ওর স্বভাবই হলো, কোনো চ্যালেঞ্জ এলে সমস্ত শক্তি আর বুদ্ধি নিয়ে সেটার মুখোমুখি হওয়া। পিছিয়ে আসার ছেলে সে নয়। এখন তার মনে হচ্ছে, জীবনে
এতোবড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সে খুব কমই হয়েছে।
৩
লাঞ্চ টেবিলটা পরিষ্কার করে সরিয়ে নেয়া হলো। তার জায়গায় এনে অর্ধচন্দ্রের আকারে গোল করে রাখা হলো সুইভেল চেয়ার।
মাঝখানের চেয়ারটায় বসলো হ্যারিস বেকার, অনেকটা উপস্থাপকের ভূমিকা নেবে সে। কিংবা বলা যায় গৃহকর্তার। তার একপাশে নেলি, আরেক পাশে মড়ার খুলি। কিশোর বসেছে একমাথায়, শিকারী কুকুরের পাশে। অন্য মাথায় ভারিপদ।
জ্বলে উঠলো আর্কলাইট। কিশোরের মনে হলো, তার ওপর এসে পড়লো আধ ডজন খুদে সূর্যের রোদ। খুব কমই খেয়েছে সে। মাত্র একটুকরো মুরগীর মাংস আর একচামচ পট্যাটো সালাদ। নার্ভাস হয়ে গিয়েছে বলে খায়নি তা নয়। অন্য চিন্তায় ব্যস্ত তার মন, খাবারের কথা ভাবার সময় নেই যেন। ভ্রাম্যমাণ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে যখন শুটিঙের নির্দেশ দিলেন সাইনাস, তখনও গভীর চিন্তায় ডুবে রইলো সে। যে করেই হোক কুইজ শোতে জিততে হবে তাকে। প্রায় কথাই বলছে না কারো সাথে।
অন্যেরা সবাই গল্প করছে। কিন্তু কিশোর তাতে যোগ দিলো না। সে শুধু শুনছে। মড়ার খুলি, ভারিপদ, আর শিকারী কুকুরের ব্যাপারে অনেক কথাই জেনে ফেলেছে, ওদের আলোচনা থেকে। কিন্তু ওরা তার ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি এখনও।
গুড ইভনিং, হাসি হাসি গলায় কললো বেকার। শো শুরু হলো।
নড়েচড়ে বেড়াতে লাগলো তিনটে টেলিভিশন ক্যামেরা। ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সাইনাস। নানারকম কাজ করতে হচ্ছে প্রায় একই সঙ্গে।
কয়েকজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে নতুন করে আবার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আপনাদের, ক্যামেরার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো বেকার। কয়েক হপ্তা ধরেই এদের ছোটবেলার অভিনীত ছবি দেখছেন আপনারা। হাজার হাজার চিঠি লিখেছেন আমাদের কাছে। জানতে চেয়েছেন ওরা কে কোথায় কেমন আছে। আপনাদের অনুরোধেই আজ ওদেরকে আমাদের স্টুডিওতে হাজির করেছি।
এক মুহূর্ত থামলো বেকার। রোদেপোড়া মুখে বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠলো তার দাঁতের সারি। পাগল সংঘের পাগল এরা সবাই।
বলে যেতে লাগলো সে, পাগলদের একজনকে, যাকে শজারুকাঁটা বলে চেনেন দর্শকরা, তাকে হাজির করতে পারেনি বলে কতোখানি দুঃখিত। দুঃখটা অবশ্যই হাসিমুখে প্রকাশ করলো সে। টেলিভিশনের ঘোষক তাদের অনুষ্ঠান যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে কয়েক মিনিট দর্শকরা দেখতে পাননি বলে যেমন দরাজ হাসি হেসে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করে অনেকটা সে-রকম ভাবে। শজারুকাঁটাকে খুঁজে রে করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হয়েছে, কলহে বেকার, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ক্যালিফোর্নিয়ায় নেই সে। কোথায় গেছে খুঁজেও ব্বে করা যায়নি।
হয়তো জেলে গেছে, মড়ার খুলি বললো।
মৃদু হেসে তার কথা এড়িয়ে গেল বেকার। এক এক করে দর্শকদের সামনে নিজেদের পরিচয় দিতে অনুরোধ করলো পাগলদের।
নেলি বললে প্রথমে, আমি ছিলাম বটিসুন্দরী। কিন্তু সেটা অনেক দিন আগে। এখনও আমি শুধুই নেলি।
কি যে বলো, তার দিকে তাকিয়ে হাসলো বেকার। এতে বিনয়ের দরকার নেই। এখনও তুমি সুন্দরী, রং আগের চেয়ে বেশি। হরি মতো সুন্দর।
নেলি হাসলো না। এখন আর আগের মতো বোকামি করি না আমি। বরং বুদ্ধিমত্তার জন্যে প্রশংসাই পাই।
বেকারের ফিকফিক হাসিটা কেমন শূন্য শোনালো কিশোরের কানে। চেয়ারে হেলান দিলো সে। ক্যামেরার চোখ ছাড়িয়ে তাকালো ইলেকট্রিশিয়ানদের দিকে, যারা কিছু জটিল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের মাঝেই রয়েছে রবিন আর মুস। কিশোর জানে, কোনো ক্যামেরাই এখনও তার দিকে তাকায়নি। কারণ নেলির পর পরিচয় দেয়ার পালা আসবে মড়ার খুলির। দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে, চোখ টিপলো সে।
ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সে যা-ই বলুক, যাই করুক, ওরা যেন অবাক না হয়। রবিনের দৃষ্টিই বুঝিয়ে দিলো, সে ইশারাটা ধরতে পেরেছে।
সামান্য ডানে সরলো কিশোরের নজর। আরেকটা পরিচিত মুখ চোখে পড়লো। অ্যালউড হোফার। সাউন্ড স্টেজের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে লম্বা দণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা আর্ক লাইটের দিকে। আলোগুলো এখন ব্যবহার হচ্ছে না।
আমি ছিলাম মাথা কামানো, পরিচয় দিচ্ছে মড়ার খুলি। বোকার ভাণকরতাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেকারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, খুব একটা বদলেহি বলে কি মনে হয় আপনার?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাসিমুখে পাল্টা প্রশ্ন করলো বেকার, তোমার নামই ছিলো মড়ার খুলি, তাই না?
হ্যাঁ। তবে আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, বোকর ভাণ করে থাকতাম বলেই আমি বোকা নই। আসলে ভালো অভিনেতা। বুদ্ধি বেশি।
তার পর পরিচয় দিলো শিকারী কুকুর, এবং তারও পরে ভারিপদ। এমন শুকনো গলায় নিজেদের উপাধি বললো, যেন বহুবার এক কথা বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে গেছে।
শিকারী কুকুর।
ভারিপদ।
ভারিপদকে নাড়া দিয়ে কিছুটা ভেজানোর চেষ্টা করলো যেন বেকার, কেন, তোমাকে ভারিপদ বলা হতো কেন?
কারণ ওই নামেই আমাকে ডাকতো সবাই।
তাতো ডাকতো। কিন্তু কেন?
কারণ ক্রিষ্টে তাই লেখা ছিলো, ডাকতে বলা হয়েছে।