তিন গোয়েন্দাকে টেবিলের মাথার কাছে নিয়ে গেল বেকার। ওখানে কালো চুলওয়ালা খুব সুন্দরী এক তরুণীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তিনজন তরুণ।
কিশোরকে এগোতে দেখে কথা বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালো ওরা।
কিশোরও তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। অনেকগুলো বছর ধরে ওদের চেহারা তার মনের পর্দায় ছিলো উজ্জ্বল? মড়ার খুলি-ডিমের মতো সাদা চকচকে মাথা, মুখে বোকা হাসি, সোজা কথায় গর্দভ। ভারিপদের আপেলের মতো টকটকে গোল মুখ, অস্বাভাবিক বড় পায়ের পাতা, হাতের তালুও স্বাভাবিক নয়, রোগা, পাতলা শরীর। শিকারী কুকুরের মুখটা অনেকটা কুকুরের মুখের মতোই লম্বাটে, প্রায় সারাক্ষণ হাঁপায়, জিভ বেরিয়ে পড়ে মাঝে মাঝে, বিষণ্ণ চোখ দুটো দেখে মনে হয় এই বুঝি কেঁদে ফেললো। বটিসুন্দরীর সুন্দর চোখা চেহারা, কপালের ওপরের চুল সমান করে কাটা।
ওই চারজনই দাঁড়িয়ে আছে এখন, কিন্তু একেবারে অন্য মানুষ। কিশোরের মনের পর্দায় যে ছবি আঁকা রয়েছে তার সঙ্গে এখনকার ওদের কোনো মিল নেই।
সুদর্শন এক তরুণ, চামড়ার জ্যাকেট গায়ে, সোনালি চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে, কান দেখা যায় না। হাত তুলে হেসে বললো, এইই যে, তোমাকেও গলায় দড়ি দিয়ে টেনে এনেছে তাহলে।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। তাকালো ছেলেটার কাউবয় বুটের দিকে। ছয় ফুট লম্বা শরীরের তুলনায় জুতো ছোটই বলতে হবে, তারমানে সে ভারিপদ নয়। শিকারী কুকুরও নয় সে। তার পাশে দাঁড়ানো তরুণের মুখটা লম্বাটে, যদিও জিভ বের করে নেই, আর চোখেও নেই আগের বিষণ্ণতা
চামড়ার জ্যাকেট আর হাতে-তৈরি বুট পরা বুদ্ধিমান দেখতে হোকরাই তাহলে মড়ার খুলি?
অন্য দুই পাগলের দিকে তাকিয়েও মাথা ঝাঁকালো কিশোর। নীরবে দেখলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ভারিপদ আর শিকারী কুকুরকে চিনে নিতে অসুবিধে হলো না।
শরীরের তুলনায় এখনও বড়ই রয়েছে ভারিপদের পায়ের পাতা আর হাতের তালু, শরীর আগের মতো রোগাটে না হলেও বেশ পাতলা। বেঁটে। তবে আপেলের মতো গোলগাল মুখটা বদলে অন্যরকম হয়ে গেছে। তার লাল লাল গাল আর হাসি হাসি চোখ দেখে রকি বীচ সুপারমার্কেটের সেলসম্যানগুলোর কথা মনে পড়ে গেল কিশোরের।
শিকারী কুকুরকে লাগছে তরুণ ব্যবসায়ীর মতো। তার বাদামী রঙের চুল ছোট করে হাঁটা। শার্টের গলার কাছ থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত একটা বোতামও খোলা নেই। শার্টের কাপড়ও বেশ ঝলমলে, উজ্জ্বল রঙের। একে দেখে এখন বিশ্বাস করাই কঠিন একসময় সে ছিলো কাঁদো কাঁদো চেহারার, পাগল সংঘের বোকা শিকারী কুকুর।
সব শেষে সুন্দরী মেয়েটার দিকে ফিরলো কিশোর। চমৎকার ফন স্যুট পরা। পানের মতো মুখ, গভীর নীল চোখ, ভারি পাপড়ি। এই মেয়েটাই ছিলো তার উদ্ধারকারিণী বটিসুন্দরী, কিন্তু স্টুডিওর বাইরে দেখলে তাকে চিনতেই পারতো না। রাস্তায় দেখলে তো নয়ই। বয়েস কতোটা বদলে দেয় মানুষকে!
হাসলো মেয়েটা। তুমি আসায় খুব খুশি হয়েছি, কিশোর। তোমাকে শুধু কিশোর বলে ডাকলাম, কিন্তু মনে কররানি তো?
না, মোটুরাম বলে না ডাকায় খুশি হয়েহে কিশোর। আমাকে শুধু নেলি বলে ডাকবে।
আস্থা। ওদের সঙ্গে রবিন আর মুসার পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে ফিরলো কিশোর। বেকার আর টিভি ক্যামেরার পাশে দাঁড়ানো আরেকজন লোকের সাথে কথা বলছে দুজনে। সাদা চুলওলা লোকটাকে চেনা চেনা লাগল কিশোরের। কিন্তু মনে করতে পারলো না, কে।
যাক, আমরা সবাই যখন এলাম, হাত বাড়িয়ে কিশোরের বাহু ধরে তাকে দলের ভেতরে টেনে নিলো মড়ার খুলি, একটা পরামর্শ আছে আমার। আমাদের প্রত্যেকের জন্যেই ব্যাপারটা জরুরী।
কিন্তু সবাই তো আসেনি এখনও, মনে করিয়ে দিলো নেলি। শজারুকাঁটা বাকি আছে।
ও আসবে না, জানালো ভারিপদ।
কেন? কিছুটা হতাশই মনে হলো নেলিকে।
হতাশ কিশোরও হয়েছে। পাগল সংঘের ওই একটিমাত্র ছেলেকে সে পছন্দ করতো, বটিসুন্দরীর চেয়েও বেশি। বাচ্চা পেয়ে তাকে কখনও খেপানোর চেষ্টা করেনি শজারু, কষ্ট দেয়নি।
কি জানি, কাঁধ ঝাঁকালো শিকারী কুকুর। হয়তো খুঁজে পায়নি। কিংবা আসতে রাজি না।
তারমানে বাকি সবাই আছি আমরা, মড়ার খুলি বললো। এবং এসেছি একটা উদ্দেশ্যে। চামড়ার জ্যাকেটের পকেট চাপড়ালো সে। টাকা। তাই না?
হ্যাঁ, দ্বিধা করে বললো শিকারী কুকুর। তার যেন সন্দেহ রয়েছে এ-ব্যাপারে।
হ্যাঁ, বললো ভারিপদ, তার সন্দেহ নেই, টাকার জন্যেই এসেছি আমরা।
নেলিও মাথা ঝাঁকালো।
তাই না? ঠিক বলিনি? কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালো মড়ার খুলি।
দ্বিধা করছে কিশোর। বিশ হাজার ডলার জিতে নিতে পারলে খুবই খুশি হবে সে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিন গোয়েন্দার ফাণ্ডে জমা রাখবে ওই টাকা। গাড়ি কিনতে পারবে। মোটর সাইকেল কিনতে পারবে। গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগে এরকম অনেক জিনিসই কেনা যাবে এতো টাকা পেলে। তবে শুধু টাকার জন্যে টিভির এই কুইজ শোতে যোগ দিতে আসেনি সে। বাচ্চা পেয়ে তাকে নিয়ে যারা মজা করেছে, নির্যাতন করেছে তার ওপর, ওদেরকে আচ্ছামতো একটা শিক্ষা দেয়াটাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। শুধু টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে এখানে কিছুতেই আনতে পারতো না হ্যারিস বেকার। তবে সেকথা তো আর বলা যায় না শত্রুদেরকে। মাথা ঝাঁকিয়ে শুধু বললো, হ্যাঁ।