কিন্তু তাকে রাগানোর মতো কিছুই বললো না গার্ড। লিস্ট দেখে পড়লো, কিশোর পাশা। পঁয়তাল্লিশ সাইজ রোড, রকি বীচ। ঠিক আছে?
ঠিক আছে, কিশোর বললো।
মাথা ঝাঁকিয়ে অন্য দুজনের দিকে তাকালো গার্ড।
আমি মুসা আমান।
রবিন মিলফোর্ড।
দুজনের নাম-ঠিকানা মিলিয়ে নিয়ে আবার মাথা ঝাঁকালো গার্ড। সামনের জানালার কাঁচে ওয়াইপারের নিচে একটা সাদা কার্ড লাগিয়ে দিলো সে। চিনতে পারলো কিশোর, স্টুডিওতে ঢোকার পাস।
হাত নেড়ে গার্ড বললো, নয় নম্বর স্টেজ।
ধীর গতিতে গাড়ি চালালো শোফার। পেরিয়ে এলো নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি। তারপর পুরনো স্যান ফ্রানসিসকো অপেরা হাউস। ওটার পর পিসার লীনিং টাওয়ার বা হেলানো স্তম্ভ-পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যের একটা।
এসবই পরিচিত কিশোরের। যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে বাস্তব হয়ে ফুটে বেরিয়ে আসহে ধীরে ধীরে বস্তুগুলো। গলা বাড়িয়ে তাজ্জব হয়ে বিল্ডিংগুলো দেখছে রবিন আর মুসা। কিন্তু কিশোর জানে, ওগুলো আসল নয় কোনোটাই। এমনকি বাড়িও নয়। ক্যানভাস আর প্লাস্টার দিয়ে তৈরি, আসল জিনিসের নকল, তাও শুধু সামনের অংশ। যে কোনোটার রজা খুলে ভেতরে তাকালে দেখা যাবে অন্য পাশে কিছু নেই, ফাঁকা।
লম্বা, কালো গাড়িটায় সীটে হেলান দিয়ে বসে আছে সে। বাইরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করছে না।
কিশোরকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিতে এই গাড়ি পাঠিয়েছে হ্যারিস বেকার। যে দুদিন কুইজ হবে, সেই দুদিনের জন্যে গাড়ি আর শোফার দিয়ে দেয়া হয়েছে কিশোরকে।
রাশেদ চাচা আর মেরিচাচীকেও লাঞ্চে দাওয়াত করেছিলো বেকার, কিন্তু তাঁরা আসতে রাজি হননি। বলে দিয়েছেন সময় নেই। কিশোরকে গোপনে বলেছেন মেরিচাচী, মাঝেসাঝে দুএকটা ছবি যে আমার ভাল্লাগে না, তা নয়। কিন্তু যখনই মনে হয় সব বানানো ব্যাপার, আর দেখতে ইচ্ছে করে না।
তার সাথে একমত হলেন রাশেদ পাশা।
তবে রবিন আর মুসা তা হতে পারলো না। ওরা স্টুডিওতে যাওয়ার কথা শুনেই লাফিয়ে উঠলো। আর খুশি হয়েই ওদেরকে সঙ্গী করে নিলো কিশোর।
স্টুডিও এলাকার ভেতরে ঘন্টায় পাঁচ মাইলের বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর নিয়ম নেই। কাজেই শামুকের গতিতে অনেকক্ষণ লাগিয়ে এসে হঠাৎ থেমে গেল লিমুজিন। কিশোর ভাবলো, সাউন্ড স্টেজ-এর সামনেই বুঝি গাড়ি থেমেছে, যেখানে লাঞ্চ খাওয়া হবে। কিন্তু না, থেমেছে কতগুলো উত্তর আমেরিকান আদিবাসীদের কুটিরের সামনে। ওগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে গেল দুজন মধ্যযুগীয় রোমান সৈনিক, হাতে ঢাল, কাঁধে বর্শা।
শোফারের নাম অ্যালিউড হোফার, কিশোরদেরকে তা-ই বলেছে। তার পাশের জানালার কাচ নামিয়ে মুখ রে করলো বাইরে। একজন সৈনিককে জিজ্ঞেস করলো, এই যে ভাই, নয় নম্বর স্টেজ কোনটা বলতে পারেন?
কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেই হতো, সে-ই বলতে পারতো। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেল না। বললো না, ওই নয় নম্বর স্টেজেই পাগল সংঘের শুটিং হতো। দেরি হয় হোক, তাড়াতাড়ি গিয়ে মড়ার খুলি আর ডারিপদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর কোনো ইচ্ছেই তার নেই।
এই পথের শেষ মাথায়, হাতে তৈরি পুরনো আমলের একটা সিগারের মাথা দিয়ে পথ-নির্দেশ করলো সৈনিক।
গেলেই পেয়ে যাবেন, বললো দ্বিতীয় সৈনিক। অসুবিধে হবেনা।
ওদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার এগিয়ে চললো শোফার। পথের শেষ মাথায় দেখা গেল বিমান রাখার হ্যাঙারের মতো দেখতে সাদা একটা বিরাট বাড়ি। একপাশে বড় করে আঁকা রয়েছে ৯।
গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দরজা খুলে ধরলো শোফার।
নেমে ওকে ধন্যবাদ জানালো কিশোর। আরেকবার তাকালো লম্বা, স্বাস্থ্যবান তরুণ লোকটার দিকে। দেখে বোঝার চেষ্টা করলো, চকচকে পালিশ করা জুতো পরা, কালো লম্বা চুল আর কালো চামড়ার এই অ্যালউড হোফার নামের মানুষটা কেমন হতে পারে।
নয় নম্বর স্টেজে ঢোকার দরজাটা বাড়িটার তুলনায় ছোট, ভারি। একপাশে লাগানো ধাতব খিল। ভারি রিঙ থেকে ঝুলছে একটা বড় তালা। মাথার ওপরের দুটো আলোর দিকে তাকালো কিশোর। তার জানা আছে, লাল আলোটা যদি জ্বলে, তাহলে খোলা যাবে না দরজা, অর্থাৎ খোলার নিয়ম নেই। ভেতরে কাজ চলছে।
কিন্তু লালটা জ্বলছে না এখন, জ্বলছে সবৃক্ট। তারমানে ঢোকা যায়। পাল্লা ঠেলে খুলে ভেতরে পা রাখলো কিশোর। পেহনে এলো মুসা আর রবিন।
সব পরিচিত এখানকার। কিশোরের মনে হলো, এই তো সেদিন এসেছিলো এখানে অভিনয় করতে। মাঝখানে এতগুলো বছর যে পেরিয়ে গেছে মনেই হলো না তার। ঠিক আগের মতোই এখনও রয়েহে রঙের তাজা গন্ধ, বড় বড় আর্ক ল্যাম্পের তাপ। আগের মতোই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো কতগুলো কণ্ঠ, এই যে মোটুরাম এসে গেছে! এই ডাকটা জীবনে আর শুনতে হবে কখনও ভাবেনি সে।
প্রেস ফটোগ্রাফাররা ঘিরে ধরলো তাকে। দুই-তিন মিনিট নীরবে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সে, ওদের ফ্যাশানের আলোর অত্যাচার সহ্য করলো। সহ্য করলো ওদের জ্বালা ধরানো কথাঃ হাসসা, মোটুরাম। এদিকে একটু তাকাও, মোটুরাম। আরেকবার, আরেকবার হাসো, মোটুরাম।
অবশেষে শেষ হলো ছবি তোলা। ওদেরকে ঠেলে হাসিমুখে এগিয়ে এলো হ্যারিস বেকার, তার ভালুক্সে থাবা ফেললো কিশোরের কাঁধে। কিশোর, এসো এসো, ওরা তোমার অপেক্ষা করছে। পাগল সংঘের অভিনেতারা।
বাড়িটার শেষ ধারে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বিশাল এক রান্নাঘর। কিশোরের জানা আছে, এটা আসলে রান্নাঘর নয়। সাজানো হয়েছে। স্টোভটা বাতিল, অকেজো। সিঙ্কের ওপরের কল থেকে পানি পড়ে না। শুধু ঘরের মাঝখানে বড় টেবিলটা, যেটায় খাবার সাজাচ্ছে ওয়েইটাররা শুধু সেটাই আসল। অন্যখান থেকে এনে রাখা হয়েছে। ছবি তৈরির সেট সাজানোয় ব্যবহৃত হচ্ছে না এখন ওটা।