ওপরতলায়। এদিক দিয়ে এসো। একটা বেডরুমে ওকে তালা আটকে রেখেছে বুড়োটা। এক পা এগিয়েই থেমে গেল মড়ার খুলি।
জ্যাকেটের পকেট থেকে সাইনাসের ডান হাত বেরিয়ে এসেছে। সে হাতে উদ্যত একটা ছোট কালো পিস্তল। না, তোমরা যেতে পারবে না। নেলি এখানে আমার সাথে থাকবে।
দুপা ফাঁক করে দাঁড়িয়েছেন তিনি। মাথা উঁচু। রাফায়েল সাইনাসের সেই তখনকার চিত্রটা মনে পড়লো কিশোরের, পাগল সংঘ পরিচালনার সময় যেরকম আস্থার সাথে দাঁড়াতেন তিনি, তাকাতেন।
ওকে দিয়ে আমি একবার অভিনয় করিয়েছিলাম, ভারি গলায় বললেন পরিচালক, আরেকবার করাবো। ওর প্রতিভা আছে। ওকে দিয়ে হবে। হবেই। অনেক, অনেক বড় অভিনেত্রী আমি বানাবো ওকে। ছবি বানিয়ে অসকার জিতবো। আরেকবার বিখ্যাত হবে আমি।
সাইনাস আর তার মাঝের দূরত্বটা আন্দাজ করলে মুসা। ওর একটা বিশেষত্ব, ডাইভ দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়া। মাথা নিচু করে এভাবে গিয়ে শত্রুর হাঁটুতে কিংবা পেটে পড়ে দুই বন্ধুকে নিয়ে কতোবার বেঁচে এসেছে। বেরিয়ে এসেছে বিপদ থেকে।
কিন্তু এবার সেটা করতে পারবে বলে মনে হলো না। দূরত্ব অনেক বেশি। আর দৌড়ে গিয়েও সুবিধে করতে পারবে না, সে গিয়ে পৌঁছানোর আগেই বুলেট এসে লাগবে তার গায়ে।
মুসার মনোভাব বুঝতে পেরে হাত তুলে তাকে সতর্ক করলো কিশোর। বললো, মিস্টার সাইনাস, আমি জানি গুলি করা আপনার উদেশ্য নয়। গুলি করতে পারবেন না। আপনি খুনী নন। একজন পরিচালক, অনেক বড় পরিচালক। আপনি…
এতো বিশ্বাস করো না, বাধা দিলো মড়ার খুলি। ও পাগল। যা খুশি করে বসতে পারে তোমার চেয়ে আমি ওকে ভালো চিনি। কুইজ শোর পুরস্কারে ভাগ পেলে কি করতো জানো? পার্টি দিতো। ওর মতো ফতুর হয়ে যাওয়া বেকুব বুড়োগুলো দাওয়াত করে আনতো। ওর মতোই ওরাও কোনোমতে ধুকে ধুকে টিকে আছে। জিপসি অর্কেস্ট্রাদলকে ভাড়া করতো, পত্রিকার রিপোর্টারদের খবর দিতো…
চুপ! ধমকে উঠলেন পরিচালক। বাঁ হাত তুললেন। একেবারে চুপ! এখন একসারিতে দাঁড়াও সবাই। মাথার ওপরে হাত তোলো।
সবার আগে আদেশ মানলো মড়ার খুলি। তার পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়ালো অন্য তিনজন।
এখন, সামরিক বাহিনীর কমান্ডারের মতো আদেশ দিলেন সাইনাস, আমি হাঁটো রুললেই ডানে ফিরে মার্চ করে হেঁটে যাবে সিঁড়ির দিকে। রেডি?
আবার আগে সাড়া দিলো মড়ার খুলি। মাথা ঝাঁকালো সে। তিন গোয়েন্দাও ঝাঁকালো।
লাইট! চিৎকার করে বললেন পরিচালক। ক্যামেরা। অ্যাকশন! মার্চ!
যেদিকে যেতে বলেছেন তিনি, সেটা হলের পেছন দিক। সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছে কিশোর, নেমে যাওয়া সিঁড়ি। নিশ্চয় সিঁড়ির নিচে মাটির তলায় ঘর-টর কিছু আছে। ওখানে যদি আটকান ওদেরকে পরিচালক, যা ভুলো মন, হয়তো খাবার দিতেই ভুলে যাবেন। আশেপাশে কোনো বাড়িঘরও নেই যে চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসবে। বাঁচতে চাইলে এখনি কিছু করতে হবে।
ঠিক তার পেছনেই রয়েহে মুসা। কদম ছোট করে ফেললো কিশোর।
এই, এই কিন্তু করো না, আতঙ্কিত কষ্ঠে অনুরোধ করলো মড়ার খুলি। গুলিটা আমার গায়ে লাগবে।
খিলানের কাছে পৌঁছে সিঁড়িতে পা রাখলো কিশোর।
মার্চ। পেছন থেকে চিৎকার করছেন সাইনাস। মার্চ। মার্চ মার্চ…
হঠাৎ থেমে গেল কণ্ঠ। অস্ফুট একটা ভয়ার্ত শব্দ কানে এলো কিশোরের। একটা থাতব জিনিস খটাং করে পড়লো মেঝেতে। এসব পরিস্থিতির আগেও পড়েছে তিন গোয়েন্দা, কি করতে হয় জানে। চোখের পলকে লাইন ভেঙে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো ওরা।
প্রথমেই কিশোরে চোখে পড়লো পিস্তলটা পড়ে আছে দরজার কয়েক ফুট দূরে। তারপর দেখতে পেলো, যেন শূন্যে উঠে চার হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতার কাটছেন সাইনাস। কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে ওপরে তুলে ফেলেছে দুটো শক্তিশালী হাত।
এমনভাবে ধরেছে হোফার, যাতে ব্যথা না পান বৃদ্ধ পরিচালক। তাঁকে নিয়ে গিয়ে একটা ক্যানভাসের চেয়ারে বসিয়ে দিলো সে। এখানে চুপ করে বসুন, মিস্টার সাইনাস। কিশোর, পিস্তলটা তুলে নাও। সেফটি ক্যাচ অন করে দিয়ে পকেটে ভরে রাখো।
যা বলা হলো করলো কিশোর। মড়ার খুলির দিকে তাকালো। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ অভিনেতা। মুখ সাদা। অল্প অল্প কাঁপছে।
থ্যাঙ্ক ইউ, হোফার, কিশোর বললো।
ওকে চোরের মতো ঢুকতে দেখলাম এখানে, মড়ার খুলিকে দেখিয়ে বললো হোফার। তখনই সন্দেহ হলো। ভাবলাম, কি করে দেখি তো।
ভালো করেছে। বলে মড়ার খুলির দিকে ফিরলো কিশোর। আসুন। নেলিকে কোথায় রেখেছে দেখান।
তখনও সুস্থির হতে পারেনি তরুণ অভিনেতা। তবে কিশোরের কথামতো এগিয়ে চললো দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ির ওপরে উঠে দেখা গেল লম্বা করিডর, ধুলোয় ঢাকা। ঘরের দরজার বাইরেই চাবিটা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো কিশোর।
তক্তা দিয়ে বন্ধ করে রাখা একটা জানালার পাশে ক্যানভাসের চেয়ারে বসে আছে নেলি। মুখে রুমাল গোজা। হাত বাঁধা চেয়ারের হাতলের সঙ্গে, পা বাধা পায়ার সঙ্গে।
তাকে ওই অবস্থায় দেখেই অস্ফুট শব্দ করে উঠলো মড়ার খুলি। আমি ভাবতেই পারিনি, সে বললো, এভাবে বেঁধে রাখবে। জানলে…জানলে কখনোই এখানে আনতে দিতাম না।
ওর কথা বিশ্বাস করলো কিশোর। গত কয়েক মিনিটে তার যা আচরণ দেখেছে, তাতে বুঝতে পেরেছে মড়ার খুলি কঠোরতা যা দেখিয়েছে আগে, সব মেকি, অভিনয়। আস্ত একটা ভীতু।