গুড। এখানে একটা পুনর্মিলনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে, মড়ার খুলি বললো। লাঞ্চের পর আমরা সবাই বসে পুরনো দিনের কথা আলোচনা করবো, কিভাবে কি কি মজা করেছি আরা, এ সমস্ত। তাই তো?
আবার মাথা ঝাঁকালো কিশোর।
তোমাদের কাছে মজার হতে পারে, আমার কাছে ছিলো না, ভাবলো কিশোর। তবে কিছুই বললো না সে।
আর আমাদের ওই প্রিয় পরিচালক, বেকারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা চুলওয়ালা মানুষটাকে দেখালো মড়ার খুলি, আমাদের এই আলোচনা টেপ করে নেবেন। কুইজ শোর আগে টেলিভিশনে দেখানোর জন্যে।
কারে ওপর দিয়ে ফিরে তাকালো কিশোর। অবাক হয়ে ভাবলো, কেন প্রথমেই মানুষটার নাম মনে করতে পারেনি? নাম আর চেহারা তো সাধারণত সে ভোলে না। একটা কথা অবশ্য ঠিক, অনেক বদলে গেছেন রাফায়েল সাইনাস। পাগল সংঘের সবার চেয়েও বেশি বদলেছেন। লম্বা, ছিপহেপে একজন প্রাণবন্ত মানুষ, কথার চাবুক হেনে যিনি চোখের পলকে ঠাণ্ডা করে ফেলতেন দুর্দান্ত বেয়াড়া ছেলেগুলোকেও, সেই মানুষের এ-কি হাল হয়েছে! বৃদ্ধ, কুঁজো, বিধ্বস্ত!
বেশ, বলে যাচ্ছে মড়ার খুলি, এখন আমাদের ভেবে দেখতে হবে, কেন আমরা টেলিভিশনের সামনে যাবো শুধু শুধু? যদি কিছু না-ই দেয়? বসে যে আলোচনা করবো তার জন্যেও পয়সা দিতে হবে আমাদেরকে। ঠিক আছে?
এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকালো সে। সবাই মাথা ঝাঁকালো, কিশোর বাদে।
তুমি কি বলো? ভুরু কুঁচকে কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো সে।
দ্বিধা করছে কিশোর। ভাবছে। মড়ার খুলির পরামর্শ মেনে নেয়ার অর্থ তাকে দলের নেতা হিসেবে স্বীকার করে নেয়, যেটা কিছুতেই করতে রাজি নয় কিশোর। কারণ ছোটবেলায় এ ছিলো দুষ্ট ছেলেদের সর্দার, মোটুরামকে কষ্ট দেয়ার বেশির ভাগ শয়তানী বুদ্ধিই তার মাথা থেকে বেরোতো।
কারো কর্তৃত্ব মানতে পারেনা কিশোর, এটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। তবে একটা কথা এখন স্বীকার না করেও পারছে না, মড়ার খুলির কথায় যুক্তি আছে। টেলিভিশনে যদি তাদেরকে দর্শকদের সামনে হাজির করতে চায় টিভিওয়ালারা, তাহলে কেন পয়সা দেবে না? বিনে পয়সায় কেন কাজ হাসিল করবে?
মাথা ঝাঁকালো কিশোর।
মুখে আঙুল পুরে জোরে শিস দিয়ে উঠলো মড়ার খুলি। হাত নেড়ে ডাকলো, এই বেকার; এদিকে আসুন।
কিশোর ভেবেছিলো এই আচরণে নিশ্চয় মাইন্ড করবে বিজ্ঞাপন ম্যানেজার, মুখ কালো করে ফেলবে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে করলো না। বিন্দুমাত্র মলিন হলো চাঁদের উজ্জ্বলতা। এগিয়ে এলো। পোষা বৃদ্ধ কুকুরের মতো তার পিছে পিছে এলেন সাইনাস।
কি চাও? খুব ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলো বেকার।
কাটা কাটা বাক্যে পরিষ্কার করে তাকে বললো মড়ার খুলি। আলোচনার জন্যে তাদের প্রত্যেককে একশো ডলার করে সম্মানী দিতে হবে। সেটা করমুক্ত হতে হবে, এবং নগদ।
একটুও মলিন হলো না চাঁদের ঔজ্জ্বল্য, তবে সামান্য একটু কোঁচকালো ভুরু দুটো। তা পারবে না। এমনিতেই লাঞ্চের জন্যে অনেক খরচ করে ফেলেছে স্টুডিও। তাছাড়া প্রত্যেকের জন্যেই একটা করে দামী সুভনিরের ব্যবস্থা করেছি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে।
কি রে উপহার? জিজ্ঞেস করলো নেলি।
কতো দাম? জানতে চাইলো মড়ার খুলি।
এটা আমি এখন কলবো না, হেসে বললো বেকার, গোপন রাখব। সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে। তবে রেখেছি, এটা ধরে নাও, বলে রান্নাঘরের দরজার দিকে দেখালো সে। আর পেলে খুব খুশি হবে, তা-ও বাজি রেখে বলতে পারি। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললো, তবে, আলোচনার জন্যে একটা পয়সাও দিতে পারবো না, একথা আবারও বলে দিচ্ছে।
বেশ। টাকা না পেলে আমরাও আলোচনায় বসছি না।
ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলো বেকার। কিন্তু কোনো কথা শুনতে রাজি নয় মড়ার খুলি। তার এক কথা, টাকা ছাড়া কিছু করবে না।
হাসি মুছলো না বেকারের মুখ থেকে, তবে তার কণ্ঠের মোলায়েম ভাবটাও আর রইলো না। দেখো, ব্ল্যাকমেল করছো তোমরা! ব্যাকমেল।
বেশ, করছি, হাসিটা ফিরিয়ে দিলো মড়ার খুলি। কিশোর দেখলে নেলি, ভারিপদ, এমনকি শিকারী কুকুরও হাসছে। তবে আলোচনায় বসাতে হলে টাকা আপনাকে দিতেই হবে।
সাথে সাথে কিছু বললো না বেকার। ভাবছে।
কিশোরও ভাবছে। অবাক হয়েছে সে। পাগল সংঘের যে চেহারা এতোদিন ছিলো তার মনের পর্দায়, সেটা দূর হয়ে গেল আজ। এরা সবাই আজ অন্য মানুষ। সবাই বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে, স্বার্থ ছাড়া কথা বলে না। কঠোর বাস্তবকে বুঝতে শিখেছে, শিখেছে টাকার জন্যে কিভাবে লড়াই করতে হয়।
কিন্তু কথা হলো, একশো ডলারের জন্যেই যদি এভাবে লড়াই করে, বিশ হাজার ডলারের জন্যে কি করবে? হায়নার মতো কামড়া-কামড়ি শুরু করে দেবে না! ওদের কাছ থেকে টাকাটা বুদ্ধির জোরে ছিনিয়ে নিতে হলে কতোটা সর্তক হয়ে এগোতে হবে, বুঝতে পেরে কিছুটা দমেই গেল কিশোর। হারিস বেকারের কথা থেকে মনে হয়েছিলো, কিশোর আসবে, আর টাকাটা নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, মোটেও ওরকম সহজ নয় ব্যাপারটা।
পাগলদের ওপর আগের সেই ঘৃণাটা আর নেই এখন কিশোরের, এটা বুঝে আরও অবাক হলো। এই মুহূর্তে বিশ্বাসই করতে পারছে না এরাই কয়েক বছর আগে ছিলো একেকটা গর্দভ, বোকার হদ্দ,তাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। প্রতিশোধের ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে যতোই দূর হয়ে যাচ্ছে কিশোরের, বাড়ছে প্রতিযোগিতায় জেতার ইচ্ছে।