎপর লেফটন্যান্ট দুবো। তিনি ব্যস্ত ছিলেন অতিথিটির মনোরঞ্জনে মার্জিত ফরাসীভাষায়। কি যেন এক অজ্ঞাত কারণে জেনারেল সাহেব তার উপরওয়ালা দুবো তা জানেন। এই বেলজিয়ান ভদ্রলোককে তলব পাঠান আতঙ্কিত হয়ে। একজন হোমরাচোমড়া অফিসার আশ্চর্যজনক ভাবে মাত্র সাতদিন পরেই আত্মহত্যা করেন। আর একজন পদত্যাগ করেন। কি যেন এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে সামরিক পরিস্থিতি একেবারে ঠান্ডা হয়ে যায়। অমন ছুঁদে জেনারেলেরর মুখেও হাসি ফুটে ওঠে–আহা দশবছর আয়ু যেন কমে গেছে।
সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ছুটে আসা জেনারেল এই বেলজিয়ান ভদ্রলোকটিকে বলছেন, আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন বন্ধু, ফরাসী সেনাবাহিনীর মান রেখেছেন, আপনি রক্তপাত বন্ধ করেছেন অযথা। সব কাজ ফেলে আপনি যে আমাদের অনুরোধ রাখতে এগিয়ে আসবেন আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল এই সৌভাগ্য। আপনি এত কষ্ট করে…। দুবোর কানে এসেছিল।
বেলজিয়ান ভদ্রলোকটি হাত পা নেড়ে তার কথা থামিয়ে দিয়ে (নাম এরকুল পোয়ারো) বললেন, একি বলছেন, ছি ছি, একসময় আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছিলেন। আমার কি মনে নেই।
খানিকক্ষণ কথার মারপ্যাঁচে তারপর পরস্পরে মনোরঞ্জন চলল। অবশেষে জেনারেল পোয়ারোকে গাঢ় আলিঙ্গন করে বিদায় নিলেন।
প্রকৃত ঘটনাটা কি লেফটেন্যান্ট দুবো অবশ্য জানেন না। এই সম্মানিত অতিথিকে ট্রেন ছাড়বার আগে পর্যন্ত তার উপর দায়িত্ব দেওয়া আছে রক্ষণাবেক্ষণ করা। আর বলা যায় না তো, হয়তো কর্তৃপক্ষ খুশী হয়ে প্রমোশনই দিয়ে দিল।
আজ হল রোববার, দুবো বললেন, কাল সোমবার আপনি ইস্তাম্বুলে সন্ধ্যায় পৌঁছে যাবেন (দূর ছাই কথাবার্তা চালানোই দায়। কতক্ষণ আর শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঐ আধবুড়ো গুফে লোকটার সাথে বকবক করা যায়। তাই তো মনে হয়, মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন। কটা দিন নিশ্চয়ই থাকবেন?
ইস্তাম্বুলে যাইনি কখনও। ইচ্ছে তো আছে–শহরটা একটু ঘুরে দেখব ভাবছি।
খুব সুন্দর শুনেছি আমি এখনও দেখিনি অবশ্য। ঠান্ডা কনকনে বাতাস বয়ে গেল এক ঝলক প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে, দুজনেই কেঁপে উঠলেন। লেফটেন্যান্ট দুবো ঘড়ি দেখলেন আর পাঁচ মিনিট বাকি আছে পাঁচটা বাজতে।
নেহাত দায়ে না পড়লে তোক বেরোয় না। বছরের এই সময়টা এত ঠান্ডা থাকে বুঝলেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
যা বলেছেন।
বরফ পড়া শুরু হবে না আশা করি।
এই সময়টা হয় নাকি?
তবে এ বছরে এখনো হয়নি, সাধারণত এই সময়ে হয়। ইউরোপের অবস্থা তো বেশ খাবপি শুনেছি। তাহলে বাবা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই যেন বরফ পড়া শুরু হয়, অন্ততঃ দপ্তর থেকে যা খবর পাঠাচ্ছে তাতে সেইরকমই মনে হয়। বলকান অঞ্চলে তো যথেষ্ট বরফ পড়ছে।
হা ওখানে অবস্থা খুবই খারাপ। একই অবস্থা জার্মানীতেও শুনলাম।
আপনি কনস্তান্তিনোপোলে মনে হয় সন্ধ্যে সাতটা চল্লিশ আন্দাজ আশা করি পৌঁছে যাবেন।
যা বলেছেন, হ্যাঁ দারুণ জায়গা শুনেছি।
অপূর্ব।
ট্রেনের স্লিপার কামরার একটা জানালা খুলে গেল ঠিক মাথার উপর। মাথা নাড়ালেন একজন তরুণী।
মেরী ডেবেনহ্যাম বাগদাদ ছেড়েছেন গত বৃহস্পতিবার। তারপর থেকে একটু ভালো করে ঘুমাতে পারেননি, কি হোটেলে কি ট্রেনে। জানালা খুলতে বাধ্য হলেন মেরী। ওঃ ট্রেনের ভেতরটা কি গরম।
কোনো স্টেশন এটা! আলেপ্পা নিশ্চয়ই। অবশ্য দেখবার কি-ই বা আছে? সারি সারি টিমটিমে বাতি জ্বলছে। লম্বাটে প্ল্যাটফর্ম, দুজন লোক ফরাসী ভাষায় কথা বলছে জানালার ঠিক নিচেই। একজন লোক তো ফরাসী সেনাবাহিনীর অন্যজন ছোটখাট গোঁফওয়ালা। কি কাণ্ড! আপনমনেই হাসলেন মেরী যত রাজ্যের গরম জামাকাপড় গায়ে চাপিয়েছেন আধ বুড়ো ছোট্ট ভদ্রলোকটি। বাইরে হয়তো দারুণ ঠান্ডা কে জানে, ইস জানালাটা আর একটু নামিয়ে দিতে পারলে ভালো হত।
ট্রেন ছাড়বার সময় হয়েছে, কণ্ডাক্টর গার্ড দুবোর দিকে এগিয়ে এল। টুপি খুললেন ছোটখাটো মানুষটি, এবার উঠে পড়ার দরকার। এমা কেমন ডিমের মতো মাথা। হেসে উঠলেন মেরী ডেবেনহ্যাম। কি অদ্ভুত দেখতে ভদ্রলোককে। দেখলেই মজা করতে ইচ্ছে করে।
বিদায় ভাষণটা আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন লেফটেন্যান্ট দুবো। পরিষ্কার মার্জিত ভাষায় শেষ মুহূর্তের স্তুতি শুরু করলেন। যথেষ্ট বিনয়ীও মঁসিয়ে পোয়ারো।
গাড়ি ছাড়বার সময় হয়েছে মঁসিয়ে, কন্ডাক্টর বলল। পোয়ারো গাড়িতে উঠলেন অনিচ্ছুক পায়ে তার পিছু পিছু কণ্ডাক্টর। লেফটেন্যান্ট দুবো লম্বা স্যালুট ঠুকলেন। হাত নাড়লেন মঁসিয়ে পোয়ারো, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটি চলতে শুরু করল।
কণ্ডাক্টর তার স্লিপার কোচ দেখাচ্ছিল পোয়ারোকে। এই যে, আপনার ব্যাগটা এখানে রাখলাম, দেখুন মঁসিয়ে কেমন চমৎকার ব্যবস্থা।
বকশিশ দিলেন কণ্ডাক্টর গার্ডকে এরকূল পোয়ারো। আপনি বোধহয় ইস্তাম্বুলে যাবেন? আপনার পাসপোর্ট আর টিকিট আমার কাছেই থাকবে ধন্যবাদ স্যার।
বেশি লোক তো যাচ্ছে না, না?
হা। না। ওখানে নামবেন দুজনেই ইংরেজ। ভারতবর্ষ থেকে এসেছেন একজন-কর্নেল বাগদাদ থেকে আসছেন আর একজন তরুণী। আর কিছু কি লাগবে আপনার?
এক বোতল পেরিয়ার চাইলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। সূর্য উঠতে এখনও ঘণ্টা দুয়েক দেরি এই ভোর পাঁচটায় ট্রেনে উঠা বিরক্তিকর। কটা দিন যা খাটুনি গেছে এই যা ভালো। যাক শেষ রক্ষা হয়েছে। গুটি সুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
তার যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেলা সাড়ে নটা। তড়িঘড়ি গরম কফি খেতে তিনি পা বাড়ালেন কিচেন কোচের দিকে।
সেই সময় সেখানে একজন মাত্র উপস্থিত, অবশ্যই কন্ডাক্টর বর্ণিত ইংরেজ তরুণী। লম্বা, রোগা, তামাটে গায়ের রঙ আঠাশ-বছর বয়স। আত্মবিশ্বাস বোধও প্রবল, খুব চালাক চতুর আর চটপটে। অন্তত নিপুণভাবে খাওয়ার ধরন দেখে সেটাই মনে হয়। কফির জন্য কণ্ডাক্টরকে যেভাবে আদেশ করলেন, তাতে মনে হয় তরুণীটির ভ্রমণের অভ্যেস আছে। বেশ গরম ট্রেনের ভেতরটা, সেইমতো পাতলা সূতির জামা পরেছেন।
কোনো কাজ নেই পোয়ারোর হাতে, কাজেই তিনি তরুণীর প্রতি মনোনিবেশ করলেন। এই যুবতীটি সেই ধরনের যারা সবরকম অবস্থায় নিজেদের বাঁচিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। নরম ধূসর রঙের চোখ। কালো কুচকুচে ঢেউ খেলানো চুল, গায়ের চামড়া নরম মসৃণ। এক কথায় যথেষ্ট আকর্ষণীয়া। তাঁর নিঃশব্দ পর্যবেক্ষণ শুরু হল।
চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বয়স একজন আগন্তুকের প্রবেশ ঘটল তার খানিকপর। সুগঠিত মেদহীন তামাটে চেহারা।
পোয়ারো স্বগোক্তি করলেন এই সেই কর্নেল। আগন্তুক তরুণীর দিকে ইষৎ ঝুঁকে অভিবাদন জানালেন।
সুপ্রভাত নিন ডেবেনহ্যাম।
সুপ্রভাত কর্নেল আবাথনট।
আপনার টেবিলে বসতে পারি?
নিশ্চয়ই। বসুন।
অসুবিধা নেই তো কোনো?
কিছুমাত্র না।
পোয়ারোর দিকেও একবার তাকালেন তিনি। বেয়ারাকে হাতের ভঙ্গিতে ডেকে ডিম আর কফির অর্ডার দিলেন কর্নেল আবাথনট। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি কর্নেল ভাবছে ব্যাটা ভিনদেশী উড়ে এসে জুড়ে বসেছে পোয়ারো ভাবলেন।
ঐ ভদ্রমহিলা আর কর্নেল দুজনেই ইংরেজ কাজেই গল্প টল্প করতে পারেন না কেউই। টুকটাক কথা চলছিল। মেরী উঠে তার কামরার দিকে চলে গেলেন একটু পরেই।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দুপুরের খাবার সময়ও। দায়সারাভাবে কথাবার্তা চালাতে লাগলেন কর্নেল আর মেরী একই টেবিলে বসে। ঘরে তৃতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ পোয়ারার উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাঞ্জাবের গল্প করছিলেন কর্নেল। তিনি বাগদাদে এক পরিবারে গভর্নেস ছিলেন, তরুণীর কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল। কিছু পরিচিত লোকজনের কথা উঠল দুজনেরই কথায় কথায়। সুতরাং দুজনেই স্বাভাবিক অল্পবিস্তর এখন। আপনি কি সোজা লন্ডনেই যাচ্ছেন না কি ইস্তাম্বুলে নামবার ইচ্ছে আছে, কর্নেল জিজ্ঞাসা করলেন।
না সোজা লন্ডনে যাব।
ইস, ইস্তাম্বুল শহরটা দেখা হবে না।
না না আমি দু বছর আগে তিনদিন থেকে ইস্তাম্বুলে সব ঘুরে বেড়িয়ে গেছি।
আমি সোজা লন্ডনেই যাব। তাহলে তো ভালোই হল, অকারণেই একটু লাল হলেন কর্নেল।
বেচারা। মনে মনে মুচকি হাসলেন পোয়ারো। সায় দিলেন মিস ডেবেনহ্যাম।
এক সঙ্গে যাওয়া যাবে ভালোই হল।
তাঁর কামরা পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। এবার কর্নেল মেরীর সঙ্গে। এরপর অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য টরাসের। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সকলে। মেরীর দীর্ঘশ্বাস শুনে চমকে উঠলেন হঠাৎ।
মেরী খুব মৃদুস্বরে বললেন, এত সুন্দর আমি যদি–ঘাড় ফেরালেন আবাথনট।
কি?
সব কিছু যদি উপভোগ করতে পারতাম।
কোনো উত্তর দিলেন না আবাথনট। তার দৃঢ় চোয়াল দৃঢ়তর হল।
তুমি এসব ঝামেলা থেকে দূরে থাক আমি প্রার্থনা করি ঈশ্বরের কাছে।
ভ্রূ বাঁকালেন মিস ডেবেনহ্যাম।
তুমি চুপ কর।
কর্নেল পোয়রোর দিকে বিরক্তি মাখানো চোখে এক ঝলক তাকালেন। কিন্তু ঠিক আছে–তোমার এই চাকরিটা আমার পছন্দ নয়। সর্বক্ষণ মায়েদের আর বাচ্চাদের তাবেদারী করা।
ইস এভাবে বোলো না। আমাদের মতো গভর্নেসদের আজকাল আর কেউ চোখ রাঙিয়ে কথা বলে না বরং মায়েরাই আমাদের ভয় পায়। চুপ করে রইলেন আবাথনট।
বাঃ দিব্যি জুটিটি, আপনমনেই ভাবলেন পোয়ারো। ট্রেন কেনিয়াতে এসে পৌঁছলো রাত সাড়ে এগারোটায়। হাত পা টান করতে স্টেশনে নামলেন দুজন ইংরেজ। হালকা পায়ে পায়চারি করতে ব্যস্ত দুজনেই। দুজনকে জানালা দিয়ে দেখছেন পোয়ারো। তিনি গরম জামা কাপড় পরে মিনিট দশেক পর সাহস সঞ্চয় করে হাত-পায়ের খিল ছাড়িয়ে নিতে নিচে নামলেন।
আবছা ছায়ামূর্তি দুটি খানিকটা দূরে। কথা বলছেন আবাথনট।
মেরী…
লক্ষ্মীটি এখন না না সব শেষ হয়ে যাবে।
ত্রস্তপায়ে পিছু হঠলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। তারপর স্বগতোক্তি করলেন আশ্চর্য।
কেউই প্রায় কারোর সঙ্গে কথা বলছে না, রীতিমতো সন্দেহ হতে লাগলো। রীতিমতো চিন্তিত মেয়েটি। তার চোখের কোণে কালি পড়েছে। হঠাৎ থেমে গেল ট্রেনটা দুপুর আড়াইটার সময়। লাইনের ধারে জটলা বিভিন্ন কামরা থেকে লোকজন উঁকি মারছে। মুখ বাড়িয়ে পোয়ারো কণ্ডাক্টর-এর সঙ্গে কথা বললেন। মেরী ডেবেনহ্যামের সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগল পোয়ারোর, মাথাটা ভেতরে গলাতে গিয়ে।
ট্রেনটা থামল কেন? মেরী শঙ্কিত গলায় ফরাসী ভাষায় বললেন।
কিছু না একটু আগুন লেগেছিল কিচেন কোচের নিচে, ভয়ের কিছু নেয় তেমন। আগুনটা নিভিয়ে ফেলা হয়েছে টুকিটাকি কাজ চলছে মেরামতির।
হাতের অদ্ভুত ভঙ্গি করলেন মেরী।
হা, হ্যাঁ, তা তো বুঝলাম, কিন্তু এই সময়টা?
কিসের সময়?
এতে তো আমাদের পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।
হ্যাঁ তা অবশ্য হতে পারে।
ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ধরতে হবে কনফোরাস পেরিয়ে আমাদের ছটা পঞ্চান্নয় পৌঁছে। কিন্তু দেরি হলে তো চলবে না। দেড় দুই ঘণ্টা দেরি হলে তো ঐ ট্রেনটা ধরতে পারব না।
হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক।
হাত ও ঠোঁট কাঁপছে মেরী ডেবেনহ্যামের। জানালার ফ্রেমটা ধরে রয়েছেন।
আপনার কি খুবই ক্ষতি হয়ে যাবে দেরি হলে? পোয়ারো নরম সুরে বললেন।
হা, হা, ওই ট্রেনটা আমার ধরতেই হবে।
করিডর ধরে কর্নেলের কামরার দিকে এগিয়ে গেলেন মেরী জানালার ধার থেকে সরে এসে।
ট্রেন চলতে শুরু করল মিনিট দশেক পরেই, মেরীর অবশ্য আশঙ্কা অমূলক। মিনিট পাঁচেক দেরিতে ট্রেনটা গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছালো।
স্টীমারে কনফোরাস পার হতে হয়। জল জিনিসটা আবার ধাতে সয় না মঁসিয়ে পোয়ারোর। স্টিমারে অবশ্য মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে মেরী বা কর্নেলের দেখা হল না।
.
০২.
তোকাতালিয়ান হোটেল
এরকুল পোয়ারো হোটেলে এসে স্নানাগার সমেত ঘর চাইলেন। আগেভাগেই কোনো চিঠিপত্র এসে অপেক্ষা করছে কি-না তার জন্য খোঁজ নিলেন তারপর।
একটা টেলিগ্রাম আর তিনটে চিঠি। টেলিগ্রামটা কিন্তু আসার কথা ছিল না। কাগজটা খুললেন ধীরেসুস্থে পোয়ারো। আপনার চিন্তাভাবনা অনুযায়ী প্রতিফলন ঘটেছে কাসনার ক্ষেত্রে, তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন।
দেখো তো কি কাণ্ড। পোয়ারো বিড়বিড় করে বললেন। কপালে বিশ্রাম নেই।
একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ছাড়ে কটায়? হোটেলের ম্যানেজারকে বললেন, আজ রাতেই আমাকে রওনা হতে হবে।
রাত নটায় মঁসিয়ে।
একটা শোবার বার্থ নিতে হবে।
নিশ্চয়ই মঁসিয়ে কোনো অসুবিধাই হবে না। এই সময়টা ট্রেন প্রায় খালিই যায়, তেমন ভিড় তো থাকে না। ফার্স্ট ক্লাস না সেকেন্ড?
ফার্স্ট ক্লাস।
খুব ভালো কথা, কতদূর যাবেন মঁসিয়ে?
লন্ডন।
বেশ আপনার টিকিটের ব্যবস্থা আমি করে দেব।
ইস্তাম্বুল শ্যালে কোচে।
আটটা বাজতে দশ পোয়ারো আবার ঘড়ি দেখলেন।
এখন কি রাতের খাবার পাওয়া যাবে?
হা হা নিশ্চয়।
ছোটখাটো বেলজিয়ান ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। ঘরটা নিয়েছিলেন থাকবার জন্য সেটা বাতিল করে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
সবেমাত্র বেয়ারাকে ডেকে খাবার আনতে দিচ্ছে একজন তার কাঁধে হাত রাখলেন।
আপনি এখানে? বন্ধু কি কাণ্ড। আমি আশাই করিনি কিন্তু।
বক্তা ভদ্রলোক একজন বেঁটে, মোটা বয়স্ক। ছোট করে ছাঁটা চুলগুলো, তিনি একগাল হাসি নিয়ে কথা বলছিলেন।
পোয়ারো লাফিয়ে উঠলেন।
মঁসিয়ে কুক!
মঁসিয়ে পোয়ারো!
মঁসিয়ে কুকও বেলজিয়ান। পদস্থ কর্মচারী রেল কোম্পানির। যখন বেলজিয়ান পুলিশে চাকরী করতেন মঁসিয়ে পোয়ারো তখন থেকেই দুজনের আলাপ।
কি খবর? বাড়ি ছেড়ে এতদূরে? মন খারাপ লাগছে না? মঁসিয়ে কুক বললেন।
একটা–কাজ ছিল সিরিয়ায়।
ফিরছেন কবে?
আজ রাতেই।
চমৎকার! আজ রাতের গাড়িতে আমিও ফিরব। যাবো লম্যান পর্যন্ত, কাজ আছে ওখানে। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে আপনি নিশ্চয় যাচ্ছেন?
হ্যাঁ, এই তো এক্ষুনি একটা বার্থ জোগাড় করতে বললাম। কটা দিন এখানে থেকে যাব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বিধিবাম। তাড়াতাড়ি ফিরে যাবার তলব এসেছে; এইমাত্র লন্ডন থেকে জরুরী তার পেলাম।
আঃ কাজ আর কাজ। কিন্তু এখন তো আপনি মশাই ওপরতলার মানুষ।
তা কয়েকটা ঘটনার সাফল্যে পেয়েছি।
কুক হাসলেন। পোয়ারো বিনীত হবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন।
আবার দেখা হবে খানিকপর।
গরম স্যুপের পাত্রে পোয়ারো সন্তর্পণে চুমুক দিলেন। আবার না গোঁফটা ভেজে। জনা ছয়েক মাত্র লোক ঘরে। কিন্তু দুজন পোয়ারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটা টেবিলে তারা বসে আছেন খানিক দূরেই। যুবক কজন বছর ত্রিশেক বয়স, বেশ হাসিখুশি। কিন্তু পোয়ারোকে আকর্ষণ করেছিলেন বয়স্ক মানুষটি, নির্ঘাত আমেরিকান। ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে বয়স তার, দেখেই মনে হয় তার পায়ের তলায় জগতটা। সামান্য টাক মাথায়, দু সারি নকল দাঁত। উঁচু কপাল হাসি মুখ। কিন্তু দুটো চোখ কুতকুতে গর্তে ঢোকা শয়তানি মাখানো। যেন সবসময় বজ্জাতির ফন্দি আঁটছে। এক মুহূর্তের জন্য পোয়ারোর চোখে চোখ পড়ল, যুবকটির সাথে কথা বলতে বলতেই তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণতর হলো পলকেই। তারপর হেক্টর দামটা মিটিয়ে দাও, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন।
গলার স্বরটা ফ্যাসফ্যাসে। নিষ্ঠুরতা আর খলতা-মেশানো।
মঁসিয়ে কুকের সাথে পোয়ারো যখন হোটেলের বাইরে বারান্দায় মিলিত হলেন, এই দুজন তখন হোটেল ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে মালপত্র। সবকিছু তদারক করছে যুবকটি। মিঃ র্যাফোট সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে বলল। কাঁচের দরজাটা সে ঠেলে ধরে।
বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
মৃদুস্বরে পোয়ারো বললেন, মঁসিয়ে কুক, আপনার কি মনে হয় এই দুজন যাত্রী সম্বন্ধে?
নিঃসন্দেহে আমেরিকান।
তাতো বটেই কিন্তু মানুষ হিসাবে যুবকটি তত দিব্যি চমৎকার।
আর অন্যজন?
সত্যি কথা বলব? দেখলেই কেমন গা জ্বলে যায়, আমার মোটেই ভালো লাগেনি। পোয়ারো এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আমার কি মনে হয় জানেন? আমার পাশ কাটিয়ে একটা বুনো হিংস্র জন্তু বেরিয়ে গেল।
ষোল আনার উপর আঠারো আনা কিন্তু কেতা আছে।
যা বলেছেন, ওর মধ্যে যেন ভেতরের পশুটা ঘাপটি মেরে বসে আছে। এই জামাকাপড় মানে বাইরের চটকটা যেন খাঁচার মতো।
এঃ এটা আমার বড্ড কষ্টকল্পনা হয়ে গেল না?
হতেও তো পারে। মনে হল পাশ দিয়ে সাক্ষাৎ শয়তান হেঁটে গেল।
ওই আমেরিকান বুড়ো ভদ্রলোকটি?
হা, ওই আমেরিকান বুড়ো ভদ্রলোকটি।
হেসে ফেললেন মঁসিয়ে কুক।
জগৎটাই যে শয়তানের কুক্ষিগত কি আর করবেন বলুন, ঘোর কলিকাল।
ম্যানেজার এগিয়ে এলেন দরজা খুলে।
আমি সত্যিই লজ্জিত মঁসিয়ে পোয়ারো কোনো ফার্স্ট ক্লাস বার্থ খালি নেই।
মঁসিয়ে কুক চেঁচিয়ে উঠলেন।
কি? এমন অবস্থা বছরের এই সময়েও। সাংবাদিকরা নির্ঘাত কোথাও যাচ্ছে ঝাঁক বেঁধে নাকি দলের রাজনৈতিক নেতারা? কিন্তু অবস্থা তো শোচনীয়।
জানি না স্যার। পোয়ারোর দিকে ফিরলেন মঁসিয়ে কুক।
আমি তো আছি কিছু ভাববেন না একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দেব। ষোল নম্বরটা খালি যায়। কণ্ডাক্টরকে বলছি। সময় হয়ে এসেছে আসুন রওনা হওয়া যাক।
কণ্ডাক্টর গার্ড স্টেশনে মঁসিয়ে কুককে বিনীত নমস্কার জানালেন। হাজার হোক ওপরওয়ালা তো বটে।
শুভ সন্ধ্যা মঁসিয়ে। আপনার কামরা এক নম্বর।
কুলিকে ডেকে গার্ডটি মালপত্র বুঝিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠল, পিছু পিছু কুক আর পোয়ারো। আজ নাকি সব জায়গা ভর্তি হয়ে গেছে তোমাদের শুনলাম।
হা মঁসিয়ে। কি কাণ্ড দেখুন যেন সারা দুনিয়ার লোক একই জায়গায় যাচ্ছে।
আমার সেসব জানার দরকার নেই। একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে আমার এই বন্ধু ভদ্রলোকটির জন্য, ষোল নাম্বার কামরায় বন্দোবস্ত করে দাও।
উপায় নেই মঁসিয়ে। ওখানেও জায়গা নেই।
সেকি। ষোল নম্বরেও?
কণ্ডাক্টর ও গার্ডের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে মঁসিয়ে কুক তাকালেন। লম্বা ফ্যাকাসে চেহারার মাঝ বয়েসি লোকটি। কণ্ডাক্টর হাসল।
আজ সব ভর্তি হ্যাঁ আমরা তো বলছি মঁসিয়ে।
কিন্তু হলটা কি? মঁসিয়ে কুক রাগী গলায় বললেন। কোথাও সভা-সমিতি আছে নাকি কোনো?
না, মঁসিয়ে, হঠাৎই আজ রাতে যাত্রা করতে যেন সব লোকই মনস্থ করেছেন।
বেলগ্রেডে এথেন্সের কোচটা জোড়া হবে। বুখারেস্টে প্যারিস কোচটাও জোড়া হবে। কিন্তু সেও আগামীকাল সন্ধের আগে নয়। কোনো সেকেন্ড ক্লাস বার্থও খালি নেই। আজ রাতের ব্যবস্থাটা কি হবে?
একটা সেকেন্ড ক্লাস বার্থ অবশ্য খালি আছে।
তাহলে?
মানে ওই কামরায় একজন মহিলা আছেন। একজন জার্মান সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহিলার পরিচারিকা। মঁসিয়ে কুক মাথা নাড়লেন।
ওঃ হো ওখানে তো অসুবিধা হবে।
আমি এমনি যেভাবে হোক চলে যেতে পারব। না, না অত ব্যস্ত হবার কিছু নেই বললেন পোয়ারো।
মঁসিয়ে কুক ধমক দিলেন।
আপনি থামুন তো। কি কন্ডাক্টর যাত্রীরা কি সবাই এসে গেছেন?
একজন যাত্রী এখনও এসে পৌঁছাননি, কণ্ডাক্টর দ্বিধার সুরে বলল। সেকেণ্ড ক্লাস! সাত নম্বর বার্থ, উনি তো এখনও এলেন না। এখন নটা বাজতে চার মিনিট।
বুকের মালপত্র রদেরি হচ্ছে দাবিস তিনি যত
যাত্রীটি কে?
একজন ইংরেজ মিঃ হ্যারিস। কণ্ডাক্টর হাতের তালিকা দেখে বলল।
মিঃ হ্যারিস? ডিকেন্সের বইয়ের এক চরিত্রের নাম। পোয়ারো বললেন, মিঃ হ্যারিস হয়তো এখানে এসে পৌঁছবেন না।
সাত নম্বরে এই ভদ্রলোকের মালপত্র রেখে দাও, মঁসিয়ে কুক বললেন। যদি মিঃ হ্যারিস এসেও যায় ওঁকে বলে দেবে ওনার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে এই ভদ্রলোককে বার্থটা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে যা হোক করে বোঝানো যাবে, মিঃ হ্যারিস তিনি যত লাটসাহেবই হোন না কেন আমার কিছু এসে যায় না।
তাহলে সেই ব্যবস্থাই করি, বলল কণ্ডাক্টর।
কণ্ডাক্টরর পোয়ারোর কুলিকে নির্দেশ দেবার পর বলল, একেবারে শেষের ঠিক আগের কামরাটা আপনার মঁসিয়ে পোয়ারো।
পোয়ারো মন্থর গতিতে এগিয়ে চললেন। বেশির ভাগ কামরার দরজায় যাত্রী বা যাত্রিনীরা দাঁড়িয়ে। তিনি যাকে তোকাতালিয়ান হোটেলে দেখেছিলেন পোয়ারোর কামরার ঠিক ভেতরে লম্বা সুদর্শন যুবকটি, পোয়ারোকে দেখেই ভুরু কুঁচকে গেল। কামরা চিনতে মনে হয় আপনার ভুল হয়েছে। রীতিমতো কষ্ট করে ভাঙা-ভাঙা ফরাসী ভাষায় সে পোয়ারোকে বলল।
পোয়ারো ইংরেজিতে উত্তর দিলেন।
আপনিই কি মিঃ হ্যারিস?
না, আমার নাম ম্যাককুইন, আমি…।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে কণ্ডাক্টরের গলা শোনা গেল। ক্ষমা প্রার্থনার সুরে সে বলছে, উপায় নেই মঁসিয়ে এই ভদ্রলোককে এখানেই ব্যবস্থা করে দিতে হল অন্য কোথাও জায়গা খালি না থাকায়।
কন্ডাক্টর নিপুণ ভঙ্গিতে মাল তুলতে লাগলেন।
পোয়ারো মনে মনে হাসলেন তার এই ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি দেখে। লোকটি নির্ঘাত ভালো বকশিসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কামরাটা একলাই দখল করবে সেই আশায়। কিন্তু সে আশায় বাদ সাদলেন মঁসিয়ে কুক। একদিকে জাঁদরেল ওপরওয়ালা অন্যদিকে কাঁচা পয়সা; কণ্ডাক্টরের অবস্থা শোচনীয়।
সব মালপত্র গোছগাছ করে কন্ডাক্টর বলল, দেখুন সব ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলাম মঁসিয়ে। আপনার বার্থ ওপরে সাত নম্বরে। আর মিনিট খানেক বাদেই ট্রেন ছাড়বে।
কামরা ছেড়ে চলে গেল কন্ডাক্টর ব্যস্ত পায়ে। আবার নিজের কামরায় ঢুকে পোয়ারো স্বগতোক্তি করলেন, কি কাণ্ড? কন্ডাক্টর নিজেই মালপত্র গুছিয়ে দিচ্ছে এমনটা তো দেখাই যায় না।
হাসল তার সঙ্গীটি। তার রাগ পড়ে যাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে, অবশ্য রাগ করেই বা উপায় কি?
ট্রেন তো একদম ভর্তি।
এইবার ট্রেন চলতে শুরু করবে। তীক্ষ্ণ শীসের শব্দ। করিডরে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলেন দুজনেই।
আমরা তাহলে চললাম, ম্যাককুইন বলল।
নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ সুরে আবার ইঞ্জিনটা জানান দিল কিন্তু ট্রেন চলল না।
পোয়ারোকে ম্যাককুইন বলল, স্যার নিচের বার্থটা আপনি ইচ্ছে করলে নিতে পারেন। আমার কোনো অসুবিধা হবে না উপরে শুতে।
যুবকটি চমৎকার, দেখলেই পছন্দ হয়।
প্রতিবাদ করলেন পোয়ারো।
না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
আরে না আমার কষ্ট হবে না।
বেলগ্রেডে এক রাতের মামলা, অবশ্য খুব অমায়িক লোক আপনি।
ওঃ আপনি বেলগ্রেডে নেমে যাচ্ছেন।
মানে তা নয়। আমি…।
ট্রেনটা হঠাৎ দুলে উঠল। চমকে উঠলেন দুজনে ঝাঁকুনি খেয়ে। ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে আলোকিত প্ল্যাটফর্ম সরে যাচ্ছে।
তার তিনদিনের যাত্রা শুরু করল ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস।
.
০৩.
পোয়ারো প্রত্যাখ্যান করলেন
মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোর কিচেন কামরায় ঢুকতে একটু দেরিই হয়ে গেল। ঘুম ভেঙে ছিল অবশ্য সকালেই, প্রাতঃরাশও একলাই প্রায় সেরেছেন। লন্ডনের সেই মামলাটার নথিপত্র নাড়াচাড়া করতে সারা সকালটা কেটেছে। দেখাই হয়নি মঁসিয়ে কুকের সঙ্গে।
মঁসিয়ে কুক পোয়ারোকে ডাকলেন। ইশারায় তার মুখোমুখি বসবার জন্য তিনি আগেভাগেই টেবিল দখল করে বসে আছেন। আর টেবিলটাও এমন জায়গায় যে, সব থেকে আগে বেয়ারারা ওখানে আসে।
চমৎকার খাওয়ার ব্যবস্থা। কয়েকটা পদ শেষ করে যখন দুজনে ক্রীম চীজে এসে পৌঁছেছেন, আহা আমার যদি কলকুকের মতো প্রতিভা থাকত। মঁসিয়ে কুক ভাবুক ভাবুক গলায় বললেন, তবে এই চমৎকার নিসর্গদৃশ্য কলমের আঁচড়ে ধরে রাখতাম।
কিছু বললেন না পোয়ারো। দু চারটে ভালো-মন্দ পদ পেটে পড়লে লোকে অমন কবি কবি হয়ে যায় এ তার বেশ ভালোই জানা আছে। ঠিক বলেছি কিনা বলুন, মঁসিয়ে কুক তার মৌনতাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বলে চললেন। এই তো আমাদের চারপাশেই দেখুন না কত দেশ কত জাতি মানুষের মিলনতীর্থ। কত রকমফের চরিত্রেরই। একসঙ্গে মিলিত হয়েছে সবাই এই তিনদিন। একই ছাদের নিচে খাচ্ছে-শুচ্ছে আবার বিদায় নিয়ে চলে যাবে নানাদিকে। কোনোদিন দেখাই হবে না হয়তো।
যদি কোনো দুর্ঘটনা-পোয়ারো বললেন।
আঃ মশাই থামুন তো? এমন বাগড়া দেন না।
না না, ব্যাপারটা হয়তো আপনার কাছে সেইরকমই। এই চলমান পান্থশালার প্রতিটি অতিথি এক ও অদ্বিতীয় এক বন্ধনে আবদ্ধ তা হল মৃত্যুর। এরকম কিন্তু ভাবতে পারেন।
নিন তো একটু মদ খান। মাঝে মাঝে এমন উল্টোপাল্টা কথা বলেন না, আপনার নির্ঘাৎ হজমের গণ্ডগোল হয়েছে।
সায় দিলেন পোয়ারো। হতেও পারে। সিরিয়ার রান্নার ধাঁচটা মনে হয় ঠিক পোয় না আমার।
পোয়ারো আস্তে আস্তে সুরাপাত্রে চুমুক দিতে থাকলেন। তারপর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সমস্ত পরিবেশটা চেয়ারে শরীর এলিয়ে জরীপ করতে লাগলেন।
সত্যিই কি বিচিত্র সব মানুষের সমাবেশ।
তিনটি পুরুষ বসে তাদের ঠিক বিপরীত দিকের টেবিলে। এককভাবে ভ্রমণ করছে বোধহয় তিনজনই। নিবিষ্ট মনে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে একজন ইতালিয়ান। একজন বিরসবদন ইংরেজ তার ঠিক উল্টোদিকে যার হাবভাব দেখে মনে হয় খুব দক্ষ পরিচারক। আমেরিকান পোশাক পরা একজন হোমরাচোমড়া চেহারার ঠিক পাশের ইংরেজটা ব্যবসাদার নির্ঘাত। নিছক দায়সারাভাবে নিজেদের মধ্যে তিনজন টুকটাক কথাবার্তা চালাচ্ছে।
এবার অন্যদিকে চোখ ঘুরে গেল পোয়ারোর। এক মহিলা একটি ছোট টেবিলে সোজা হয়ে বসে আছেন। জীবনে কমই দেখেছেন তার মতো কুদর্শনা নারী। এঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না যে মনকে কিন্তু কুশ্রীতাও টানে। তার গলায় বড় বড় মুক্তোর কলার, আসল মুক্তো। হাতভর্তি আংটি, দামী ফারের কোট পরনে।
বেয়ারার সঙ্গে কথা বলছিলেন ভদ্রমহিলা খুব কর্তৃত্বের সুরে।
এক বোতল জল আর গ্লাস ভর্তি কমলালেবুর রস দিয়ে আসবে আমার কামরায়, ভুল যেন না হয় খবরদার। একদম ভালোমশলা বাদে আমি মুরগীর মাংস খাবো আজ রাতে। আর হা শোনো কিছু মাছ সেদ্ধও করো। বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছিল বেয়ারাটি। দৃপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। পোয়ারোর মুখের ওপর দিয়ে তার নিরুৎসুক উন্নাসিক দৃষ্টি ঘুরে গেল।
রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, মঁসিয়ে কুক ফিসফিস করে বললেন। রাশিয়ান। ওঁর স্বামী পশ্চিম ইউরোপে ব্যবসার ধান্দায় চলে আসেন প্রচুর সম্পত্তি নিয়ে ঠিক বিপ্লবের আগে। এখন তো টাকার পাহাড়। কি ব্যক্তিত্ব তবে দেখতে ভালো নয়।
রাজকুমারীর নাম তিনিও শুনেছেন, পোয়ারো মাথা নাড়ালেন।
মেরী ডেবেনহ্যাম বসে আছেন অন্য আর একটা বড় টেবিলে। সঙ্গে আরও দুজন মহিলা। মাঝ বয়েসী লম্বা একজন সাদামাটা স্কার্ট আর ব্লাউজ পরা। বিরাট খোঁপার আড়ালে শোভা পাচ্ছে এক মাথা হলুদ চুল, চোখে চশমা, ভালো চেহারার মানুষ। মনে হয় দেখলেই সকলের • কথা মন দিয়ে শোনেন আর সায় দেন। তৃতীয় মহিলাটির বাক্যবাণে বিধ্বস্ত দুজনেই। একটানা বকরবকর করেই যাচ্ছেন। এই তৃতীয়জন মোটাসোটা ভারিক্কি চেহারার।
তারপর বুঝলেন আমাদের কলেজে কি চমৎকার পড়াশুনা হয়। মাগো তুমি ভাবতেই পারবে না আমার মেয়েটা তাই বলে। শিক্ষার মতো কি জিনিস আছে, কি সুন্দর পড়ান অধ্যাপকরা। আমার মেয়ে বলে পাশ্চাত্য দেশ থেকে কত ভালো-ভালো জিনিস প্রাচ্যে শিক্ষার বিষয় হতে পারে। একটা সুড়ঙ্গে সশব্দে ট্রেনটা ঢোকায় গলার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল ভদ্রমহিলার।
কর্নেল আবাথনট একলা বসে পাশের ছোট টেবিলটায়। মেরী ডেবেনহ্যামের দিকে করুণ সতৃষ্ণ নয়নে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন। যা চিনে জোঁকের পাল্লায় পড়েছেন মেরীর কিন্তু উঠে আসার উপায় নেই। ওরা দুজনে এক সঙ্গেই কিন্তু বসতে পারতো প্রথম থেকেই বসলো না কেন?
পোয়ারো হয়ত ভাবলেন মেরী একটু সতর্ক প্রকৃতির মেয়ে, নিজেকে জড়াতে চায় না চট করে। এতে সুনামও নষ্ট হতে পারে তার চাকরীর। পোয়ারোর চোখ এবার কামরার অন্যদিকে চলে গেল। মাঝ বয়েসী জার্মান কালো পোশাক পরা সাধারণ চেহারার একজন স্ত্রী লোক একদম কোণে, রাজকুমারীর পরিচারিকা বোধহয়। একজন ভদ্রমহিলা আর একজন ভদ্রলোক নিচুস্বরে অন্তরঙ্গ তার ঠিক পরের টেবিলে আলাপরত। ভদ্রলোকের বয়স তিরিশের কোঠায়, চমৎকার এক জোড়া গোঁফের মালিক, সুবেশ ও সুদর্শন। তিনি এপাশে তাকালেন কথা বলতে বলতে। তরুণটি যে ইংরেজ নয় পোয়ারো নিশ্চিত। তার সঙ্গে ভদ্রমহিলাটি সুন্দরী বললে কম বলা হবে, মেয়ে বলাই ভালো তাকে, যেন ডানাকাটা পরী। বছর কুড়ি বয়স, চমৎকার ছাঁটকাটের পোশাক পরা। সাদা মসৃণ চামড়া হাতির দাঁতের মতো, মায়াবী বাদামী চোখ বড় বড়, কুঁচকুচে কালো চুল একমাথা চাপার কলির মতো আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেট। প্লাটিনামের ওপর পান্না বসানো গয়না পরেছে, চকচকে লাল রঞ্জনী নখে, চোখের দৃষ্টি আর গলার স্বর মদির স্বপ্নলু।
মেয়েটি কি সুন্দর, বোধহয় ওরা দম্পতি না?
হ্যাঁ, পোয়ারোর প্রশ্নের উত্তরে কুক বললেন। হাঙ্গেরীর দূতাবাসে কাজ করেন সম্ভবতঃ, দুজনকে দারুণ মানিয়েছে তাই না?
কুক তার দৃষ্টি অনুসরন করলেন পোয়ারোকে নিরুত্তর দেখে। কঠিন দৃষ্টি পোয়ারোর। ম্যাককুইন আর রাশেট তার লক্ষ্য। রাশেট সেই শয়তানি মাখানো-ধূর্ত চাউনি পোয়ারোর দিকে মুখ করে বসে আছেন।
কি হল, বন্যপ্রাণীটিকে পর্যবেক্ষন করছেন, কুক বললেন। কুক কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ঘাড় নাড়লেন পোয়ারো।
আপনি তাহলে বসুন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি আমার কামরায় যাচ্ছি একটু কাজ আছে, একটু পরে আড্ডা মারা যাবে আপনিও আসুন না।
বেশ তো।
ধীরে ধীরে কফি খেতে লাগলেন পোয়ারো। আরও পানীয় আনতে বেয়ারাকে আদেশ করলেন। অনেকেই উঠে যাচ্ছেন একে একে।
এখন বলে চলেছেন সেই প্রৌঢ়া আমেরিকানটি।
আমার মেয়ে বলে মা সঙ্গে একটা নামের তালিকা রেখো সব দেশের খাবারের। কোনো অসুবিধেই হবে না দেশে-বিদেশে বেড়াতে, কিন্তু এখানে দেখ পছন্দসই পানীয়টি পর্যন্ত ঠিকভাবে মেলে না আর জলটারও এত বাজে স্বাদ যে তেষ্টা মেটে না…।
যা বলেছেন, তার টেবিলে নিরীহ মহিলাটি মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
আমার মেয়ে বলে একরাশ খুচরো দীনার না কি যেন বলে আবার দেখুন, যত্তোসব ঝামেলা। চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মেরী ডেবেনহ্যাম তার সঙ্গে আর্বানটও। আমেরিকান প্রৌঢ়াটি ও অন্য মহিলাটি পিছু পিছু খুচরো টাকা ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়ালেন। এখন খানাকামরায় রাশেট আর ম্যাককুইন, হাঙ্গেরিয়ান দম্পতিও চলে গেছেন।
কি যেন বললেন নিচুস্বরে রাশেট ম্যাককুইনকে। খানা কামরা ছেড়ে ম্যাককুইন বেরিয়ে গেল। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই রাশেট উঠে এগিয়ে এলেন পোয়ারোর টেবিলের দিকে। রাশেট বললেন নরম ভাঙা ভাঙা নাকি সুরে, মাপ করবেন আপনার কাছে কি দেশলাই আছে? আমার নাম রাশেট।
পোয়ারো অভিবাদনের ভঙ্গি করে ঈষৎ ঝুঁকে দেশলাই বার করে আনলেন পকেটে হাত দিয়ে। রাশেট কাঠি জ্বালালেন না সেটা হাতে নিয়েও।
আজ আমার পরম সৌভাগ্য, বললেন, মনে হয় আমি মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে কথা বলছি।
আপনি ঠিকই ধরেছেন মাসিয়ে। আমি এরকুল পোয়ারো।
বড় তাড়াতাড়ি কাজের কথায় আসে আমার দেশের মানুষেরা। আপনি আমার জন্য একটি কাজ হাতে নিন আমি চাই।
ভ্রূ তুললেন পোয়ারো।
আজকাল আমি খুব কম সেই হাতে নিই মঁসিয়ে রাশেট।
মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি যে খুব ব্যস্ত মানুষ তা আমার অজানা নয়। নিশ্চয় আমি আপনাকে এর জন্য কিন্তু ভালো পারিশ্রমিক দেব। ভালো পারিশ্রমিক সত্যিই।
পোয়ারো দু-এক মিনিট চুপ করে থেকে বললেন, আমাকে আপনি কি কাজের ভার দিতে চান মঁসিয়ে রাশেট?
আমি অত্যন্ত ধনী লোক মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার শত্রুর অভাব নেই। কাজেই বুঝতে পারছেন আমার একটি বিশেষ শত্রু আছে।
একটি বিশেষ শত্রু?
আপনি কি বলতে চান রাশেট, তীক্ষ্ণস্বরে বললেন। আমার অভিজ্ঞতা বলে ধনী মানুষদের একাধিক শত্রু থাকে, মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন।
রাশেট যেন নিশ্চিন্ত হলেন পোয়ারোর কথায়।
হা হা তা তো বটেই, তাড়াতাড়ি বললেন।
আমার নিরাপত্তা প্রয়োজন। একজনই থাক তার দশজন, অবস্থা তো একই বুঝলেন মশাই। নিরাপত্তা।
হা। খুন করবার হুমকি দেওয়া হয়েছে আমায়, অবশ্য আমি প্রস্তুত শত্ৰু মোকাবিলা করতে। একটা ছোট ঝকঝকে স্বয়ংক্রিয় রিভলবার রাশেটের হাতে। তবে কি জানেন, সাবধানের মার নেই। তিনি বলে চললেন, আমি কিন্তু এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চাই যিনি নিরাপত্তার ঠিকঠিক ব্যবস্থা করবেন আমার। প্রচুর টাকা খরচ করতে রাজী আছি সেই জন্য। আপনার চেয়ে সে যোগ্য ব্যক্তি আমি পাবো না আর এও জানি।
রাশেটের মুখের দিকে চিন্তিত ভাবে তাকালেন পোয়ারো। তার মুখে ভাবলেশহীন এত কথার পরও। রাশেট কেন স্বয়ং ভগবানেরও সাধ্য নেই তা বোঝার। শেষ পর্যন্ত পোয়ারো বললেন ধীর স্বরে, মঁসিয়ে আমি দুঃখিত আমার পক্ষে সম্ভব নয় আপনার অনুরোধ রাখা।
রাশেট ক্রুর চোখে তার দিকে তাকালেন।
আপনি কত চান?
মাথা নাড়লেন পোয়ারো।
মঁসিয়ে আপনি বুঝতে পারছেন না আমারও টাকার অভাব নেই। আমাকে কম প্রাচুর্য দেয়নি আমার জীবিকা। যেগুলোত আমি নিজে উৎসাহ বোধ করি সেইসব কেসই হাতে নিই, কিন্তু আজকাল।
বেশ বেশ, আগাম কুড়ি হাজার ডলা পেলে আপনি কি কাজ শুরু করতে রাজী? রাশেট বললেন।
না।
যদি আমাকে ভেবে থাকেন টাকা আদায় চাপ দিয়ে করবেন তবে ভুল করছেন, আমি ব্যবসাটা ভালোই বুঝি।
আমিও…মঁসিয়ে রাশেট।
কিন্তু কি আশ্চর্য আপনার আপত্তিটা কোথায়?
উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো।
আশাকরি সত্যি কথাটা বলার জন্য আপনি আমায় ক্ষমা করবেন কিন্তু এই মুহূর্তে আপনার মুখ যে আমি অত্যন্ত অপছন্দ করছি।
মঁসিয়ে পোয়ারো বড় বড় পা ফেলে খানাকামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
.
০৪.
মধ্যরাতে আর্তনাদ
রাত পৌনে নটায় ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস বেলগ্রেডে পৌঁছালো। এখানে আধঘণ্টা থামবে। প্ল্যাটফর্মে নামলেন পোয়ারো। বাইরে বেশিক্ষণ থাকা কিন্তু গেল না। হাত, পা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। যথেষ্ট সুরক্ষিত অবশ্য প্ল্যাটফর্ম কিন্তু দারুণ বরফ পড়া শুরু হয়েছে। তিনি অগত্যা আবার ট্রেনের দিকে পা বাড়ালেন। তাকে দেখে রীতিমাফিক অভিবাদন জানিয়ে কণ্ডাক্টর বলল, এক নম্বরে আপনার সব জিনিসপত্র অর্থাৎ মঁসিয়ে কুকের কামরায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কোথায় তাহলে গেলেন মঁসিয়ে কুক?
নতুন যে কোচটা এক্ষুনি দেওয়া হল, তিনি তারই একটা কামরায় গিয়েছেন। কুকের নতুন কামরায় গেলেন পোয়ারো।
ছি ছি, খুব খারাপ লাগছে আমার। শুধু শুধু ঝামেলা হল আমার জন্য। কিছু ঝামেলা হয়নি রাখুন তো মশাই, কুক বললেন। সোজা ইংল্যান্ডে যাবেন তো আপনি। ব্যালে পর্যন্ত যাবে আপনার কোচটা তাই সুবিধাই হল ওখানে আপনার। মশাই এখানে দিব্যি নিরিবিলিতে আরামে আছি। একজন গ্রীক ডাক্তার আর আমি ব্যাস। দেখছেন কি ঠান্ডা পড়েছে। আর তেমনি বরফ পড়া। আমরা নিরাপদে ঠিক সময়মতো যেন পৌঁছে যাই ভগবানকে ডাকুন।
ট্রেন ছাড়লো ঠিক নটা পনেরোয়। পোয়ারো বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে করিডোর ধরে নিজের কামরায় চলে এলেন তার একটু পরেই।
মোটামুটি পরিচয় হয়ে গিয়েছে বোঝা যায় যাত্রীদের নিজেদের মধ্যে। ম্যাককুইনের সঙ্গে কর্নেল আবাথনট দরজার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। পোয়ারোকে দেখে ম্যাককুইন অবাক হলেন।
একি বেলগ্রেড নেমে যাবেন যে বললেন আপনি? হেসে ফেললেন পোয়ারো।
আমার কথাটা আপনি ঠিক ধরতে পারেননি। ট্রেনটাও তখন আসলে ছেড়ে দিল তো বেলগ্রেডের যখন কথা উঠল।
কিন্তু আপনার মালপত্র কই কামরায়?
অন্য কামরায় গেছে সেগুলো।
ওঃ তাই বলুন।
এগিয়ে গেলেন পোয়ারো।
কন্যাগতপ্রাণা প্রৌঢ়া আমেরিকানটির সঙ্গে একটু এগিয়েই দেখা হল। সুইডিশ মহিলাটির সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত তিনি এখনও। একটা পত্রিকা সুইডিশ মহিলাটির হাতে গুঁজে দিতে দিতে বললেন শ্রীমতী হার্বাড, একটা পত্রিকা তো ভারী পড়তে নেবেন এত সঙ্কোচের কি আছে তাতে। আমার তো কত বই আছে সঙ্গে। কি ঠান্ডাটাই না পড়েছে।
সুইডিশ মহিলাটি ধন্যবাদ জানিয়ে বইটি নিলেন। বেশি রাত জেগে বই পড়বেন না কিন্তু তা বলে, শ্রীমতী হার্বাড বললেন। মাথা ধরেছে বললেন। তা আপনি ভালো করে ঘুমোবেন আজ রাতে। দেখবেন কাল সকালে উঠে শরীর দিব্যি ঝরঝরে হয়ে গেছে।
আগে এক কাপ চা খাব।
হা ঠান্ডা যা। আমার কাছে একটা অ্যাসপিরিন আছে দেব?
না না থাক। হয়তো আমার কাছেও আছে। আচ্ছা শুভরাত্রি।
নিজের কামরার দিকে সুইডিশ মহিলাটি পা বাড়াতেই এবার পোয়ারোকে নিয়ে পড়লেন শ্ৰীমতী হার্বাড। কাণ্ড দেখেছেন সুইডিশ মহিলাটির। এত কিন্তু কিন্তু ভাব। কোনো মঠ বা ধর্মীয় সংস্থায় মনে হয় কাজকর্ম করেন। এত ভালো মহিলাটি কিন্তু ইংরেজিতে কথাবার্তা চালাতে পারেন না বেশিক্ষণ। বারবার আমার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।
ভদ্রমহিলার কন্যারত্ন সম্পর্কে শুনে শুনে পোয়ারোরও বোধ করি একটা বিশদ ধারণা হয়ে গেছে। শুধু পোয়ারো কেন? ইংরেজি যারাই বোঝেন ট্রেনে তাদের সকলের। শ্রীমতী হার্বাডের মেয়ে জামাই দুজনেই নামী কলেজে অধ্যাপনা করে। ভদ্রমহিলা প্রাচ্যভ্রমণ এই প্রথম। তিনি কি ভাবেন তুর্কীদের সম্বন্ধে। কি দারুণ অবস্থা রাস্তাঘাটের। নানা প্রসঙ্গেই ভদ্রমহিলার দৌলতে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এখন পোয়ারো।
যখন দুজনে দাঁড়িয়েছিলেন, শীর্ণ চেহারার পরিচারকটা বেরিয়ে এল পাশের কামরার দরজাটা খুলে। মিঃ রাশেট বিছানায় বসে আছেন পোয়ারো ভেতরে এক ঝলক দেখলেন। তার চোখ মুখ বিকৃত হয়ে উঠল পোয়ারোর চোখে চোখ পড়তেই। বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।
ছি ছি, কি অভদ্র দেখছেন! ফিস ফিস করে বললেন শ্রীমতী হার্বাড। একটি ভদ্রবেশী শয়তান নির্ঘাৎ! আমি মানুষ চিনতে পারি মুখ দেখলেই। যার যা মনে হয় সেটাই ঠিক আমার মেয়ে বলে। এইরকম একটা অভদ্র লোকের পাশের কামরায় জায়গা পেয়েছি ভাবতেই তো আমার বাজে লাগছে। মনে হয় কাল রাতে লোকটা হাতল ঘোরাতে চেষ্টা করেছিল আমার কামরায়। আমি একটুও অবাক হব না ও যদি একজন মারাত্মক খুনীও হয়। ভয়ে তো আমার বুক কাঁপছে। এই লোকটার পাল্লায় পড়ে ওই যে সুন্দর দেখতে ছোকরাটা হাসি মুখে কাজ করছে তাই ভাবি।
ম্যাককুইনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে এলেন কর্নেল আবাথনট। আমার কামরায় আসুন, ম্যাককুইনকে বলতে শোনা গেল। আড্ডা মারা যাবে খানিক। রাত হয়নি এখনো তেমন। তার পর হা কি বলছিলেন যেন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে। ম্যাককুইনের কামরার দিকে এগিয়ে গেলেন দুজনে। আমিও যাই বুঝলেন, বললেন শ্রীমতী হার্বাড, রাতে একটু বই না। পড়লে ঘুমই আসে না আবার।
আচ্ছা শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি ম্যাডাম।
নিজের কামরার দিকে এগোলেন পোয়ারো। ঠিক পরের খুপরিটা রাশেটের। তিনি জামা কাপড় বদলিয়ে আধ ঘণ্টাটাক বিছানায় শুয়ে বই পড়লেন। হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দিলেন তারপর।
পোয়ারোর ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। কেন? একি কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে এল। সজোরে একটা ডাকঘণ্টা বেজে উঠল।
পোয়ারো চমকে উঠলেন আর্তনাদ শুনে। পোয়ারো লাফিয়ে উঠে দরজা খুললেন। তার ঠিক পাশের কামরাটি রাশেটের। দেখা গেল সেই মুহর্তে রাশেটের দরজায় এসে কণ্ডাক্টরও টোকা দিল। করিডরের ঠিক পাশের কামরা থেকেও ঘণ্টা বাজানোর আওয়াজ ভেসে এল এর মধ্যে। না না দরকার নেই সব ঠিক আছে (জ মে স্যুই এঁপে) সেই ঠিক সময়। রাশেটের বন্ধ কামরা থেকে ফরাসী ভাষায় জবাব পাওয়া গেল চোখ তুলে তাকালো কণ্ডাক্টর।
ধন্যবাদ সিয়ে, কণ্ডাক্টর বলল।
পাশের কামরার দিকে তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। বিছানায় ফিরে এলেন পোয়ারো। একটা বাজতে তেইশ মিনিট আলো নেভানোর আগে ঘড়ি দেখলেন, তার মন থেকে দুশ্চিন্তার ভার নেমে গেছে।
.
০৫.
হত্যাকাণ্ড ঘুম আসছে না পোয়ারোর চোখে। থেমে আছে কেন ট্রেনটা। এটা যদি কোনো স্টেশনেও হয় লোকজনের চেঁচামেচি তাহলে তো কানে আসতো। অনেক বেশি লোকজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে ট্রেনের মধ্যে। ঐ তো বেসিনে কল খোলার আওয়াজ হলো। জল পড়ছে কলকল করে। বন্ধ হল হল। রাশেটের চলাফেরার শব্দ পরিষ্কার পাশের কামরায়। কেউ যেন ঘরেপরার চটি পরে হেঁটে যাচ্ছে, বাইরে পায়ের শব্দ।
কামরার ছাদের দিকে চেয়ে চুপটি করে শুয়ে রইলেন এরকুল পোয়ারো। শুতে যাবার আগে জল চেয়ে নেওয়া হয়নি, ইস্ বড্ড ভুল হয়ে গেছে। এত চুপচাপ কেন বাইরের স্টেশনটা। পোয়ারো ঘড়ি দেখলেন রাত সওয়া একটা। জল চাইবেন কি কণ্ডাক্টরকে ডেকে? ঘন্টা বাজবার বোতামে আঙুলটা রেখে সবে চাপ দিতে যাবেন হঠাৎ পাশের কোনো কামরা থেকে অর্ধেক ঘণ্টা ধ্বনি বেজে উঠল টিং টিং টিং এক মুহূর্ত লোকটার যেন সবুর সইছে না।
শ্ৰীমতী হার্বাডের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর, বাইরে ব্যস্ত পায়ের শব্দ। কে যেন হাতটা বোতামে রেখেই দিয়েছে। অন্য কামরার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কন্ডাক্টর।
ও শ্রীমতী হার্বাড। ভদ্রমহিলাটি নব্বইভাগ কথা বলেছেন আর দশভাগ কন্ডাক্টর, পোয়ারো হাসলেন নিজের মনেই। সন্ধি স্থাপন হলো খানিকক্ষণ বাদানুবাদ হবার পর। শুভরাত্রি মাদাম, পোয়ারো পরিষ্কার শুনলেন।
বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
এইবার ঘণ্টা বাজালেন পোয়ারো। কন্ডাক্টরটি সঙ্গে সঙ্গেই এসে হাজির হল। তাকে চিন্তিত আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
আমাকে একটু জল দেবে।
হা নিশ্চয় মঁসিয়ে।
সে নিশ্চিন্ত হল পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বরে, ঐ আমেরিকান ভদ্রমহিলাটি বুঝলেন।
তার কি হলো?
কন্ডাক্টর কপালের ঘাম মুছল।
কি অদ্ভুত উনি, ভাবতে পারবেন না–একই কথা বারবার, লোক ঢুকেছিল নাকি ওর কামরায়। বুঝুন কাণ্ড। আর সে নাকি মোটাসোটা চেহারার। লোকটা কি বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল নাকি। আমি তো সেই নিয়ে ওঁর সঙ্গে তর্ক করতে বাধ্য হলাম। ওঃ কি সাংঘাতিক মহিলা, নিশ্চয় ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছেন। নিশ্চিত নাকি তোক ঢুকেছিল। আপনিই বলুন তাহলে কি সে আবার বাইরে বেরিয়ে ভেতরে হাত গলিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে? দরজায় তো ফঁকফোকর নেই। এমনিতে বরফের ঝড়ে…।
বরফ?
হা। যা বরফ পড়েছে এগোনোই দায়। এরকম অবস্থা কদিন চলবে কে জানে। আপনি কি খেয়াল করেননি যে ট্রেন থেমে আছে? আমরা আটকা পড়েছি? একবার তো সাতদিন ট্রেন অচল ছিল।
এখন কোথায় আমরা?
ভিনভোকি আর ব্রডের মাঝামাঝি।
ইস কি কাণ্ড!
কন্ডাক্টরর দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস জল নিয়ে এল।
শুভরাত্রি মঁসিয়ে।
জল খেয়ে ঘুমোবার চেষ্টা কলেন পোয়ারো। চোখের পাতাটা সবেমাত্র বুজে এসেছে দরজার কাছে একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ হল এমন সময়।
পোয়ারো লাফিয়ে উঠে দরজা খুললেন। কই কিছু নাতো! তার নজরে পড়ল এক ভদ্রমহিলা ডানদিকে করিডোর ধরে হেঁটে চলে যাচ্ছেন ধীর লয়ে।
পরনে লাল টুকটুকে কিমোনো। আর সব চুপচাপ অন্য প্রান্তে কন্ডাক্টর ছোট্ট চেয়ারে বসে একরাশ কাগজপত্রের মধ্যে ডুবে আছে।
যতসব উল্টোপাল্টা শব্দ শুনছি–ভাবলেন পোয়ারো, সত্যিই আমার ভীমরতি হয়েছে।
তিনি আবার বিছানায় এসে শুলেন, ঘুমটা অবশ্য এবার ভালোই হল।
যখন ঘুম ভাঙল জানালার শার্সি খুলে মুখ বাড়ালেন পোয়ারো, তখনো ট্রেনটা থেমে রয়েছে। ঘড়িতে নটা বেজে গেছে। বাইরে চাপ চাপ বরফ। খানাকামরায় ফুলবাবুটি হয়ে ঠিক পৌনে দশটায় গেলেন তখন সেখানে জমজমাট অবস্থা। প্রথম পরিচয়ের বাধাটা কেটে যাওয়ার পর তিনি দেখলেন সবাই নিজেদের মধ্যে জোর কথাবার্তা চালাচ্ছেন। এই তুষার ঝড়ের কল্যাণে একটা কথা সকলের মুখে। অবশ্য শ্রীমতী হার্বাডের গলাই কানে ভেসে আসে সব কিছু ছাপিয়ে। আমার নাকি কিছু অসুবিধা হবে না বলে আমার মেয়ে আমাকে পই পই করে এই ট্রেনেই শুয়ে বসে চলে আসতে পারব বলল। দেখুন কাণ্ডটা। কিন্তু এখন। কাল বাদে পরশু স্টীমার ছাড়বে। কদিন এমন দুর্ভোগ কপালে আছে কে জানে। সেটা ধরতে পারব কি না তাই বা কে জানে।
একই অবস্থা ইতালিয়ানটিরও। মিলানে তার জরুরী ব্যবসায়িক লেনদেন আছে। ঘন্টা কয়েক পর ট্রেন চলতে শুরু করবে সকলেই এমন আশা করছে। আমার বোন আর তার ছেলে মেয়েরা আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে বলে সুইডিশ মহিলাটি কুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। নিশ্চয়ই ভাববে কোনো গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাদেরও তো কোনো উপায় নেই জানবার। আচ্ছা, আর কতক্ষণ আমরা এখানে আটকা পড়ে থাকব। কেউ কি উত্তরটা দিতে পারবে না? মেরী ডেবেনহ্যাম জিজ্ঞাসা করলেন। অধৈর্য তার গলার স্বর। কিন্তু লক্ষ্য করলেন পোয়ারো আগের মতো তাতে আর উৎকণ্ঠা নেই। আবার শ্রীমতী হার্বাড মুখ খুললেন।
কারও আর উৎসাহ নেই কেউ কোনো খবরই রাখে না। কেন একটু গতর নাড়তে কি হয়, তেমনি হয়েছে এই ট্রেনটাও। এক দঙ্গল নিষ্কর্মা বিদেশী।
আপনি বোধহয় রেল কোম্পানির ডিরেক্টরের পদে আছেন যদি এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করতে পারেন, বললেন আবাথনট ফরাসীতে পোয়ারোর দিকে ফিরে।
পোয়ারো তাঁকে হাত নেড়ে থামিয়ে দিলেন।
আপনি বোধহয় আমাকে মঁসিয়ে কুক ভেবে ভুল করছেন।
ওঃ হো, আমি দুঃখিত।
না, তাতে কি হয়েছে। এ রকম ভুল তো হয়েই থাকে। আমি আবার ওর জন্য বরাদ্দ কামরাটাতেই এখন আস্তানা গেড়েছি।
খানাকামরায় অনুপস্থিত কিন্তু মঁসিয়ে কুক। কে কে আসেননি আর?
রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, হাঙ্গেরিয়ান দম্পতি, রাশেট তাঁর পরিচালক, রাজকুমারীর জার্মান পরিচারকটি। চোখ মুছলেন সুইডিশ মহিলাটি।
এভাবে পাঁচজনের সামনে কেউ কান্নাকাটি করে! ইস কি বোকামিটাই না করলাম। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য।
তবে এইভাবে কদিন থাকতে হবে কে জানে। তা ঠিক, অধৈর্য গলায় ম্যাককুইন বলল।
কোনো মুলুকে আছি তাই বা কে জানে! সজল চোখে মিসেস হার্বাড বললেন।
তিনি শুনে বললেন, যুগোশ্লাভিয়া। ওঃ বলকান অঞ্চল তাই বলুন।
সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার মানুষ দেখছি আপনিই মাদমোয়াজেল। মিস ডেবেনহ্যামকে বললেন পোয়ারো।
মেরী কাঁধ ঝাঁকালেন।
মিথ্যে চেঁচামেচিই তো সার হবে। কিই বা করা যাবে বলুন।
আপনি সত্যিই বুদ্ধিমতী।
অকারণ আবেগ আমার আসে না। তবে অবস্থার সঙ্গে মানুষকে মানিয়ে চলতেই হবে। তা নয়। বাইরের বরফের স্তূপের দিকে উদাস চোখে মেরী তাকালেন। সব থেকে মনের জোর বেশি আমাদের মধ্যে আপনার। চারিত্রিক দৃঢ়তাও খুব আপনার।
না না। আমার থেকে অনেক মনের জোর রাখেন অন্ততঃ আমি একজনকে জানি।
কে তিনি?
মেরী ডেবেনহ্যামের হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরল। তার মুখে হাসি ফিরল মনে পড়ল এতক্ষণ সে একজন অচেনা বিদেশীর সঙ্গে কথা বলছিল। ঐ যে কুশ্রী মহিলাটি শুধুমাত্র নিঃশব্দ তর্জনী হেলানই কেমন বিশ্বচরাচর শাসন করছেন বরং ঐ বয়স্কা মহিলাটির কথাই ধরুন না কেন। সমস্তই যেন ওঁর পৈতৃক সম্পত্তি।
আমার বন্ধু কিন্তু ট্রেনের সব কর্মচারী মঁসিয়ে কুকেরও বংশব্দ। অবশ্য তিনি একজন ওপরওয়ালা বলে। তার চরিত্রের অনমনীয়তার জন্য নয়।
মেরী ডেবেনহ্যাম হাসলেন।
এইভাবে সকালটা কেটে গেল। দুশ্চিন্তা অনেক কমে যায় সবাই মিলে একসঙ্গে কথাবার্তা বললে, খানাকামরায় পোয়ারো কেন অনেকেই বসেছিলেন। তাঁর মেয়ের কথা, মৃত স্বামীর খুঁটিনাটি অভ্যাস, স্ত্রীর বোনা মোজা না পরলে ভদ্রলোক নাকি শান্তি পেতেন না। এইরকম গল্পে মিসেস হার্বাড একাই আসরের মধ্যমণি ছিলেন। তার কথার স্রোত যেন থামতেই চায় না।
বেশ খানিকক্ষণ পর সুইডিশ ভদ্রমহিলার সঙ্গে পোয়ারো যখন ব্যস্ত তখন একজন কন্ডাক্টর এসে দাঁড়ালো।
আমি সত্যিই দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য, মাপ করবেন মঁসিয়ে।
কি ব্যাপার?
আপনাকে একবার মঁসিয়ে কুক দেখা করতে বলেছেন। সুইডিশ ভদ্রমহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, পোয়ারোকে নিয়ে এল কন্ডাক্টর।
মঁসিয়ে কুকের নয় এই দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরাটা। এই কামরাটাকে পছন্দ করা হয়েছে কারণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবার জায়গা এবং আলাপ আলোচনার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত। আরও কয়েকজন আছেন ঘরে উঁসিয়ে কুক ছাড়াও। মঁসিয়ে কুক একটা ছোট সীটে বসে আছেন। একজন ছোটোখাটো চেহারার গাঢ় বাদামী চামড়ার মানুষ উল্টোদিকের জানালার ধারে। বাইরে বরফের স্তূপের দিকে তাঁর চোখ। নীল পোশাক পরা একজন মানুষ দরজার ঠিক সামনে। এ ছাড়াও আছে পূর্ব পরিচিত পোয়ারোর কন্ডাক্টরটি।
এই তো আপনি এসে গেছেন, চেঁচিয়ে উঠলেন মঁসিয়ে কুক। আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার আপনাকেই।
পোয়ারো বন্ধুর মুখোমুখি বসলেন। একটু সরে গিয়ে জানলার ধারে মানুষটি পোয়ারোকে বসবার জায়গা করে দিলেন। বেশ গুরুতর কোনো কিছু ঘটেছে তা কুকের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ব্যাপার কি বলুন তো?
আর বলবেন না এই বরফের ঝড়ে ট্রেনআর চলছে না তার উপর…।
একটু থামলেন মঁসিয়ে কুক, একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে এল কন্ডাক্টরের গলা থেকে।
আবার কি হল?
একজন যাত্রীকে খুন করা হয়েছে ছোরা দিয়ে। তাকে তার কামরায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।
কাকে?
দাঁড়ান নামটা হল গিয়ে। হ্যাঁ, রাশেট-এই যে কাগজে লেখা আছে উনি একজন আমেরিকান।
মাথা নেড়ে যায় দিল কন্ডাক্টর।
ইস, চোখ মুখ সাদা হয়ে গেছে ভয়ে বেচারীর। পোয়ারো মুখের দিকে তাকালেন কন্ডাক্টর।
এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে বেচারীর যা অবস্থা দেখছি, ওঁকে একটু বসতে বলুন মঁসিয়ে
কন্ডাক্টর গার্ড সসঙ্কোচে একটা কোণে বসল নীল ইউনিফর্ম পরা লোকটি সরে দাঁড়াতেই। তার মুখ দু হাত দিয়ে ঢাকা।
তাহলে তো সাংঘাতিক কাণ্ড মশাই। গম্ভীর গলায় পোয়ারো বললেন।
তাছাড়া আবার কি! খুন যেভাবে হল, ঝামেলা প্রচণ্ড বেড়ে গেল তার উপর আবার ট্রেন যেভাবে আটকে আছে। কতক্ষণ যে এই দুর্দশা চলবে কে জানে?
এখন যে আমরা যুগোশ্লাভিয়ায় আটকে পড়লাম। ট্রেনে এই মুহূর্তে এখানকার কোনো পুলিশও নেই যে তার সাহায্য আমরা নিতে পারি।
এতো ভীষণ মুশকিল হল।
ওঃ হো। ইনিই ডাক্তার কনস্টানটাইন, আর ডাক্তার ইনি মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো। আপনার সঙ্গে কথায় কথায় আলাপ করিয়ে দিতে একেবারে ভুলেই গেছি।
ডাক্তার ঈষৎ ঝুঁকে অভিবাদন জানালেন। ওঁর চেহারাটি খুবই ছোটোখাটো।
ডাক্তার বললেন, আমি কিন্তু মোটামুটি নিঃসন্দেহ যে খুনটা রাত বারোটা থেকে দু-টোর মধ্যে হয়েছে। এই রকম পরিস্থিতিতে কিছুই বলা যায় না অত হিসেব করে।
মিঃ রাশেটকে জীবিত অবস্থায় সবার শেষে কে দেখেছে? পোয়ারো জানতে চাইলেন।
উনি জীবিত ছিলেন খবর যা আছে আমাদের কাছে তাতে মনে হয় রাত একটা বাজতে কুড়ি মিনিট উনি কন্ডাক্টর গার্ডের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
এ কথা পোয়ারো সমর্থন করলেন।
আমার ঠিক পাশের কামরাতেই তো। হ্যাঁ আমি নিজের কানে তা শুনেছি। আমিও জানি কোনও খবর আর মেলেনি তারপর।
ডাক্তার বললেন, জানালাটা হাট করে খোলা ছিল রাশেটের। ঐ পথেই মনে হয় আততায়ী পালিয়েছে। কিন্তু বরফের উপর তো ছাপ থাকত তাহলে। আমাদের সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত করবার জন্যই জানালাটা খোলা ছিল আমার মনে হয়।
আর কখন এই হত্যাকাণ্ডের খবরটা জানতে পারা গেল? গম্ভীর গলায় কুক বললেন, মিশেল, যা যা জানতে চান মঁসিয়ে পোয়ারো তার উত্তর দাও।
পূর্ব পরিচিত মিশেল নামের কন্ডাক্টর গার্ডটি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো।
স্যার আজ সকালে মিঃ রাশেটের পরিচারকটি মনিবের কামরার দরজায় ধাক্কা দেয়। কোনো সাড়া শব্দ ভেতরে থেকে পাওয়া যায়নি। মিঃ রাশেট প্রাতঃরাশ করবেন কি না তা জানতে খানাকামরার লোক আসে আধঘন্টা আগে তাও প্রায় ধরুন বেলা এগারোটা নাগাদ। বাধ্য হয়ে ওঁর কামরার দরজা আমি আমার চাবি দিয়ে খুলি, ভিতরে কিন্তু শেকল দেওয়া ছিল। হু হু করে বরফ কুচি ভেতরে ঢুকছে জানালাটা খোলা থাকার জন্যে সঙ্গে একরাশ ঠান্ডা হাওয়া। ভদ্রলোক বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছেন ভাবলাম। আমি তাড়াতাড়ি এই ট্রেনেরই একজন কর্মচারীকে ডেকে দরজার শেকল ভেঙ্গে দুজনে ভেতরে ঢুকে দেখি উনি মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন।
ওঃ সে কি ভয়ানক দৃশ্য।
শিউরে উঠে মিশেল আবার দু হাতে মুখ ঢাকলো।
আচ্ছা আত্মহত্যা নয় তো? চিন্তিত গলায় পোয়ারো বললেন, শেকল তুলে কুলুপ দেওয়া ছিল ভেতর থেকে, গ্রীক ডাক্তার মৃদু হাসলেন।
না মশাই। একটা সুস্থ বুদ্ধির লোক নিজের দেহে বারো চোদ্দবার ছোরার আঘাত করবে আত্মহত্যা করতে চাইলে?
পোয়ারোর চোখ কপালে উঠল।
সেকি! এ তো নৃশংস-কাণ্ড।
এই প্রথম মুখ খুলল নীল ইউনিফর্ম পরা লোকটি। নির্ঘাত কোনো মেয়ের কাণ্ড। এরকম ওরাই করতে পারে।
তাহলে তো বলতে হবে শরীরে যথেষ্ট শক্তি রাখেন সেই মহিলাটি। ডাক্তার বললেন, ডাক্তারী শাস্ত্রমতে যথেষ্ট গায়ের জোর দরকার ওইরকমভাবে ছোরা চালাতে গেলে। দু-তিনটি কোপ তো মাংস ভেদ করে হাড়ে গিয়ে ঠেকেছে মশাই।
কি বলেন? পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত বা কেতাদুরস্ত নয় পোয়ারো বললেন।
যা বলেছেন। দেখলে মনে হবে নির্ঘাত কোনো পাগলের কাণ্ড, যেমন তেমন ভাবে যত্রতত্র আঘাত করা হয়েছে আবার মৃদু আঁচড়ের মতো আঘাতও আছে কোনো কোনো জায়গায়। যেমন হয় কেউ এলোমেলো ভাবে ছোরা চালায় চোখ বন্ধ করে। রাগলে তো মেয়েদের আর জ্ঞান থাকে না। দেখবেন এ কোনো মেয়ের কাণ্ড না হয়েই যায় না নীল ইউনিফর্ম পরা লোকটি বলল।
আমার একটা কথা বলবার ছিল। বললেন পোয়ারো, মিঃ রাশেটের মৃত্যুভয় ও জীবনহানির আশঙ্কা ছিল সে কথাই মিঃ রাশেট আমাকে বলেছিলেন গতকাল। একটু রসিকতা করলেন এতক্ষণ পর মঁসিয়ে কুক। কোনো মহিলা নিশ্চয়ই নয়। এই ট্রেনেই একজন জাঁদরেল চেহারার আমেরিকান আছে চকচকে জামাকাপড় পরে আর চুইংগাম খায়। আমি যার কথা বলছি বুঝতে পারছেন তো, বেশ সন্দেহজনক লোকটার হাবভাব।
মাথা নাড়লো কন্ডাক্টর গার্ড।
তবে আমার কিন্তু ওঁকে সন্দেহ হয় না স্যার। এই আমেরিকান ভদ্রলোক ষোল নম্বর কামরায় আছেন আমি ওঁকে একেবারের জন্য কামরা থেকে বেরোতে বা ঢুকতে দেখেনি।
ওভাবে কি কাউকে অষ্টপ্রহর চোখে চোখে রাখা যায় নাকি। সেটা তুমি নাও দেখতে পারো। কথা হচ্ছে আমরা এখন কি করব?
বন্ধুর মুখের দিকে তাকালেন পোয়ারো।
দেখুন আমি কি বলতে চাইছি তা আপনি বুঝতে পারছেন, বললেন মঁসিয়ে কুক। আমি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে। আপনি পূর্ণ তদন্তভার গ্রহণ করুন এটাই আমি চাই। না না, আপত্তি মোটেই করবেন না। একটা দায়িত্ব মানে রেল কর্তৃপক্ষের তো আছে। আমি একটা সমাধান চাইছি যুগোশ্লাভিয়ার পুলিশ আসার আগেই।
তা যদি না হয় ঝঞ্জাট, ঝামেলা অনেক বেড়ে যাবে। আপনিও নিশ্চয় চান না। অন্য কোনো নিরীহ যাত্রী অকারণ দুর্ভোগ সহ্য করুক। আমার অগাধ আস্থা আপনার বিদ্যাবুদ্ধির উপর মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনি যদি খুনীকে ধরে দেন তাহলেই আমার কাজ শেষ। পুলিশ যখন আসবে তখন এই একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আর এই লোকটা খুনী। বললেই কাজ শেষ।
আমি যদি কাজটা হাতে না নিই বা সমাধান না করতে পারি তাহলে?
আহা, এমন করে বলবেন না, বন্ধুকে পিঠ চাপড়ানোর ভঙ্গিতে মঁসিয়ে কুক বললেন। আপনি অসীম ক্ষমতাবান আর এটা একটা সোনার সুযোগ আমি জানি। মশাই হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলবেন না।
সমস্ত যাত্রীদের খুঁটিনাটি বিবরণ সংগ্রহ করা কি সোজা কাজ?
আমি যা শুনেছি, আপনি গোঁফে তা দিতে দিতে চেয়ারে বসে বসেই রহস্যের সমাধান করতে পারেন। আমার এই উপকারটা দয়া করে করুন। আমি আর কিছু চাই না। আপনি মৃতদেহ দেখুন, যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করুন, সূত্র সংগ্রহ করুন, তার একটা সন্তোষজনক সমাধান করে দিন। আপনার উপর আমি সত্যিই ভরসা রাখি এবং জানি আপনি কি ভীষণ বুদ্ধিমান। আপনাকে শুধু একটু মাথা খাটাতে হবে। আর আপত্তি করবেন না।
আবেগ মাখানো সুরে পোয়ারো বললেন, তখন হয়তো অতটা বুদ্ধিমান নই। তবে সমাধান এই ঘটনার পক্ষে অতটা কঠিন হবে না। আমি একটু আগেই ভাবছিলাম হাতে কোনো কাজ নেই এতখানি সময়। কিন্তু দেখুন ঠিক কাজ এসে জুটে গেল হাতের কাছে। কথায় আছে কেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙ্গে।
তাহলে আপনি তদন্ত করছেন?
নিশ্চয় আমার উপর সেটুকু ভরসা করতে পারেন।
খুব ভালো হল। আমরা আপনাকে যথাসাধ্য সাহায্য করব।
এই ট্রেনটার একটা নক্সা চাই প্রথমেই। এবং তাদের পাসপোর্ট টিকিট এবং কে কোনো কামরায় আছে তাদের পরীক্ষা করা দরকার।
এ বিষয়ে মিশেল আপনাকে সাহায্য করবে।
বাইরে বেরিয়ে গেল কন্ডাক্টর।
আমি যাঁদের চিনি তারা ছাড়া ট্রেনে আর কে কে আছেন, ডাক্তার কনস্টানটাইন আর আমি এই কোচটাতে।
তাঁকে ভালো করেই চেনে কন্ডাক্টর বুখারেস্ট থেকে আসা কোনো একজন খোঁড়া বয়স্ক ভদ্রলোককে। তারপর অন্যান্য কামরাগুলো বোধহয় কাজে আসবে তেমন। কারণ ঐ দিকের জানালাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল কাল রাতে। খানাকামরা কি ইস্তাম্বুল ক্যালে কোচের সামনের দিকে ক্যাস, ডাক্তার আপনি তো তাই বলতে চান, যে ইস্তাম্বুল-ক্যালে কোচের ভেতরেই খুনীর খোঁজ পাওয়া যাবে তাই না? পোয়ারো ধীর স্বরে বললেন।
ঘাড় নাড়লেন ডাঃ কনস্টানটাইন।
আমরা তুষার ঝড়ের মধ্যে পড়ি রাত সাড়ে বারোটার পরই তারপর থেকে অন্য কোথাও একজন যাত্রীও নেমে যাননি।
চিন্তার সুর মঁসিয়ে কুকের গলায়।
এই ট্রেনে..এই মুহূর্তে…খুনী তাহলে তো আমাদের সঙ্গেই আছে।
.
০৬.
রহস্যময়ী?
পোয়ারো বললেন, আমার খুব ভালো হয় প্রথমে আমি মিঃ ম্যাককুইনের সাথে কথা বলবার পর একবার মৃত মিঃ রাশেটের কামরায় ডাক্তার যদি আমার সঙ্গে যান।
নিশ্চয়ই যাবো।
সেখানকার কাজ মিটে গেলে…।
হেক্টর ম্যাককুইন ঠিক সেই মুহূর্তে প্রবেশ করলেন। উঠে দাঁড়ালেন মঁসিয়ে কুক।
মিঃ ম্যাককুইন আপনি বরং আমার জায়গায় বসুন এই জায়গাটা বেশ ছোট। আর মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার মুখোমুখি।
তিনি তারপর কর্মচারীটির দিকে ফিরলেন।
শোনো সব লোকজন সরিয়ে দাও খানাকামরা থেকে। মঁসিয়ে পোয়ারোর সুবিধে হবে ওখানে বসে কথাবার্তা বলতে আমার মনে হয়।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সে বলল ভাঙা ভাঙা ফরাসীতে, শুধু শুধু আমাকে কেন…এ সবের মানেটা কি? তখনও ম্যাককুইন দাঁড়িয়ে।
পোয়ারো তাকে বসতে বললেন হাতের ইঙ্গিতে।
ব্যাপার কি মশাই, চেয়ারে বসে আবার জিজ্ঞাসা করল ম্যাককুইন।
মাথা নাড়লেন পোয়ারো।
আপনার মনিব মিঃ রাশেট মারা গেছেন তাই আপনাকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি ব্যাপারটা অত্যন্ত জটিল। শিস দিয়ে উঠল ম্যাককুইন। সে অবাক হয়ে গেছে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো চকচক করে উঠল যেন। মুখের ভঙ্গিটা যাই হোক না কেন দুঃখ বা বেদনার ছায়ামাত্র তার মধ্যে দেখা গেল না।
এই করল তাহলে শেষ পর্যন্ত ওরা…
মিঃ ম্যাককুইন আপনি ঠিক কি বলতে চান?
ম্যাককুইন দ্বিধাগ্রস্ত।
মিঃ রাশেটকে খুন করা হয়েছে তা আপনি কি ধরেই নিয়েছেন, জিজ্ঞাসা করলেন পোয়ারো।
ম্যাককুইন এবার সত্যি সত্যিই অবাক হল।
হয়নি বুঝি? সেইরকমই ভেবেছিলাম কিন্তু আমি।
তাহলে উনি ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন অসুস্থ হয়ে আপনি বলতে চান; স্বাস্থ্য কিন্তু ওনার দারুণ ভালো ছিল।
মিঃ রাশেটকে ছোরা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু আপনি এ বিষয়ে এত নিশ্চিত হলেন কি করে সেটাই অবাক লাগার এবং আপনার ধারণাটাই সঠিক। আমাকে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ম্যাককুইন বলল, আপনি কে? কেনই বা এত প্রশ্ন করা হচ্ছে?
আমি একজন গোয়েন্দা। আমার নাম এরকুল পোয়ারো। আমি এ বিষয়ে তদন্ত করছি রেল কর্তৃপক্ষের হয়ে।
পোয়ারো ম্যাককুইনের চোখে মুখে কোনো ভাবান্তর না দেখার ফলে একটু হতাশ হলেন। বললেন, আমার নামটার সঙ্গে আপনি হয়তো পরিচিত।
হা মানে কোনো মহিলা দর্জির দোকানে আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে-নামটা দেখেছি।
তাঁর নামের ওই রকম মাহাত্ম্য দেখে পোয়ারোর মুখটা কুঁচকে গেল।
যাকগে ওসব কথা। আপনি আপনার মনিব সম্পর্কে কতটুকু জানেন সেটাই হল আমার আসল বক্তব্য, ওঁর কি আপনি আত্মীয় ছিলেন?
না না নেহাতই সচিব।
ওঁর কাছে কাজ করছেন কতদিন হল?
এই বছর খানেক হবে।
ওঁর সম্পর্কে ঠিক কি কি জানেন?
পারস্যে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বছর খানেক আগে।
ম্যাককুইনকে বাধা দিলেন পোয়ারো।
মাপ করবেন। আপনি ওখানে কি করছিলেন?
সে অনেক কথা। একটা তেল কোম্পানির কাজ নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে গিয়েছিলাম।
মিঃ রাশেটও একই হোটেলে আমার সঙ্গে ছিলেন। ওখানে রীতিমত আর্থিক কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। সেই সময় ঝগড়াঝাটি চলছিল ওঁর সচিবের সঙ্গে তাই এই কাজটা উনি আমাকে নিতে বলেন। বেশ খারাপ অবস্থা থাকার দরুন আমার কাজটা নিতে অগত্যা রাজী হয়ে যাই। অবশ্য মাইনেপত্রও ভালোই ছিল।
তারপর?
মিঃ রাশেটের ভ্রমণের নেশা ছিল। কিন্তু বিদেশী ভাষা জানতেন না। দেশ বিদেশে ঘোরার ফলে আমার কিছুটা দো-ভাষীর কাজও করতে হত এবং কাজটা আমার মনের মতোই ছিল।
এইবার বলুন আপনার মনিব কেমন ছিলেন?
ম্যাককুইন কাঁধ ঝাঁকালো। তার চোখমুখ দেখলে মনে হয় বিব্রত বোধ করছে।
বেশ কঠিন সেটা বলা।
পুরো নাম কি ওঁর?
স্যামুয়েল এডওয়ার্ড রাশেট।
আমেকিান নাগরিক?
হা।
কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা?
সঠিক বলতে পারব না।
আপনি তাহলে যতটুকু জানেন তাই বলুন।
মিঃ রাশেট সম্বন্ধে আমার তেমন কিছুই জানা নেই, সত্যি কথা বলতে নিজের কথা উনি সাতকাহন করে শোনাতেন না।
কেন বলুন তো?
কি করে জানব? কিছু কিছু মানুষের জীবনে তো এরকম ঘটে পুরানো দিনের কথা ভুলতে চাইতেন উনি। ওঁর অতীত কিঞ্চিৎ লজ্জাকর।
ব্যস। আপনি কি সন্তুষ্ট ছিলেন এইরকম কিছু ঘটেছে ধরে নিয়েই।
তা নয় ঠিক।
আত্মীয়স্বজন কি ছিল ওঁর?
তেমন কারো কথা বলতে শুনিনি কখনও।
ঈষৎ কাঠিন্য গলার স্বরে আনলেন পোয়ারো।
তবুও আপনার কিছু একটা অস্পষ্ট ধারণা নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছে?
হ্যাঁ, কিছুটা তা বলতে পারেন। এই যেমন ধরুন রাশেট ওঁর আসল নাম নয় আমার কেন জানি না মনে হয়। তিনি আমেরিকা ছাড়েন নির্ঘাত কোনো গোপন কারণে। কেননা তিনি দিব্যি খোশমেজাজে ছিলেন আর কয়েক সপ্তাহ আগে।
তারপর?
ভয় দেখানো উড়ো চিঠি আসতে শুরু করে ওঁর নামে।
স্বচক্ষে দেখেছেন আপনি?
হা। চিঠিপত্র লেনদেন ওঁর আমিই করতাম।
চাকরীর একটা অঙ্গ ছিল এটা। প্রথম চিঠিটা ধরুন দিন পনেরো আগে আসে।
এই চিঠিগুলি কি নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল?
না। বোধহয় আমার কাছেই খুঁজলে পাওয়া যাবে গোটা দুয়েক চিঠি। একটা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন রাগের মাথায়। লাগবে চিঠিগুলো?
বড় উপকার হয়, যদি একটু কষ্ট করে খুঁজে দেখেন। কামরা ছেড়ে ম্যাককুইন বেরিয়ে গেল। খানিক পর ফিরে এসে পোয়ারোর টেবিলে দুটো নোংরা কাগজ রাখল।
এই রকম প্রথম চিঠিটা :
আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যদিও তুমি সফল হতে পারোনি। তোমাকে আমরা খুঁজে বার করবই এবং জীবন দিয়ে তোমাকে ঋণ শোধ করতে হবে। পৃথিবীর যেখানেই থাকো না কেন রাশেট নিস্তার তোমার নেই।
সাক্ষর নেই কোনো চিঠির নিচে।
দ্বিতীয় কাগজটা ভুরু কুঁচকে পোয়ারো হাতে নিলেন।
রাশেট তোমার এবার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। খুব শীগগিরই দেখা হবে। আমরা তোমায় ছাড়ব না।
ধীরে ধীরে চিঠিটা নামিয়ে রেখে পোয়ারো বললেন, মোটামুটি একই ধাঁচ চিঠি দুটোর। অবশ্য সম্পূর্ণ একই রকম নয় হাতের লেখাটা।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে রইল ম্যাককুইন। মিঃ ম্যাককুইন চিঠিটা একজন লোক লেখেনি। অবশ্য আপনার চোখে এত কিছু ধরা পড়বে না; এর জন্য চোখ চাই অভিজ্ঞ লোকের বললেন পোয়ারো। এক সঙ্গে দু তিনজনে মিলে লিখেছে। অনেকটা এই রকম একজন একটা লিখেছে–অন্যজন আরেকটা যাতে চট করে হাতের লেখা না চেনা যায়, সবই বড় বড় অক্ষরে একজন একটা শব্দ লিখেছে। আচ্ছা মিঃ রাশেট যে আমার সাহায্য চেয়েছিলেন তা জানেন?
আপনার সাহায্য?
এ বিষয়ে সে যে বিন্দুবিসর্গও জানেন না। ম্যাককুইনের গলার স্বরেই পরিষ্কার টের পাওয়া গেল।
পোয়ারো ঘাড় নাড়লেন।
হা ভয় পেয়েছিলেন উনি। আচ্ছা ওঁর কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বলুন তো প্রথম চিঠিখানা পেয়ে।
সেভাবে সঠিক করে কিছু বলা মুস্কিল। কিছুটা দ্বিধার সুরে বলল ম্যাককুইন। একটু হেসেছিলেন প্রথমে। কিন্তু শঙ্কিত হয়েছিলেন বেশ মনে মনে। চেঁচামেচি করে বাইরে প্রকাশ করার মানসিকতা ওঁর ছিল না।
সায় দিলেন পোয়ারো। তারপর একটা সত্যি কথা বলবেন মিঃ ম্যাককুইন, আপনি কি ধারণা পোষণ করতেন আপনার মনিব সম্বন্ধে? আচমকা জিজ্ঞাসা করলেন।
হেক্টর ম্যাককুইন ভাবলো দু এক মুহূর্ত উত্তর দেবার আগে। তারপর দ্বিধাহীন গলায় বলল, আমি ওঁকে একেবারেই পছন্দ করতাম না।
কেন?
তা ঠিক বলতে পারব না। উনি আমার সঙ্গে মোটামুটি সহৃদয় ব্যবহারই করতেন কিন্তু আমি ওঁকে সত্যি কথা বলতে–ঠিক বিশ্বাস করতে পারতাম না। উনি একজন নৃশংস ভয়ঙ্কর লোক মনে হত। অবশ্য আমার এই ধারণার কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না এটা স্বীকার করতেই হবে।
ধন্যবাদ মিঃ ম্যাককুইন। আর একটা কথা, আপনি শেষ কখন জীবিত অবস্থায় দেখেন মিঃ রাশেটকে।
কাল রাতে। এই ধরুন দশটা হবে। কয়েকটা জরুরী কাগজে সই করতে আমি ওঁর কামরায় গিয়েছিলাম।
কাগজ? কি সংক্রান্ত?
কিছু পুরানো কাঁচের জিনিস পারস্যে উনি কিনেছিলেন। তারই রসিদ, যে জিনিসগুলি আসলে উনি কেনেন, ভুল করে অন্য মাল পাঠানো হয়েছিল তার বদলে। আমরা বেশ খানিকক্ষণ কথা বলি সেই বিষয়ে।
এবং তখনই মিঃ রাশেটকে শেষবারের মতো জীবিত অবস্থায় আপনি দেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
শেষ উড়ো চিঠিটা কবে নাগাদ পান মিঃ রাশেট আপনি কি জানেন?
কনস্তান্তিনোপোল আমরা যেদিন ছাড়ি সেইদিন সকালবেলায়।
আর একটা কথা, আপনার মনিব মিঃ রাশেটের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল মিঃ ম্যাককুইন? চোখ দুটো ঝিকিয়ে উঠল ম্যাককুইনের।
চমৎকার স্যার। এককথায় চমৎকার। বিন্দুমাত্র তিক্ততা ছিল না আমাদের সম্পর্কের মধ্যে।
একটু লিখে দিন আপনার নাম আর ঠিকানাটা।
ম্যাককুইন লিখে দিল। হেক্টর উইলার্ড ম্যাককুইন।
ঠিকানা : নিউইয়র্কের এক জায়গা।
মিঃ ম্যাককুইন আজ এই পর্যন্তই।
আপনার সঙ্গে আজ যে সমস্ত কথাবার্তা হল, এই মুহূর্তে দয়া করে প্রকাশ করবেন না বাইরে এমনকি অপনার মনিব যে নিহত হয়েছেন তাও।
ওঁর পরিচারক ম্যান্টার ম্যান তো জানবেই।
এতক্ষণে সে হয়তো জেনেও গেছে। নরম গলায় পোয়ারো বললেন, তাই যদি হয় তবে তাকেও মুখ বন্ধ করে থাকতে দয়া করে অনুরোধ জানাবেন।
কোনো অসুবিধা নেই তাতে। খাঁটি ইংরেজ তত মিশুকে নয় মোটেই কারুর সাতে পাঁচে থাকে না দিব্যি আপন মনে থাকে। তাছাড়া ওর ধারণা আমেরিকানদের সম্পর্কে বেশ নিচুমানের আর অন্য জাতের লোকেদের তো মনিষ্যি বলেই মনে করেন না।
ধন্যবাদ মিঃ ম্যাককুইন।
কি মনে হয় সবই বিশ্বাসযোগ্য, মঁসিয়ে কুক বললেন। ম্যাককুইন বাইরে বেরিয়ে যাওয়া মাত্র।
ও মোটেই পছন্দ করত না মনিবটিকে সেটা স্পষ্টই বলে গেল। রাশেট যে সাহায্য চেয়েছিলেন আমার কাছে তাও ওর কাছে অজানা ছিল অবশ্য অবাক হবার কিছুই নেই এর মধ্যে কারণ রাশেট গোপনীয়তা পছন্দ করতেন।
কিছুটা উৎফুল্ল হলেন মঁসিয়ে কুক।
তাহলে আমরা অন্ততঃ একজনকে সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখতে পারি।
আমি কিন্তু সেরকম কিছুই বলিনি।
আমার পেশা সবাইকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সন্দেহ করা।
আমার বিশ্বাস এই ভদ্র সুন্দর সুদর্শন ব্যক্তিটি তার মনিব মিঃ রাশেটকে রাগের মাথায় এলোপাথাড়ি বারো চোদ্দবার ছোরা চালিয়ে নিশ্চয় খুন করেনি।
তা ঠিক। মনে হয় নির্ঘাত পাগল খুনিটা। কোনো মহিলা নয়তো কোনো লাতিন মনোবৃত্তির মানুষ ঘৃণায়, আক্রোশে হয়তো সে স্বাভাবিক মানুষ ছিল না।
.
০৭.
মৃতদেহ
পোয়ারো ডাঃ কনস্টাইনের পিছু পিছু নিহত মিঃ রাশেটের কামরায় এসে প্রবেশ করলেন। একটু আগেই কণ্ডাক্টর দরজা খুলে দিয়েছিল চাবি দিয়ে।
জিনিসপত্র কি খুব বেশি নাড়াচাড়া করা হয়েছে এ কামরার, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন।
না। সাবধানেই মৃতদেহ যথাসম্ভব পরীক্ষা করেছি।
কিছুই ছোঁয়া হয়নি।
পোয়ারো চারধারে চোখ বুলিয়ে নিলেন।
অসম্ভব ঠান্ডা কামরার ভেতরটা, হু হু করে হাওয়া ঢুকছে শার্সির ফাঁক দিয়ে। ডাক্তার হেসে বললেন, জানালাটা বন্ধ করিনি আমি ইচ্ছে করেই যেমন ছিল তেমনই আছে।
জানালাটা পরীক্ষা করলেন পোয়ারো।
জানালাটা বিভ্রান্ত করবার জন্যেই খোলা রয়েছে। কেউ বাইরেও বেরোয়নি এই পথে। যদি হত্যাকারী পালাতেও কিন্তু তুষার ঝড়ই সে আশায় বাধ সেধেছে।
জানালার ধারে পোয়ারো কিছুটা সাদা রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে দিলেন।
না। কোনো কিছুই পাওয়া গেল না, আঙুলের ছাপটাও নেই। অবশ্য আঙুলের ছাপ কারই বা পাওয়া যেতো।
আজকাল খুনীরা এই সব কাঁচা কাজ করেই না। জানালাটা বন্ধই করাই ভালো।
পোয়ারো জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে রাশেটের মৃতদেহের দিকে ঘুরে তাকালেন।
রাশেটের পরনে পায়জামা আর কুর্তা। জামার বোতামগুলো খোলা আর জায়গায় জায়গায় রক্তের কালচে ছোপ। আমি বোতামগুলো খুলেছিলাম মৃতদেহ পরীক্ষা করবার সময়, ব্যাখ্যা করলেন ডাক্তার।
সামনের দিকে ঝুঁকে পোয়ারো নীরস গলায় বললেন, ওঁকে কেউ এখানে দাঁড়িয়ে বারম্বার আঘাত করেছে, গুণে দেখেছেন কি ক্ষতস্থানের সংখ্যা কটা?
গোটা বার তো হবেই–কয়েকটা সামান্য আঁচড়ের মতো তার মধ্যে তিনটে ক্ষত সাংঘাতিক, এগুলোর মধ্যে যে কোনো একটাই মৃত্যু ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট। পোয়ারো ফিরে তাকালেন কারণ তার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল।
মৃতদেহের দিকে স্থির দৃষ্টিতে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছেন ডাক্তার।
নতুনত্ব কিছু চোখে পড়ছে ডাক্তার?
ঠিকই ধরেছেন।
ব্যাপারটা কি?
এই যে এখানে লক্ষ্য করুন ক্ষতস্থানগুলো যতটা গভীর রক্তপাত কিন্তু হয়নি ঠিক এই দুটি ক্ষতস্থানে।
অর্থাৎ?
এই আঘাতগুলো করা হয়েছিল রাশেটের মৃত্যুর পর।
কিন্তু সেটা সম্ভব কি?
পোয়ারো চিন্তান্বিতভাবে জবাব দিলেন, হত্যাকারী হয়তো নিশ্চিত ছিল না যে সে কাজটা করতে পেরেছে কিনা। সেই জন্যেই দ্বিতীয়বার ফিরে এসেছিল এটা একটা ব্যাপার হতে পারে। তবে এতে ঝুঁকি থেকে যায়। আপনার আর কিছু নজরে পড়ছে?
আর একটা কথা।
বলুন।
এই ক্ষতটা দেখুন। ডান কাঁধের কাছাকাছি ডান হাতের নিচে। এই পেন্সিলটা দিয়ে আপনি কি এই আঘাত করতে পারবেন?
উজ্জ্বল হয়ে উঠল পোয়ারোর মুখ।
একটু কষ্টসাধ্য ডান হাত দিয়ে আঘাত করাটা তবে বাঁ হাত দিয়ে করে থাকলে…
ঠিক তাই মঁসিয়ে পোয়ারো বাঁ হাত দিয়েই আঘাতটা করা হয়েছে। ডাক্তার বললেন।
অর্থাৎ আমাদের হত্যাকারী ন্যাটা। কাজটা কিন্তু তাহলে আমাদের আরও জটিল হয়ে গেল।
হা। ডান হাত দিয়েও কতকগুলো আঘাত নিশ্চিতভাবে করা হয়েছে। অর্থাৎ একজন সঙ্গী ছিল হত্যাকারীর। আচ্ছা কামরার আলো জ্বলছিল?
বলা শক্ত। কারণ সব কামরার আলো সকাল দশটায় কণ্ডাক্টর নিভিয়ে দেয়।
বোঝা যাবে সুইচগুলো দেখলে।
দুটো আলো কামরায়। বড় আলোটা কামরাটাকে পুরো আলোকিত করার জন্য, মাথার কাছে যে আলো সেটা বইপত্র পড়ার জন্য। দ্বিতীয় আলোটার মাথায় ঢাকনা আছে সেটা টানলে আড়াল পড়বে। সুইচ বন্ধ ছিল আলোটার আর ঢাকা দেওয়া ছিল দ্বিতীয় আলোটার।
প্রথম আততায়ী ফিরে যাবার সময় বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যায় তার কাজ শেষ হয়ে যাবার পর। দ্বিতীয় জন কয়েকবার মৃত দেহে আঘাত করে চুপি সারে চলে যায়। আমার মনে হয়, পোয়ারো বললেন।
চমৎকার, ডাক্তার বললেন।
খুব সন্তোষজনক ব্যাখ্যা এটাও কিন্তু আমার কাছে নয়।
পরিস্থিতিটা কিভাবে আর বোঝাতে পারবেন বলুন।
নিজের কাছে বারবার জিজ্ঞেস করছি সেই কথাই। আচ্ছা আসুন ভাবা যাক এর স্বপক্ষে আর কি কি যুক্তি খাড়া করা যায় যে হত্যাকারীরা কমপক্ষে দুজন।
সে কথা তো বোঝা যাচ্ছে ক্ষতগুলো পরীক্ষা করলেই।
সেগুলি হালকা আঁচড়ের মতো তার জন্য দৈহিক শক্তির প্রয়োজন হয়নি কিন্তু সেগুলি মাংসপেশী ভেদ করে গেছে। এমনই গভীর সেগুলোর ক্ষেত্রে দৈহিক শক্তির প্রয়োজন হয়েছে।
নিঃসন্দেহে একজন পুরুষ দায়ী গভীর ক্ষতগুলোর।
হা।
একেবারেই অক্ষম কি কোনো মহিলা এই ধরনের আঘাতের ক্ষেত্রে।
তা নয়। তবে দক্ষতা এবং তারুণ্য দরকার। আমি ডাক্তার হিসাবে বলতে পারি যে, এ কোনো মহিলার কাজ নয়। এবং এ যুক্তি সমর্থন যোগ্যও নয়।
পোয়ারো চুপ করে থাকলেন দু এক মুহূর্ত।
আপনি কি আমার কথাটা বুঝতে পারছেন? ডাক্তার উদ্বিগ্ন গলায় বললেন।
নিশ্চয়ই। কোনো মহিলার দ্বারা হালকা আঁচড়গুলো সৃষ্ট আর একজন শক্তিশালী পুরুষ রাশেটকে আঘাত করেছে ব্যাপারটা হল এই। আর একজন নিশ্চয় ন্যাটা। কি আক্কেল দেখুন মিঃ রাশেটও দিব্যি শান্তভাবে খুন হয়েছে, কোনো ধস্তাধস্তির বিন্দুমাত্র চিহ্নই নেই।
ছোট্ট স্বয়ংক্রিয় পিস্তলটা বার করলেন পোয়ারো রাশেটের বালিশের নিচে থেকে।
পিস্তলে গুলি ভরা আছে, তার মনে বিপদের আশঙ্কা ছিল দেখুন ডাক্তার।
রাশেটের দিনের বেলায় পরবার স্যুট কামরার দেওয়ালে হুকে পরিপাটিভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বাঁধানো দাঁতের পাটি একটি গ্লাসে ডোবানো। একটা খালি গ্লাস, ছাইদানী, জলের বোতল, ফ্লাক্স। ছাইদানীতে এক-একটা পোড়া সিগারেটের টুকরো। আর কয়েক টুকরো পোড়া কাগজ, দুটো ব্যবহার করা দেশলাই কাঠি। খালি গ্লাসটা নাকের কাছে আনলেন ডাক্তার।
হু এবার বোঝা যাচ্ছে কড়া ঘুমের ওষুধের জন্য রাশেট হত্যাকারীকে বাধা দেয়নি।
পোয়ারো পোড়া দেশলাই কাঠি দুটি পরীক্ষা করতে লাগলেন।
কি মশাই সূত্র মিললো? ডাক্তার উৎফুল্ল গলায় জিজ্ঞাসা করলেন।
একটা সাধারণ, অন্যটা চ্যাপ্টা, কাগজের তৈরি দুটো কাঠি দু রকমের।
সাধারণত ট্রেনে এই ধরনের কাগজের কাঠি বিক্রি হয়। পোয়ারো রাশেটের জামাকাপড়ের ভেতর থেকে একটা দেশলাই পেলেন।
এটা দেখুন সাধারণ মানের। চ্যাপ্টা দেশলাই কাঠিটা নিঃসন্দেহে ওঁর নয়। ওই রকম প্যাকেট কামরায় পাওয়া যায় কিনা খুঁজে দেখি একটু।
কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সারা কামরা খোঁজার পর তিনি একটি মেয়েদের দামী রুমাল পেলেন, তাতে রঙিন সূততা দিয়ে এককোণে লেখা আছে ইংরেজীতে H অক্ষর।
রেলকর্মচারীর সন্দেহ তাহলে ঠিকই ছিল যে এ ব্যাপারে কোনো মহিলা নিশ্চয় জড়িত, ডাক্তার বললেন।
হতেও তো পারে সেই মহিলাটি চলচ্চিত্রের গোয়েন্দা গল্পের মতো তার রুমালটা সূত্র হিসাবে ফেলে রেখে গেছেন।
তাই নাকি?
ঈষৎ ব্যাঙ্গের সুর যেন শোনাল পোয়ারোর কথায় ডাক্তারের মনে হল।
আরও একটা পাইপ ক্লিনার খুঁজে পেলেন পোয়ারো। এটা হয়তো রাশেটের সম্পত্তি, ডাক্তার বললেন।
না, রাশেটের সম্পত্তির মধ্যে পাইপ, পাউচ, বা তামাক কিছুই নেই।
এটাও একটা রহস্যের সূত্র তাহলে।
নিশ্চয়ই, সূত্রের এই আধিক্যটাই আমাকে বেশি ভাবচ্ছে। যে জিনিস পুরুষ মানুষের তিনিও কি ভুল করে ফেলে গেছেন? আচ্ছা গেল কোথায় ছোরাটা?
সেটা নিশ্চয়ই হত্যাকারী সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।
কিন্তু কেন?
রাশেটের জামার বুক পকেটে এই সোনার ঘড়িটা ছিল এটা নজরে পড়েনি এই দেখুন। ডাক্তার, মঁসিয়ে পোয়ারোকে বললেন।
ঘড়িটা একটা বেজে পনের মিনিটে বন্ধ হয়ে গেছে এবং নিশ্চয় আঘাতের ফলে কাঁচটাও ভেঙে গেছে।
একটা মোটামুটি আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে যে খুন হবার সঠিক সময়ের। রাত বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে যে কোনো সময় ঘটনাটা ঘটেছে অবশ্য আমিও বলেছিলাম।
হা হা সে তো হতেই পারে।
বোধহয় পোয়ারোর স্বরে সূক্ষ্ম বক্রোক্তি ছিল।
ফিরে তাকালেন ডাক্তার।
আমি বুঝি না মশাই আপনি কি এত ভাবেন সময় সময়।
আমিও নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।
আর সেজন্যই বেশি করে ভাবাচ্ছে আমায়।
তীক্ষ দৃষ্টিতে পোয়ারো জরীপ করতে লাগলেন। এক টুকরো আধপোড়া কাগজ দেখালেন ডাক্তার।
সেটাকে খুব যত্ন করে তাকের উপর রেখে শুকনো কাপ চাপা দিয়ে রাখলেন পোয়ারো, যাতে উড়ে না যায়।
যে কোনো মহিলার একটা টুপি রাখার বাক্স খুবই প্রয়োজন বুঝলেন ডাক্তার। দাঁড়ান কণ্ডাক্টরকে ডাকি। পোয়ারো কামরার দরজা খুলে মুখ বাড়ালেন কণ্ডাক্টর গার্ড দৌড়ে এল।
এই বগিতে মহিলা কজন আছেন? জিজ্ঞাসা করলেন।
মঁসিয়ে ছজন। ঐ আমেরিকান প্রৌঢ়া, সুইডিস মহিলা। ইংরেজ তরুণী। কাউন্টেস আন্দ্ৰেসি, রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, আর তাঁর পরিচারিকা।
টুপি রাখবার বাক্স কি সবার কাছে আছে এঁদের?
হা মঁসিয়ে।
বেশ তুমি বরং … আচ্ছা ঐ সুইডিস মহিলাটির আর রাজকুমারীর পরিচারিকাটির কামরা থেকে বাক্স দুটো হাতিয়ে নিয়ে এস। যদি ধরা পড়ে যাও কিছু একটা বানিয়ে বলে দেবে।
কোনো অসুবিধেই হবে না মঁসিয়ে, কেউ ওঁদের কামরায় নেই।
তাহলে চটপট যাও।
কণ্ডাক্টর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গিয়ে বাক্স দুটো নিয়ে এল। পরিচারিকাটির বাক্সটি খুলে আবার বন্ধ করে সরিয়ে রাখলেন পোয়ারো। সুইডিস মহিলার বাক্সটি থেকে কোনো ঈঙ্গিত বস্তুর বোধহয় সাক্ষাত মিলল। ধাতব তৈরি তারের ছোট ছোট টুকরো জাল বের করলেন টুপিগুলো সাবধানে সরিয়ে।
এই দেখুন পেয়েছি। এই টুপি রাখার বাক্সগুলো পনের বছর আগে চালু ছিল। একটা পিন দিয়ে টুপিগুলো জালের উপর আটকে রাখা যায়।
দু টুকরো জাল নিপুণভাবে খুলে নিয়ে কণ্ডাক্টরের হাতে বাক্সগুলো ফেরত দিলেন।
এবার জায়গা মতো এটা রেখে এস।
আপনি বোধহয় অবাক হচ্ছেন আমার কাজের পদ্ধতি দেখে, ডাক্তারকে পোয়ারো বললেন কণ্ডাক্টর চলে যাবার পর। আসলে আমি বিশ্বাসী নই চিরাচরিত ধারায়-তাই যে কোনো অপরাধের পেছনে আমি খুঁজি মনস্তত্ব। দু-চারটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দরকার মনস্তাত্বিক জটিলতা সমাধানের জন্য। অনেক সূত্র তো সারা কামরায় আছে কোনোগুলি আসল আর কোনোগুলি জাল তা আগে জানা উচিত।
বুঝলাম না ঠিক।
আপনাকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমরা একটা মহিলার রুমাল পেয়েছি। তিনিই কি এই রুমালটা ফেলে গেছেন? নাকি কোনো পুরুষ আমাদের বিভ্রান্ত করবার জন্য একাজ করেছেন তা জানা জরুরী। আবার এও হতে পারে মহিলাটিই অপরাধী তিনি আমাদের বিভ্রান্ত করবার জন্য পাইপ ক্লিনারটা ফেলে গেছেন অর্থাৎ যাতে আমরা ভাবি এ নিশ্চয় কোনো পুরুষের কাজ। আবার এও অবাস্তব নয় যে দুজনেই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তারা একটা করে সূত্র দুজনেই ফেলে রেখে যাবার মতো কি ভুল করতে পারে?
কিন্তু ঐ টুপি রাখার জালের ব্যাপারটা
ওটার কথায় পরে আসছি। রাত একটা বেজে পনেরো মিনিটে ঘড়িটি বন্ধ হয়ে গেছে দেখা যাচ্ছে। সূত্র হিসাবে এই তিনটেই যেমন একদিকে খাঁটিও হতে পারে অথবা জাল হওয়াও অসম্ভব নয়। তবে এর মধ্যে একটা সূত্র অবশ্য সঠিক, কাগজের তৈরি চ্যাপটা দেশলাই কাঠিটা কিন্তু রাশেটের নয়। বোঝাই যাচ্ছে ওটা হত্যাকারীর, এটা আবার বিশ্বাস্য। কারণ ওই টুকরো কাগজটা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল যা ছিল হত্যাকারীর পক্ষে বিপজ্জনক কোনো চিঠি। আমি আসছি দাঁড়ান।
কামরা থেকে পোয়ারো বেরিয়ে গেলেন।
একটা স্পিরিট ল্যাম্প, আর এক জোড়া সরু চিমটে নিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন।
এই বুদ্ধিমান বেলজিয়ান ছোটোখাটো ফিটফাট চেহারার গোয়েন্দাটিকে ডাক্তার অবাক হয়ে দেখছিলেন।
পোয়ারো এক টুকরো জালের উপর আধপোড়া কাগজটিকে বিছিয়ে দিয়ে অন্য জালের টুকরোটা চাপা দিলেন, এরপর সাবধানে পুরো জিনিষটা চিমটে দিয়ে ধরে স্পিরিট ল্যাম্পের শিখায় ধরলেন, তারের জালগুলো লালচে হয়ে উঠল এবং একটু পরেই কয়েকটি অস্ফুট কথা ফুটে উঠল কাগজে।
মনে রেখো ছোট্ট ডেইজি আর্মষ্ট্রংয়ের কথা।
তিনি সমস্ত জিনিষগুলো টেবিলের উপর নামিয়ে রাখার পর তাকে খুব পরিতৃপ্ত দেখাল।
কিছু পেলেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
নিশ্চয়ই।
পোয়ারোর চোখ দুটো উত্তেজনায় চকচক করছিল।
মৃত ব্যক্তির পরিচয় আমি জানি ডাক্তার। সে কেন আমেরিকা থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল তাও।
মিঃ রাশেটের আসল নাম কি?
কাসেট্টি।
কাসেট্টি? আমেরিকার কোনো ঘটনা কি? দাঁড়ান দাঁড়ান একটু একটু যেন মনে পড়ছে..।
হ্যাঁ।
ডাক্তার দেখছিলেন যে মিঃ রাশেটকে এই প্রথম সে বলে সম্বোধন করলেন পোয়ারো, শুধু তাই নয় আমেরিকা থেকে সে কেন পালাতে বাধ্য হয়েছিল তাও বা কেন বললেন।
মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন কিন্তু পোয়ারো।
ডাক্তার বললেন, আমায় একটা জিনিষ বুঝিয়ে দেন যদি পোয়ারো। হত্যাকারী জানালা দিয়ে না পালিয়ে পালালো তাহলে কোনো পথে? কেননা এই কামরা আর পাশের কামরা তো বন্ধ ছিল। অন্য দিক থেকে আবার করিডোর থেকে যে বেরোবার দরজা সেটাও তো ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
ভানুমতির খেল দেখেছেন কি ডাক্তার? সেই যে একটা লোককে হাত পা বেঁধে সিন্দুকে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেওয়া তালা চাবি এঁটে। অথচ কিছুক্ষণ পর লোকটিকে আর দেখা গেল না।
এখানেও কি সেই একই ব্যাপার।
হা। অনেকটা সেই। হত্যাকারী অন্যদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। সে যেন জানালা দিয়েই পালিয়েছে এবং অন্য পথ তার বন্ধই ছিল। একটা বুদ্ধির খেলা আছে সেটা খুব কৌশলেই আমায় ধরতে হবে। ওধার থেকে তো পাশের কামরা বন্ধই ছিল। এদিক থেকে সেটাও বন্ধ করে দিলেন পোয়ারো।
মিসেস হার্বাডের যা কৌতূহল, বুঝলেন ডাক্তার। বলা তো যায় না গোপনে অকুস্থল দেখার লোভ উনি সামলাতে পারবেন না হয়তো সেই মেয়েকে চিঠি লেখবার আগে। এবং আমি সেই হেতু ও পথ বন্ধ করে দিলাম।
আরো একবার ভালো করে দেখে নিলাম। বললেন চলুন মঁসিয়ে কুকের ওখানে যাওয়া যাক কেননা এখানে আপাতত আর কোনো কাজ নেই।
.
০৮.
আর্মষ্ট্রং পরিবারের কথা
তারপর তদন্তের কাজ কতদুর এগোল মঁসিয়ে পোয়ারো। মঁসিয়ে কুক জিজ্ঞাসা করলেন।
কুক, পোয়ারো আর ডাক্তার এই তিনজন কামরায় ছিলেন। যাত্রীদের সবাইয়ের খাওয়া দাওয়ার পর খানা কামরায় বসে সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করবেন মঁসিয়ে পোয়ারো সেই রকমই বলেছেন মঁসিয়ে কুক।
মিঃ রাশেটের প্রকৃত পরিচয় জানা গেছে এবং সে কেন আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল তাও।
একটু প্রাঞ্জল করে বলবেন ব্যাপারটা।
আপনারা কাসেট্টির নাম শুনেছেন নিশ্চয়। যে আর্মষ্ট্রং নামের ফুলের মতো একটি শিশুকে হত্যা করেছিল।
দাঁড়ান দাঁড়ান। নামটা খুবই চেনা লাগছে, একটু খুলে বলুন তো।
নিহত মিঃ রাশেটের আসল নাম কাসেট্টি। কর্নেল আর্মষ্ট্রং ছিলেন ইংরাজ। তিনি ভিক্টোরিয়া ক্রস পান প্রথম মহাযুদ্ধের সময়। জন্ম সূত্রে তাকে অবশ্য আধা আমেরিকানও বলা চলে। ওঁর মা ছিলেন একজন নামজাদা মার্কিন কোটিপতির মেয়ে। বিখ্যাত অভিনেত্রী লিণ্ডা আর্ডেনের মেয়েকে উনি বিয়ে করেন। ট্রাজিক চরিত্র অভিনয়ে শ্রীমতী আর্ডেনের তুলনা মেলা ভার ছিল। আমেরিকায় থাকতেন কর্নেল আর্মস্ট্রং। ডেইজি নামের একটা ফুটফুটে মেয়ে ছিল। যখন তার বয়স তিন তখন তাকে অপহরণ করা হয়। কাসেট্টি তখন দুবৃত্ত দলের নেতা ছিলেন। মোটা টাকা মুক্তিপণ হিসাবে নেওয়ার পরও ডেইজিকে আগে মারা হয়েছিল। রাশেট এরকম নৃশংস কাজ আগেও করেছে। সমাজবিরোধী কাজকর্ম করেও সে কোটিপতি হয়ে উঠে তারপর কাগজেও হৈ চৈ হয়। পরে সে আমেরিকা ছেড়ে পালায়। এখানেই কিন্তু ঘটনার শেষ নয়। মিসেস আর্মষ্ট্রং সেই সময় সন্তান সম্ভবা ছিলেন। এই আকস্মিক আঘাত সহ্য করতে না পারার দরুণ তিনি মারা যান একটি মৃত শিশুর জন্ম দিয়ে এবং কর্নেল আর্মস্ট্রং আত্মহত্যা করেন।
কুক বললেন, ওঃ কি ভয়ানক। আমারও এবার মনে পড়েছে ঐ পরিবারের বোধ হয় আরও একটা মৃত্যু…।
হ্যাঁ ডেইজির দেখাশোনা করত এক হতভাগিনী ফরাসী পুলিশ। তাকে অহেতুক সন্দেহ করার ফলে সে লজ্জায় ক্ষোভে আত্মহত্যা করেছিল খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে। কিন্তু সে ছিল সম্পূর্ণ নিরাপরাধ।
আর্মষ্ট্রং পরিবারের মৃত্যু যজ্ঞের মূল হোতা কাসেট্টি ছ মাস পরে ধরা পড়ে। এবং পুলিশের আওতা থেকে কোনোরকমে বেরিয়ে এসে আমেরিকা ছেড়ে পালায়, সেই হেতু তার প্রকৃত পরিচয় কেউ জানতে পারেনি।
তাহলে দেখছি খুন হয়ে উচিত শাস্তিই সে পেয়েছে। একটা ঘৃণ্য জন্তুরও অধম, কুক বললেন।
আপনার সঙ্গে আমি একমত এ বিষয়ে। কিন্তু এত জায়গা থাকতে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে কেন?
পোয়ারো একটু হাসলেন।
এটা আমারও প্রশ্ন বন্ধু।
তবে কি অন্যদলের কেউ রেষারেষি করে ওকে খুন করল? নাকি পুরোপুরি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফসল?
অনুমান যদি সত্য হয় হত্যাকারী এই কাগজটা কেন পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল, আর্মষ্ট্রং পরিবারের উল্লেখ ছিল বলে।
কেউ কি জীবিত আছেন আর্মস্ট্রং পরিবারের?
দুঃখের বিষয় আমার তা জানা নেই। তবে কাগজে পড়েছিলাম মিসেস আর্মষ্ট্রং-এর এক বোন ছিল।
ভাঙা ঘড়িটার কথা উঠতেই কুক বললেন, তাহলে তো খুনের সঠিক সময়টা জানা হয়ে গেল।
হা। সময়টা সঠিক বলেই মনে হচ্ছে। একটু চিন্তান্বিত গলায় পোয়ারো বললেন।
তার কথা বলার ভঙ্গিতে একটা এমন কিছু ছিল, যে অন্য দুজন চমকে তাকালেন।
রাত একটা বাজতে কুড়ি মিনিটে রাশেট ওরফে কাসেট্টি জীবিত ছিলেন আপনি বলেছেন কারণ তার সঙ্গে কণ্ডাক্টর কথা বলছিল।
একটা বাজতে তেইশ মিনিট তখন।
অর্থাৎ বারোটা সাঁইত্রিশেও জীবিত ছিল। এটা তো আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পোয়ারো কোনো উত্তর দিলেন না। দরজায় মৃদু টোকা পড়ল, একজন রেল কর্মচারী খবর দিল যে পোয়ারো ইচ্ছে করলে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন যাত্রীদের। মঁসিয়ে কুক উঠে দাঁড়ালেন।
চলুন যাওয়া যাক।
আমিও আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি, বললেন ডাক্তার।
নিশ্চয়। অবশ্য মঁসিয়ে পোয়ারো যদি আপত্তি না করেন।
কিছুমাত্র না আপনিও চলুন।
তিনজন এগিয়ে গেলেন খানাকামরার দিকে।
২. দ্বিতীয় পর্ব: যাত্রীদের জবানবন্দী
দ্বিতীয় পর্ব: যাত্রীদের জবানবন্দী
০১.
কণ্ডাক্টর গার্ডের সাক্ষী
তদন্ত শুরু হলো।
একটা টেবিলের ধারে মঁসিয়ে পোয়ারো আর কুক বসলেন।
একটু দূরে ডাক্তার। পোয়ারোর সামনে ইস্তাম্বুল কাল কোচের যাত্রীদের নামের তালিকা, কোচের নকশা, লাল কালি দিয়ে কে কোথায় কোনো কামরায় চিহ্নিত করা আছে। টেবিলের উপর স্তূপাকৃতি পাসপোর্ট আর টিকিট। এছাড়াও লেখবার কাগজ। কালির দোয়াত, কলম আর পেন্সিল।
ব্যবস্থা চমৎকার।
কাজ শুরু হয়ে গেল প্রথমে কণ্ডাক্টর গার্ডের সাক্ষ্য নেওয়া দরকার মনে হয়। দয়া করে মঁসিয়ে কুক-এর সম্বন্ধে বলুন। ও কি বিশ্বাসভাজন?
নিশ্চয়ই। আমি হলফ করে বলতে পারি। পিয়ের মিশেল জাতিতে ফরাসী, পনের বছরের উপর রেলেঞ্চাকরী করছে। ফ্যালের কাছাকাছি এক জায়গায় থাকে এবং এর সম্বন্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কোনো যাত্রীদের বা কর্তপক্ষের।
বেশ তাহলে ওকে ডাকা যাক।
পিয়ের মিশেল জবানবন্দী দিতে হবে শুনে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় আর কি, যাক সামলে নিয়েছে। তাকে বুঝিয়ে পোয়ারো শান্ত করলেন।
মিশেল ত্রস্ত গলায় বললেন। আমার কর্তব্যের কোনো গাফিলতি ছিল না এবং এটা খুবই দুঃখজনক যে রাশেট নিহত হয়েছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি এর কিছুই জানি না। এর জন্য জানি না আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে কি না?
তাকে আশ্বস্ত করে তার সমস্ত কিছুই জেনে নিলেন তার সম্পর্কে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন গতকাল মিঃ রাশেট রাত কটায় শুতে যান?
নৈশ আহারের ঠিক পরেই। তার আগের দিনও একই সময় শুয়ে পড়েন। যখনই তিনি খেতে যান আমাকে ওর বিছানাপত্র ঠিকঠাক রাখতে বলে যান এবং আমিও সেইমত করি।
তারপর তার কামরায় কেউ কি গিয়েছিলেন?
ওঁর পরিচারক আর সেক্রেটারী।
এ ছাড়া?
না আমি অন্ততঃ কাউকে দেখিনি।
তোমার সাথে আর তারপর কোনো কথা হয়নি তাই তো?
নাকে ডেকে ছিলেন ঘন্টি বাজিয়ে। ট্রেন সেই সময় থেমে ছিল।
ঠিক ঠিক কি হয়েছিল?
আমি দরজায় টোকা দিতে উনি বলেন, যে ঘন্টিটা ভুল করে টিপেছেন।
ইংরাজীতে না ফরাসীতে?
ফরাসীতে।
তোমার মনে আছে কথাগুলো।
স্য ন্য বিয়, জ্য মে সুই ঐ পে।
ঠিক বলছ। কথাগুলো আমিও শুনতে পেয়েছিলাম। তারপর তুমি চলে গিয়েছিলে?
হুঁ।
তুমি কি নিজের জায়গায় ফিরে গিয়েছিলে?
না আরো একজন যাত্রী ডেকেছিলেন তার কাছে যাই। মিশেল এবার ভেবেচিন্তে জবাব দাও গতকাল রাত সওয়া একটায় কোথায় ছিলে?
আমি? কেন? আমার নিজের জায়গায়, করিডোরের মুখোমুখি।
তুমি নিশ্চিত তো?
হ্যাঁ তবে…..
কি হল?
আমার সহকর্মী এথেন্সের বগিতে যাই অল্প সময়ের জন্য কথা বলতে। আমাদের মধ্যে বরফ ঝড় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তবে মনে হয় রাত একটার পর ঠিক বলতে পারব না।
কখন ফিরলে?
আমার বগিতে সময় ঘন্টা বাজে। ও হ্যাঁ ওই আমেরিকান ভদ্রমহিলাটি। সেই যে…..অনেকবার ঘন্টি বাজিয়েছিলেন।
ঠিক তারপর? আমারও মনে পড়ছে।
তারপর আপনার কামরায় গিয়ে জল দিয়ে আসি এবং এর প্রায় আধঘন্টা পর মিঃ রাশেটের সেক্রেটারি বিছানা পেতে দিই তার কামরায়।
কামরায় কি মিঃ ম্যাককুইন তখন একলাই ছিলেন?
না ওর সঙ্গে পনেরো নম্বরের কর্নেল ভদ্রলোক গল্প করছিলেন।
কর্নেল তার পর কোথায় যান?
নিজের কামরায়।
তোমার বসার জায়গার খুব কাছেই না পনেরো নম্বর….
হ্যাঁ। দ্বিতীয় কামরা করিডোরের শেষ প্রান্তেই।
ওঁর বিছানা কি করাই ছিল?
হা। উনি খেতে যাওয়ার পর আমিই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।
আচ্ছা এ সব যখন ঘটে তখন রাত কত হবে?
ঠিক বলতে পারব না, তবে দুটো বেজে গিয়েছিল নিশ্চয়ই।
তারপর?
আমি বাকি রাতটুকু চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দিই।
ঘুমিয়ে পড়েছিলে কি?
মনে হয় না। ট্রেন থেমে থাকলে ঘুম আসে না। দুলুনি হলে তবেই একটু ঝিমুনি আসে। কাউকে যেতে আসতে দেখেছিলে করিডোরে?
একটু চিন্তা করে বলল, ঐ প্রান্তে কোনো মহিলা বোধহয় বাথরুমে গিয়েছিলেন।
কোনো জন?
ঠিক বলতে পারব না, আমার বসার জায়গার থেকে দূরে তো, আর তা ছাড়া মহিলার পিঠটুকু দেখেছিলাম একটা গাঢ় লাল রংয়ের কিমোননা ছিল ড্রাগন আঁকা।
মাথা নাড়লেন পোয়ারো।
তারপর?
তেমন কিছু ঘটেনি সকাল হয়ে গেল।
তুমি নিশ্চিত তো?
ও হা আপনি এক মুহূর্তের জন্য মুখ বের করেছিলেন কামরা থেকে।
খুব ভালো মিশেল, আমি ভেবেছিলাম তোমার হয়ত আমার কথাটা মনে নেই। আমার দরজার বাইরে ভারী কিছু একটা পড়ার শব্দ হয়েছিল এ ব্যাপারে কি কিছু জান?
না মঁসিয়ে। কোনো অদ্ভুত ব্যাপার হলে চোখ এড়াত না।
তাহলে নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছিলাম।
হয়তো পাশের কামরায় কিছু ঘটে থাকবে।
পোয়ারো কোনো কথায় না গিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
বাইরে থেকে কোনো লোক যদি ঢোকে সে কি পালাতে পারবে মিশেল?
মনে হয় না। এক যদি লুকিয়ে থাকে।
সব কামরা আমরা খোঁজ করেছি ওসব ধারণার কিছু নেই।
কুক বললেন।
তাছাড়া আমার চোখে তো পড়তই, মিশেল বলল।
শেষ কোথায় আমরা থামি মিশেল?
ভিনভোকিতে।
ট্রেন সেখান থেকে কটায় ছাড়ে?
এগারটা আটান্নয় ছাড়ার কথা ছিল কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় কুড়ি মিনিট দেরি হয়।
কেউ যদি ট্রেনের অন্য বগি থেকে আসে?
না মসিয়ে। দুটো বগির মধ্যেকার দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হয় খাবার পরেই।
তুমি কি ভিনভোকি স্টেশনে নেমেছিলে?
হ্যাঁ, হাত পা ছড়ানোর জন্য। তবে ট্রেনে উঠবার দরজার পাশেই ঠিক ছিলাম অন্য বগির কণ্ডাক্টরও ছিল।
একটা দরজা আছে না খানাকামরার পাশে বাইরে যাবার?
সেটা সবসময়ই ভেতর থেকে বন্ধ থাকে।
এখন তো বন্ধ নেই?
কোনো যাত্রী হয়ত দরজা খুলে বাইরের দিকে উঁকি দিয়ে থাকবেন তাই জন্য।
আপনি হয়ত ভাবছেন বোধ হয় এটা আমার কর্তব্যের ত্রুটি।
না না, তবে আমি একটু চিন্তিত এই ব্যাপারে।
রাশেটের কামরার দরজায় টোকা দিয়েছিলে যখন তখন একটা কামরা থেকে ঘন্টা বেজে উঠে; সেই কামরাটা কার?
রাজকুমারী দ্রাগোমিরফের। উনি পরিচারককে ডেকে দিতে বলছিলেন।
তুমি কি ডেকেছিলে?
নিশ্চয়।
তাহলে এই পর্যন্তই। বলে কুকের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তোমার কোনো কর্তব্যে ত্রুটি হয়েছে বলে আমি মনে করি না, কুক বললেন এবং কোনো চিন্তার কারণ নেই।
প্রশংসা পেয়ে মিশেল চলে গেল।
.
০২.
সেক্রেটারীর সাক্ষ্য
মিশেলের সব কথা শুনে এবার পোয়ারো মিঃ ম্যাককুইনকে ডাকা যাক বললেন কিছুক্ষণ পর।
ম্যাককুইন এসে হাজির হলো।
কি ব্যাপার আপনাদের কাজ কতদূর এগোল?
এই চলছে তবে আপনার মনিবের প্রকৃত পরিচয়টা জেনেছি।
ম্যাককুইন উগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি নাম মশাই?
আসল নাম কাসেট্টি, রাশেট তার ছদ্মনাম। ডেইজি হত্যার মামলার প্রধান আসামী।
কিছুটা ক্রুদ্ধ এবং বিস্মিত হল ম্যাককুইন। ছি ছি, নরাধম পশু একটা।
এটা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেননি আপনি মিঃ ম্যাককুইন, তাই না?
না স্যার। জানলে কোনোদিনই ওঁর কাজকর্ম করতাম না এবং যে হাত দিয়ে কাজ করেছি সেই হাত কেটে ফেলতাম।
খুব খারাপ লাগছে তাই না?
লাগবে না বলেন কি? আমাকে আপনারা কি কসাই ভেবেছেন, আমিও একটা রক্তমাংসের মানুষ। আর তাছাড়া আমার বাবা তদন্তকারী অফিসার ছিলেন ডেইজি হত্যা মামলার, সেই কারণে অনেকবার এসেছেন ডেইজির মা মিসেস আর্মষ্ট্রং। তিনি কি সুন্দরী ছিলেন এবং কতই না কষ্ট পেয়েছেন। আমি সত্যিই খুব খুশী যে রাশেট না না কাসেট্টি তার সাজা পেয়েছে। যদি ও বেঁচে থাকত তবে সেটা সমাজের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর হতো।
আপনার এই কথা শুনে মনে হচ্ছে আগে যদি জানতেন তবে আপনিই খুন করতেন।
ম্যাককুইন এ কথায় ঈষৎ লজ্জিত হলেন।
না মানে…. আমি মনের ভাব চাপতে পারি না।
আপনার সঙ্গে একটু ঠাট্টা করছিলাম। যদি আপনি আপনার মনিবের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দুঃখ পেতেন সন্দেহটা আরোও বেড়ে যেত আমার।
আমি চোখে জলও আনতাম না যদি ওর ফাঁসি হত। কিছু যদি না মনে করেন আপনারা ওর পরিচয়টা জানলেন কিভাবে।
একটু টুকরো কাগজে …পাওয়া গেছে ওর ঘরে তার মানে ওঁর সেটা বেশ বোকামী হয়েছিল।
সেটা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?
ম্যাককুইন কথাটা না ধরতে পারার ফলে হা করে তাকিয়ে রইল পোয়ারোর দিকে।
আপনি কিছু মনে করবেন না ম্যাককুইন আমার কাজ যাত্রীদের গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া।
না আমায় যে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন।
ধন্যবাদ। আপনি কোনো কামরায় আছেন, অবশ্য উত্তরও আমার জানা কারণ একসঙ্গে আমরা দুইজনেই রাত কাটিয়েছি। আপনি কি একাই আছেন ওখানে আপাতত?
আপনি ঠিকই বলেছেন।
গতকাল আপনি খানাকামরা থেকে ডিনার সেরে কি কি করছিলেন?
খুব সোজা উত্তর। নিজের কামরায় ফিরে যাই কারণ পড়াশুনার কাজ ছিল। বেলগ্রেডে প্ল্যাটফর্মে নেমেছিলাম গাড়ি থামার পর পায়চারি করতে। ঠান্ডার জন্য ফিরে আসি। আমার সহযাত্রী কর্নেল আর্বাথনট এবং পাশের কামরায় ইংরেজ তরুণীটির সঙ্গে কথাবার্তা বলি। আপনি বোধহয় সেই সময় পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর জরুরী কাগজপত্র নিয়ে মিঃ রাশেটের কামরায় যাই। আপনাকে এ কথা আগেও বলেছি। কাজ সেরে শুভরাত্রি জানিয়ে ফিরে আসছি কর্নেল ছিলেন করিডোরে, তাকে আড্ডা মারার জন্য আমার কামরায় আসতে বলি। এবং দু গ্লাস পানীয় আনতে দিই। রাজনীতি, ভারত সরকার, নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা এই সব নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সাধারণত ইংরেজরা অমিশুকে হয় কিন্তু ইনি দিব্যি আমুদে।
আপনার কামরা থেকে কর্নেল যখন ফিরলেন তখন রাত কত হবে?
তা প্রায় দুটো।
লক্ষ্য করেছিলেন কি যে ট্রেনটা থেমে গেছে?
হা হা। দু চারটে কথাও বলি এ বিষয়ে। বাইরে উঁকি মেরে দেখেছিলাম সব বরফে ঢাকা তবে যে এতটা গুরুতর তা ভাবিনি।
তারপর কর্নেল আপনাকে শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের কামরায় চলে গেলেন।
হা। আমি কণ্ডাক্টরকে ডেকেছিলাম বিছানা করে দেবার জন্য।
বিছানা পাতার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
ঠিক বাইরের দরজায় এবং একটা সিগারেট ধরিয়ে ছিলাম।
তারপর?
বিছানায় শুয়ে এক ঘুমে রাত কাবার।
রাতে একবারের জন্যও ট্রেন ছেড়ে বাইরে যাননি?
ট্রেনে বসে বসে গা ব্যথা হবার জন্য ভেবেছিলাম কর্নেল এবং আমি বাইরে নামব। ভিনভোকিতে একটু নেমেছিলাম কিন্তু থাকতে পারিনি ঠান্ডার কারণে।
কোনো দরজা দিয়ে নেমেছিলেন?
যে দরজাটা আপনাদের কাছাকাছি আছে?
খানাকামরার পাশের দরজা?
হা।
আপনারা নামবার সময় ওটা বন্ধ না খোলা ছিল?
বন্ধ ছিল ভেতরে, আমরা হুড়কোটা খুলে নামি।
ফিরে এসে বন্ধ করেছিলেন তো?
বোধহয়…. না..না…না বোধহয় ভুলে গেছিলাম কেননা শেষে আমিই উঠেছিলাম।
ব্যাপারটা খুব জরুরী ভালো করে মনে করুন।
না পারছি না।
কর্নেল এবং আপনারা যখন গল্প করছিলেন তখন নিশ্চয়ই করিডোরের কামরার দরজাটা খোলা ছিল।
হা।
ভিনভোকি ছাড়বার পর ট্রেনে কাউকে যেতে আসতে দেখেছিলেন কি?
খানা কামরার দিক থেকে যেন কণ্ডাক্টরকে যেতে দেখেছিলাম। এবং উল্টোদিক থেকে একজন মহিলা আসছিলেন।
কোনো জন?
কি জানি। তর্ক এবং গল্পে মশগুল ছিলাম নজর করিনি, তবে লাল রংয়ের পোশাক ছিল বোধহয়। এক ঝলক দেখেছি মাত্র। খানাকামরার মুখোমুখি তো আমার কামরাটা তাই যিনি খানাকামরার দিকে গিয়েছিলেন করিডোের ধরে তাই তার পেছন দিকটাই নজরে পড়েছে।
মহিলাটি হয়ত বাথরুমে গিয়েছিলেন। আচ্ছা ফিরে আসতে কি দেখেছিলেন?
বোধহয় না। অতটা খেয়াল করিনি, নিশ্চয় ফিরেছিলেন।
আর একটা কথা আপনি কি পাইপ খান ম্যাককুইন।
না।
তাহলে এই পর্যন্তই, এক মুহূর্ত থেমে পোয়ারো বললেন।
আপনি দয়া করে রাশেটের পরিচারককে পাঠিয়ে দেবেন। আর একটা কথা আপনারা কি বরাবরই সেকেণ্ড ক্লাসে যাতায়াত করতেন?
না। আমরা ফার্স্ট ক্লাসেই যেতাম। এবারে জায়গা পাওয়া যায়নি অনেক চেষ্টা করেও।
বুঝেছি। ধন্যবাদ।
.
০৩.
পরিচারকের সাক্ষ্য
বিবর্ণ চেহারার পরিচারকটি প্রবেশ করার পর পোয়ারো বসতে বললেন তাকে।
মিঃ রাশেটের কাজকর্ম তুমিই তো কর?
হা স্যার।
তোমার পুরো নাম?
এডওয়ার্ড হেনরি মাস্টারম্যান।
বয়স?
ঊনচল্লিশ
বাড়ির ঠিকানা?
একুশ ফায়ার স্ট্রীট ক্লার্কেন ওয়েল।
তোমার মনিব নিহত হয়েছেন তুমি নিশ্চয় জান?
হা খুব দুঃখের ব্যাপার।
তোমার শেষবারের মতো কখন মনিবের সাথে দেখা হয়?
একটু চিন্তা করে বলল, রাত নটা অথবা পরেও হতে পারে।
ঠিকমত গুছিয়ে বলো।
আমি কোনো দরকার আছে কিনা জানতে যাই।
তোমাকে সাধারণত কি কাজ করতে হত?
ওঁর জামাকাপড় টাঙিয়ে রাখা, নকল দাঁতের প্লেটে জল দেয়া আর অন্য কিছু দরকার কিনা তা জানা।
ওঁকে কাল রাতে কি স্বাভাবিক দেখেছিলে?
চিন্তিত মনে হয়েছিল একটু যেন।
কি রকম?
উনি একটা চিঠি পড়ছিলেন। চিঠিটা আমি রেখে গেছি কিনা তা জানতে চাইলেন। কিন্তু চিঠির কথা আমি জানতামই না। উনি রেগে যান চিঠিটা পড়ে। প্রতিটি কাজের খুঁত ধরে উনি অকারণে বকাবকি করতে থাকেন আমাকে। অবশ্য সহ্য হয়ে গিয়েছিল আমার। তার মেজাজ সবসময়ই বিগড়ে থাকত কারণে অকারণে।
উনি কি কোনো ঘুমের ওষুধ খেতেন?
হা স্যার। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঘুম না আসার ফলে।
ওষুধের নাম কি তুমি জানতে?
না স্যার। নিদ্রার ওষুধ লেখা শিশির গায়ে।
উনি ওষুধ খেয়েছিলেন গত রাতে?
হা স্যার। আমিই টেবিলের উপর গ্লাসে ঢেলে রেখেছিলাম।
তুমি কি খেতে দেখেছিলে ওষুধটা ওঁকে?
না স্যার।
তারপর?
আমি সব ঠিকঠাক আছে কিনা জানতে চাইলাম আর কখন সকালে ডাকতে হবে ওঁকে। উনি বললেন ঘন্টা না বাজানো পর্যন্ত আসবার দরকার নেই। যেন কেউ ওঁকে বিরক্ত না করে।
উনি কি তাই করতেন বরাবর?
হা। উনি সকালে আমাকে ডাকবার জন্য কণ্ডাক্টরকে বলতেন।
একটু সকাল সকাল না দেরি করে উঠতেন?
সেটা ওঁর মর্জির উপর।
আজ সকালে যখন কেউ তোমায় তলব করল না; তুমি অবাক হওনি?
না স্যার।
আচ্ছা তোমার মনিবের শত্রু ছিল তুমি কি জানতে?
হা স্যার।
কি করে?
মিঃ ম্যাককুইনের সঙ্গে উড়ো কয়েকটা চিঠি নিয়ে আলোচনা করতে শুনেছি।
তুমি কি ওকে পছন্দ করতে, মাস্টারম্যান?
সেটা বলা উচিত হবে না স্যার। মুখ ভাবলেশহীন। তবে ব্যবহার উনি ভালোই করতেন।
তুমি কিন্তু ওঁকে পছন্দ করতে না তাই তো?
তা ঠিক নয়। আমি আমেরিকানদের অতটা পছন্দ করি না।
তুমি আমেরিকায় গেছ কখনও?
না স্যার।
কখনও কাগজে আর্মস্ট্রং মামলার কথা পড়েছিলে?
হ্যাঁ, খুবই মর্মান্তিক। একটা ছোট্ট মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছিল।
তোমার মনিবই সেই মামলার প্রধান আসামী জান?
নাতো! আমার বিশ্বাস হয় না।
যাই হোক সেটা সত্যি। কি করলে তোমার মনিবের কামরা থেকে বেরিয়ে?
মনিব তলব করছেন ম্যাককুইন সেটা বললেন। তাই নিজের কামরায় গিয়ে বই পড়ছিলাম।
তোমার কামরাটা।
খানাকামরার ঠিক পরেই সেকেণ্ড ক্লাস।
তোমার কোনো বার্থটা?
নিচেরটা।
তোমার সঙ্গীটি কে?
ইটালিয়ান একটা দৈত্যের মতো।
ইংরাজী বলতে পারে?
এই যেমন তেমন করে। ও আগে আমেরিকার শিকাগোতে থাকত।
নিশ্চয়ই গল্পটল্প করলে তোমরা?
না স্যার বই পড়তেই বেশি ভালোবাসি আমি।
সাচ্চা ইংরেজ একেবারে, হাসলেন পোয়ারো।
বেশ বেশ কি বই?
মিসেস অ্যারাবেলা রিচার্ডসনের প্রেমের ফাঁদ।
কেমন বই?
চমৎকার।
তারপর?
সাড়ে দশটায় আমার সঙ্গীটি শুতে যাবে বলায় কণ্ডাক্টর বিছানা করে দিল আমাদের।
তুমিও শুতে গেলে?
শুতে তো গেছিলাম কিন্তু ঘুমতে পারিনি, কারণ দাঁতের যন্ত্রণার জন্য। কিন্তু ওষুধ মেলেনি, দাঁতের গোড়ায় লবঙ্গের তেল দেওয়ার জন্য কিছুটা কমল। যাতে অন্যমনস্ক করা যায় তাই বই পড়ছিলাম।
তাহলে একটুও ঘুমোওনি?
একটু তন্দ্রার ভাব এসেছিল ভোর চারটায়।
আর সঙ্গীটি?
সে বিছানায় নাক ডাকতে শুরু করেছিল।
ও কি তার কামরা ছেড়ে বেরিয়েছিল?
না।
আর তুমি?
আমিও না।
কোনো শব্দটব্দ শুনেছিলে?
না। ট্রেন থেমে থাকার ফলে নিস্তব্ধ ছিল।
এই খুনের বিষয়ে কিছু জান?
না স্যার।
কখনও মনিবের সঙ্গে ম্যাককুইনের কথা কাটাকাটি হয়েছে?
না। চমৎকার লোক ম্যাককুইন।
মিঃ রাশেটের আগে কোথায় কাজ করতে?
গ্রসভেনার স্কোয়ারে, স্যার হেনরী টমলিনসনের বাড়িতে।
ছাড়লে কেন?
পূর্ব আফ্রিকায় স্যার হেনরী চলে যাওয়ার জন্য আমাকে দরকার হল না। অবশ্য তিনি আমার সম্বন্ধে আশা করি প্রশংসাই করবেন।
ধন্যবাদ মাস্টারম্যান, ও হ্যাঁ তুমি কি পাইপ খাও?
না স্যার সিগারেট।
ঠিক আছে, এবার তুমি যেতে পার।
একটু থমকে মাস্টারম্যান বলল, স্যার একটা কথা। ঐ আমেরিকান প্রৌঢ়টি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন খুন সম্পর্কে কিছু বলার জন্য।
পোয়ারো হেসে বললেন, তাহলে ওকে তো ডাকতে হয়।
আমি কি ওঁকে পাঠিয়ে দেব। উনি বড়কর্তার সঙ্গে কথা বলবার জন্য অনেকক্ষণ চেষ্টা করছেন মোটে সামলাতে পারছে না কণ্ডাক্টর।
ওঁর কি বক্তব্য শুনি তুমি পাঠিয়ে দাও।
.
০৪.
আমেরিকান মহিলার সাক্ষ্য
শ্ৰীমতী হাবার্ড ব্যস্ততা এবং ভীতি প্রকাশ করে বললেন,আমার জানার আছে যে, কেউ কি এখানে কর্তৃপক্ষ স্থানীয় আছেন।
মহাশয়ার কিছু বলার থাকলে আমায় বলতে পারেন নির্দ্বিধায়, কিন্তু তার আগে দয়া করে একটু বসুন, বললেন পোয়ারো।
শ্রীমতি হাবার্ড বসে পড়লেন সামনের চেয়ারটিতে। এই ট্রেনে যে খুনটা হয়েছে কাল রাতে আমার কামরাতেই খুনিটা ছিল বললেন।
এই কথাগুলোর নাটকীয় প্রভাব লক্ষ্য করতে চাইলো শ্রীমতী হাবার্ড।
সত্যি।
তা নয়তো কি। কাল খাওয়া-দাওয়ার পর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে যাবার পর দেখলাম একটা লোক কামরায় ঢুকেছে। খুন জখম রাহাজানি তো ট্রেনে হয়ই অবশ্য গয়নাগাটির সম্বন্ধে ভয় নেই কারণ ওগুলো শোবার আগে মোজায় ভরে বালিশের নিচে রেখেছিলাম, প্রাণের ভয় তো আছে। যাই হোক কি বলছিলাম যেন?
ওই যে বললেন একজন লোক আপনার কামরায় ঢুকেছিল?
হা হা, আমি চুপটি করে মড়ার মত পড়ে থেকে কি করা যায় ভেবে ভগবানের নাম জপছি। ভাগ্যিস মেয়ে জানেনা এসব কাণ্ডের কথা নাহলে একেবারে কেঁদে ভাসিয়ে দিত। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি আসার ফলে ডাক ঘন্টিটা টিপে ধরতেও কোনোও লোক না আসতে ভাবলাম হয়ত বা সবাই খুন টুন হয়েছে। শেষে বাইরে আওয়াজ শোনার পর বুকে যেন বল এল। আমি চেঁচিয়ে কণ্ডাক্টরকে ভেতরে আসতে বলার পর দেখলাম আমি ও কণ্ডাক্টর ছাড়া কেউ নেই।
তারপর?
আমি কণ্ডাক্টরকে বলতে সে ব্যাটা বলল আমার নাকি ভুল হচ্ছে আমার কথা মেয়ে জামাই ও অক্ষরে অক্ষরে মানে ও বলে ভুল হচ্ছে। এই দেখুন আপনাদের সঙ্গে পরিচয়ই হয়নি আর আমি কখন থেকে বকে চলেছি।
আমি পোয়ারো, ইনি মঁসিয়ে কুক এই রেল কোম্পানির ডিরেক্টর আর ইনি ডাক্তার কনস্টানটাইন।
আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে খুশী হলাম। বুঝলেন মঁসিয়ে পোয়ারো আমার ঠিক সুবিধের মনে হল না ব্যাপারটা, আমার কামরায় তো ঢুকেছিল তা সে পাশের কামরা থেকে আসেনি তো? কণ্ডাক্টরকে বললাম মাঝের দরজা আটা আছে কিনা দেখতে। ভেবেছি তাই, সেইজন্য ভালো করে ভারী সুটকেশ দিয়ে এঁটে রাখতে বলে নিশ্চিন্তে শুলাম।
তখন রাত কটা?
কেমন করে বলব আমার সে অবস্থাই তখন ছিল না ঘড়ি দেখার।
তা তো বটে।
আমার কামরায় যে লোকটা ঢুকেছিল সেই আসলে খুনী। বলে হাবার্ড চোখ বন্ধ করলেন।
আপনার তাহলে কি মনে হয় সে আবার পাশের কামরাতেই চলে গিয়েছিল?
সে আমি বলতে পারব না। কারণ আমার তখন চোখ বন্ধ ছিল। আপনারা তো বিশ্বাস করছেন না। এই দেখুন, বলে নিজের হাতব্যাগটি টেবিলের উপরে উপুড় করলেন। ব্যাগ থেকে বেরুলো দুটো রুমাল, একটা চশমা, এক শিশি অ্যাসপিরিন, এক প্যাকেট হজমিগুলি, একটা কঁচি, পিপারমেন্ট এক গোছা, চাবি, চেকবই, একটা অতি সাধারণ চেহারার বাচ্চার ছবি। কয়েকটা চিঠি, এক ছড়া পাথরের মালা আর একটা ধাতুর তৈরি বোম।
শ্ৰীমতী হাবার্ড বোতামটা তুলে ধরলেন।
এই হচ্ছে প্রমাণ।
কি রকম?
এই বোতামটা! আমাদের মেয়েদের পোশাকে কি এই বোতাম থাকে? কি সব বুদ্ধি আপনাদের পুরুষদের।
মঁসিয়ে কুকু এবার সুযোগ পেলেন কিছু বলার। এতো রেলের কণ্ডাক্টর গার্ডের পোশাক। আপনার কামরায় তল্লাসী চালাবার সময় হয়তো পড়ে গিয়ে থাকবে।
নাও ঠেলা। এটা পেয়েছি কোথায় জানেন? কাল রাতে ঘুমানোর আগে একটা পত্রিকা পড়ছিলাম। ঘুম পেয়ে যাবার ফলে আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সকালে এটা দেখি রয়েছে বই-এর উপর। কাল রাতে তো কণ্ডাক্টরকে জানালার কোথাও দেখিনি, আমার মেয়ে কিন্তু বলে যে আমার কাজের খুঁত ধরা খুব কঠিন। শ্রীমতী হাবার্ড কথাগুলো বলে নিজেকে গর্বিত অনুভব করলেন।
বেশ। রাশেট লোকটা সুবিধের নয় তো আগেই বলেছিলেন; তা হলে মাঝের দরজাটা বন্ধ করেননি কেন?
আমার কিন্তু ভুল হয়নি, মনে হয় কোনো ফাঁকে কেউ খুলে রেখেছিল। তবে শোবার আগে সুইডিস ভদ্রমহিলা এসেছিলেন তাকেও বলেছিলাম ছিটকিনিটা ভালো করে দেওয়া আছে কিনা দেখতে। উনি না লক্ষ্য করে বলেছিলেন বন্ধই আছে। আর তাছাড়া একটা ভোলো হুকে রাখা ছিল।
সেটা হয়ত চাপা পড়ে যাবার ফলে ওনার নজর এড়িয়ে গেছে। যখন ওনাকে দরজা দেখতে বলেছিলেন তখন কি নিজে শুয়ে পড়েছিলেন?
হা। বই পড়ছিলাম, উনি এসে অ্যাসপিরিন চেয়েছিলেন।
কাল আরও একটা কাণ্ড হয়েছে। আমার কামরায় আসতে গিয়ে উনি পাশের কামরায় গিয়ে পড়েছিলেন। এরকম তো মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়।
ভদ্রমহিলা তাড়াতাড়ি মাপও নিয়েছিলেন।
কিন্তু রাশেট অভদ্র ভাষায় বললেন। দেবী, তুমি যে বড্ড বেশি বুড়ি লাভ নেই কিছু।
ডাক্তার হাসি চাপতে গিয়ে একটু কাশলেন।
গম্ভীর হল শ্রীমতী হাবাডের মুখ।
ছি ছি, কেউ এরকম ভাবে বলে নাকি আর সেটা নিয়ে হাসাহাসি করাটাও অভদ্রতা।
ডাক্তার তাড়াতাড়ি ক্ষমা চেয়ে নিলেন।
কোনো আওয়াজ কি পেয়েছিলেন রাশেটের ঘর থেকে?
আওয়াজ।, নাকডাকার আওয়াজ ছাড়া কিছুই পাইনি।
লোকটা আপনাদের কামরা থেকে পালাবার পর আর কি নাক ডাকার আওয়াজ পেয়েছিলেন?
কি মুশকিল। রাশেট তো মরে গেছে আর কে নাক ডাকবে।
ওঃ হ্যাঁ। আচ্ছা আপনি ডেইজি মামলার কিছু জানেন?
জানি না আবার? সত্যিই কাজের নয় পুলিশগুলো, খুনিটাকে ধরতেই পারল না।
আপনি শুনে খুব খুশী হবেন রাশেটই সেই খুনী।
ভদ্রমহিলা লাফিয়ে উঠলেন উত্তেজনায়।
লোকটা সুবিধের নয় আগেই বুঝেছিলাম।
আচ্ছা আপনি আর্মস্ট্রং পরিবারের কাউকে চিনতেন?
না। ওরা কারোর সঙ্গেই মিশত না। তবে অসাধারণ রূপ এবং চমৎকার স্বভাবের ছিল ডেইজির মা। পুরো পরিবারটাই নষ্ট হয়ে গেল।
আপনার পুরো নাম আর ঠিকানাটা?
ক্যারোলিন মার্থা হার্বার্ড।
তিনি নাম ঠিকানা লিখে দিলেন।
লাল রঙের ড্রেসিং গাউন কি আছে আপনার?
না তো, একটা গোলাপী আর বেগুনি রঙের, ব্যস।
আসলে কাল রাতে যে মহিলা কে রাশেটের কামরায় ঢুকতে দেখা গিয়েছিল।
তবে এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই ওটা তো আমার কামরা নয় ওটা রাশেটের।
কোনো মহিলার গলার আওয়াজ তাহলে পাশের কামরায় পেয়েছিলেন?
হু।
কই আগে তো বলেননি?
ছিঃ, এসব আলোচনা কিন্তু খুব সুরুচির নয় যেহেতু আমি একজন ভদ্রমহিলা!
রাত কটার সময় আপনি মেয়েটির আওয়াজ শোনেন।
কে জানে। কারণ ঘুম ভাঙতে সাড়া পেয়েছিলাম। কি ঘেন্নার কথা রাশেটের চরিত্র জানতে আমার আর বাকি নেই।
সেটা আপনার কামরায় তোক ঢোকার আগে না পরে?
আচ্ছা গেরো দেখছি, রাশেট তো মরেই গেছে, পরে কি করে হবে?
ও হ্যাঁ, সত্যি খুব বিরক্ত করলাম আপনাকে।
শ্ৰীমতী হার্বাড ব্যাগটা গুছিয়ে খানাকামরার দরজা পর্যন্ত যেতে পোয়ারো বললেন, এই রুমালটাতো আপনার?
ও রুমাল আমার কেন হবে?
না মানে রুমালের কোণে এইচ অক্ষরটা তোলা দেখে ….
আমি প্রত্যেক রুমালে পি, এম. এইচ, এই প্রথম অক্ষরগুলো তুলে রাখি। একটা অক্ষরে কি হবে? তাছাড়া যা দামী রুমাল। বিবিয়ানা করবার বয়সও নেই। আর আমার নাকটা এমন কিছু হীরে জহরত দিয়ে বাঁধানো নয় যে রেশম বা মসলিন দিয়ে না মুছলে ক্ষয়ে যাবে। এই কথাগুলো বলে মহিলা বেরিয়ে গেলেন।
মঁসিয়ে কুক পিয়ের মিশেলের বোম নিয়ে দেখলো।
আমি বুঝতে পারছি না মঁসিয়ে পোয়ারো, মিশেল কি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত?
দাঁড়ান ওসব পরে ভাবব। আগে সুইডিস ভদ্রমহিলাকে ডাকা যাক এই যে ওঁর পাসপোর্ট। গ্রেটা অলসঁ। বয়স ঊনপঞ্চাশ।
ভদ্রমহিলাকে ডাকা হল।
ভালোমানুষ চেহারার বোকা বোকা ধূসর চুল চুড়ো করে বাঁধা, চোখে চশমা, ধীর শান্ত প্রকৃতির। মহিলাটি ফরাসী ভাষায় বুঝতে এবং বলতে পারেন কথাবার্তাও তাই ফরাসীতেই হচ্ছিল। প্রথমে নাম, ঠিকানা, বয়স জিজ্ঞাসা করলেন। যদিও এগুলো পোয়ারোর জানা। অবিবাহিতা, একটা মিশনারী স্কুলের মেট্রন ইস্তাম্বুল এবং ধাত্রীবিদ্যায় পাশ।
আচ্ছা মাদমোয়াজেল এই ট্রেনে একটা হত্যাকাণ্ড…..।
হা। খুনীটি নাকি ওঁর কামরাতেই লুকিয়ে ছিল আমেরিকান ভদ্রমহিলা বলেছিলেন।
মিঃ রাশেটকে শেষবারের মতো আপনিই জীবিত দেখেন খবর পেয়েছি।
ঠিক বলতে পারব না। তবে ভুল করে ওঁর কামরায় ঢুকে পড়াটা একটা লজ্জার ব্যাপার হয়েছিল।
ওঁর সঙ্গে কি দেখা হয়েছিল?
বই পড়ছিলেন ক্ষমা চেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসি।
আপনাকে কিছু কি বলেছিলেন?
না মানে কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারিনি।
তারপর?
আমি অ্যাসপিরিনের জন্য আমেরিকান ভদ্রমহিলার কাছে গিয়েছিলাম।
উনি কি রাশেটের আর ওঁর কামরার দরজা বন্ধ আছে কিনা দেখতে বলেছিলেন।
হা।
বন্ধ ছিল?
হা।
তারপর?
আমি অ্যাসপিরিন খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।
তখন কটা বাজে?
আমি ঘড়িতে দেখেছিলাম তখন বাজে এগারোটা বাজতে পাঁচ।
ঘুমিয়ে কি তাড়াতাড়ি পড়েছিলেন?
খুব তাড়াতাড়ি নয় মাথা ব্যথাটা কমে যাবার ফলে কিছুক্ষণ তো জেগেই ছিলাম।
তখন ট্রেন কি থেমেছিল?
মনে হয় না। কেননা আধ ঘুমে ভেবেছিলাম হয়ত কোনো স্টেশন এল।
ওটা ভিনভোকি স্টেশন। আপনার তো এইটা কামরা।
হা।
আপনার বার্থ আপার না লোয়ার?
নিচের দশ নম্বর।
কোনো সঙ্গী কি ঐ কামরায় আছে আপনার?
হা। বাগদাদ থেকে একটি ইংরাজ ভালো, ভদ্র, মার্জিত মেয়ে আছেন।
উনি কি ভিনভোকি ছাড়বার পর কামরার বাইরে এসেছিলেন?
না।
কি করে বুঝলেন? আপনি তো ঘুমিয়েছিলেন।
ওপরের বার্থ থেকে উনি নামলে আমি নিশ্চয় জেগে যেতাম কারণ আমার ঘুম খুব পাতলা।
আপনি নিজে কি বেরিয়েছিলেন?
আজ সকালের আগে নয়।
কোনো লাল রং-এর সিল্কের কিমোনো কি আছে আপনার?
নাতো? ড্রেসিং গাউন আছে তবে তার রং লাল।
আপনার সহযাত্রী ডেবেনহ্যামের?
হাল্কা বেগুনী রং-এর।
আপনি বুঝি ছুটিতে যাচ্ছেন?
হা, বাড়ি যাচ্ছি তবে ল্যাসনে আমার বোনের কাছে আগে যাব।
আপনার বোনের নাম ও ঠিকানাটা যদি একটু লিখে…..
কিন্তু কি আছে, দিন লিখে দিচ্ছি।
আপনি কোনোদিন আমেরিকায় গেছেন?
না। একজন পঙ্গুলোকের দেখাশোনার কাজের জন্য কথা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। এমনিতে শুনেছি খুব দিলদরাজ হয় আমেরিকানরা।
আর্মষ্ট্রং মামলার কথা শুনেছেন?
না তো কি হয়েছিল?
পোয়ারো বলার পর গ্রেটা অঁলস-এর চোখ জলে ভরে গেল।
ওঃ মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয়। ভাবুন তো, ডেইজির মায়ের কথা। বিদায় নিলেন সুইডিস মহিলাটি।
কি সব লিখছিলেন পোয়ারো।
কৌতূহল না চাপতে পেরে কুক বললেন, কি লিখছেন সব?
সমস্ত পরিকল্পনা মাফিক এগোতে হয় বলে কাগজটা দেখালেন।
রাত নটা পনের : ট্রেন বেলগ্রেড ছাড়ল।
রাত নটা চল্লিশ : রাশেটের কামরা ছেড়ে পরিচারক ঘুমের ওষুধ গুছিয়ে বেরিয়ে আসা।
রাত দশটা : ম্যাককুইন রাশেটের কামরা ছেড়ে বেরিয়ে আসা।
রাত দশটা চল্লিশ: গ্রেটা অঁলস–এর ভুল করে রাশেটের কামরায় ঢোকা এবং শেষ জীবিত দেখেন। রাশেট বই পড়ছিলেন।
রাত বারোটা : ট্রেন ভিনভোকি ছাড়ে।
রাত সাড়ে বারোটা : ট্রেন বরফ ঝড়ের কবলে পড়ে।
রাত বারোটা সাইত্রিশ : রাশেটের কামরা থেকে ঘন্টায় আওয়াজ শুনে দরজায় কণ্ডাক্টর টোকা দিলে ফরাসী ভাষায় রাশেট বলেন স্য ন্য রিয়, জ্য মে সুই ঐ পেঁ।
আন্দাজ একটা সতেরো : লোক ঢুকেছে তার কামরায় ঘন্টি টিপে জানান শ্রীমতী হার্বার্ড।
বাঃ খুব পরিষ্কার, মঁসিয়ে কুক মাথা নাড়ালেন।
আপনার কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ছে না?
না। সবই তো ঠিক পর পর সাজানো আছে, বোঝাই যাচ্ছে খুনটা হয়েছিল রাত সোয়া এগারোটা নাগাদ আন্দাজ। ভাঙা ঘড়িটা, শ্ৰীমতী হাবাডের কথা সবই মিলে যাচ্ছে। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে ঐ হুমদো ইতালিয়ানটাই খুনী কেননা ওরা খুব রাগচটা হয় এবং কথায় কথায় ছুরি চালায়। এবং ও শিকাগোয় থাকত।
তা ঠিক।
রাশেট এবং ও একই দলের। ইতালীয় ঘেষা কাসেট্টি নামটাও। দুষ্কর্মগুলো ওরা মিলেমিশে করত। কোনো কারণে মনকষাকষির সময় ইতালিয়ানটা পিছু নিয়ে ঠিক রাশেটকে মেরে ফেলেছে।
পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন অত সহজে বলা যায় না বন্ধু।
কেন নয়? আমি তো নিশ্চিত।
আর রাশেটের পরিচারক। তার কথামতো ইতালিয়ানটি তো দাঁতের ব্যথার ফলে একবারও কামরা ছেড়ে বেরোয়নি।
সেটাই তো মুশকিল হয়েছে।
পোয়ারো হাসলেন।
আপনার সত্যিই দুর্ভাগ্য। ভাগ্যিস ইতালিয়ানটির দাঁতের ব্যথা হয়েছিল। সেটাই তার পরম সৌভাগ্য।
যাকগে, পাপ কখনও চাপা থাকে না। একদিন না একদিন সব জানা যাবেই।
পোয়ারো মাথা নাড়াল।
মশাই সবকিছু অত জলবৎ তরলং নয়।
.
০৫.
রাজকুমারীর সাক্ষ্য
বোতামটার সম্পর্কে জানার জন্য মিশেলকে ডাকা হল।
মিশেল এসে দাঁড়ালো।
মিশেল এই বোতামটা সম্ভবত তোমার পোশাকের। ঐ আমেরিকান ভদ্রমহিলার কামরা তল্লাসীর সময় পড়ে গেছে।
মিশেল নিজের পোশাকে হাত রাখল।
না আমার জামার বোতাম তো হারায়নি।
অদ্ভুত তো।
আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
সে যে নির্দোষ তার দৃঢ়তায় প্রকাশ পেল।
কাল রাতে শ্রীমতী হাবাডের কামরা থেকে যে বোতামটা পাওয়া গেছে তাহলে নিশ্চয় যে কামরায় ঢুকেছিল তারই পড়ে গিয়ে থাকবে।
কুক বললেন, কিন্তু ওঁর কামরায় কেউ ঢোকেনি।
এ বোতামটা নিশ্চয় হত্যাকারীর, মিশেল কিছুটা বিচলিত হল।
আপনারা মিথ্যেই সন্দেহ করছেন। আমি এ ব্যপারে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমি জীবনে যে ভদ্রলোককে প্রথম দেখলাম তাকে খুন করার আমার স্বার্থটা কি!
শ্ৰীমতী হার্বাডের ঘন্টা বাজানোর সময় তুমি কোথায় ছিলে?
আমি তো বলেছি পাশের কোচে সহকর্মীটির সঙ্গে কথা বলতে গেছিলাম
তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
দয়া করে তাই করুন আঁসিয়ে।
পাশের কোচের কণ্ডাক্টরকে ডাকার পর সেও একই কথা বলল। এবং এও বলল যে বুখারেষ্ট কোচের কণ্ডাক্টর ও সে ওই সময় গল্প করছিল। সবাই বরফ পড়া নিয়েই কথা বলছিল। প্রায় মিনিট দশেক পর মিশেল বলে সে ঘন্টার আওয়াজ পাচ্ছে। সে যখন ক্যাল কোচের দিকে এগোয় তখন বাকি দুজনও আওয়াজ পেয়েছিল।
তাহলে এই বোতাম এল কোথা থেকে?
মিশেল ছাড়া বাকি দুজনও একই বলল যে তাদের বোম খোয়া যায়নি, কেননা তারা হার্বাডের কামরার ধারে কাছেই যায়নি।
শ্রীমতী হার্বাডের দরজার কাছে গিয়ে করিডোরে কি তোমার কারোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল? ভালো করে ভেবে বল, কুক বললেন।
না মঁসিয়ে।
অদ্ভুত তো।
অদ্ভুত কিছুই নয় আসলে ব্যবধান হচ্ছে সময়ের। শ্রীমতী হার্বাড জেগে উঠে লোকটাকে দেখেন এক দু মিনিট নিথর হয়ে চোখ বুজে থাকেন। তখনই হয়তো লোকটা দরজা খুলে করিডোরে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গেই উনি ডাক ঘন্টা বাজাতে শুরু করেন। ওই সময়ের মধ্যে লোকটা হয়ত কোথাও পালিয়ে….।
কিন্তু কোথায় যাবে? বাইরে তো তখন তুমুল বরফ ঝড় চলছে।
দুটো পথ আছে এক হয়তো সে বাথরুমে নতুবা অন্য কোনো কামরায় ঢুকে পড়ে ছিল।
কিন্তু সব কামরায় তো লোক ছিল?
হা…
তবে সে কি তার নিজের কামরাতেই ঢুকেছিল, পোয়ারো সম্মতি জানালেন।
কণ্ডাক্টরের অনুপস্থিতিতে লোকটি নিজের কামরা ছেড়ে এসে রাশেটকে হত্যা করে। হিসেবে দেখা যাচ্ছে। তারপর করিডোরের দিকের দরজাটা বন্ধ করে দেয় এবং শ্রীমতী হার্বাডের কামরা দিয়ে নিজের কামরায় চলে যায়।
ব্যাপারটা এত সহজ নয় সেটা ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলেই বুঝতে পারবেন, পোয়ারো বললেন।
এরপর মিশেলকে চলে যেতে বললেন।
পোয়ারো যাত্রী তালিকায় নজর দিলেন।
এখন আটজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলা বাকি। পাঁচজন ফাস্ট ক্লাসের– রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, কাউন্ট অফ কাউন্টেস, আন্দ্রেনী, কর্নেল আবাথনট, আর মিঃ হার্ডম্যান। তিনজন সেকেণ্ড ক্লাসের মিস্ ডেবেনহ্যাম, আন্তেলিও ফলকারেন্নি, আর রাজকুমারীর পরিচারিকা শ্ৰীমতী ইল্ডগ্রেদ স্মিট।
ইতালিয়ানটিকে বরং ডাকা যাক আগে।
আগে উপর থেকে শুরু করা যাক। রাজকুমারী যদি না আসতে চান তবে ওঁর কামরাতেই আমাদের যেতে হবে।
মিশেলকে খবর দিয়ে পাঠালেন ওঁনাকে আসার জন্য।
রাজকুমারী মাথা উঁচু করে দৃঢ় ভঙ্গী এক মুখের বিবর্ণ হলুদ কুৎসিত মুখ এবং চোখ দুটো চকচকে। ভেতরে অসীম মানসিক শক্তি এবং ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী মহিলা।
পোয়ারোর সম্ভাষণ থামিয়ে দিয়ে বললেন, এই বিশ্রী হত্যাকাণ্ডের জন্য আপনাদের কর্তব্য এবং যথাসাধ্য সাহায্যের জন্য আমি প্রস্তুত। আপনাদের বিচলিত হবার কোনো কারণ নেই মঁসিয়ে।
আপনারা কি জানতে চান বলুন?
আপনার পুরো নাম এবং ঠিকানাটা লিখে দিন।
নাতালিয়া দ্রাগোমিরফ। সতেরো ফ্লেবার অ্যাভিনিউ, প্যারিস।
মাদাম আপনি বোধহয় কনস্তান্তিপোল থেকে বাড়ি ফিরছেন?
হা। আমি এবং আমার পরিচারিকা অষ্ট্রিয়ান দূতাবাসে ছিলাম।
আপনি গতরাত্রে ডিনারের পর কি করছিলেন?
খানাকামরায় থাকাকালীন কণ্ডাক্টরকে বিছানা ঠিকঠাক করে রাখতে বলেছিলাম এবং খাওয়ার পরই শুতে চলে যাই।
এগারটা পর্যন্ত বইপত্র পড়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বাতের ব্যথায় কষ্ট পাবার জন্য রাত পৌনে একটা নাগাদ পরিচারিকাকে ডাকতে পাঠাই, সে এসে মালিশ করে এবং বই পড়ে শোনায়। তারপর ঘুম এসে যাবার ফলে ও যে কখন চলে গিয়েছিল আমার মনে নেই তবে মনে হয় আধ ঘন্টা মত ছিল।
ট্রেন কি তখন চলছিল?
না।
কোনো অস্বাভাবিক শব্দ কি পেয়েছিলেন যতক্ষণ জেগে ছিলেন?
না।
আপনার পরিচারিকার নাম?
ইল্ডগ্রেদ স্মিট।
আপনার কাছে উনি আছেন কতদিন?
পনেরো বছর।
বিশ্বাসভাজন?
সন্দেহাতীত ভাবে। আমার স্বামীর খাস তালুকের প্রজা ছিল ওর বাবা।
আপনি নিশ্চয় আমেরিকায় গেছেন মাদাম।
রাজকুমারী একটু অবাক হলেন হঠাৎ বিষয়ের পরিবর্তনের ফলে।
হ্যাঁ, অনেকবার।
আচ্ছা ওখানে আর্মষ্ট্রং পরিবারকে চিনতেন? যাঁদের পরিণতি অত্যন্ত করুণ ও দুঃখজনক…।
বেদনা বিধূর হয়ে উঠল রাজকুমারীর গলার স্বর।
মঁসিয়ে ওঁরা আমার বন্ধুস্থানীয় ছিলেন।
কর্নেল আর্মষ্ট্রংকে তাহলে ভালোভাবেই চিনতেন আপনি?
ওঁকে তেমন নয় তবে ওঁর স্ত্রী সোনিয়া আমার মেয়ের মতো ছিল। ওঁর মা লিণ্ডা আর্ডেন আমার পুরনো বান্ধবী।
উনি কি মারা গেছেন?
না না, শোকে পাথর হয়ে যাবার ফলে একাকীত্ব নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন এবং আজকাল চলাফেরাও বেশি করতে পারেন না।
আর একটা মেয়ে ছিল তো ওঁর?
হা। সে অবশ্য অনেক ছোট সোনিয়ার থেকে।
মেয়েটি নিশ্চয় জীবিত?
নিশ্চয়ই।
বলতে পারেন কোথায় আছে?
রাজকুমারী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন।
আচ্ছা এসব জিজ্ঞাসার কারণ, এর সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের কি সম্পর্ক?
সম্পর্ক থাকার ফলেই জিজ্ঞাস্য কারণ যিনি খুন হয়েছেন তিনি ডেইজির হত্যাকারী।
আমাকে ক্ষমা করবেন। সত্যিই এ খবরটা আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দদায়ক।
আর লজ্জা দেবেন না সত্যি এটা স্বাভাবিক কারণ ওঁরা আপনার পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। আচ্ছা লিণ্ডা আর্ডেনের ছোট মেয়েটা কোথায় এখন?
আমি এ ব্যাপারে সঠিক জানি না, তবে শুনেছিলাম একজন ইংরেজ বিয়ে করে ইংল্যাণ্ডের বাসিন্দা। আর কিছু জানতে চান?
একটাই প্রশ্ন মাদাম। আপনার ড্রেসিং গাউনের রঙ কি?
অদ্ভুত প্রশ্ন। নীল রেশমের।
ধন্যবাদ আপনার সহযোগিতার জন্য।
রাজকুমারী হাত নাড়লেন।
ও কিছু নয়। আমার অপরাধ যদি না নেন তবে আপনার নামটা আমার খুব চেনা লাগছে।
এরকুল পোয়ারো।
মিনিট খানেক চুপ থাকার পর অস্ফুট স্বরে বললেন এরকুল পোয়ারো। হ্যাঁ এইবার মনে পড়েছে ভবিতব্য।
বেরিয়ে গেলেন দ্রাগোমিরফ।
আহা চমৎকার মহিলা।
মোহিত হয়ে গেলেন মঁসিয়ে কুক।
চিন্তিতভাবে পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন, আমাকে একটু ভাবিয়ে দিয়ে গেলেন বন্ধু। ভবিতব্য কথার মানে কি?
.
০৬.
কাউন্ট আর কাউন্টেস আন্দ্রেনীর সাক্ষ্য
ডেকে পাঠানো হল কাউন্ট আর কাউন্টেস আন্দ্ৰেনীকে। একাই এলেন কাউন্ট। দেখলে ইংরেজ বলে মনে হবে। ছ ফুট লম্বা, চওড়া কাঁধ। সুবেশ মার্জিত এক চমৎকার দেখতে।
কাউন্ট এসে বললেন, আমি কি করতে পারি আপনাদের জন্য বলুন? এবং কেন ডেকে পাঠিয়েছেন?
একটু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আপনাকে এখানে ডাকা হয়েছে যাত্রী এবং রেল কর্তৃপক্ষের তরফে কারণ মাঝ রাতে একটা ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড হবার ফলে।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তবে এ ব্যাপারে আমি হয়ত কোনো সাহায্যই করতে পারব না, কেননা কাল রাতে আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই ঘুমিয়েছিলাম।
আপনি কি ওই মৃত ব্যক্তির পরিচয় জানেন?
ওই টেবিলে রুক্ষ চেহারার আমেরিকান ভদ্রলোকটির!
হা। ঠিকই ধরেছেন।
নাতো। তবে ওর নামটাম নিশ্চয় পাসপোর্টে আছে।
পাসপোর্টে নাম আছে রাশেট কিন্তু ওটা ওর নাম নয়। ওঁর প্রকৃত নাম কাসেট্টি, আমেরিকান, কুখ্যাত খুনে ও ছেলেধরা।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পোয়ারো নিরীক্ষণ করছিলেন কাউন্টকে তবে ভাবলেশহীনভাবে।
কাউন্ট বললেন, তাই নাকি। তাহলে রহস্যের কিছু আলোকপাত হবে। সত্যিই আমেরিকা–আজব দেশ।
আপনি আমেরিকায় গেছেন কোনোদিন?
এক বছর ওয়াশিংটনে ছিলাম।
আর্মষ্ট্রং পরিবারকে চিনতেন?
এই নামে অনেকেই আছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।
ওঁরা পাশাপাশি বারো এবং তেরো নম্বর কামরায় আছেন।
কখন শুতে গিয়েছিলেন কাল রাতে?
কাল রাতে খাচ্ছিলাম যখন তখন কণ্ডাক্টর আমাদের বিছানা পেতে দেয় ওখান থেকে ফিরে অন্য কামরায় কিছুক্ষণ তাস খেলি।
কোনো কামরায়?
তেরো নম্বরে। আমার স্ত্রী রাত এগারটায় শুয়ে পড়ে, আমি অন্য কামরায় শুতে যাই, আজ সকালের আগে ঘুম ভাঙেনি।
আপনার স্ত্রীর?
ওতো ঘুমের বড়ি খেয়ে শোয় ট্রেনে। আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
আপনার নাম ঠিকানাটা?
কাউন্ট নাম ঠিকানা লিখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
আমার মনে হয় না আমার স্ত্রীর এখানে আসার দরকার আছে কেননা ও কিছুই বলতে পারবে না।
তা ঠিক তবে দু একটা কথা বলা দরকার।
না না দরকার নেই।
দেখুন এটা আমাদের তদন্তের অপরিহার্য অঙ্গ।
যা ইচ্ছে আপনাদের, বলে বেরিয়ে গেলেন।
পোয়ারো স্বামী-স্ত্রীর পাসপোর্টটা দেখলেন।
ভদ্রমহিলার নাম এলেনা মারিয়া প্রাকৃবিবাহ পর্বে গোল্ডেনবার্গ। বয়স : কুড়ি। পাসপোর্টে একটু দাগ আছে।
কুক বললেন, দেখবেন, আমাদের চাকরী আর সম্মান যেন না যায়; কেননা এঁরা সব উপর তলার মানুষ।
আপনার ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই।
রাজহংসীর মতো কাউন্টেস আন্দ্রেনী ঘরে ঢুকলেন।
আপনারা আমায় ডেকেছেন?
হা মাদাম কর্তব্যের খাতিরেই।
আমি জানতে চাই কাল রাতে আপনি….
আমি ঘুমিয়েছিলাম।
ঐ আমেরিকান ভদ্রমহিলা অত হৈ চৈ করলেন পাশের কামরায়….।
একটা ওষুধ খাওয়ার ফলে ঘুম ভাঙেনি।
আপনার পাসপোর্টে নাম ধাম যা আছে সব সত্যি তো?
নিশ্চয়ই।
তাহলে একটা সই করে দিন।
সই করে দিলেন কাউন্টেস এলেনা আন্দ্রেনী।
মাদাম আপনি কি স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় ছিলেন?
মেয়েটির মুখ ঈষৎ লাল হলো।
না। আমাদের মোটে এক বছর হলো বিয়ে হয়েছে।
ধন্যবাদ। আচ্ছা আপনার স্বামী কি ধূমপান করেন?
হা।
পাইপ?
না। সিগারেট আর সিগার।
কাউন্টেস আন্দ্রেনী উঠে দাঁড়ালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
এমনটাই জানেন তো গোয়েন্দারা এরকম উদ্ভট প্রশ্ন করেই থাকে। আপনার ড্রেসিং গাউনটা কি রং-এর?
কাউন্টেস হেসে উঠলেন।
গমের দানার রং-এর সিফন। সত্যিই অদ্ভুত প্রশ্ন কিন্তু এটা জানা কি দরকার ছিল?
নিশ্চয়ই।
সত্যিই আপনি গোয়েন্দা! যুগোশ্লাভিয়ার কোনো গোয়েন্দা এই ট্রেনে থাকতে পারেন ভাবতেই পারিনি।
আমি কোনো একটা দেশের গোয়েন্দা নই আমার বিচরণ সর্বত্রই। বেশির ভাগ সময়ই লণ্ডনে থাকি। ইংরেজী বলতে পারেন আপনি?
ঠিক আছে আর আটকাব না।
মাথাটা নুইয়ে খানাকামরা ছেড়ে গেলেন এলেনা।
কুক রূপের প্রশংসা করে জিজ্ঞাসা করলেন তার কাজ এখনো কতদূর?
কোথায় আর এই দম্পতি তো ঘুমিয়েই কাটিয়েছেন।
এবার ইতালিয়ানটাকে ডাকা যাক।
পোয়ারো কোনো জবাব না দিয়ে ব্যস্ত ছিলেন পাসপোর্টের দাগ লাগা জায়গাটা নিয়ে।
.
০৭.
কর্নেল আর্বাথনটের সাক্ষ্য
কর্নেল আবাথনটের ফরাসী ভাষা জ্ঞান কম থাকার ফলে ইংরেজীতেই সমস্ত কিছু অর্থাৎ নাম, ধাম বয়স, পেশা জিজ্ঞাসা করার পর বললেন ভারতবর্ষ থেকে ছুটিতে কি দেশে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু জাহাজে গেলেন না কেন?
এটা একান্তই ব্যক্তিগত।
ভারতবর্ষ থেকে সোজা আসছেন?
একটু কাজ ছিল বাগদাদে।
কর্নেলকে এই সব প্রশ্ন করায় একটু অসন্তুষ্ট হলেন।
বাগদাদে তিনদিন ছিলেন। বাগদাদ থেকে তো ইংরেজ তরুণীটিও আসছেন, ওঁর সঙ্গে কি বাগদাদেই আলাপ?
না। ট্রেনেই কারকুক থেকে নিসিবিন যাওয়ার পথে।
কিছু মনে করবেন না কর্নেল একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি বলে। মিস্ ডেবেনহ্যাম সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
আপনার এই প্রশ্নের তাৎপর্য না জানা পর্যন্ত উত্তর দিতে আমি অপারগ।
আমাদের অনুমান এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে কোনো মহিলা আছেন এই কারণে এবং কমপক্ষে বারোবার আঘাত করা হয়েছে। আমার কাজ হলো উপস্থিত সমস্ত মহিলাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া। অন্য সমস্ত মহিলাদের থেকে ডেবেনহ্যাম সম্পূর্ণ আলাদা তাই যদি-এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেন সেই হেতু জিজ্ঞাসা করা।
সত্যিকারের ভদ্রমহিলা যাকে বলে তিনি তাই।
তাহলে আপনার মতে হত্যা করাটা ওঁর পক্ষে সত্যিই অসম্ভব?
হা। মিস ডেবেনহ্যামের সম্পূর্ণ অপরিচিত ওই নিহত ব্যক্তি, আর তাছাড়া লাভটাই বা কি?
আপনাকে বুঝি সেইরকমই বলেছেন?
হা। প্রথম দর্শনেই ওঁকে ওঁর খারাপ লেগেছে। যদি কোনো মহিলা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকেন তবে ডেবেনহ্যাম সম্পর্কে আমার কথায় ভরসা করতে পারেন। আর যেই করুন না কেন ডেবেহ্যাম সম্পূর্ণ ভাবে এ ব্যাপারে নির্দোষ।
কি আশ্চর্য। উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?
জবাবে কর্নেল পোয়ারোর দিকে বিরক্তভাবে তাকালেন এবং কাগজ পত্রের দিকে চোখ নামালেন।
একটা কথা কর্নেল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস রাত সওয়া একটা নাগাদ খুন হয়েছে এবং এও জানতে হচ্ছে সেই সময় প্রত্যেক যাত্রী বা যাত্রীনিরা কি করছিলেন?
আমি ওই সময়ে নিহত ভদ্রলোকের সেক্রেটারীর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।
উনি আপনার কামরায় এসেছিলেন নাকি আপনি গিয়েছিলেন?
আমি ওঁর কামরায় গিয়েছিলাম।
মিঃ ম্যাককুইন তো?
হ্যাঁ।
উনি কি পূর্ব পরিচিত আপনার?
না। ট্রেনেই ওঁনার সঙ্গে গল্প করছিলাম, ভারতবর্ষ সম্পর্কে ভুল ধারণা থাকার ফলে ওই নিয়ে আলোচনা করছিলাম। অবশ্য আমেরিকানদের বিশেষ পছন্দ করি না তবে উনি বেশ ফুর্তিবাজ। রাজনীতি নিয়েও চলছিল হঠাৎ রাত পৌনে দুটো ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখেছিলাম।
আড্ডা থামিয়ে কি করলেন?
নিজের কামরায় শুয়ে পড়লাম।
বিছানা পাতা ছিল?
হা।
পনেরো নম্বর কামরা।
তার মানে খানাকামরার দিক থেকে হিসেব করলে সব শেষের ঠিক আগেরটা।
হ্যাঁ।
কণ্ডাক্টর কোথায় ছিল আপনি যখন কামরায় গেলেন?
কোণের টেবিলে বসে কাজ করছিল। অবশ্য আমি বেরিয়ে আসবার পরই মিঃ ম্যাককুইন তাকে ডেকে পাঠান।
কেন?
নিশ্চয়ই বিছানা করবার জন্য।
মিঃ ম্যাককুইনের কামরায় আপনারা দুজন যখন গল্প করছিলেন তখন কাউকে কি করিডোর দিয়ে যাতায়াত করতে দেখেছিলেন একটু ভেবে বলুন তো?
তা বেশ কয়েকজন হবে। লক্ষ্য করিনি।
না মানে, আপনাদের আলাপ আলোচনার শেষ দেড় ঘন্টার মধ্যে। ভিনভোকিতে আপনারা তো নেমেছিলেন?
হা। মিনিট খানেকের জন্য তবে ঠান্ডায় চলে এসেছি।
ভালো করে ভেবে দেখুন ঠান্ডা ছিল বাইরে, আপনারা আবার কামরায় এসে বসলেন। আপনি ধূমপান করছিলেন সিগারেট বা পাইপ….
পাইপ, ওটাই আমার পছন্দ।
বেশ রাত তখন অনেক হয়েছে। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। পৃথিবীর নানা সমস্যায় আপনারা আলোচনারত, বেশির ভাগই শুয়ে পড়েছে। সেই সময় কেউ কি করিডোর দিয়ে গেছিল?
আমি সত্যিই লক্ষ্য করিনি।
আপনি তো সেনাবাহিনীর লোক আপনার নিশ্চয় পর্যবেক্ষণ শক্তি অন্য কারো তুলনায় বেশি।
না মনে করতে পারছি না। একবার বোধহয় কণ্ডাক্টর গিয়েছিল। তারপর… একজন মহিলা। মৃদু খন খন আওয়াজ পেয়েছিলাম জামাকাপড়ের আর এক ঝলক মিষ্টি গন্ধ….
দামী সেন্টের? ভদ্রমহিলা বয়স্কা না তরুণী? হয়তো।
তখন হতে পারে রাত তেমন গভীর নয়। আসলে সঠিক সময়টা বলতে পারব না। কিন্তু মনে হয় সেটা ভিনভোকি ছাড়ার পর।
এরকম মনে হল কেন?
অনেক রাতে আমরা রাশিয়া নিয়ে আলোচনা করছিলাম সেটা নিশ্চিত।
আপনি আমেরিকায় গেছেন কখনও?
না তেমন ইচ্ছাও নেই।
কর্নেল আর্মস্ট্রং নামে কাউকে চেনেন।
আর্মষ্ট্রং! আর্মস্ট্রং, দু তিনজনকে চিনি একজন টনি আর্মষ্ট্রং আর একজন সেলবি আর্মষ্ট্রং… কিন্তু উনি তো মারা গেছেন।
আমি যার কথা বলছি তিনি একজন আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন এবং তার একমাত্র সন্তানকে অপহরণ করা হয়।
ও হা হা। কাগজে পড়েছিলাম তবে ওনার সঙ্গে আলাপ ছিল না। শুনেছি খুবই জনপ্রিয় এবং ভিক্টোরিয়া ক্রসও পেয়েছিলেন।
তিনিই হত্যাকারী ঐ শিশুটির যিনি এই ট্রেনে নিহত হয়েছেন।
কঠোর হয়ে উঠল কর্নেলের চোখ মুখ।
তবে তো ভালোই হয়েছে যদিও এইসব ক্ষেত্রে আইন আদালতের আশ্রয় নেওয়াই ভালো।
আপনি বোধ হয় ব্যক্তিগত প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করেন না?
না। অনর্থক রক্তপাত হৈ চৈ আমার রুচিবিরুদ্ধ।
আমার আর কোনো জিজ্ঞাসা নেই শুধু একটা কথা, কাল রাতে কোনো সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলেন?
কর্নেল দু এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন।
না মানে। আমি কামরায় ফিরে যাবার সময় ষোলো নম্বরের ভদ্রলোক মাথা উঁচু করে উঁকি দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই ভেতরে ঢুকে যান অবশ্য এ আর এমন কি?
ধন্যবাদ কর্নেল আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই।
আমি শুধু বলতে চাই মিস ডেবেনহ্যামকে সন্দেহ করবেন না। উনি একজন সাচ্চা ইংরেজ।
মিঃ রাশেটের কামরা থেকে পাইপ ক্লিনার পাওয়া গেছে এবং কর্নেল পাইপ খান এবং মিঃ রাশেট শুধুই সিগার খেতেন। বললেন পোয়ারো।
আপনার ধারণা কি?
এক কর্নেল আবাথনটই স্বীকার করেছেন উনি পাইপ খান এবং আর্মষ্ট্রং-এর নাম শুনেছেন এবং যা বলেছেন তার থেকে বেশিও হতে পারে।
অর্থাৎ হতে পারে কর্নেলই….
না না। একজন সম্ভ্রান্ত ফৌজী অফিসার কখনই একাজ করতে পারেন না। এবং তা মনস্তাত্বিক দিক দিয়ে অসম্ভব।
.
০৮.
মিঃ হার্ডম্যানের সাক্ষ্য
প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষ ব্যক্তি। সুপ্রভাত, বলুন কি সাহায্য করতে পারি?
খুনের ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চয় শুনেছেন মিঃ হার্ডম্যান?
হ্যাঁ।
আমাদের সব যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা কর্তব্য। স্বচ্ছন্দে। এটাই তো কাজ।
পাসপোর্ট দেখলেন পোয়ারো, আপনি সাইরাস রেথম্যান হার্ডম্যান। আমেরিকার নাগরিক, বয়স একচল্লিশ। টাইপরাইটিং কোম্পানির ভ্রাম্যমান এজেন্ট।
হ্যাঁ।
ইস্তাম্বুল থেকে প্যারিসে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
কারণ?
ব্যবসা।
প্রথম শ্রেণীতেই যাতায়াত করেন সবসময়?
হ্যাঁ। কোম্পানির খরচাতেই।
কাল রাতের ব্যাপার কতটুকু বলতে পারেন?
কিছু না।
সে তো হয় না। কালরাতে খাবার পর আপনি কি করছিলেন?
একটু ভেবে বললেন, আমি জানতে চাই আপনারা এসব জিজ্ঞাসা করার কে?
ইনি মঁসিয়ে কুক রেল কোম্পানির ডিরেক্টর আর উনি ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করেছিলেন।
আর আপনি?
আমি এরকুল পোয়ারো, এই হত্যার তদন্তের ভার আমাকে নিয়োগ করা হয়েছে কোম্পানির তরফ থেকে।
আপনার নাম আমি শুনেছি। আমার সত্যি পরিচয়টা জানিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমারও তাই মত।
আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না তবুও নৈতিক দায়িত্ব কিছু থেকেই যায় তাই বলছি। বলে একটা কার্ড দিলেন তিনি পোয়ারোকে।
মিঃ সাইরাস বি হার্ডম্যান।
ম্যাকনীলস ডিটেকটিভ এজেন্সী।
নিউ ইয়র্ক।
পোয়ারো এর আগেই এই ফার্মের সাথে পরিচিত তবুও বললেন, এর অর্থ?
আমি ইস্তাম্বুলে এসেছিলাম। ওখানে কাজ হয়ে যাওয়ার পর ফিরে যাব তারপর এই চিঠিটা পাই।
চিঠিটা পড়লেন পোয়ারো ওপরে তোকাতলিয়ান হোটেলের ঠিকানা :
প্রিয় মহাশয়,
বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলাম আপনি ম্যাকনীলস ডিটেকটিভ কোম্পানির কর্মী। যদি অনুগ্রহপূর্বক আজ বিকেল চারটায় এই হোটেলে সাক্ষাৎ করেন তবে বিশেষ বাধিত হব।
নমস্কারান্তে
ভবদীয়
এম. ই. রাশেট
বুঝলাম।
বললেন পোয়ারো।
আমি সময় মতোই রাশেটের সাথে দেখা করি উনি দুটো উড়ো চিঠি আমায় দেখিয়েছিলেন।
মিঃ রাশেট কি খুব ভয় পেয়েছিলেন?
ওনার মুখের ভাবে উনি প্রকাশ করেননি কিন্তু মনে মনে যথেষ্ট মুষড়ে পড়েছিলেন। একই ট্রেনের যাত্রী হওয়ার ফলে উনি চেয়েছিলেন যাতে ওঁর নিরাপত্তার সম্পূর্ণ ভার আমি নিই কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা হল।
উনি কি কোনো নির্দেশ দিয়েছিলেন নিরাপত্তার বিষয়ে?
হ্যাঁ। উনি বলেছিলেন ট্রেনে পাশের কামরাটাতেই আমি থাকব। কিন্তু ভাগ্যের বিপর্যয় আমার জুটল ষোল নম্বর কামরা। অবশ্য কাজ করার পক্ষে এটা সবচেয়ে সুবিধা ছিল। নজরও ভালো রাখা যেত। সামনে শুধু খানাকামরা আর প্ল্যাটফর্মে নামবার দরজাটা তাও সেটাতে হুড়কো লাগানো থাকে। একমাত্র বাইরে থেকে ঢুকবার রাস্তা পেছনের ছোট দরজাটা আর নয়তো ট্রেনের একদম পেছন থেকে করিডোর ধরে সোজা এগিয়ে আসা। আমার কামরাটা এমনই জায়গায় যে ফাঁকি দেওয়ার রাস্তাই নেই।
কিছু জানেন হত্যাকারী সম্পর্কে?
একটা বর্ণনা উনি আমায় দিয়েছিলেন।
একজন ছোটোখাটো মানুষ গাঢ় বাদামী চেহারা, মেয়েলি কণ্ঠস্বর। এবং এও বলেছিলেন যে প্রথম রাতে হয়তো কিছু হবে না অতর্কিতে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় রাতে।
তাহলে সবই জানতেন মিঃ রাশেট, বললেন মঁসিয়ে কুক।
হ্যাঁ, সবই চেপে রেখেছিলেন অন্ততঃ ম্যাককুইনের কাছে ওঁর মনিব।
আচ্ছা মিঃ হার্ডম্যান ওঁর জীবনহানির ভয় ছিল কেন জানেন?
না। উনি সেটা বলতে চাননি। আততায়ী ওঁর রক্তদর্শন করতে চায় এটাই বলেছিলেন।
আপনি কি ওঁর আসল পরিচয় জানেন?
কোনো লোকটির?
রাশেটের।
আপনি কি বলতে চাইছেন সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
রাশেটের আসল নাম কাসেট্টি। আর্মষ্ট্রং হত্যা মামলার মূল গায়েন।
আচ্ছা তাই নাকি! না সত্যিই আমি চিনতে পারিনি। যখন ডেইজি মামলা চলছিল তখন আমি পশ্চিমে গেছিলাম। তবে ছবিটবি দেখেছিলাম তবু ফোটোগ্রাফারদের যা গুণ নিজের মা বাপকেই চিনতে অনেক সময় বেশ নষ্ট হয়। তাহলে রাশেটের তো অনেকজন শত্রু ছিল।
রাশেট বর্ণিত হত্যাকারীর সঙ্গে আর্মষ্ট্রং পরিবারের কারোর কি মিল আছে বলতে পারেন?
না। সবাই তো মারা গেছেন বলেই জানি।
একটা মেয়ে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল জানালা দিয়ে মনে আছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ। মেয়েটি বিদেশী ছিল। তাই তার আত্মীয়স্বজনের জানাটা বিচিত্র নয়। তবে আরও তো মামলা ঝুলছিল কাসেট্টির সেই সময় কাজেই সেটা ডেইজি হত্যা মামলা না হয়ে অন্য কোনোও হতে পারে।
ডেইজি হত্যার ঘটনা এই নৃশংস খুনের কারণ তার প্রমাণ আমাদের হাতে আছে।
মিঃ পোয়ারো আমি ডেইজি হত্যা মামলা সম্পর্কে কিছুই জানি না।
কাল রাতে কি কি ঘটেছিল সেটা বলে যান।
আমার বক্তব্য খুবই কম। আমি দিনে ঘুমিয়ে রাতে জেগে নজর রাখতাম। প্রথম রাতে সন্দেহজনক কিছুই ঘটেনি। কাল রাতেও তাই দরজা ফাঁক করে উঁকিও দিয়েছিলাম কিন্তু কোনো আগন্তুকও চোখে পড়েনি।
আপনি নিশ্চিত?
নিশ্চয়ই। এ আমি হলফ করে বলতে পারি যে বাইরে থেকে কোনো লোক ট্রেনে ওঠেনি আর পেছনের কোচ থেকে কেউ এদিকে আসেনি।
আপনি দরজার ফাঁক দিয়ে কি কণ্ডাক্টরকে দেখতে পাচ্ছিলেন?
হ্যাঁ। ও তো বসে ছিল।
ভিনভোকি ছাড়বার পর একবারও নিজের জায়গা জেড়ে অন্যত্র গিয়েছিল কি?
– হ্যাঁ। দুবার। ট্রেন থেমে যাবার ঠিক পরেই ঘন্টার আওয়াজে সাড়া দিতে যায়। পেছনের কোচে যায় সে আমার সামেন দিয়েই, সেখানে মিনিট পনেরো ছিল। কেউ মনে হয় পাগলের মতো ডাক ঘন্টা বাজাচ্ছিল তাই শুনে দৌড়ে আসে। আমিও বাইরে বেরিয়ে যাই কি হয়েছে দেখতে। মনে হয় আমেরিকান প্রৌঢ়াটির কাণ্ড। তার অন্য কামরায় ডাক পড়তে সেখানে জলের বোতল নিয়ে যায়। শেষে বিছানা পাতার তলব আসে তারপর আর নড়েনি নিজের জায়গা ছেড়ে।
ঘুমোচ্ছিল কি?
হতে পারে খুঁটিয়ে দেখিনি।
এই কাগজটাতে সই করে দিন।
আপনাকে যদি দরকার পড়ে কেউ কি এমন আছে যে আপনার প্রকৃত পরিচয় জানে।
এই ট্রেনে? না বোধহয়। তবে ম্যাককুইনের বাবার দপ্তরে কয়েকবার গেছি। কিন্তু অত ভীড়ে আময় চিনে রাখাটা মোটেই সম্ভব নয়। তবে নিউইয়র্কে আপনি বরং জেনে নিতে পারেন এবং আমি সত্যি কথাই বলছি এবং আপনার সাথে আলাপ করে আমি খুবই খুশী হয়েছি।
মিঃ হার্ডম্যানের দিকে সিগারেটকেসটা এগিয়ে দিলেন পোয়ারো।
আপনি কি পাইপ পছন্দ করেন?
না। হার্ডম্যান সিগারেট তুলে নিয়ে হালকা পায়ে বেরিয়ে গেলেন।
কি মনে হয় আপনাদের লোকটার পরিচয় কি সত্যি?
ডাক্তার কনস্টানটাইন বললেন।
হ্যাঁ। মনে হয় না সাহস পাবে মিথ্যে কথা বলবার।
উনি কিন্তু একটা দরকারী তথ্য দিলেন যা হলো হত্যাকারীর বর্ণনাটা, বললেন কুক।
হ্যাঁ।
পোয়ারো বললেন, বর্ণনাটি এমনই যে কোনো মিল নেই এই ট্রেনের যাত্রীদের সঙ্গে।
.
০৯.
ইতালিয়ান যাত্রীর সাক্ষ্য
আন্তেলিও ফলকারেল্লি হাজির হলেন সাক্ষ্য দেবার জন্য। ইতালিয়ান মার্কা চেহারা সুন্দর স্বাস্থ্য লালচে রঙ, মুখে শিশুর সারল্য। একটু ইতালিয় ঘেঁষা চমৎকার ফরাসী ভাষায় কথা বলেন।
আপনার নাম আস্তেলিও ফলকারেল্লি।
হ্যাঁ।
বর্তমানে আমেরিকার নাগরিক?
হ্যাঁ, ব্যবসার সূত্রে।
আপনি ফোর্ড মেরি কোম্পানির এজেন্ট?
হ্যাঁ।
একবার কথা শুরু করলে থামতেই চান না। বললেন ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য।
আপনি তাহলে আমেরিকায় বছর দশেক আছেন?
হ্যাঁ। তারপর স্মৃতিচারণ করলেন মা এবং বোনের।
যিনি খুন হয়েছেন আপনার সঙ্গে কি তার আলাপ পরিচয় ছিল?
না, ওরা ওপর তলার আর আমরা তার সঙ্গে মেশার সুযোগ পাব কি করে বলুন তবে বোঝা যায় উনি খুব সুবিধের ছিলেন না।
ঠিকই ধরেছেন ও কুখ্যাত খুনে আর ছেলে ধরা।
দেখলেন তো এই শর্মা মানুষ চিনতে ভুল করে না।
আর্মস্ট্রং মামলার কথা মনে আছে?
মনে নেই তবে চেনা চেনা লাগছে একটা ছোট্ট মেয়েকে চুরি করা হয়েছিল…
হ্যাঁ খুবই দুঃখের।
ঠিক কিন্তু খুবই আজব দেশ আমেরিকা।
আপনি আর্মষ্ট্রং পরিবারের কাউকে চিনতেন?
না। তবে বলা শক্ত যখন ওখানে গেলাম….।
হাতে সময় কম। পোয়ারো বললেন, কাজের কথায় আসি।
কাল রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর কি করছিলেন?
রাতে খাওয়ার পর খাবার টেবিলে ঐ আমেরিকান ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছিলাম। ঐ যে যিনি টাইপের রিবন বেচেন। তারপর নিজের কামরাতেই চলে আসি। আমার সহযাত্রীটি মশাই এক গোমড়া মুখো ইংরেজ, যিনি মারা গেছেন তার পরিচারক। আমি কামরায় গিয়ে ওকে দেখতে পাইনি বোধহয় প্রভুর খিদমদগারী করতে গিয়েছিল। ফিরলেন যখন গোমড়া মুখ করে। কথাবার্তা তো বললেনই না একখানা কেতাব খুলে বসলেন, তারপর কণ্ডাক্টর বিছানা ঠিক করে দিতে এল। চার আর পাঁচ নম্বর বার্থ তো?
হ্যাঁ। শেষের কামরাটা। আমার বার্থটা উপরে। ধূমপান করছি আর বই পড়ছি। দাঁতের ব্যথায় কাবু ইংরেজটি একটা বিটকেল গন্ধওয়ালা দাওয়াই লাগালেন তারপর শুয়ে শুয়ে কাতরাতে লাগলেন। একটু পরেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিন্তু যখনই ঘুম ভেঙেছে দেখি ভদ্রলোক তখনও কাতরাচ্ছেন।
সারা রাতে বাইরে বেরিয়েছিলেন কি উনি?
না।
কখনও কোনো কথা উঠল ওনার মনিব সম্বন্ধে বলেছিলেন?
বলছি তো উনি বিশেষ কথা বলেন না।
আপনি পাইপ না সিগারেট খান।
শুধু সিগারেট।
একটা সিগারেট দিলেন পোয়ারো।
আপনি শিকাগোয় গেছেন কখনও, কুক বললেন?
হ্যাঁ। চমৎকার। তবে নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, আর ডেট্রয়েট ভালো লাগে আমার।
পোয়ারো একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, এইখানে নাম সই করে ঠিকানাটা লিখে দিন।
বেশ আর কোনো দরকার নেই তো। চলি তাহলে, ট্রেনটা যে কখন চলবে একটা ভালো কাজ মিলনে পেয়েছিলাম সেই দাঁওটাও মারা গেল।
বিদায় নিলেন ফলকারেল্লি।
আমেরিকায় তো উনি অনেকদিন আছেন আর জাতে ইতালীয় এবং এরা ছুরি চালাতে সিদ্ধহস্ত আর ভাষণে মিথ্যেবাদীও হয়, আমি এই জাতটাকে একদম সহ্য করতে পারি না। পোয়ারো আপনার মনস্তত্ব কি বলে?
পোয়ারো বললেন, তা ঠিক এই জাতটার মাথা খুব গরম কিন্তু এখানে খুব পরিকল্পনা মাফিক খুনটা করা হয়েছে এবং যে আছে এর পেছনে তিনি অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন।
.
১০.
মিস ডেবেনহ্যামের সাক্ষ্য
সুন্দরী এবং চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী মেরী ডেবেনহ্যাম।
আপনার নাম মেরী ডেবেনহ্যাম? বয়স ছাব্বিশ?
হ্যাঁ।
আপনি ইংরেজ?
হ্যাঁ।
এই কাগজটায় আপনার নামও ঠিকানা লিখে দিন।
তিনি চমৎকার এবং গোটা গোটা অক্ষরে লিখলেন।
এবার বলুন কাল রাতে আপনি কি করছিলেন?
আমার মনে হয় তেমন কোনো সাহায্যই করতে পারব না, আমি বিছানায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।
এই ট্রেনে খুন হওয়ার ঘটনায় আপনি কি বিচলিত বোধ করছেন?
তেমন কিছু ভাবিইনি। তবে বিচলিত নই।
কেন? খুনটা কি দৈনন্দিন ব্যাপার?
না না, ব্যাপারটা খুবই বিশ্রী।
আপনি খাঁটি ইংরেজ অযথা আবেগে ভেসে যান না।
মেরী হাসলেন।
আমার ধাতে হৈ চৈ, চেঁচামেচি কান্নাকাটি পোযায় না। মানুষ হয়ে জন্মালে মরতে তাকে হবেই একদিন না একদিন তাই না?
এটা তো একটা হত্যাকাণ্ড?
তা তো বটেই।
মৃত ব্যক্তিটিকে আপনি কি চিনতেন?
না। ওঁকে গতকালই প্রথম দেখি খানাকামরায়।
কি মনে হয়েছিল আপনার প্রথম দর্শনেই?
ভালো করে লক্ষ্যই করিনি।
উনি বেশ খারাপ লোক কি মনে হয়েছিল?
সত্যিই আমি কিছুই ভাবিনি।
কিছুক্ষণ স্থির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকানোর পর বললেন পোয়ারো, আমার তদন্ত পদ্ধতি মনে হয় আপনার ঠিক পছন্দ নয়। কোনো ইংরেজ হলে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক কোনো আলোচনা করতেন না কিন্তু পদ্ধতিটা অন্য, আমার প্রশ্ন ব্যক্তিত্ব বুঝে–তাই আপনার আগে যার সঙ্গে কথা বলেছিলাম তিনি একটু বেশি কথা বলতে ভালোবাসেন, তাই বাজে কথা বলার সুযোগ তাঁকে আমি দিইনি তাই একটু অন্যধরনের প্রশ্ন করছি আপনাকে।
মাপ করবেন। আমার ভুল বুদ্ধির কাছে অগম্য ঠেকছে এইটা ভেবে যে আমি রাশেটকে পছন্দ করতাম কিনা তার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের কি সম্পর্ক।
রাশেট লোকটি কে, সেটা কি আপনি জানেন?
তার সম্বন্ধে জানতে আর কারোর বাকি নেই শ্রীমতী হার্বাডের অনুগ্রহে।
আপনার কি মত আর্মষ্ট্রং মামলা সম্পর্কে?
নৃশংস এবং ঘৃণ্য নিঃসন্দেহে।
বাগদাদ থেকে তো আপনি আসছেন তাই না?
হ্যাঁ।
লণ্ডনে যাবেন।
হ্যাঁ।
কি করেন বাগদাদে?
দুটি বাচ্চার গভর্নর তাদের দেখাশোনার কাজ।
বাগদাদে ছুটি ফুরিয়ে গেলেই কি ফিরবেন?
জানি না এখনও কিছু ঠিক নেই।
কেন?
বাড়ি ছেড়ে থাকা আর ভালো লাগে না। লণ্ডনে যদি পছন্দসই কাজ পাই লণ্ডনেই থেকে যাব।
ও এইবারে হয়তো বিয়ে থা করে সংসারী হবেন।
পোয়ারোর এই মন্তব্যে খুশী হতে পারলেন না মেরী ডেবেনহ্যাম এবং এটাকে অনধিকার চর্চা বলে মনে করলেন বোঝা গেল।
নিস্ অঁগাস কেমন মহিলা যিনি আপনার সহযাত্ৰীনী?
বেশ চমৎকার মিষ্টি স্বাভাবের সাধাসিধে।
ওঁর ড্রেসিং গাউনটা কি রং-এর? বা
দামী পশমের।
আলেপ্পো থেকে ইস্তাম্বুলে আসার পথে যেন দেখেছিলাম। আপনারটা বোধহয় হাল্কা বেগুনী তাই না?
হ্যাঁ।
আপনার অন্য রং-এর…. মানে এইরকম লাল রং-এর ড্রেসিং গাউন আছে?
না ওটা আমার না।
পোয়ারো ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
আপনার নয় তাহলে কার?
জানি না আর এ কথায় উত্তেজিত হওয়ার কারণ।
না আপনি বলতে পারতেন যে ঐ ড্রেসিং গাউন আমার নেই।
তার বদলে ওটা আমার নয় মানেটা তাহলে কি দাঁড়ায়, তার মানে আপনি নিশ্চিত জানেন। ওটা কার?
মেরী সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।
এই ট্রেনের কোনো মহিলা যাত্রীর?
হ্যাঁ।
কার?
ভোর পাঁচটা নাগাদ যখন আমার ঘুম ভাঙ্গে ভাবলাম গাড়িটা বোধহয় কোনো স্টেশনে দাঁড়িয়েছে। কামরার দরজা খুলে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল লাল রং-এর কিমাননা পরা কেউ একজন করিডোর দিয়ে চলে গেলেন।
আপনি জানেন না তিনি কে? ফর্সা না বাদামী চেহারার, চুল পাকা না কঁচা।
আমি পেছন থেকে দেখেছি মাথায় টুপি ছিল আর কিমাননার উপর ড্রাগন আঁকা ছিল এমব্রয়ডারি করা। ভদ্রমহিলার গড়ন একটু লম্বাটে, ছিপছিপে ধরনের।
আপাতত প্রশ্ন শেষ আপনি আসতে পারেন।
মেরী ডেবেনহ্যাম চলে যেতে যেতে থমকালেন, বললেন ঐ সুইডিস মহিলা কিন্তু ভীষণ ভয় পেয়েছেন। উনি যে শেষ জীবিত দেখেন মৃত ব্যক্তিটিকে তাই হয়ত ভেবেছেন আপনাদের সন্দেহ ওঁনার দিকে। ভদ্রমহিলা সম্পর্কে বললে বলতে হয় যে উনি একেবারেই শান্তশিষ্ট এবং নিরীহ, ওনার দ্বারা কোনো মাছি মারাও কিন্তু অসম্ভব।
শ্ৰীমতী হার্বাডের কাছ থেকে উনি কখন অ্যাসপিরিন চাইতে যান?
এই সাড়ে দশটা নাগাদ।
কতক্ষণের জন্য বাইরে ছিলেন?
তা মিনিট দশেক হবে।
আর সারারাত বাইরে যাননি?
না। পোয়ারো ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কি মনে হয় ঐ সময় রাশেটের খুন হয়েছে?
না মনে তো হয় না।
আপনার সহযাত্রিনীটিকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলবেন ওনার কোনো সমস্যাই হবে না।
ধন্যবাদ। বেচারী ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন যে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মেরী ডেবেনহ্যাম চলে গেলেন।
.
১১.
জার্মান পরিচারিকার সাক্ষ্য
আপনি ঠিক কি চাইছেন এখনও বোধগম্য হল না, বলে কুক তাকিয়ে রইলেন পোয়ারো দিকে।
কোথাও একটা ভুল হয়েছে সেটাই খুঁজতে হবে।
ভুল?
হ্যাঁ। আমার তদন্তের ধারা সম্বন্ধে আগের তরুণীটির ধারণা ছিল না।
সন্দেহ কি তাহলে ওঁকেই করছেন। ওঁকে দেখলে তো বোঝাই যাবে না যে উনি এই ব্যাপারে জড়িত আছেন।
আমার এবং কুকের সেই একই মত।
এই হত্যাকাণ্ডটা যে আকস্মিক এটা দুজনেই বেশ বলছেন বারবার।
সত্যি বলতে কি মিস্ ডেবেনহ্যামকে সন্দেহ করি দুটো কারণে।
এক ওর সংলাপগুলো হঠাৎ শুনে ফেলার দরুণ আমার ঠিক ভালো লাগেনি।
মেরী ডেবেনহ্যাম কর্নেল আবাথনটকে যে কথাগুলো বলতে শুনেছিলেন সেই গুলো পোয়ারো জানালেন।
তাহলে তো মিস ডেবেনহ্যাম এবং কর্নেল দুজনেই জড়িত। কুক বললেন, দুজনে দুজনের হয়ে সাফাই গাইলেন এটাই তো স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু তা হয়নি। পোয়ারো বললেন, মিস ডেবেনহ্যামের গতিবিধি সম্পূর্ণ অপরিচিত সুইডিস মহিলা এবং কর্নেলের মিঃ ম্যাককুইন সমর্থন করেছেন। না না, ব্যাপারটার সমাধান এত সোজা নয়।
দ্বিতীয় বক্তব্যটা কি।
ও, ওটা পুরোপুরি মনস্তাত্বিক। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই অপরাধ করা কি সম্ভব মিস ডেবেনহ্যামের পক্ষে; কারণ এর পেছনে বিচক্ষণ ঠান্ডা মাথার ব্যক্তি আছেন উত্তর পেলাম হা মিস্ ডেবেনহ্যাম অপরাধী হলেও হতে পারেন।
না না, এই ইংরেজ তরুণীটির উপর মনে হয় অযথা অবিচার করছেন।
যাক গে এবার ইল্ডগ্রেদ স্মিটকে ডাকুন।
ভদ্র, মার্জিত জার্মান পরিচারিকাটি এসে দাঁড়ালেন পরে বসতে বললেন পোয়ারো।
সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণে কথাবার্তা বললেন পোয়ারো।
নাম, ঠিকানা লেখার পর কথাবার্তা চলছিল জার্মান ভাষায়।
আপনি কাল রাতে কি কি করেছিলেন যা হয়তো অনেক অপ্রাসঙ্গিক সেগুলোও তদন্তের স্বার্থে বলুন।
ঠিক বুঝলাম না মঁসিয়ে।
তাহলে প্রশ্ন করি কাল রাত্রে আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তো আপনার কর্ত্রী?
হ্যাঁ।
সময়টা মনে আছে?
না। আমাকে কণ্ডাক্টর যখন ডাকে আমি ঘুমিয়েছিলাম।
এমনটা কি প্রায়ই করেন আপনার কী?
হ্যাঁ। রাতে ভালো ওঁর ঘুমই হয় না অবশ্য শরীর তো খারাপ হতেই পারে।
আপনি তাড়াতাড়ি নিশ্চয় বেরিয়ে পড়েন ড্রেসিং গাউনটা চাপিয়ে?
না তাহলে তো উনি রাগ করতেন।
লাল রং-এর তো একটা ড্রেসিং গাউন আছে আপনার তাই তো?
না তো ওটা গাঢ়নীল ফানেলের।
ও! আপনি তো গেলেন তারপর?
একটু গা হাত পা টিপে দিই এবং বই পড়ে শোনাই। অবশ্য চেঁচিয়ে পড়া আমার পোষায় না। তার পর ওঁর ঘুম এসে যাবার ফলে নিজের কামরায় চলে আসি।
তখন কটা বেজেছে?
জানি না।
কতক্ষণ ছিলেন রাজকুমারীর কামরায়?
আধঘন্টা মতো হবে।
তারপর?
উনি ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে একটা বাড়তি কম্বল এবং খাবার জল দিই তারপর উনি চলে যেতে বলায় আমি আলো নিভিয়ে চলে আসি।
তারপর?
নিজের কামরায় এসে শুয়ে পড়ি।
করিডোরে ফেরার পথে কারোর সাথে দেখা হয়েছিল?
না তো।
পিঠে ড্রাগন আঁকা লাল কিমাননা পরা কোনো মহিলা?
শুধু কণ্ডক্টর ছাড়া আর সবাই ঘুমোচ্ছিল।
কণ্ডাক্টরকে দেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
সে কি করছিল?
একটা কামরা থেকে বেরিয়ে আসছিল।
কোন কামরা?
ও নিয়ে অত ভাববার কিছুই নেই রাতবিরেতে দরকার পড়লে আমরা ডেকেই থাকি তবু যদি বলেন কোনো কামরা?
রাজকুমারীর কামরার দু তিনটে দরজা পরে কোচের মাঝামাঝি জায়গায়।
তারপর কি হলো?
আমি কম্বল নিয়ে ঠাকুরণের ঘরের দিকে যেতে ওর সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লেগেছিল। ও তখন মাপ চেয়ে খানাকামরায় চলে যায়। অবশ্য এর মধ্যে অন্য একটা কামরা থেকে ঘন্টার আওয়াজ হয় সে কানও দেয়নি। আচ্ছা এসব জিজ্ঞাসা করার অর্থ কি?
না এমনিই। কণ্ডাক্টরদের অবস্থা দেখুন এদের অন্যের খিদমতগারী করতে করতেই কেটে যায়।
এই কণ্ডাক্টর আর যে ডেকেছিল আমাকে, তারা কিন্তু এক লোক নয়। এই কণ্ডাক্টর মানে যার সাথে ধাক্কা লাগে আমার।
সেকি? অন্য কেউ? একবারও তাকে দেখেছিলেন?
না।
যদি আবার দেখেন চিনতে পারবেন?
আশা করি পারব।
কুকের কানে কানে নির্দেশ দেবার পর উনি বেরিয়ে গেলেন।
আপনি আমেরিকা গেছেন কখনও?
না তবে যা শুনেছি চমৎকার জায়গা।
তা আপনি নিশ্চয় শুনেছেন নিহত ব্যক্তি একটি ফুটফুটে মেয়েকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল?
শুনেছি, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে মানুষ এত নৃশংস হয়।
আচ্ছা এই রুমালটা কি আপনার?
রুমালটা নিয়ে দেখে বলল যে এটা তার নয়।
এইচ লেখা আছে। আপনার নামের প্রথম অক্ষরও এইচ সেইজন্যই ভেবেছিলাম রুমালটা আপনার।
না না, এত দামী রুমাল ব্যবহার করি না। সূতোর নকশা দেখে মনে হয় এটা প্যারিসের।
এটা আপনার বা আপনি জানেন না এটা কার?
না না আমি কেমন করে জানব!
শ্ৰীমতী স্মিটের গলায় মুহূর্তের দ্বিধা ছিল তা পোয়ারোর কাছে ধরা পড়ল।
আচ্ছা দেখুন তো এদের মধ্যে আপনার কারোর সাথে ধাক্কা লেগেছিল কিনা! এই তিনজন কণ্ডাক্টরের মধ্যে।
না এরা নয়।
আপনার নিশ্চয় কোনো ভুল হচ্ছে এরা ছাড়া তো আর কেউ নেই।
না। এরা তো বেশ লম্বা চওড়া চেহারার আমি যার কথা বলছি সে ছোটোখাটো। বাদামী চামড়ার গোঁফও ছিল। আমার কাছে মাপ চাইবার জন্য তার গলা শুনি মেয়েলি ধাঁচের এগুলো পরিষ্কার মনে আছে।
.
১২.
যাত্রীদের সাক্ষের সংক্ষিপ্ত সার
কিছুক্ষণ আগে খানাকামরা থেকে তিনজন বেরোনোর পর কুক কিছুটা হতাশ হলেন কারণ বেঁটে লোক, রঙ বাদামী, গলার স্বর মেয়েলি কিছুই বুঝতে পারছি না। রাশেট খুনীর যে বর্ণনা দিয়েছিল সবই তো মিলে যাচ্ছে। সে তাহলে গেল কোথায়? আপনি আমায় কিছুটা আলোকপাত করুন। যা অসম্ভব তা সম্ভব হয় কি করে?
কোনো কিছুই অসম্ভব নয় সবই সম্ভব।
কি আশ্চর্য আমি তো আর যাদুকর নই, তোমারও একই ব্যাপার। রহস্য খুবই গভীর।
আমরা এক তিলও এগোতে পারিনি
তা নয়। যাত্রীদের জবানবন্দীতে কিছুটা পাওয়া গেছে।
তারা আর কি বলেছেন?
না এ কথাটা মানতে পারলাম না।
শ্রীযুক্ত হার্ডম্যান আর শ্রীমতী স্মিট রহস্যের কিছুটা সাহায্য করেছেন বইকি কিন্তু তাতে বেড়েছে কমেনি।
তাহলে আপনিই বা কেন কিছু আলোকপাত করছেন না?
আমি তো চেষ্টা করছি সমাধানের জন্য। আমরা সন্দেহাতীত ভাবে কিছু তথ্য জানি যেমন রাশেট ওরফে কাসেট্টিকে হত্যা করা হয়েছে ছোরার আঘাত করে, বারো বার দেহের বিভিন্ন জায়গায়। এ ব্যাপারে ডাক্তারের সঙ্গে যা আলোচনা হয়েছে আমরা সেটা এখন সরিয়ে বলছি খুনের বিষয়টা হল সময়। সে তো আমরা জানিই যে রাত সওয়া একটা নাগাদ-আন্দাজ। তিনটে সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের সামনে।
এক : আমাদের ডাক্তার এবং স্মিটের সাক্ষ্যের তার মিল আছে।
দুই : আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দিয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল পরে।
তিন : হত্যাকাণ্ড হয়েছে ঐ সময়ের আগে ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম নম্বরটা যদি ঠিক ধরি তাহলে পরিস্থিতি অনুযায়ী ট্রেন থেকে পালানো অসম্ভব ছিল। তাহলে লোকটিই বা কে আর গেলই বা কোথা থেকে।
যাত্রীদের সাক্ষ্যের বিশ্লেষণে যা পাওয়া যাচ্ছে তা হল।
মিঃ হার্ডম্যানের কাছে থেকে বেঁটে মেয়েলি গলার লোকের কথা শুনি তিনি আবার সেটা রাশেটের কাছ থেকে শুনেছিলেন। হার্ডম্যানের কথার সত্যতা যাচাই করা এখন সম্ভব নয়। তবে এর পরিচয়ের মতামত খুব শীঘ্রই পাব।
আপনি তাহলে সন্দেহের আওতায় রাখছেন না হার্ডম্যানকে।
না না। সমস্ত সম্ভাবনার কথা আমি ভাবছি যে যদি সে ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করছেন বলে উঠি তবে পুলিশ দিয়ে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। সুতরাং যাঁরা ঝুঁকি নেন তার কোনো পরোয়া না করেই করেন। উনি নিজের সম্বন্ধে যা যা বলেছেন সবই যদি মিথ্যে হয় ধরা পড়লে কিন্তু তিনি লজ্জিত হবেন আমার মুখোমুখি হতে। কোনো বিচিত্র নয় কঠিন রাশেট সে চরিত্রের ছিলেন তাকে খুন করতে চাওয়াটা। নিজের নিরাপত্তার জন্য রাশেট মিঃ হার্ডম্যানকে নিয়োগ করতে চাওয়াটাও অসম্ভব নয়। তবে কার্যক্ষেত্রে যদি তাই হয় তবে প্রমাণ সাপেক্ষ। আরও অদ্ভুত শ্ৰীমতী হার্বাডের কণ্ডাক্টরের বোম পাওয়াটা। খুনের প্রসঙ্গে আর একটা কথা ভুলে যাচ্ছি।
কি কথা?
কর্নেল আবাথনট আর হেক্টর ম্যাককুইন দুজনেই বলেছেন তাদের কামরার পাশ দিয়ে কণ্ডাক্টর গেছিল। এদিকে মিশেল নিজের জায়গা ছেড়ে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ওঠেনি এটা সে জোর গলায় বলেছে এবং যেদিকে ওঁরা আড্ডা মারছিলেন সেদিকে যেতেই হয়নি।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চারজনেরই সমর্থন আছে বেঁটে ও মেয়েলি লোকটির উপস্থিতি সম্বন্ধে।
ডাক্তার হাত তুললেন।
একটা ছোট্ট কথা, শ্রীমতী স্মিটের কথা যদি সত্যি হয় আমাদের কণ্ডাক্টর মিসেস হার্বাডের কামরায় টোকা দেবার সময় শ্রীমতী স্মিটকে দেখেনি কেন?
এই ব্যাখ্যা সহজ, কারণ তখন শ্রীমতী স্মিট তার কত্রীর সঙ্গে ছিল। আর নিজের কামরায় যখন সে যায় তখন হার্বাড কামরার ভেতরে।
কুকের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙল। বললেন, তাহলে অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকটি কোথায় গেল সে তো উপস্থিত ছিল?
লোকটি আদৌ ছিল কিনা সেটা বরং নিজেকে প্রশ্ন করুন। যার কোনো অস্তিত্বই নেই তাকে অদৃশ্য করে দেবার মতো সহজ কাজ আর বোধহয় নেই। তাহলে জানতে হবে লোকটার রক্তমাংসের কোনো অস্তিত্ব আদৌ ছিল কিনা?
আর যদি লোকটা থাকে তবে সে কোথায় যেতে পারে?
এ প্রশ্নের দুটো উত্তর হতে পারে।
এক : লোকটা এমনই এক জায়গায় লুকিয়ে আছে তাই তাকে খোঁজা অসম্ভব।
দুই : এই ট্রেনেরই কোনো যাত্রী সে যে ছদ্মবেশে ধরায় রাশেট তাকে চিনতে পারেনি।
হ্যাঁ। হ্যাঁ। এটা হওয়া সম্ভব। কিন্তু….।
লোকটার উচ্চতা একমাত্র রাশেটের পরিচারক ছাড়া সকলেই লম্বা। তবে পরিচারকটাকে আমার সন্দেহ হয় না।
সম্ভাবনা অবশ্য একটা থেকে যায় যে লোকটার গলার স্বর মেয়েলি। কাজেই এমন হতে পারে সে মহিলার ছদ্মবেশে ছিল নতুবা সে সত্যিই মহিলা। পুরুষের পোশাক পরলে কোনো মহিলাকে কিন্তু বেঁটেই দেখাবে।
কিন্তু রাশেট তো….
হ্যাঁ। সে জানত। তাকে হয়ত অনেক আগেই এই স্ত্রীলোকটি হত্যার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। তাই এই চেষ্টা সে আবার করবে ভেবে মেয়েলি গলার পুরুষের কথা বলেছিল। বুঝতে পারছি বন্ধু খুবই জটিলতা এই হত্যাকাণ্ডে।
এ নিশ্চয় কোনো পাগলের কাণ্ড এবং অসম্ভব, অবাস্তব।
আমিও তাই ভাবছি। ট্রেনে দুজন আগন্তুক কাল রাতে ছিল।
একজন কণ্ডাক্টরের বেশে (পুরুষ) যাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন মিঃ হার্ডম্যান, শ্রীমতী স্মিট। কর্নেল আর ম্যাককুইন। আর অন্যজন লাল কিমানো পরা মহিলা তার উপস্থিতি সমর্থন করেছেন তিনজন পিয়ের মিশেল, মিস্ ডেবেনহ্যাম এবং আমি নিজে। এই ট্রেনে তো লাল কিমানো নেই। তিনিও উবে গেছেন তার মানে তিনিও ছদ্মবেশে ছিলেন তাছাড়া কণ্ডাক্টরের পোশাক আর লাল কিমানো তো এগুলোই বা গেল কোথায়?
কুক লাফিয়ে উঠে বললেন, সমস্ত যাত্রীদের মালপত্র তল্লাসী করব যদি কোনো হদিশ পাওয়া যায়।
আমার অনুমান যদি না ভুল হয়ে থাকে তবে লাল কিমাননাটা কোনো পুরুষযাত্রীর বাঙ্কে এবং ইউনিফর্মটা শ্ৰীমতী স্মিটের জিনিষপত্রের মধ্যে খুঁজে পাবেন।
না আপনি যা ভাবছেন তা নয়। শ্রীমতী স্মিট যদি অপরাধী হন তাহলে কণ্ডাক্টরের ইউনিফর্মটা তার জিনিষপত্রের মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে যদি নিরাপরাধ হন তবে অবশ্যই পাওয়া যাবে তার কাছে।
অবশ্য এগুলো সবই অনুমান….।
সশব্দে খানাকামরার দরজা খুলে শ্ৰীমতী হার্বাড চিৎকার করে উঠলেন।
ওঃ কী ভীষণ কাণ্ড….আমার ভোলোর মধ্যে…. একটা এতো বড়ো ছোরা ….বলে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মূৰ্ছা গেলেন একেবারে মঁসিয়ে কুকের ঘাড়ের উপর।
.
১৩.
হত্যার হাতিয়ার
মিসেস হার্বাডকে কুক চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। ডাক্তার তোক ডাকলেন।
এভাবেই উনি থাকুন। জ্ঞান ফেরার পর একটু কনিয়াক দিতে বললেন।
তারপর তারা তিনজনই শ্রীমতী হার্বাডের কামরায় গেলেন।
জ্ঞান ফেরার পর মিসেস হাবার্ড কথা বলা শুরু করলেন ট্রেনের বেয়ারাটির সঙ্গে।
ওঃ কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য যা আমি বোঝাতে পারব না এবং এতে অনেক স্নায়ুর চাপ পরে। আমার মন ভীষণ নরম সেই ছোট বেলা থেকে এবং রক্ত দেখলেই গা যেন গুলিয়ে উঠে। আমাদের কস্মিনকালেও কেউ মদ ছোয়নি কিন্তু ডাক্তার বলায় আমায় তাও খেতে হচ্ছে।
শ্ৰীমতী হার্বাডের কামরায় তখন প্রচণ্ড ভীড়। কণ্ডাক্টর সবাইকে ঠেকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে।
সবাইকে সরিয়ে কুক বললেন, আমাদের একটু যেতে দিন। আপনারা এসে ভালোই করেছেন। যা করছিলেন উনি আমি তো ভেবেছি উনিই খুন হয়েছেন এবং সবাইকেই উনি বলছিলেন কি কি কাণ্ড হয়েছে। আপনারা গিয়ে অস্ত্রটা দেখুন আমি কিন্তু ওটা ছুঁইনি বলল কণ্ডাক্টর। শ্রীমতী হার্বাড আর রাশেটের কামরা দুটোর মাঝের দরজাটায় সেদিকে হাবাডের কামরা তার হাতলে একটা বড় চৌখুপি নকশাটা ভোলো তার ঠিক নিচেই পড়ে আছে চ্যাটালো ইস্পাতের একটা ছোরা সস্তার জিনিষ। ফলাটায় মরচের ছাপের মতো দাগ।
পোয়ারো ছোরাটাকে তুলে নিয়ে বললেন, কোনো ভুল নেই এটাই খুনের অস্ত্র।
ছোরাটা হাতে নিলেন ডাক্তার।
সাবধানতার কিছু নেই কেননা এতে কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে না শ্ৰীমতী হাবার্ডের ছাড়া।
যথেষ্ট ধারালো, এটা দিয়েই হত্যা করা হয়েছে মসিয়ে।
দুজন আততায়ী একই দিনে একই অস্ত্র দিয়ে রাশেটকে খুন করতে চাইবে এটা বুঝতে পারছি না।
অবশ্য হতেও পারে। কেননা এই ছোরা বাজারে সর্বত্রই পাওয়া যায়।
ভোলোটা সরিয়ে হাতল ঘুরিয়ে দরজাটা খুলতে চাইলেন কিন্তু দরজা খুলল না।
আমরা তো আগেই রাশেটের কামরার দিক থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি, ডাক্তার বললেন।
তবুও কি যেন চিন্তা করছেন পোয়ারো।
খুনী তাহলে এই দিক থেকে ঢুকেছিল। দু কামরার মাঝের দরজাটা বন্ধ করবার সময় তার হাত ঠেকে ভোলোয় তাই তাড়াহুড়ো করে ওর মধ্যেই ফেলে যায়। শ্রীমতী হার্বাড জেগে উঠলে পালায়।
হয়তো তাই, পোয়ারো বললেন।
কি হল কিছু একটা যেন ঠিক সন্তুষ্ট করতে পারছে না।
না। কিছুই চোখে পড়ছে না আপনার।
শ্ৰীমতী হাবড় ততক্ষণে এসে পড়েছেন।
দেখুন এই কামরায় আর থাকব না, আমাকে যত দামই দেন না কেন?
কিন্তু মাদাম….
না না আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না, আমি এই করিডোরেই বসে থাকব। কাঁদতে লাগলেন তিনি।
আমার মেয়ে যদি থাকত এখানে সে কিছুতেই আমার হেনস্থা মেনে নিত না।
ঠিক আছে আপনার জিনিষপত্র অন্য কামরাতেই দিয়ে আসবে।
শ্ৰীমতী রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, বাবা এতক্ষণে স্বস্তি পেলাম।
কিন্তু কোথায় যাবো সবটাইতো ভর্তি।
আপনাকে বেলগ্রেড কোচে একটা কামরা দেওয়া হবে।
মিশেল ভদ্রমহিলাকে নিয়ে নতুন কোচে গেল।
আপনার পছন্দ তো মাদাম? একেবারে আপনার আগের কামরাটার মতোই।
হ্যাঁ তবে এটার মুখ অন্যদিকে।
আপনার পছন্দ হলেই হল।
যা বরফ ঝড়ে আটকা পড়লাম আমরা, কাল বাদে পরশু স্টিমার ছাড়বে এখন ভালোয় ভালোয় পৌঁছতে পারলে বাঁচি।
আমাদের সকলের এই একই অবস্থা, কুক বললেন।
কিন্তু খুনীটা বেছে বেছে ঠিক আমারই কামরায় ঢুকেছিল সত্যিই কপালটা বড়ই মন্দ।
আচ্ছা আপনার কামরার দিক থেকে মাঝখানের দরজাটা যদি বন্ধই থাকে তবে লোকটা ঢুকলো কি করে? সত্যিই বন্ধ ছিল তো দরজাটা?
কেন? তাই তো বললেন সুইডিস মহিলাটি।
ধরুন আপনি শুয়ে আছেন হুড়কোটা তো দেখা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।
না দেখব কি করে ভোলোটা তো ছিল। ওটা দেখলেই বুক কাঁপছে, পৌঁছে একটা ব্যাগ কিনতে হবে।
ভোলোটা হাতলে টাঙালেন পোয়ারো।
এই দেখুন হুড়কোটা ঠিক ঠিক হাতলের নিচে-ভোলোটা সেটা আড়াল করছে। সত্যিই আপনার পক্ষে দেখাটা সম্ভব নয়।
এতক্ষণ ধরে তো সেটাই বলছি।
দাঁড়িয়ে দেখছিলেন তো সুইডিস মহিলাটি। সম্ভবত উনি ভুল করেছেন হাতলটা ডানদিকে ঘোরালে দরজাটা বন্ধ হয়। সোজা ভাবে থাকলে দরজাটা ভেজানো থাকে। উনি হয়তো হাতলটা ঘুরিয়ে ছিলেন। ভোলো আড়াল থাকায় হুড়কোটা দেখেননি, দরজা না খোলায় ভেবেছিলেন বন্ধ আছে। আসলে সেটা রাশেটের অন্যদিক থেকে মাঝ কামরার দিক থেকে লাগানো ছিল।
মহিলাটি তাহলে নির্বোধ।
ওরকম বলবেন না হয়তো বিচক্ষণ নন।
হবে হয়তো।
কোথায় কোথায় বেড়ালেন আপনি?
আমার মেয়ের এক বন্ধু মিঃ জনসন তার ওখানে অর্থাৎ ইস্তাম্বুলে যাই। তিনি শহরটা দেখালেন কিন্তু আমার ভালো লাগেনি জায়গাটা।
মিঃ জনসন নিজেই দেখা করেন আপনার সঙ্গে?
হ্যাঁ। ফেরার ব্যবস্থাও উনি করে দেন। দেখুন দেখি ওদিকে জামাই এসে অপেক্ষা করবে। একটা কোনোরকমে খবর দেওয়া যেত। মেয়েতো ভেবে ভেবেই সারা হবে একেবারে…।
পোয়ারো দেখলেন শ্রীমতী হার্বাড আবার কাদার উপক্রম করছেন তাই বললেন, চা আর বিস্কুট খান মাদাম খুব ভালো লাগবে।
আমার চা খেতে ভালো লাগে না।
তাহলে কফি? একটা অনুরোধ আপনার জিনিসপত্রগুলো একবার আমরা পরীক্ষা করব?
কেন?
সমস্ত যাত্রীদেরই তল্লাসি করতে হবে কেন না আপনার ভোলো থেকে দেখলেন তো ছোরাটা পাওয়া গেল। কিছুই করার নেই এই কাজগুলো আমাদের নিয়মের মধ্যে পড়ে।
বেশ তো।
শ্ৰীমতী হার্বাডের কাছ থেকে কিছুই পাওয়া গেল না।
কুক বললেন, এবারে আমাদের পরের কাজ কি?
সব কামরাগুলো একে একে দেখা।
প্রথমেই হার্ডম্যানের কামরা ষোলো নম্বর। কুক তাদের আমার উদ্দেশ্যটা জানালেন।
হার্ডম্যান নিঃসঙ্কোচে বললেন তিনি তাঁর বাক্স খুলে দেবেন কিনা?
না মিশেলেই পারবে।
তার বাক্সে কয়েক বোতল মদ থাকার জন্য বললেন প্যারিসেই এটা শেষ করে ফেলবেন।
কণ্ডাক্টর সমস্ত জিনিষপত্র গুছিয়ে দিলেন দেখবার পর।
এরপর পাশের কামরায় কর্নেল আর্বাথনটের কাছে গেলেন এবং তাঁকে–তাদের আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। তিনি নিজের দুটো চামড়ার বড় স্যুটকেশ বের করে দিলেন।
এই যা মালপত্র জাহাজে যাচ্ছে বাকিগুলো।
সবকিছু দেখার পর একটা জিনিসের প্রতি পোয়ারোর দৃষ্টি গেল। তা হল এক প্যাকেট পাইপ ক্লিনার।
এই ধরনের ক্লিনারই কি আপনি ব্যবহার করেন?
হ্যাঁ অবশ্য বাজারে যদি পাওয়া যায়।
এই রকমই একটা ক্লিনার রাশেটের কামরায় পাওয়া গেছে। রাজকুমারীর কামরার দরজা বন্ধ ছিল, বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনজন দরজায় টোকা দিয়ে তাদের আসার উদ্দেশ্য বললেন।
রাজকুমারী সব শুনে বললেন তার পরিচারিকার কাছেই সব চাবি রাখা আছে। আপনারা দেখে নিতে পারেন।
সবসময়ই কি পরিচারিকার কাছে আপনার চাবি থাকে?
নিশ্চয়ই।
যদি গভীর রাতে মালপত্র খোলবার দরকার হয় তখন?
কণ্ডাক্টর তাকে ডেকে নিয়ে আসবে।
মাদাম খুব বিশ্বাস করেন ওকে?
এ প্রশ্নের উত্তর তো আগেই দিয়েছি। যাকে বিশ্বাস করি না তাকে চাবিও দিই না।
আমার তো মনে হয় যদি কোনো বুদ্ধিমতী ফরাসী মহিলাকে নিযুক্ত করতেন…।
আপনার কথা আমি ঠিক বুঝছি না। ইল্ডগ্রেদ অত্যন্ত বিশ্বাসী এবং বিশ্বাসের দাম আমার কাছে সবচেয়ে বেশি।
চাবি নিয়ে পরিচারিকাটি এল। তাকে রাজকুমারী প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে করিডোরে বেরিয়ে এলেন। পিছনে পোয়ারোও।
আপনার কি কোনো উৎসাহ নেই জিনিষপত্র দেখার?
মাদাম আমার নিয়মরক্ষার খাতিরেই এগুলো করতে হচ্ছে।
আমি সোনিয়া আর্মস্ট্রংকে ভালোবাসতাম। কিন্তু কাসেট্টির মতো একটা ছুঁচোকে মেরে হাত গন্ধ করার স্পৃহা আমার নেই। হয়ত চাকরদের ডেকেই বলতাম এই লোকটাকে কুকুর দিয়ে খাওয়া, আমাদের ছেলেবেলায় শাস্তিটা এমনই ছিল। সত্যিই আপনার দেহের শক্তি সম্বন্ধে আমার জানা নেই তবে মনে হয় অসীম শক্তি আপনার।
কি জানি হয়ত ঠিকই বলছেন।
তবে আপনারা যেটা করছেন সেই প্রথা মাফিক কাজ আপনাদের করতেই হবে কারণ কাজের এটা একটা অঙ্গ।
পরের কামরা দুটো ভেতর থেকে বন্ধ। কাউন্ট আর কাউন্টসের কামরা। কুক একটু দোনামোনা করছিলেন। কারণ উনি জানতেন ওরা বিদেশী দূতাবাসের কাজ করেন। যদি কোনো অভিযোগ উপর মহলে পাঠান এই ভেবেই। যদি না দেখলে হয় তবে থাক।
কেন? ওঁরা কিছুই মনে করবেন না। এমন তো হতে পারে দেখলেন না রাজকুমারী মেনে নিলেন।
সে কথা আলাদা।
কুকের কথার মাঝে তেরো নম্বর কামরায় পোয়ারো টোকা দিলেন। তাদের আসার কারণ বলার পর কাউন্ট বললেন, সবারই যখন তল্লাশী হচ্ছে আমারটাই বা বাদ হবে কেন, বলে বললেন, কি বল এলেনা।
মালপত্র দেখতে দেখতে হঠাৎ নীল মরক্কো চামড়ার ব্যাগ তুলে নিলেন। একটু ভিজে ভিজে যেন ওপরে নাম লেখা লেবেলটা। ওয়াশ বেসিনের ওপরের তাকে তোয়ালে, ক্রীম, পাউডার এক শিশি ঘুমের বড়ি।
এর পরের তিনটে কামরা পরপর শ্রীতী হার্বাডের (পুরোনো কামরা), রাশেটের আর পোয়ারোর।
এরপর দশ আর এগারো দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা। মেরী ডেবেনহ্যাম একটা বই পড়ছিলেন আর ঘুমোচ্ছিলেন গ্রেটা অলসঁ।
আমরা আপনার মালপত্র একটু পরীক্ষা করব ততক্ষণ যদি আপনি শ্ৰীমতী হার্বাডের কামরায় যান কেননা শ্রীমতী হার্বাডের কথা বলার সঙ্গী নেই। আপনি গেলে ওঁর ভালো লাগবে। তিনি তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। তার বাক্সে চাবি দেওয়া ছিল না তাই স্বচ্ছন্দে পরীক্ষা করা যায়। তার বাক্স ঘেঁটে বোঝা যায় তিনি অবগত নয় তার টুপির বাক্স থেকে জালটা বেপাত্তা। মেরী ডেবেনহ্যাম বললেন, আপনি ঐ আমেরিকান ভদ্রমহিলাকে বিদায় করলেন কেন?
আমি?
অযথা ছল করবেন না। আসলে আপনি আমার সঙ্গে নিভৃতে কথা বলতে চান তাই তো?
আপনি সত্যিই বুদ্ধিমতী।
আসল ব্যাপার হলো আপনি বুঝেছেন যে এই খুনের ব্যাপারে আমি কিছু জানি এই তো?
তাহলে মাদমোয়াজেল খুলেই বলি, সিরিয়া থেকে আসবার পথে কোনিয়া স্টেশনে কর্নেল আর আপনি পায়ের খিল ছাড়াতে নামেন। সেই সময় দুটো কথা আমার কানে আসে সেটা হল, না না এখন নয়, সব মিটে গেলে…কথাগুলোর মানে সত্যি বলবেন মাদমোয়াজেল….?
আশ্চর্য রকমের শান্ত মেরীর গলা।
আপনার কি মনে হয় তার মানে খুন?
দুটো কথার মানে জানতে চাইছি মাদাম।
আমি আপনাকে বলতে পারছি না কারণ আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবে রাশেটকে এর আগে কখনও দেখিনি তা আমি শপথ করে বলতে পারি।
তাহলে কেন আপনি প্রত্যাখান করছেন?
সেভাবে ধরলে তাই। একটা কর্তব্যের দায়িত্ব প্রসঙ্গেও কথা বলেছিলাম।
এখন কি সেই কাজ শেষ হয়েছে?
আপনি কি বলতে চান? আপনার হঠাৎ এ কথা মনে হল কেন?
ইস্তাম্বুলে আসার দিন ট্রেন দেরি করার ফলে আপনি অত্যন্ত উত্তেজিত ছিলেন যেটা আপনার স্বভাবে নেই।
পরের ট্রেনটা ধরা জরুরী ছিল।
এই ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস তো সপ্তাহে সাতদিন ট্রেনটা চলে। বড় জোর চব্বিশ ঘন্টা দেরি হত সেটা এমন কিছু জীবনমরণ সমস্যা নয়।
একটা ট্রেন যদি ঠিকমত না ধরা যায় তবে পরের কাজগুলোও ভেস্তে যায়। আমি ব্যস্ত হয়ে থাকলেও অবাক হবার কারণ নেই।
তা ঠিক। তবে আমার আশ্চর্য লাগছে অন্য কারণে। আমরা তো এখানে অনেকক্ষণ ধরে আটকে আছি তাতে কোনো বিকার লক্ষ্য করছি না আপনার। কি হলো উত্তর দিন মাদাম। মেরী ডেবেনহ্যাম মনে মনে রেগে গেলেন।
আপনি কি বেশি কষ্ট কল্পনা করছেন না মঁসিয়ে পোয়ারো?
হতে পারে। একটু বেশি সন্দেহপ্রবণ হয় গোয়েন্দারা নিশ্চয় জানেন। কর্নেল আবাথনটকে আপনি কতটা চেনেন? একটু আশ্বস্ত মেরী কথার পরিবর্তনে।
এইবারেই আলাপ।
রাশেট কে যে উনি চিনতেন এ বিষয়ে আপনার কি কোনো সন্দেহ হয়?
না আমি নিঃসন্দেহ এ ব্যাপারে।
কেমন করে বুঝলেন?
ওঁর কথাবার্তায়।
আমরা একটা পাইপ ক্লিনার মিঃ রাশেটের কামরা থেকে পেয়েছি এবং একমাত্র কর্নেলই এই পাইপ খান।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিলেন পোয়ারো কিন্তু মেরীর মুখের রেখার কোনো পরিবর্তন দেখলেন না।
কর্নেলের রাশেট কেন কাউকেই খুন করবার মানসিকতা নেই। ওঁর স্বভাববিরুদ্ধ অত নাটকীয়তা।
মনে মনে সমর্থন হয়তো বা করলেন পোয়ারো।
এতটা নিশ্চিত হলেন কি করে? আপনি তো ভালো করে ওঁকে চেনেনই না।
মানুষের ধরনধারণ দেখলেই বোঝা যায়।
ঐ কথাটার মানেটা তাহলে আপনি বলবেন না।
না।
আমি ঠিক বের করে ফেলব দেখবেন।
মেরী আর কর্নেল দুজনকেই পরোক্ষভাবে কথাগুলো বলে কি ভালো হল, কুক বললেন।
দরকারে ফাদ একটু পাততেই হয়।
পরের কামরায় শ্রীমতী স্মিটের হাতব্যাগের জিনিষপত্র পরীক্ষা করার পর সুটকেশ খুললেন তাতে চাবি দেওয়া ছিল না।
একটা কণ্ডাক্টরের পোশাক ওপরে ভাঁজ করা ছিল। শ্রীমতী স্মিট চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন, আমি এসবের কিছু জানি না। ইস্তাম্বুল ছাড়ার পর একবারও বাক্সই খুলিইনি।
আপনাকে আমরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। আপনার ভেঙে পড়ার কিছুই নেই। আপনি সত্যিই ভালোমানুষ এবং আপনার রান্না প্রশংসার দাবী রাখে।
ইল্ডগ্রেদ ভয়ার্ত মুখে চুপ করে গেলেন।
এবার পোয়ারো আসল রহস্যটা বললেন এই যে শ্রীমতী স্মিটের সঙ্গে লোকটার ধাক্কা লাগার পর তাড়াতাড়ি পোশাকটা লুকিয়ে রাখতে চায় কিন্তু সমস্ত কামরায় তোক ভর্তি থাকার ফলে এই কামরা খালি পেয়ে সুটকেশ খুলে তাড়াতাড়ি রেখে দেয়।
দেখা যায় জামাটার বোম নেই এবং কণ্ডাক্টরের পকেটে চাবিটাও মজুত।
তাহলে ওসব দরজার হুড়কো ছিটকিনি কোনো কিছুই কাজে আসেনি। এই বাবাজীর কাছে সব খোল চাবিটিই। কুক বললেন।
তারপর মনে আছে শ্রীমতী হার্বাডের কামরার করিডোরের দিকের দরজাটাও বন্ধ ছিল ভেতর থেকে, মিশেল বলেছিল।
হ্যাঁ মঁসিয়ে, ভদ্রমহিলা যে স্বপ্ন দেখেছেন নিশ্চয় এটা সেইজন্যই বলেছিলাম।
এখন শুধু লাল কিমানোটা খুঁজতে বাকি, পোয়ারো বললেন।
হ্যাঁ শেষ কামরার দুটো দুজন পুরুষের।
ম্যাককুইন হেসে বলল, বুড়ো যদি একটা উইলটুইল করে থাকে তাহলে ফোকটে কিছু দাও মারা যাবে।
সন্দেহ ভরা চোখে কুক তাকাতে একটু অপ্রস্তুত হল ম্যাককুইন।
না না আমায় উনি টাকাপয়সা দিতে যাবেনই বা কেন। আমি ঠাট্টা করছি, আমি ওঁর চাকর ছাড়া আর কিছুই ছিলাম না।
মাস্টারম্যান আর ফলকারেল্লির কামরায় কিছুই পাওয়া গেল না।
সব কিছুর শেষে পোয়ারো বললেন, কিচেন কামরার দিকে যাওয়া যাক। তদন্ত শেষ, এবার বুদ্ধির খেলা।
সিগারেট ফুরিয়ে যাবার ফলে নিজের কামরায় যেতে পোয়ারো ভাবতে লাগেলেন যদি লাল কিমানোটা পাওয়া যেত তবে একটা সূত্র পাওয়া যেত। নিজের কামরায় এসে ছোট্ট বাক্সটা খুলে ভাবলেন যদি সিগারেট থাকে। তার চোখ বড় হয়ে উঠল।
সমস্ত জিনিষপত্রের উপর নিপুণভাবে ভাঁজ করে রাখা আছে একটা লাল সিল্কের কিমানো এবং তাতে ড্রাগন আঁকা আছে।
পোয়ারো মৃদুস্বরে বললেন, চ্যালেঞ্জ! বেশ আমি তা গ্রহণ করলাম।
৩. তৃতীয় পর্ব : পোয়ারোর ভাবনাচিন্তা
তৃতীয় পর্ব : পোয়ারোর ভাবনাচিন্তা
০১.
কোনো জন?
পোয়ারো কিচেন কামরায় এসে দেখলেন কুক এবং ডাক্তার কথাবার্তা বলছিলেন।
আপনি যদি এই রহস্যের সমাধান করতে পারেন বুঝব অসম্ভবও সম্ভব হয়। কুক বললেন।
আপনাকে ব্যাপারটা খুব ভাবাচ্ছে তাই না?
হ্যাঁ বুঝতে পারা যাচ্ছে না।
সায় দিলেন ডাক্তারও।
এরপর আমাদের করণীয় কি আছে সেটাই মাথায় আসছে না, সমাজ, লোকালয় থেকে আমরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। কোনো সাহায্য বাইরে থেকে পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং সবকিছুই মাথা খাঁটিয়ে করতে হবে।
তা ঠিক, এবার তাহলে কিভাবে এগোবেন?
কেন? যাত্রীদের তথ্য এবং আমাদের পর্যবেক্ষণ এসবই তথ্য মজুদ। যাত্রীদের সাক্ষ্য থেকে কিই বা জানা গেছে?
না জানতে পারলাম। তারা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অনেক কিছু তথ্যই সরবারহ করেছেন।
প্রথমে ম্যাককুইনের কথা ধরুন। উনি বলেছিলেন ভ্রমণ ছিল মিঃ রাশেটের নেশা। কিন্তু বিদেশী ভাষায় দখল না থাকার ফলে সেক্রেটারী এবং দোভাষী দুই-এর কাজের জন্য তাকে বহাল করা হয়েছিল। আরও একটা সূত্র হচ্ছে যদি আমেরিকান ইংরাজী ছাড়া আর কিছুই জানা না থাকে তবে চলাফেরাই মুশকিল ছিল।
তার মানে।
ফরাসী ভাষা রাশেট জানত না। যখন কণ্ডাক্টর দরজায় টোকা মারে ভেতর থেকে ফরাসী ভাষায়ই জবাব আসে স্য ন্য রিয়, মে সুই ঐ পে। কথাটা স্পষ্ট শুনেছিলাম। ফরাসী ভাষায় দখল না থাকলে এত সুন্দর ভাবে বাক্য গঠন করা সম্ভব নয়। সুতরাং রাশেটের কামরায় নিশ্চয় অন্য কেউ উপস্থিত ছিল।
চেঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার।
আপনি তাই ঘড়ির ব্যাপারটাকে অত গুরুত্ব দেননি। রাশেট মৃত তার মানে একটা বাজতে তেইশ মিনিটে। এবং কামরার ভেতর থেকে হত্যাকারী কথা বলেছিল, কুক বললেন।
না না, এত তাড়াতাড়ি এগোনোর কিছু নেই। এটুকু বলা যায় যে একটা বাজতে তেইশ মিনিটে রাশেটের কামরায় এমন একজন কেউ ছিল যে অনর্গল ফরাসী ভাষায় কথা বলতে পারে।
বড় বেশি আপনি সাবধানী মঁসিয়ে।
একধাপ করে এগোনোই শ্রেয় আর এখন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই যে রাশেট সেই সময়ই মৃত।
কেন? তার একটু আগেই তো আপনার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আর্তনাদ শুনে।
তা অবশ্য ঠিক।
এতে কতটুকু লাভ হল অবশ্য জানি না, কুক বললেন। রাশেটের পাশে একটা লোক ছিল হয়তো সেই সময়। খুনটুন করে হাত ধুচ্ছে বা চিঠিটা পোড়াচ্ছিল, তারপর সুযোগ বুঝে শ্ৰীমতী হার্বাডের কামরার মধ্যে দিয়ে পালিয়েছে। হত্যাকারী অ্যালিবাই সৃষ্টি করার জন্য ঘড়ির কাটাও আধঘন্টা পিছিয়ে দিয়েছিল।
হ্যাঁ। ঘড়ির কাঁটা একটা বেজে পনের মিনিটে বন্ধ হয়ে গেছে। ওই সময় মঞ্চ থেকে হত্যাকারী বিদায় নিয়েছিল। একটা বেজে পনের মিনিট এই সময়টা নিয়ে আমাদের প্রধান কাজ হল ওই সময়কার অ্যালিবাই সবচেয়ে নিখুঁত ছিল তা হদিশ করা।
ডাক্তার হ্যাঁ হ্যাঁ তা ঠিক।
কুকও উৎসাহিত হলেন।
মনে রাখতে হবে খুনী কখন কামরায় ঢুকেছিল। সম্ভাব্য সময় হল ভিনভোকিতে ট্রেনটা যখন থেমে ছিল।
তারপর তো করিডোরের সামনে কণ্ডাক্টর বসে ছিল।
তাহলে অন্য কাউকে কণ্ডাক্টরের পোশাকে দেখলে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। সুতরাং মিশেল যখন ভিনভোকি প্ল্যাটফর্মে নামে ওই লোকটা গাড়িতে ওঠে।
এই ব্যক্তিটি মনে হয় মহামান্য যাত্রীদেরই একজন।
পোয়ারো হাসলেন।
আমি একটা তালিকা তৈরি করেছি আপনার এটা কাজে লাগে কিনা দেখুন তো।
হেক্টর ম্যাককুইন– আমেরিকান নাগরিক। ৬ নম্বর বার্থ।
দ্বিতীয় শ্রেণী কিন্তু তিক্ততা থাকা অসম্ভব নয় মৃত ব্যক্তির উদ্ভট সম্পর্কের ফলে।
অ্যালিবাই –রাত্রি বারোটা থেকে দুটো (রাত্রি বারোটা থেকে একটা ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত কর্নেল আবাথনট কর্তৃক এবং একটা পনের মিনিট থেকে দুটো পর্যন্ত কণ্ডাক্টর কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য– কিছু নেই।
সন্দেহজনক গতিবিধি কিছু নেই।
কণ্ডাক্টর পিয়ের মিশেল– ফরাসী।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই –রাত্রি বারোটা থেকে দুটো (বারোটা সাইত্রিশ মিনিটে রাশেটের কামরা থেকে যখন কথা শোনা গিয়েছিল সেই সময় পোয়ারো তাকে করিডোরে দেখেছিলেন। রাত্রি একটা থেকে একটা মোল মিনিট পর্যন্ত তার গতিবিধি কন্ডাক্টর কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য — নেই।
সন্দেহজনক গতিবিধি –মিশেলের সুবিধে হয়েছে একটি ইউনিফর্ম পাওয়াতে নইলে সন্দেহটা তার দিকে পড়ত।
এডওয়ার্ড মাস্টারম্যান –ইংরেজ, ৪ নম্বর বার্থ, দ্বিতীয় শ্রেণী।
অভিপ্রায় –মৃত ব্যক্তির পরিচারক। ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়।
অ্যালিবাই– রাত্রি বারোটা থেকে দুটো (আস্তেলিও ফলকারেল্লি কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য — নেই।
সন্দেহজনক গতিবিধি– নেই। তবে কণ্ডাক্টর পোশাকটি মাপসই হতে পারে তবে ফরাসী ভাষায় জ্ঞান না থাকা সম্ভব।
শ্ৰীমতী হাবার্ড –আমেরিকান। ৩ নম্বর বার্থ, প্রথম শ্রেণী।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই –বারোটা থেকে দুটো। কিছু নেই।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য — কিছু নেই।
সন্দেহজনক গতিবিধি –একটি লোকের উপস্থিতি সম্পর্কে যা বলেছেন তা মিঃ হার্ডম্যান ও শ্রীমতী স্মিটের সাক্ষ্যে পরোক্ষভাবে সমর্থিত।
গ্রেটা অঁলস –সুইডিস।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই –রাত্রি বারোটা থেকে দুটো ( মিস ডেবেনহ্যাম কর্তৃক সমর্থিত)।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ –শেষবারের মতো ইনিই জীবিত দেখেন রাশেটকে।
রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ– জন্মসূত্রে রাশিয়ান। বর্তমানে ফরাসী নাগরিক। ১৪ নং বার্থ, প্রথম শ্রেণী।
অভিপ্রায় –একসময় আমং পরিবারের সাথে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন এবং সোনিয়া আর্মষ্ট্রং ছিলেন এঁর ধর্মকন্যা এবং বিশেষভাবে স্নেহের পাত্রী।
অ্যালিবাই –রাত্রি বারোটা থেকে দুটো (কণ্ডাক্টর ও পরিচারিকা কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য– সন্দেহজনক গতিবিধি কিছু নেই।
কাউন্ট আন্দ্রেনী –হাঙ্গেরীয়। কূটনৈতিক পাসপোর্ট। ১৩ নং বার্থ, প্রথম শ্রেণী।
অ্যালিবাই –রাত্রি বারোটা থেকে দুটো (রাত্রি একটা থেকে একটা পনের মিনিট পর্যন্ত সময়টুকু বাদে বাকি সময় কণ্ডাক্টর কর্তৃক সমর্থিত)।
কাউন্টেস আন্দ্রেনী –কাউন্ট আন্দ্রেনীর স্ত্রী। ১২ নম্বর বার্থ, প্রথম শ্রেণী।
অভিপ্রায় –কিছুই নেই।
অ্যালিবাই বারোটা থেকে দুটো ( ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন ওঁর স্বামী কর্তৃক সমর্থিত) কামরায় ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে।
কর্নেল আর্বাথনট –ইংরেজ। ১৫ নম্বর বার্থ, প্রথম শ্রেণী।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই– বারোটা থেকে দুটো (একটা ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত ম্যাককুইনের সঙ্গে গল্প করছিলেন। তারপর নিজের কামরায় যান ম্যাককুইন ও কণ্ডাক্টর কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য –পাইপ ক্লিনার।
সাইরাস হার্ডম্যান –আমেরিকান। ১৬ নম্বর বার্থ, দ্বিতীয় শ্রেণী।
অভিপ্রায় –অজ্ঞাত।
অ্যালিবাই– বারোটা থেকে দুটো (নিজের কামরাতেই ছিলেন ম্যাককুইন ও কণ্ডাক্টর কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য –কিছু নেই।
আন্তেলিও ফলকারেল্লি –জন্মসূত্রে ইতালিয়ান। বর্তমানে আমেরিকার নাগরিক। ৫ নম্বর বার্থ, দ্বিতীয় শ্রেণী।
অভিপ্রায় –অজ্ঞাত।
অ্যালিবাই –বারোটা থেকে দুটো (মাস্টারম্যান কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য –কিছু নেই। তবে যে অস্ত্রের সাহায্যে রাশেটকে হত্যা করা হয়েছে সেটি ব্যবহার করা এঁর পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয়। কুকের মতে লোকটি সন্দেহজনক তালিকায় পড়ে।
মেরী ডেবেনহ্যাম –ইংরেজ। ১১ নম্বর বার্থ, দ্বিতীয় শ্রেণী।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই –বারোটা থেকে দুটো (গ্রেটা অঁলস কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য –পোয়ারোর কাছে ইনি নিজের বক্তব্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে অসম্মত হন।
ইল্ডগ্রেদ স্মিট –জার্মান। ৮ নম্বর বার্থ, দ্বিতীয় শ্রেণী।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই –বারোটা থেকে দুটো (কণ্ডাক্টর ও রাজকুমারী কর্তৃক সমর্থিত কামরায় ঘুমোচ্ছিলেন)। বারোটা আটত্রিশ মিনিট নাগাদ কণ্ডাক্টর ডেকে তোলে। তারপর কত্রীর কামরায় গেছিলেন।
দ্রষ্টব্য– যাত্রীদের এবং কণ্ডাক্টরের সাক্ষ্য থেকে সাধারণভাবে জানা যাচ্ছে যে রাত্রি বারোটা থেকে একটা এবং একটা পনের মিনিট থেকে দুটোর মধ্যে রাশেটের কামরায় কেউই ঢোকেনি বা বেরোয়নি। একটা থেকে একটা পনের মিনিট এই সময়টুকুর জন্য কণ্ডাক্টর পাশের কোচে গেছিলেন।
কুক ব্যাগদুটো ফেরত দিলেন।
কিছু হদিশ করতে পারেলেন না মঁসিয়ে পোয়ারো।
এবার এই কাগজটা দেখুন বলে এগিয়ে দিলেন পোয়ারো।
.
০২.
দশটি প্রশ্ন
এক : রুমালের উপর এইচ অক্ষরটি তোলা আছে। রুমালটি কার?
দুই : পাইপ ক্লিনার ফেলে দিয়েছিলেন কে? কর্নেল আবাথনট না আর কেউ?
তিন : লাল কিমানো পরা মহিলাটি কে?
চার : কণ্ডাক্টরের ছদ্মবেশে পুরুষ বা স্ত্রীলোকটি কে?
পাঁচ : ঘড়ির কাঁটা একটা পনের বেজে বন্ধ। এর ইঙ্গিত কি?
ছয় : হত্যা কি ওই সময় হয়?
সাত : না ওই সময়ের আগে?
আট : অথবা পরে?
নয় : একজনের বেশি লোক ছোরা মেরেছিল তার নিশ্চয়তা কি?
দশ : অন্য কি ব্যাখ্যা ক্ষত চিহ্নগুলোর হতে পারে?
রুমাল দিয়েই শুরু করা হল। এইচ অক্ষর দিয়ে শুরু শ্রীমতী হার্বাড, কুমারী হারমিয়োন ডেবেনহ্যাম। আর শ্রীমতী ইল্ডগ্রেদ স্মিট।
এই তিন জনের মধ্যে?
মিস ডেবেনহ্যাম নিজেকে হারমিয়োন বলতেই পছন্দ করেন। একটু সন্দেহজনক চরিত্রের কারণ উনি কিছু সাক্ষে ভাঙ্গেননি।
শ্ৰীমতী হার্বাডের রুমাল বলেই মনে হয় বললেন ডাক্তার কেননা উনি আমেরিকান এবং রুমালটাও দামী। সবাই জানে পছন্দ হলে দামের জন্য পরোয়া নেই আমেরিকানদের।
শ্ৰীমতী স্মিটের যে রুমালটা নয় আপনারা দুজনেই তাহলে একমত।
হ্যাঁ। বেশ দামী উনিই তো বলে গেলেন।
এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন পাইপটা কি কর্নেল আবাথনটের?
যেহেতু ইংরেজরা চট করে ছোরাছুরি চালায় না এবং কর্নেলের ওপর যাতে সন্দেহটা যায় সেজন্যই হয়ত ওটাকে রাশেটের কামরায় ফেলে রাখা হয়েছিল।
কেউ দুটো জিনিষই ভুল করে ফেলে যাবে এটা ঠিক নয়, ডাক্তার বললেন। অবশ্য পাইপক্লিনারের কথাটা আলাদা। এটা ইচ্ছাকৃত এবং কর্নেল স্বচ্ছন্দেই বললেন যে তিনি ঐ পাইপক্লিনারেই ব্যবহার করে অন্ধকারে আ সৈটাই প্রশ্ন।
কিমানোটার প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ অন্ধকারে আছি। কুক এবং ডাক্তারের একই মত।
কণ্ডাক্টরের ছদ্মবেশে পুরুষ বা মহিলাটি কে সেটাই প্রশ্ন।
যারা নয় বলা সহজ। যাদের বাদ দেওয়া যেতে পারে তারা হলো হার্ডম্যান, কর্নেল, ফলকারেল্লি, কাউন্ট আন্দ্রেনী, আর ম্যাককুইন এঁরা যথেষ্ট লম্বা। শ্রীমতী হার্বাড, শ্রীমতী স্মিট আর গ্রেটা অঁলস আর ফলকারেল্লি জানিয়েছে যে মেরী ডেবেনহ্যাম বা মাস্টারম্যান কেউই কামরা ছেড়ে বাইরে বেরোয়নি। শ্রীমতী স্মিট বলেছে রাজকুমারী তার কামরায় ছিলেন। কাউন্ট বলেছেন তার স্ত্রী ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন। ব্যাপারটা খুবই জটিল হল।
আমার ধারণা কিন্তু চারজনের মধ্যেই কেউ হবেন যদি না কোনো বাইরের লোক আসে, ডাক্তার বললেন।
একটা পনের মিনিট বেজে ঘড়ির কাঁটা বন্ধ, এর দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। হত্যাকারী অ্যালিবাই সৃষ্টি করার জন্য ঘড়ির কাটা ঘুরিয়ে রেখেছিল কারণ যখন সে দেখল তার কামরা থেকে বেরোতে দেরি হচ্ছে। আর যদি তা না হয় তবে দ্বিতীয় হত্যাকারী যে ন্যাটা এবং স্ত্রীলোক বলে অনুমান তারও একই উদ্দেশ্য ছিল।
চমৎকার, বললেন পোয়ারো। দ্বিতীয় হত্যাকারী কামরায় ঢুকে ছোরা চালালো। যদিও রাশেট আগেই নিহত।
যখন অন্ধাকরে টের পেল যে রাশেটের পায়জামার পকেটে ঘড়ি আছে অন্ধকারেই ঘড়ির কাটা সরালো এবং ঘড়িটাকে ভেঙ্গে অচল করল তারপর ঠিকঠাক করে পকেটে রেখে বেরিয়ে গেল।
হত্যা কি একটা পনের মিনিটে হয়েছে।
ডাক্তার এবং মঁসিয়ে কুক আপনারা একমত কি হত্যা হয়েছে ঐ সময়ের পরে?
আমার বিশ্বাস পোয়ারোর ধারণা কিন্তু উনি এখন মত প্রকাশে অনিচ্ছুক, ওঁর মত বোধহয় প্রথম হত্যাকারী সম্ভবতঃ ন্যাটা। যাত্রীদের কেউ ন্যাটা আছেন কিনা সেটা খোঁজ করা উচিত।
আমি অনুসন্ধান করে দেখছি পোয়ারো বললেন।
আপনারা লক্ষ্য করে দেখবেন প্রত্যেককেই নিজের নাম ঠিকানা লেখার জন্য বলেছিলাম একমাত্র রাজকুমারী সন্দেহের উর্দ্ধে কারণ ওর শরীর দুর্বল, ডাক্তার বললো। ডাক্তার একটা কথা জানেন কি এটা এমন একটা কাজ যা দৈহিক শক্তির চেয়ে মনের জোর বেশি দরকার।
রাজকুমারী একজন প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী নারী। যাই হোক এই প্রসঙ্গ থাক দশ নম্বর প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করি, পোয়ারো বললেন।
রাশেটের হত্যাকারী দুজন এটা ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে বলা যায়। প্রথম জন চলে যাবার পর অন্ততঃ আধ ঘণ্টা পরে দ্বিতীয় আততায়ী আসে। প্রথমজন বলশালী, দ্বিতীয়জন অপেক্ষাকৃত কমজোরী এবং ন্যাটা। এর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা আর নেই কারণ সে ডান হাতে ছোরা চালাবে আর খানিক পরে এসে নিশ্চয় বাম হাতে ছোরা চালাবে এটা কি সম্ভব।
আততায়ী যে দুজন এটাও কি সম্ভব?
সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি ডাক্তার, পোয়ারো বললেন।
.
০৩.
কয়েকটি লক্ষ্যণীয় বিষয়
পোয়ারো অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি। এতক্ষণ এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেই ভাবছিলাম কিন্তু এর জন্য একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। এই ট্রেন যেন এক চলামান পান্থশালা মঁসিয়ে কুক কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন। বিভিন্ন দেশের অপরিচিত মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে চলছে….।
এই প্রসঙ্গে আমার মনে হয়েছিল যে ট্রেনটা একদম ফাঁকাই যায় বছরের এই সময়টাতে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে এথেন্স-প্যারিস কোচটা ভর্তি। শুধু একজন টিকিট কেটেও ঠিক সময়ে পৌঁছোননি; এটা লক্ষ্য করার বিষয়।
দরজার ছিটকানিকে আড়াল করা জন্য একটা ঝোলা রাখা ছিল। শ্রীমতী হার্বাড-এর কামরা দিয়ে পাশে রাশেটের কামরায় যাবার তাতে ভোলা বা বন্ধ কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। ঝোলাটা ওখানে ছিল কেন? শ্রীযুক্ত আর্মষ্ট্রং-এর মায়ের নাম। শ্রীযুক্ত হার্ডম্যানের গোয়েন্দাগিরি, রাশেটের কামরায় আধপোড়া চিঠি, ম্যাককুইনের বক্তব্য, রাজকুমারীর নাম, কাউন্টেস আন্দ্রেনীর পাসপোর্টে দাগ এগুলো লক্ষ্যণীয় বিষয়। এগুলো থেকে কি মনে হয় আপনাদের?
দুজনেই বুঝিয়ে দিলেন যে তারা কিছুই বুঝতে পারছেন না। কাউন্টেসের পাসপোর্টটা মেলে ধরে কুক বললেন, এই দাগটার কথা বলছেন?
হা দেখুন কোথায় লেগেছে?
আন্দ্রেনীর নামের গোড়ায় কিন্তু তাতে কি হল?
রুমালের ব্যাপারে মিস ডেবেনহ্যাম, মিস হার্বাড আর পরিচারিকা স্মিট এই তিনজন সন্দেহের তালিকায় ছিলেন কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে, এটা প্যারিসের এবং খুব দামী রুমাল। কিন্তু এই তিনজন সাধারণ জামাকাপড়, রুমাল ব্যবহার করেন এবং রুমালটার দাম কমসে কম দুশো ফ্র। এই রুমালটির সম্ভাব্য দাবীদার : রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ আর…।
অবাক হলেন কুক।
ওর নাম তো নাতালিয়া।
হ্যাঁ। কথাটা মনে রাখবেন আর অন্যজন কাউন্টেস আন্দ্রেনী আর তখনই মনে হল…।
এবার আপনার। আমরা এতে নেই মশাই।
বেশ, কাউন্টেসের পাসপোর্টের দাগটা সন্দেহজনক হয়ত নিছক দুর্ঘটনা। কিন্তু ওঁর আসল নাম কি! এলেনা?
এমন তো হতে পারে ওর নামটা আসলে হেলেনা।
এটা অবশ্য অনুমানভিত্তিক।
হা কাউন্টেসের ব্যাগের লেবেলটা সেদিন ভিজে ভিজে লেগেছিল কেন? হয়ত সেদিন সেটা বদলানো হয়ে থাকে, এই হত্যাকাণ্ড কিন্তু আকস্মিক নয় পূর্ব পরিকল্পিত। আকস্মিক ব্যাপার দুটো। এক বরফ ঝড় দুই এই ট্রেনে এরকুল পোয়ারোর উপস্থিতি।
এই অবস্থার জন্য হত্যাকারী বা হত্যাকারীরা প্রস্তুত ছিল না। যদি বরফ ঝড় না হত তবে নির্দিষ্ট সময় ট্রেনটা ইতালি-সীমান্তে গিয়ে পৌঁছাত। সেই সময় হত্যাকাণ্ডের সংবাদ জানা যেত। এবং এই রকম সাক্ষ্য ইতালিয় পুলিসের কাছে দেওয়া হত। ম্যাককুইন দেখাতেন উড়োচিঠির নমুনা ব্যার্থ গোয়েন্দাগিরি শোনাতেন হার্ডম্যান। শ্রীমতী হার্বাড রহস্যময় লোকের বিবরণ শোনাতেন। বোতামটি এবং কণ্ডাক্টরের উর্দিটি বাথরুমে পাওয়া যেত। হত্যাকারীরা যে বাইরের লোক এটাই প্রমাণ করা হচ্ছে হত্যাকারী বা হত্যাকারীদের মূল উদ্দেশ্য।
কিন্তু মাঝখানে বরফ ঝড়ই সব ওলোটপালোট করে দেয়। রাশেটের কামরায় হত্যাকারী অপেক্ষা করেছিল কারণ সে হয়ত ভেবেছিল ট্রেন চলবে। কিন্তু ট্রেন না চলায় পরিকল্পনা বদল হল যে হত্যাকারী ট্রেনের মধ্যে আছে।
সবই ভাঁওতা ছিল উড়ো চিঠিগুলো কারণ রাশেট জানত তার শত্রু কে বা কারা। তবে যেটা আধপোড়া অবস্থায় পেয়েছি সেটা দেখে সে সত্যিই ভয় পেয়েছিল। এবং সেই কারণেই পোড়ানো হয়েছিল। এবার রুমাল আর পাইপক্লিনার। রুমালটা ভুল করে সত্যিই ফেলে যাওয়া হয়েছিল। এমন কোনো মহিলার যদি রুমালটা হয় যিনি আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে যুক্ত তিনি নিমোতে তার পরিচয় গোপন করবেন এবং এই ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। কাউন্টেস আন্দ্রেনী নাম বদল করেছেন ওঁর প্রকৃত নাম এলেনা নয়, হেলেনা।
উনি আমেরিকায় কখনও যাননি তিনি তা বলেছেন। তাহলে আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে ওঁর কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
হা সাক্ষ্যে তাই বলেছেন। কারণ ওঁর চেহারা ইংরেজ বা আমেরিকানদের মত নয়। অনেকটা ইউরোপ অধিবাসীদের ধাঁচের এবং ইংরাজী উচ্চারণেও জড়তা আছে। আমি বুঝতে পেরেছি উনি কে?
ডেইজি আর্মষ্ট্রং-এর মাসী হেলেনা। শ্রীযুক্তা আর্মষ্ট্রং-এর আপন ছোট বোন। অভিনেত্রী লিণ্ডা আর্ডেন-এর কনিষ্ঠ কন্যা।
লিণ্ডা আর্ডেন ছিলেন পেশাদার মঞ্চাভিনেত্রী। আমরা সবাই জানি তাঁর অতুলনীয় পারদর্শিতার কথা, পেশাদার নাম নিয়েই এক্ষেত্রে সবাই থাকে। লিণ্ডা আর্ডেন শেক্সপীয়ারের অ্যাজ ইউ লাইক ইট নাটকে আর্ডেন অরণ্য আর রোজা লিণ্ডা দুইয়ে মিলে লিণ্ডা আর্ডেন হওয়া বিচিত্র নয়। লিণ্ডার পূর্ব পুরুষরা হয়ত মধ্য ইউরোপের লোক ছিলেন। তার প্রকৃত পদবী হয়ত গোল্ডেনবার্গ। লিণ্ডা আর্ডেনের ছোট মেয়ে হেলেনা গোল্ডেনবার্গ বর্তমানে কাউন্টেস আন্দ্রেনী। ওয়াশিংটনে কাউন্ট যখন ছিলেন তখনই বিয়ে হয় ওদের।
রাজকুমারী তো বলেছেন যে লিণ্ডা আর্ডেনের ছোট মেয়ে এক ইংরেজকে বিয়ে করেছে। এবং সেটা রাজকুমারীর মনে নেই। রাজকুমারী ওদের পরিবারের বন্ধু অথচ এই তথ্যটুকু জানবেন না। কিন্তু ট্রেনে যে হেলেনা আছেন এবং রাজকুমারীও তাকে দেখেছেন কিন্তু আমরা যাতে হেলেনাকে সন্দেহ না করি তাই তিনি মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
খানাকামরায় নৈশভোজের জন্য যাত্রীদের আহ্বান করা হল।
.
০৪.
পাসপোর্টে নাম বদল
খাবার পরিবেশন করার আগে প্রধান পরিচারককে ডেকে কিছু একটা নির্দেশ দিলেন পোয়ারো। কাউন্ট আর কাউন্টেসকে সবার শেষে পরিবেশন করা হচ্ছে দেখলেন ডাক্তার এবং মঁসিয়ে কুক। বিলের ক্ষেত্রেও একটু দেরি হল তাদের। সবাই যখন বেরিয়ে গেলেন ওঁরা তখনও টেবিলে বসে। দাম মিটিয়ে যাবার পথে আটকালেন পোয়ারো হাতে সেই দামী রুমালটা। এই রুমালটা মাদাম আপনি ফেলে যাচ্ছেন।
কাউন্টেস রুমালটি হাতে নিয়ে দেখলেন এবং বললেন আপনার ভুল হয়েছে মঁসিয়ে, রুমালটা আমার নয়।
আপনার নয়?
না।
কিন্তু এইচ অক্ষরটা সেলাই করা আছে যে।
কাউন্টেস অবিচলিত মুখে বললেন আমার নামের প্রথম অক্ষর এইচ নয় ই।
না মাদাম। আপনার নাম এলেনা নয় হেলেনা, হেলেনা গোল্ডেনবার্গ। অভিনেত্রী লিণ্ডা আর্ডেনের কনিষ্ঠ কন্যা শ্রীমতী আর্মষ্ট্রং-এর ছোট বোন।
কাউন্ট আর কাউন্টসের মুখে মৃত্যুর বিবর্ণতা। দুপক্ষই চুপ থাকলেন দুই মিনিট।
নরম গলায় পোয়ারো বললেন, আমি যা বললাম তা সত্যি কিনা অস্বীকার করবেন না মাদাম।
কাউন্ট গলা চড়িয়ে বললেন, আপনি কোনো অধিকার…. তা আমি জানতে চাই।
লক্ষ্মীটি মাথা গরম করো না। আমায় বলতে দাও এবং এঁর কাছে অস্বীকারের উপায় নেই।
হা মঁসিয়ে আমি হেলেনা গোল্ডেনবার্গ। শ্রীমতী আর্মস্ট্রং আমার দিদি।
সেটা আগে বলেননি কেন উল্টে আপনার স্বামী-সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলে গেছেন।
গর্জে উঠলেন কাউন্ট। কাউন্টেস তাকে চুপ করিয়ে বললেন। উনি যা বলছেন তা তিক্ত এবং সত্য।
আচ্ছা মাদাম পাসপোর্টে নাম বদল করলেন কেন?
ওকে কিছু বলবেন না ওটা আমিই করেছি, বললেন কাউন্ট।
হেলেনা শুরু করলো। ট্রেনে যে লোকটা খুন হয়েছে সে একসময় আমার দিদির ছোট্ট মেয়েকে চুরি করে হত্যা করেছিল এবং সে আমার দিদি-ভগ্নিপতির মৃত্যুর জন্যও দায়ী। একটা সুন্দর সংসার নষ্ট করে দিয়েছিল মঁসিয়ে পোয়ারো।
এই ট্রেনে রাশেটকে হত্যা করবার স্বপক্ষে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি ছিল।
আপনি তো তাকে খুন করেননি?
না। এটা শপথ করে বলছি এক আধবার হয়তো ভেবেছি এই পর্যন্তই।
আমি ভগবানের নামে শপথ করে বলছি যে আমার স্ত্রী রাতে একবারের জন্যও কামরা ছেড়ে বেরোয়নি ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। কাউন্ট বললেন।
তাহলে নাম বদল করতে গেলেন কেন পাসপোর্টে? আমি চাইনি কোনো পুলিশি জেরার মুখোমুখি হোক আমার নিরাপরাধ স্ত্রী, ও খুব নরম মনের মেয়ে।
আপনাকে অবিশ্বাস করছি না এবং এও জানি আপনি অভিজাত বংশের। আপনার নিশ্চয় এটা কাম্য ছিল না যে আপনার স্ত্রী একটা বিশ্রী মামলায় জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু রুমালটার ব্যাপারে কি বলবেন?
রুমালটা আমার নয় মঁসিয়ে কারণ এই রুমাল আমি ব্যবহার করি না। এটা আপনি বিশ্বাস করুন, কাউন্টেস বললেন।
আপনাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলার জন্যই কি এই রুমালটা ফেলে আসা হয়েছিল?
তা জানিনা তবে সত্যিই রুমালটা আমার নয়।
পাসপোর্টে নাম বদল করতে গেলেন কেন?
কাউন্ট বললো, যে লোকটিকে খুন করা হয়েছে তার কামরা থেকে এইচ অক্ষরের একটা রুমাল পাওয়া গেছে তাই অযথা হেলেনাকে সন্দেহ না হয় এবং জেরার ভয়ে।
তাই বলে এতবড় একটা বে-আইনী কাজ করলেন?
না না, আসলে খুবই ভয় পাওয়ার জন্য এবং আবার হয়ত পুরনো ক্ষত খুঁচিয়ে ভোলা হবে তাই।
গম্ভীর গলায় পোয়ারো বললেন, এখন আপনি আমাকে সাহায্য করুন মাদাম।
আপনি কার কথা জানতে চান? রবার্ট, সোনিয়া, ডেইজি কেউই এদের বেঁচে নেই।
মাদাম আরও একটা মৃত্যু হয়েছিল।
সুশান? ওঁর কথা ভুলেই গেছিলাম। অন্যায় সন্দেহ করেছিল পুলিশ ও আত্মহত্যা করে, জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে কিন্তু ও সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিল।
মাদাম মেয়েটি কোনো দেশীয় ছিল?
ফরাসী।
তার পদবী কি ছিল?
সেটা জানি না তবে সুশান বলেই ডাকতে শুনেছি।
একজন নার্স ছিলেন না ডেইজিকে দেখাশোনা করার জন্য?
হা শিক্ষিত নার্স। শ্রীমতী স্টেনগেলবার্গ।
আচ্ছা এই ট্রেনে আপনার ছেলেবেলায় চেনা জানা কাউকে দেখেছেন?
না।
রাজকুমারী –দ্রাগোমিরফ?
হ্যাঁ আমি ভাবলাম বোধহয় অন্য কারোর কথা জিজ্ঞাসা করছেন।
কেননা ওর কথাই আলাদা।
ভালো করে ভেবে বলুন মাদাম?
না মঁসিয়ে।
তখন অবশ্য ছেলেমানুষ ছিলেন পড়াশুনা কার কাছে করতেন?
আমার এক কড়া গভর্নেস ছিলেন ইংরেজ বা স্কচ হবেন। তবে সোনিয়ার সঙ্গে ভীষণ ভাব ছিল। মাথার চুলগুলো লালচে ধরণের।
তার নাম কি?
মিস ফ্রিবভি।
তাঁর বয়স কত ছিল?
আমার তো তাকে বেশ বুড়ি বুড়িই লাগত। এখন ভাবলে মনে হয় সে সময় তার বয়স চল্লিশ-টল্লিশ হবে।
বাড়িতে আর কে কে থাকত?
কয়েকজন চাকর বাকর গোছের।
এই ট্রেনে আপনি তাহলে কাউকে চেনাজানা দেখেননি?
না মঁসিয়ে।
.
০৫.
রুশ রাজকুমারীর নাম
আপনার কি অপূর্ব বিচার ক্ষমতা তবে কাউন্টসের জন্য দুঃখ হয়। বেচারীর অল্প বয়স কয়েক বছরের বেশি অবশ্য জেল হবে না কেননা বয়স এবং মানসিক আঘাতের কথা চিন্তা করে বিচারকরা নিশ্চয়ই লঘু শান্তির বিধানই দেবেন। বললেন কুক।
তাহলে আপনি ধরে নিচ্ছেন যে রাশেটকে উনি হত্যা করেছেন?
করেননি?
তার স্বামী-তো কত সাফাই গেয়েছিল শুনলেন তো।
সে তো স্ত্রীকে বাঁচাতে উনি চাইবেনই।
কাউন্টের কথা আমার কিন্তু সত্যি বলেই মনে হয়। কিন্তু রুমালটা। ওঃ রুমালটা তো বলেছি দুটো সম্ভাবনার দিক।
আপনারা নাকি একটা রুমাল পেয়েছেন? রুমালটা আমার, বললেন রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ।
তাই নাকি, মাদাম এইটা কি?
হা হা, এইটা। ওর কোণে আমার নাম লেখা আছে।
মাদাম আপনার নাম তো নাতালিয়া, কুক বললেন।
ঠিকই কিন্তু রাশিয়ান ভাষায় এন অক্ষরটা ইংরেজীর এইচ-এর মতো দেখতে।
কুকের অস্বস্তি হতে আরম্ভ করল।
পোয়ারো সামলে নিয়ে বললেন, কই সকালে তো বলেননি যে রুমালটা আপনার।
আপনি তো জিজ্ঞাসা করেননি।
বলুন মাদাম।
আমি জানি পরবর্তী প্রশ্নটা এবার জিজ্ঞাসা করবেন রাশেটের কামরায় এটা গেল কি করে। আমি উত্তরটা জানি না।
জানেন না?
না।
আপনার কথার উপর আমরা কতটা আস্থা রাখতে পারি?
একথা বলার অর্থ কি এই যে হেলেনা আন্দ্রেনী সে সোনিয়ার বোন জানাইনি বলে।
আপনি আমাদের এ বিষয়ে বিভ্রান্ত করেছিলেন।
নিশ্চয়। দরকার হলে আরও করব। জানেন সে আমার বান্ধবীর মেয়ে। এবং বন্ধুর প্রতি আনুগত্য আমি বিশ্বাস করি।
কিন্তু এতে যদি বিচারের অসুবিধা হয়?
বিচারের কি আছে, রাশেট উপযুক্ত শিক্ষা পেয়েছে।
কাউন্টেসকে বাঁচবার জন্যই কি এই রুমালটা আপনার বলে দাবী করছেন?
না না, রুমালটা সত্যিই আমার। যদি বিশ্বাস না হয় প্যারিসের যে দোকানে কেনাকাটা করি সেখানে জিজ্ঞাসা করলেই বুঝতে পারবেন। আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে!
আপনার পরিচারিকাও তো বলেনি যে রুমালটা আপনার।
বলেনি বুঝি সেও তার মানে আনুগত্যে বিশ্বাস করে। বলে বেরিয়ে গেলেন রাজকুমারী।
রাশেটকে কি উনি হত্যা করতে পারেন? ডাক্তারকে পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন।
মনে হয় না। যথেষ্ট দৈহিক শক্তির দরকার হয় এই ধরনের আঘাত করতে গেলে।
আর মৃদু আঘাতগুলো?
সেগুলো অবশ্য সম্ভব হতেও পারে।
আমি সকালবেলায় যখন ওঁকে বললাম যে হাতের থেকে মনের জোর বেশি ওঁর তখন উনি ডান বা বাঁহাত নয় দুটো হাতের দিকে নজর দিয়ে স্বগোতোক্তি করেছিলেন। সত্যিই ওঁর হাতে জোর নেই।
উনি যে ন্যাটা তাতে প্রমাণ হয় না।
কত মিথ্যা কথাই এঁরা সবাই মিলে বলেছেন, মঁসিয়ে কুক বললেন।
পোয়ারো হেসে বললেন, এটাই মজা। এর জন্যই এরা ফাঁদে পড়ে, নিজেদের বাঁচাতে মিথ্যা কথা বলাটা কিন্তু পরোক্ষে আমাদেরই সুবিধা হওয়া।
এবার তা হলে কর্নেল সাহেবকেই ডাকা যাক।
.
০৬.
কর্নেলের সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার
তিনি যে বিরক্ত তা তাঁর ধরণ দেখলেই বোঝা যায়। ক্ষমা করবেন কর্নেল আপনাকে ডেকে পাঠাতে হল বিশেষ প্রয়োজনে। আপনি আমাদের কিছু সংবাদ-জানাতে পারেন এই কারণে।
তাই নাকি?
হা। এই পাইপ ক্লিনারটা কি আপনার?
কি করে বলি বলুন, চিহ্ন তো দিয়ে রাখিনি।
আপনি এই কোচের মধ্যে যে পাইপ খান সেটা কি জানেন?
সেক্ষেত্রে ওটা আমার হলেও হতে পারে।
জানেন কি এটা কোথায় পাওয়া গেছে?
কি করে জানব?
নিহত লোকটির পাশে।
একটু ভুরু তুললেন কর্নেল।
এ জিনিষটা ওখানে গেল কেমন করে বলতে পারেন? পোয়ারো বললেন।
আমি ওটা ওখানে ফেলে এসেছিলাম নিশ্চয় বলতে চাইছেন!
উত্তরটা ঠিক হল না।
রাশেটের কামরায় কি একবারও আপনি গিয়েছিলেন?
কখনও কথাই বলিনি ওঁর সঙ্গে।
তাকে খুনও করেননি কথাও বলেননি?
যদি করেও থাকি, তাহলে কি আমি আহাম্মক যে সাত কাহন করে বলতে যাব। তবে লোকটিকে আমি খুন করিনি।
তাতে কিছুই যায় আসে না।
মানে?
তাতে কিছুই যায় আসে না আমি বলছি।
ও।
কর্নেল চুপ থাকলে পোয়ারো বললেন, তাহলে পাইপ ক্লিনারটার কোনো গুরুত্ব নেই আর কেন ওখানে পড়েছিল তার ডজন খানেক সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ আমার কাছে মজুদ আছে। যাক কেন আপনাকে ডেকেছি সেই প্রসঙ্গে আসি। মিস ডেবেনহ্যাম আপনাকে কোনিয়া স্টেশনে বলেছিল না না এখন নয় পরে, আগে সব শেষ হোক। তারপর এই কথাগুলোর মানে কি কর্নেল?
সেটা আপনাকে জানাতে বাধ্য নই আমি। এটা সম্পূর্ণ একজন মহিলার ব্যক্তিগত ব্যাপার সেটা ওঁকেই বরং জিজ্ঞাসা করে দেখবেন।
সেটা জিজ্ঞাসা করতে উনি উত্তর দেননি।
তাহলে আমিই বা কি করে বলি বলুন?
মিস্ ডেবেনহ্যামও বলেছে এটা তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের।
কেন তার কথা মানছেন না?
কারণ তিনি সন্দেহজনক চরিত্রের মেয়ে।
কি সব বলছেন?
ঠিকই বলছি।
আপনি মিস ডেবেনহ্যাম সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
তিনি যে আর্মষ্ট্রং পরিবারের গভর্নেসের কাজ করতেন সেইটা জেনেছি; তাহলে স্বীকার করেননি কেন?
আপনি ভুল করছেন এমনও তো হতে পারে।
ভুল হয় না আমার। কেন উনি আমার কাছে মিথ্যা কথা বললেন।
আমার এখনও মনে হয় আপনি ভুল করছেন, যাই হোক ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন।
পোয়ারো পরিচারককে আদেশ দেবার ফলে মিস ডেবেনহ্যাম কিচেন কামরায় চারজনের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন।
মঁসিয়ে পোয়ারো আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
হা। আপনি সকালে আমার কাছে মিথ্যে কথা বলেছিলেন কেন সেটাই জানতে চাই। মিথ্যে কথা! কখন?
ডেইজিকে অপরহণ ও হত্যার সময়ে আপনি আর্মষ্ট্রং-এর বাড়িতে ছিলেন আপনি তো বলেননি। উল্টে বলেছেন আপনি নাকি কখনও আমেরিকায়ই যাননি।
মেরী একটু লাল হলেন। তারপর বললেন কথাটা ঠিক।
ওঃ তাহলে স্বীকার করছেন।
ঈষৎ বঙ্কিম হলো মেরীর অধর।
আপনি যখন সব জেনেই ফেলেছেন তখন মিথ্যে কথা বলে লাভ নেই।
তাহলে সকালে মিথ্যে কথাটা বলেছিলেন কেন?
কারণটা খুবই স্পষ্ট।
আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না।
আপনি জানেন না মঁসিয়ে পোয়ারো যে একটি মেয়ের পক্ষে খুবই শক্ত একটি ভদ্রজীবিকা খুঁজে বের করা; তাই যদি এ কথা সবাই জানত যে নিহত শিশুর পরিবারের সাথে আমি যুক্ত তাহলে কোনো ভদ্র পরিবারে বা ভালো প্রতিষ্ঠানে আমার চাকরী বা পেশা কিছুই থাকবে না।
তা কেন? যদি নিরাপরাধ হন?
আপনি নিশ্চয় বোঝেন যে মানুষ গুজবে কান দিতে ভালোবাসে অপপ্রচার যে সাংঘাতিক জিনিষ।
একটা ব্যাপারে একটু সাহায্য করবেন মাদমোয়াজেল?
কি ব্যাপারে?
একটা সনাক্ত সম্পর্কে। আপনি নিউইয়র্কে যে মেয়েটিকে পড়াতেন তিনিই বর্তমানে কাউন্টেস আন্দ্ৰেনী। এটা নিশ্চয় আপনি ধরতে পেরেছেন।
কাউন্টেস আন্দ্রেনী! সত্যি আমি কিন্তু ধরতেই পারিনি। বিয়ের পর তো বিদেশী হয়ে গেছে, হয়ত ওর স্বামী বিদেশী বলেই তবে… অবশ্য একটু চেনা চেনা ঠেকছিল ওর পোশাক আর স্বামীটাকেই লক্ষ্য করছিলাম। মেয়েদের যা স্বভাব, বলে হাসলেন মেরী।
সবই বললেন, সেই গোপন কথাটা তো বললেন না।
না না, সেকথা কিছুতেই বলতে পারব না। বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মেরী।
মেরীর মাথায় কর্নেল হাত রেখে শান্ত করলেন।
আশা করি আর কিছু জিজ্ঞাসা নেই মঁসিয়ে পোয়ারো, আবার দরকার হলে বলবেন।
কর্নেল মেরীকে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ফিরে এসে বললেন, মিস ডেবেনহ্যামের সঙ্গে এই ব্যাপারের কোনো সম্পর্কই নেই, আশা করি আপনি আপনার সীমাবদ্ধতায় থাকবেন। বলে শাসিয়ে চলে গেলেন কর্নেল।
কি প্রচণ্ড অনুমান শক্তি আপনার। সত্যিই আপনার বিশ্লেষণ ক্ষমতা দেখলে হিংসে করতে ইচ্ছে হয়, বললেন ডাক্তার।
এতে আমার কোনো কৃতিত্বই নেই। খানিকটা কাউন্টেস আন্দ্রেনী বলে গিয়েছিলেন আর বাকিটা আন্দাজ।
কাউন্টেস আন্দ্রেনী? মেরী ডেবেনহ্যামের কথা কখন বললেন?
এক গভর্নেসের কথা কাউন্টেস বলেছিলেন না?
তিনি তো মাঝবয়েসী চেহারার বর্ণনা অনুযায়ী মেরী ডেবেনহ্যামের বিপরীত, মিস ডেবেনহ্যামকে আমরা চিনতে পারি এই কারণেই। উনি ভদ্রমহিলার নাম বলেছিলেন শ্রীমতী ফ্রিবভি। নিউইয়র্কে একটি বিখ্যাত দোকানের নাম ডেবেনহ্যাম অ্যাণ্ড ফ্রিবভি। ডেবেনহ্যাম পদবীটা কাউন্টেসের মাথায় ঘুরছিল। উনি তাড়াহুড়ায় বানাতে গিয়ে বলে ফেলেন ফ্রিবভি। সেই জন্যই মিস ডেবেনহ্যামকে খুঁজতে অসুবিধা হল না।
সকলেই কি কিছু কিছু মিথ্যে বলেছেন?
সেটাই চেষ্টা করছি যাচাই করবার।
এই ট্রেনের কোনো না কোনো যাত্রী আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে যুক্ত তাহলেও আর কিন্তু অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এবার আস্তেলিও ফলকারেল্লিকে ডাকা যাক।
আন্তেলিও ফলকারেন্নি চোখে মুখে ভয়ের ছাপ নিয়ে প্রবেশ করলেন।
আমার আর কিছু নতুন করে বলার নেই।
তাই নাকি? অনেক কথাই বলার আছে আমার তো তাই মনে হয়। অন্ততঃ যেগুলো সত্যি। ফলকারেল্লি অস্বস্তি মাখানো দৃষ্টিতে তাকালেন পোয়ারোর দিকে।
সত্যি কথা!
হা। আপনার কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই যদি আপনি সব কিছু খুলে বলেন কারণ আমার সবই জানা আছে।
আপনি যে দেখছি আমেরিকান পুলিশদের মতো কথা বলছেন।
তার মানে আমেরিকান পুলিশদের সাথে আপনার মোলাকাত হয়েছিল?
না না ওরা কোনো তথ্যই পায়নি সে চেষ্টাও অবশ্য করেনি।
আর্মষ্ট্রং মামলায় তাই না। আপনি ড্রাইভার ছিলেন বোধ হয়?
অ্যাঁ। হ্যাঁ।
বিস্ফারিত চোখে তাকালেন পোয়ারোর দিকে। আপনি যখন সবই জানেন তাহলে জিজ্ঞাসা করার অর্থ কি?
এক ঝুড়ি মিথ্যা কথা সকালে বললেন কেন?
আমি চাইনি মঁসিয়ে আমার বর্তমান ব্যবসার ক্ষতি হোক এবং কালকের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমি যে নিজের কামরা থেকে বেরোইনি সেজন্য সাক্ষীর দরকার হলে আমার সহযাত্রী ইংরেজটাই সাক্ষী হবে। আমি ঐ রাশেট হারামজাদাকে খুন করিনি এবং কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না আপনারা।
আপনি এখন আসতে পারেন।
আপনারা আমার বিরুদ্ধে শুধু শুধু চক্রান্ত করছেন। বহুদিন আগেই ওকে মারার দরকার ছিল যদি আমি থাকতাম…।
আপনি এত ভাবছেন কেন? ডেইজিকে আপনি তো আর অপহরণ করেননি।
ডেইজি আহা। তাকে ভুলতে এখনো পারিনি। তার সেই মিষ্টি ডাক যে যেন সাদা গাড়িটায় এসে বসেছে। পুরোনো স্মৃতিতে দু চোখে জলে ভরে যায় ফলকারেল্লির এবং বিদায় নেন।
পোয়ারো সুইডিস মহিলাটিকে ডাকবার আদেশ দিলেন।
গ্রেটা অঁলস এলেন। তিনি আঁকুল হয়ে কাঁদছিলেন।
আপনাকে একটি মাত্র প্রশ্ন করব দয়া করে সত্যি কথাটা বলবেন। ডেইজির দেখাশোনার ভার তো আপনার হাতে ছিল তাই তো?
হা। সকালেই একথা বলতাম কিন্তু ভয়ে বলিনি। ডেইজি এবং ডেইজির মায়ের ব্যবহার সম্পর্কে সমস্ত কথাই বললেন শ্রীমতী অঁলস।
শ্রীমতী অঁলস যাবার পরই মাস্টারম্যান এসে ঘরে ঢুকল। এবং বললেন আর্মষ্ট্রং পরিবারের উনি আদালী ছিলেন এবং নিউইয়র্কের বাড়িতে পরিচারকের কাজ করতেন। আপনারা স্যার টোনিওকে অযথা সন্দেহ করবেন না। ও সারারাত নিজের কামরায় ছিল এবং ও ভীষণ নরম মনের মানুষ। সুতরাং ওর পক্ষে একাজ একেবারেই অসম্ভব।
আর কিছু বলবে?
না স্যার।
এইসব বলার পর মাস্টারম্যান চলে গেল।
বারো জন যাত্রীর মধ্যে নজনই যে আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে যুক্ত। কুক বললেন, একি এ তো তাজ্জব কাণ্ড।
নতুন অতিথিটিকে এবার দেখুন। আমেরিকান সেই গোয়েন্দা শ্রীযুক্ত হার্ডম্যান।
হার্ডম্যান সতর্কভাবে সকলের দিকে তাকাতে তাকাতে এসে বসলেন।
কি হুলুস্থুল কাণ্ড চলছে মশাই, ট্রেন না তো যেন পাগলা গারদ।
পোয়ারো হেসে বললেন, আপনার উপর তো আর্মষ্ট্রং বাড়ির বাগানের পরিচর্যার ভার ছিল। তাই না?
ওদের বাগানই ছিল না।
তবে কি খানসামার দায়িত্বে ছিলেন।
মাথা আমার খারাপ হয়নি।
আর্মস্ট্রংদের সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিল বলুন।
কিছু না।
পরোক্ষ ভাবেও না।
না, তবে ধন্যবাদ জানাতে এবং অভিনন্দন জানাতে এলাম কারণ আপনার প্রতিভা অসাধারণ। ধন্যবাদ।
আমাকে বাদ দিন আমার সঙ্গে ঐ পরিবারের কোনো যোগাযোগই ছিল না। কিন্তু আর দুজন শ্ৰীমতী হার্বাড আর শ্রীমতী স্মিট এদের সঙ্গে। এই রহস্যের সম্পূর্ণ সমাধান কি করতে পেরেছেন আপনি?
বহুক্ষণ আগেই। তাহলে বলছেন না কেন?
সত্যিই আপনারা সবাই অধৈৰ্য্য হয়ে উঠেছেন এইবার বলব। সকলের সামনে এই রহস্যের জট খুলে দেব। হার্ডম্যান আপনি বরং সকলকে এইখানে আসতে বলুন। দুটো সম্ভাব্য সমাধান আছে সেটাই সকলের সামনে পেশ করব।
সবাই খানাকামরায় এসেছেন এবং চুপচাপ ও শান্ত। কিন্তু গ্রেটা অঁলস কেঁদে চলেছেন এবং শ্রীমতী হার্বাড তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
পোয়ারো উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাবৃন্দ আমরা সবাই এখানে সমবেত হয়েছি স্যামুয়েল এডওয়ার্ড রাশেট ওরফে কাসেট্টির মৃত্যু সম্পর্কে তদন্তের জন্য এবং আমি আমার বক্তব্য ইংরেজী ভাষাতেই নিবেদন করব যাতে সকলেই ইংরেজী মোটামুটি বুঝতে পারেন।
এই হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য দুটি সমাধান আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব। কোনো সামাধানটি গ্রহণযোগ্য তার বিচারের ভার পুরোপুরি মঁসিয়ে কুক এবং ডাক্তার কনস্টানটাইনের উপর।
আপনারা জানেন রাশেটের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারে আজ সকালে তাকে ছুরিকাঘাতে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়। কাল সে শেষবারের মতো কণ্ডাক্টরের সাথে কথা বলেছিল রাত বারোটা সাইত্রিশ আন্দাজ। জানতে পারা যায় একটি ঘড়িও তার পায়জামার পকেটে পাওয়া যায় এবং তার থেকে আবিষ্কৃত হয় যে রাত একটা পনের মিনিটে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করে রায় দেন যে বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে তার হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। রাত বারোটা ত্রিশ মিনিট নাগাদ ট্রেন বরফ ঝড়ের কবলে পড়ে আপনারা জানেন। সুতরাং ঐ সময় ট্রেন ছেড়ে বাইরে যাওয়া কারোর পক্ষে সম্ভব নয়।
নিউইয়র্ক ডিটেকটিভ এজেন্সির মিঃ হার্ডম্যান তার জবান বন্দীতে বলেছেন যে কারোর পক্ষে কোচের শেষ প্রান্ত ১৬নং কামরার (মিঃ হার্ডম্যানের) সামনে দিয়ে চলে যাওয়া সম্ভব নয় কারণ তিনি সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছেছি যে হত্যাকারী এই ইস্তাম্বুল ক্যালে কোচের মধ্যেই রয়েছে। এবার বিকল্প সমাধানটি হল খুবই সহজ। মিঃ হার্ডম্যানকে রাশেট সম্ভাব্য শত্রুর বর্ণনা দিয়েছিল কারণ তার মনে মৃত্যুভয় ছিল। এবং এও বলেছিলেন যে তাকে হয়ত দ্বিতীয় রাত্রেই এই ট্রেনে হত্যার চেষ্টা করা হবে।
মিঃ হার্ডম্যানকে রাশেট যা বলেছিল তার অনেক বেশিই সে জানত। ওর শত্ৰুটি বেলগ্রেড অথবা ভিনভোকিতে ট্রেনে ওঠে। কর্নেল এবং ম্যাককুইন প্ল্যাটফর্মে নেমেছিলেন এবং ভুল করে কোচে ঢোকার দরজাটা খুলে রেখে আসেন। কণ্ডাক্টরের একটা উর্দি আর বিশেষ ধরণের চাবি লোকটা যোগাড় করে রেখেছিল। এবং এই চাবি সাধারণত রেলকর্মীদের কাছে থাকে। সুতরাং দরজা বন্ধ থাকলেও তা খোলা যায়। এই চাবি দিয়ে রাশেটের কামরায় আততায়ী যখন ঢোকে তখন সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আততায়ী রাশেটকে হত্যা করে মিসেস হার্বাডের কামরায় চলে যায় মাঝের দরজাটা দিয়ে।
শ্ৰীমতী হার্বাড শুনে সম্মতি জানালেন।
পোয়ারো বলে চললেন, আততায়ী এর পর হাতের কাছে শ্রীমতী হার্বাডের ভোলোটা পেয়ে তার মধ্যেই ছোরাটা ফেলে দেয় এবং তার পোশাকের একটি বোতামও খোয়া যায় মুহূর্তের অসতর্কতার ফলে। তারপর অন্য একটি খালি কামরায় পোশাকটা ছেড়ে ঐ কামরার মহিলা যাত্রীর বাক্সে ঢুকিয়ে দেয় এবং ট্রেন ছাড়বার আগের মুহূর্তে চট করে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ে। হ্যাঁ, যে পথে সে কোচে প্রবেশ করে সেই পথেই।
কিন্তু ঘড়ির ব্যাপারটা! মিঃ হার্ডম্যান বললেন।
রাশেটের ঘড়িতে পূর্ব ইউরোপের সময় নির্দেশ করা আছে যার ফলে সব সময় সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা এগিয়ে থাকে। রাশেট জারব্রেডে এসে ঘড়ির কাটা পিছিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিল। সুতরাং সে খুন হয় সওয়া একটায় নয় সওয়া বারোটায়।
রাশেটের কামরা থেকে একটা বাজতে তেইশ মিনিটে যে স্বর শোনা গিয়েছিল তার ব্যাখ্যাটি কি?
সে স্বর হয় রাশেটের নয় হত্যাকারীর।
সেটা নাও হতে পারে। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হয়ত তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন। যখন তিনি দেখলেন রাশেট মৃত তৎক্ষণাৎ কণ্ডাক্টরের উদ্দেশ্যে ডাক ঘণ্টা বাজান। পরে তার নিজের ভুল বুঝতে পারেন। কণ্ডাক্টর যদি এসে তাকেই হত্যাকারী বলে সন্দেহ করে এই কারণেই তিনি রাশেটের জবানীতে বলেছিলেন কামরার ভেতর থেকে। কণ্ডাক্টর বুঝেছিলেন তাকে প্রয়োজন নেই বলেই ফিরে গিয়েছিলেন।
মাদাম আপনি মনে হয় কিছু বলবেন?
হা নিজের ঘড়ির কাঁটা তো আর ঘোরাতে ভুলে যাইনি?
না মাদাম, আপনার কামরায় লোকটি যখন ঢোকে আপনি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। আপনি আধ ঘুমে তার উপস্থিতি অনুভব করেন ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর দুঃস্বপ্ন চোখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এবং আপনি তখন ঘন্টা বাজান। কোনো হিসাব ছিল না চেতনায় ঘুম, স্বপ্ন এসবের।
রাজকুমারী বললেন, আমার পরিচারিকাটি সে বলেছে আমার কামরায় গভীর রাতে আসার সময় সে দেখেছিল লোকটিকে।
আপনার একটা রুমাল রাশেটের কামরায় পাওয়ার ফলে যে আপনাকে সন্দেহ মুক্ত করতে উল্টোপাল্টা বলেছিল তার আনুগত্যের তারিফ করতে হয়। সে লোকটিকে দেখেছিল ঠিকই ট্রেনে তবে চলার পরে নয়, গভীর রাতে গাড়িটা যখন ভিনভোকিতে দাঁড়িয়েছিল তখনই।
সত্যিই আপনার বিচারবুদ্ধি প্রশংসনীয় মঁসিয়ে, রাজকুমারী বললেন।
না না এটা কোনো প্রকৃত রহস্যের সমাধান নয়। এই ব্যাখ্যা পুলিশ হয়ত মেনে নেবে কিন্তু এতে আমার সায় নেই, বললেন ডাক্তার।
বেশ তাহলে আমি অন্য সম্ভাব্য সমাধানটা জানিয়ে দিচ্ছি, তবে প্রথম সমাধানটি ভুললে চলবে না। বলা যায় না শেষ পর্যন্ত প্রথমটাই হয়ত গ্রহণযোগ্য বলে মনে করবেন আপনারা, বললেন পোয়ারো।
প্রথম দিন কুক খানাকামরায় বসে বলেছিলেন যে নানা দেশ নানা ভাষা আর নানা জাতের মানুষ আছেন এই যাত্রীদের মধ্যে। তখনই আমার মনে হয় একমাত্র ট্রেন বা জাহাজ ছাড়া কোথায় এমনভাবে বিভিন্ন দেশের মানুষ জমায়েত হতে পারেন। শুধুমাত্র আমেরিকাতে একটা সংসার হতে পারে নানা দেশের লোক নিয়ে। একই বাড়িতে থাকতে পারে ইতালিয়ান ড্রাইভার। ইংরেজ গভর্নেস, সুইডিস নার্স, ফরাসী পরিচারিকা ইত্যাদি। বিষয়টি একটু ভাবতেই আর্মষ্ট্রং পরিবারে কোনো ভুমিকা কাকে দেওয়া যায় সেই বিষয়ে নির্ভুল অনুমান করতে পেরেছি।
প্রত্যেক যাত্রীরই সমস্ত অদ্ভুত তথ্য পেলাম ম্যাককুইনের সাথে দ্বিতীয় বার যখন মিলিত হলাম। উনি অদ্ভুত একটি মন্তব্য করলেন, রাশেটের কামরায় একটুকরো আধপোড়া কাগজ পাওয়া গেছে। উনি সেটা শুনে বিস্মিত হলে বললেন কিন্তু সেটা তো…মানে তার পক্ষে খুবই বোকামীর কাজ হয়েছিল। ম্যাককুইন তার কথাটা ঘোরাতে গিয়ে প্রায় বলেই ফেলেছিলেন যে সেটা তো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল তার মানে তিনি চিঠিটা সম্পর্কে জানতেন। অর্থাৎ হয় তিনি বা তার সহযোগী হত্যাকারী।
মাস্টারম্যান বলেছিল যে তার মনিব ট্রেনে যাতায়াতের সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে থাকেন। অন্যান্যবার সত্যি হলেও গত রাত্রে যে প্রাণহানির আশঙ্কায় ঘুমের ওষুধ না খাওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা তার বালিশের তলায় গুলিভরা পিস্তল পাওয়া গিয়েছিল। তবে রাশেট গতরাত্রে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল অজান্তে। ঘুমের ওষুধ কে তাকে খাওয়াতে পারে? যে কোনো একজন হয় মাস্টারম্যান নয়ত ম্যাককুইন।
মিঃ হার্ডম্যানের পরিচয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না কিন্তু রাশেটকে বাঁচাতে তার অন্তরিকতা সম্বন্ধে। যদিও রাশেটকে বাঁচানোর চেষ্টা করতেন তবে নিশ্চয় তিনি তার কামরাতেই থাকতেন অথবা এমন কোনো জায়গায় থাকতেন যাতে তীক্ষ্ণ নজর রাখা যায় বা মঁসিয়ে কুককে বলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেন। তবে তার সাক্ষ্য থেকে এটুকু প্রমাণ হয় যে হত্যাকারী কোচের বাইরের কেউ নয়।
কর্নেল আর মেরী ডেবেনহ্যাম যে পরস্পর পরস্পরের খুব কাছাকাছি এবং ওদের অন্তরঙ্গতা আমার চোখে ধরা পড়ে যায়। তা সত্ত্বেও ওরা না চেনার ভান করে ছিলেন, দুজনে। দুজনকে সেটা বুঝতে একেবারেই অসুবিধা হয়নি। রাশেট পুলিশকে ফাঁকি দিলেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা আর্মষ্ট্রং পরিবারে যুক্ত ছিলেন তারা রাশেটকে চরম শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং চমৎকার ভাবে ছকে ফেলেন তারা।
ক্ষতচিহ্নগুলোর কথা ধরলে প্রত্যেকেই একবার করে আঘাত করেছিলেন রাশেটকে। সেইজন্যই কোনো আঘাত সমান নয়। ছোরাকেই অস্ত্র হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল যাতে সকলেই ব্যবহার করতে পারেন। অনেকে মিলে চিঠিগুলোও লিখে ছিলেন তবে ম্যাককুইন যে চিঠিগুলো আমাকে দেখান ওগুলো সম্পূর্ণ ভুয়ো এবং ধোঁকা দেবার জন্যই লেখা হয়েছিল। ম্যাককুইন আসল চিঠিগুলি নষ্ট করে ফেলেছিলেন। সম্পূর্ণ আকস্মিক ভাবেই সেই চিঠির আধপোড়া অংশ আমি পাই। হার্ডম্যানের আততায়ীর বর্ণনাটিও আজগুবি গল্প, যা কারোর ক্ষেত্রেই খাটে না আর ছদ্মবেশে থাকলে সকলের সম্বন্ধেই খাটে।
আমার অনুমান রাশেট গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হবার পর শ্রীমতী হার্বাড আর রাশেটের মাঝের কামরার দরজা দিয়ে যাত্রীরা একে একে মেরে আসে, তবে–কার আঘাতে মৃত্যু হয় সেটা বলা শক্ত।
সবই পরিকল্পনা মাফিক হবার পর নিজেরা আলোচনা করে নিয়ে এই হত্যার ব্যাপারটা জটিল করার জন্য কর্নেলের পাইপ ক্লিনার এবং রাজকুমারীর রুমাল ফেলে রেখে আসা হয় অকুস্থলে। কারণ এতে কোনো ক্ষতি নেই যেহেতু এদের সাথে আর্মস্ট্রং পরিবারের সাথে কোনো মতোই সম্পর্ক থাকতে পারে না। রাজকুমারীর শারীরিক অক্ষমতা নিয়েও দুবার ভাবতে হবে পুলিশের। এক রহস্যময়ী লাল কিমানো পরা নারীকেও হাজির করা হল এবং সেটা দেখতে কণ্ডাক্টর, মিস ডেবেনহ্যাম আর ম্যাককুইন ছাড়া আমাকেও দেখতে বাধ্য করা হল। আমারই বাক্সে কিমানোটা পাওয়া গেল। তবে সঠিক ভাবে বলতে পারছি না কিমানোটা কার। তবে মনে হয় কাউন্টেস আন্দ্রেনীর। তার জিনিষপত্রে গাউন আছে বটে তবে ড্রেসিং গাউন নেই।
আর্মষ্ট্রং পরিবারের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আমি জেনে যাবার ফলে ম্যাককুইন সবাইকে সতর্ক করে দেন এবং খুব বিচলিত হয়ে পড়েন কাউন্টেস আন্দ্ৰেনী। তিনি ব্যাগ লেভেল এবং পাসপোর্টে নাম বদল করলেন হেলেনা থেকে এলেনা। আপনারা বোধহয় আশাও করতে পারেননি সকলকে একসঙ্গে এইভাবে অভিযুক্ত করব। কণ্ডাক্টর মিশেল ছাড়া এই কাজ আপনাদের পক্ষে কখনই সম্ভব হত না। রাশেটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা সংখ্যায় বারো। কর্নেল জবানবন্দীতে বলেছিলেন আইন আদালতের আশ্রয় নেওয়াই ভালো। অর্থাৎ জুরিপ্রথার গুণকীর্তন করেন। ইংল্যাণ্ডে সাধারণত বারোজন সদস্য নিয়ে জুরি গঠিত হয়। মামলার রায়দানের জন্য আমাকে আর রাশেটকে বাদ দিয়ে, মিশেলকে নিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়ায় তেরো। কিন্তু তেরো সংখ্যাটা অপয়া ভাবার জন্য একজন এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি হলেন কাউন্টেস আন্দ্রেনী। কাউন্ট বলেছিলেন তাঁর স্ত্রী সারারাত কামরায় ছিলেন এ কথায় অবিশ্বাস করিনি। স্ত্রীর বদলে তিনিই আঘাত করে আসেন।
দীর্ঘদিন সুনামের সাথে চাকরী করার পরও এ কাজ মিশেল করল কেন? তাকে তো ঘুষ দিয়েও বশ করা যায় না তাহলে কি মিশেল আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে যুক্ত? যদি তা হয় তবে কিভাবে? যে মেয়েটি অন্যায় ভাবে পুলিশের কাছে সন্দেহজনকভাবে মনোকষ্টে আত্মহত্যা করেছিল তখনই মনে পড়লে যে মিশেল হয়ত সেই হতভাগিনীর পিতা এবং তখনই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে উঠল। এবং ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসকেই খুনের সম্ভাব্য জায়গা হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল এবং কিভাবে? মনে হয় কর্নেল আবাথনট আর্মষ্ট্রং-এর বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে যুদ্ধের সময় হয়ত কাজ করে থাকবেন। ইল্ডগ্রেদ স্মিটকে ভালো রাঁধুনি হিসাবে মনে হয়েছিল আমার, তবে কি আর্মষ্ট্রং-এর বাড়িতে রান্নার কাজ করত?
কথার ছলে তাকে জিজ্ঞাসা করি আপনি খুব ভালো রান্না জানেন তাই না। শ্রীমতী স্মিট এ কথায় সায় দেন। যাদের কাছেই তিনি রান্না করেছেন সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। সুতরাং পরিচারিকার কাজ তাতে রান্নার প্রশংসা পাবার সুযোগ তার থাকার কথা নয়।
মিঃ হার্ডম্যানের প্রেমিকা ছিল সেই ফরাসী মেয়েটি। শুধু এটুকু ছাড়া কোনো যোগাযোগ ছিলনা আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে। ওঁর কাছে বিদেশিনীর কথা তোলায় ওর চোখ জলে ভরে যায়। তবে উনি এমন ভান করেছিলেন যে বরফের জন্য চোখ ধাঁধিয়ে গেছে।
এই হত্যাকাণ্ডের রহস্যময় নাটকে শ্রীমতী হার্বাডের ভূমিকা সবচেয়ে কঠিন। এই ভূমিকায় তিনি অতুলনীয় তিনিই রাশেটের পাশের কামরায় ছিলেন। তিনি এও জানতেন যে রাশেট খুন হলে সন্দেহ তার দিকেই পড়বে তাতে তিনি পিছু না হঠে আগাগোড়া চমৎকার অভিনয় করে গেছেন। কারণ তিনি প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী শ্রীমতী আর্মষ্ট্রং-এর মা।
সত্যিই আপনি বুদ্ধিমান। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলে উঠলেন শ্রীমতী হার্বাড। আমার আরো ভালো করে খেয়াল করা উচিত ছিল। আপনি তো সবই বোঝেন। কিন্তু এটা নিশ্চয় বোঝেন নিউইয়র্কের একটি সকাল কি ভয়ঙ্কর হয়েই না ধরা দিয়েছিল কয়েকজন নিরাপরাধ মানুষের জীবনে। আমি দুঃখ যন্ত্রণায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম মঁসিয়ে, শুধু আমি নই সমস্ত আর্মস্ট্রং পরিবারে যারা ওই সময় যুক্ত ছিল তারা সকলেই। কর্নেল আবাথনট-জনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আমার জীবন রক্ষা করেছিলেন যুদ্ধের সময়। স্বৰ্গতজন আমরা বড় দুঃখে শপথ নিয়েছিলাম, বললেন শ্রীমতী হার্বাড। যে কাসেট্টিকে চরম দণ্ড দেব। বারোজন ছিলাম আমরা দলে, না না এগারোজন, ফ্রান্সে তখন সুশানের বাবা মিশেল। আমরা প্রথমে ঠিক করি লটারিতে যার নাম প্রথমে উঠবে সেই যাবে কাসেটিকে চরমদণ্ড দিতে। শেষে মত বদল হয়। আন্তেলিও প্রথম এই প্রস্তাব করে। মেরী সেটাকে ছকে ফেলে। ম্যাককুইনের সাহায্যে, ম্যাককুইন আমার মেয়ের বন্ধু স্থানীয় ছিল।
আমরা দীর্ঘদিন মাথা খাটিয়েছিলাম। রাশেটের সম্বন্ধে খোঁজ হার্ডম্যানের চেষ্টায় মেলে। হেক্টর আর মাস্টারম্যান বুদ্ধি খাঁটিয়ে চাকরী যোগাড় করে নেয়। তারা মিশেলের সাথে যোগাযোগ করে। কর্নেল বারোজনের দল যাতে হয় চেয়েছিলেন, তবে ছোরাছুরি ওঁর পছন্দ ছিল না। কিন্তু অন্য উপায় না থাকতেই এই ব্যবস্থাই পাশ হয়। মিশেলের একমাত্র সন্তান ছিল সুশান এবং খুশি মনে এই সাহায্যে ও রাজী হয়। হেক্টর আমাদের খবর দেয় যে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে কাসেট্টি ওরফে রাশেট ফিরছে। আমাদের কপাল ভালো মিশেলও ওই লাইনে কাজ করে। তাই এই সুযোগ আমরা হারাতে চাইনি এবং ট্রেনে এই সময় বাইরের লোকজন থাকার সম্ভাবনা কম ছিল।
হেলেনাকে জানাতে ওঁর স্বামী না শোনার ফলে রুগুলফ ও এল ওঁর সঙ্গে। এমনই ব্যবস্থা হেক্টর করেছিল যাতে মিশেলের রাতে ডিউটি থাকে এবং রাশেট সেদিনই টিকিট কাটে। আমরা পুরো ইস্তাম্বুল কোচটাই দখল করাবার চেষ্টা করি অবশ্যই আলাদা নামে। একটা কামরা রেল ডিরেক্টরের নামে থাকায় পাওয়া যায় না। মিঃ হ্যারিন একটা ভুয়া নাম। আমরা চাইনি অন্য কোনো লোক হেক্টরের কামরায় থাকুক তাই ভুয়ো নামে বার্থটা রিজার্ভ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আপনি এলেন… এবার আপনার সবকিছুই জলের মতে পরিষ্কার মঁসিয়ে পোয়ারো তবে আমার অনুরোধ আমাকে সব দায় মাথা পেতে নিতে দিন এবং প্রয়োজনে বারো বার রাশেটকে আঘাতে আমি প্রস্তুত ছিলাম। শুধু আমার নাতনি নয় আমার মেয়ে এমন কি অনাগত শিশুকেও সে হত্যা করেছিল। আমার জামাই জন আর সুশানের কথা ভুলে যাবেন না মঁসিয়ে। ডেইজি…
এই মধুর পৃথিবীর আলো দেখতে আরও কত শিশুকে দেননি রাশেট ভবিষ্যতেও দিত না। মিশেলের মনের অবস্থাটা ভাবুন। মেরী আর কর্নেল ওদের ভবিষ্যতও আমি নষ্ট হতে দেব না..ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ মুক্তকণ্ঠে রাশেটকে ধিক্কার জানিয়েছিল। আইন শাস্তি দেবার চেষ্টা করেছিল পারেনি কিন্তু আমরা তা পেরেছি। এটা ছিল আমাদের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যও। বয়স এবং শরীর নয় ভেঙ্গে গেছে আমার, আপনি আমাকে অভিযুক্ত করে কাঠগোড়ায় তুলুন। কিন্তু এতগুলো নবীন জীবন নষ্ট করে দেবেন না নিষ্ঠুর হবেন না।
সেই কণ্ঠস্বর যা একদা পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে কত শত মানুষকে হাসাতো কাঁদাতো ভালোবাসতে শেখাতে নিউইয়র্কের মানুষ যা শুনে পাগল হয়ে যেত। অভিভূত হয়ে যেত। পোয়ারো বন্ধুর দিকে তাকালেন।
মঁসিয়ে কুক আপনি কি বলেন?
কুক বললেন, প্রথম সমাধানটাই থাক। আমরা বরং সেটা পুলিশ এলে জানিয়ে দেব। ওটাই সঠিক সমাধান হিসাবে গ্রহণ করতে চাই। ডাক্তার আপনার কি মত? ডাক্তার কনস্টানটাইন বললেন, আমারও ঐ একই মত। পোয়ারো স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
বেশ তবে তাই হোক।