কিশোওর। এই কিশোর, কোথায় তুই?
মেরিচাচীর ডাক শোনা গেল বাইরে থেকে।
জলদি বেরিয়ে আয়, আবার বললেন তিনি।
এইই সুযোগ। আর দেরি করলো না কিশোর। লাফিয়ে উঠে গিয়ে বন্ধ করে দিলে টেলিভিশন। মোটামের হাসিখুসি আলুর মতো মুখ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বাচলো সে, অন্যদিকে মন খারাপ হয়ে গেল রবিন আর মুসার। ওদের দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু মেরিচাচীর নির্দেশ অমান্য করে এখানে বসে থাকার সাহস ওদের নেই।
জঞ্জালের ভেতর থেকে গোপন পথ দিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা।
এই যে, এসেছিস, মেরিচাচী বললেন।
জ্যাকেট খুলতে খুলতে কিশোর জিজ্ঞেস করলো, কি কাজ করতে হবে, বলো?
কিন্তু কাজ করার জন্যে ডাকেননি মেরিচাচী। গেটের দিকে দেখালেন।
গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। আবার! পাগল সংঘ টিভিতে দেখানোর পর থেকেই অনেক লোক আসে তার সঙ্গে দেখা করতে। খবরের কাগজের রিপোর্টারও থাকে তাদের মধ্যে। মোটুরামকে নিয়ে ফীচার স্টোরি করতে। হেডিং লেখেঃ মোটুম এখন কোথায়? কিংবা মোটুরামের কি হয়েছে?
ওকে যেতে বলল, লোকটাকে দেখিয়ে চাচীকে অনুরোধ করলো কিশোর। বলে দাও, আমি কথা বলতে চাই না।
অনেক বার বলেছি, যায় না। ও বলছে, কথাটা নাকি জরুরী। সহানুভূতির হাসি হাসলেন চাচী। কিশোরের কেমন লাগছে বুঝতে পারছেন। টেলিভিশনে সিরিয়ালটা দেখানোর পর থেকে যে লোকে তাকে বিরক্ত করছে, জানেন একথা। দেখছিস না, কি রকম বড় গাড়িতে চড়ে এসেছে। আমি বলায় বললো, যতোক্ষণ লাগে বসে থাকবে। তুই খেয়েদেয়ে জিরিয়ে নিয়ে যখন খুশি দেখা কর, ও বসে থাকবে। এরপর আর কি কলবো?
ঠিক আছে, কি আর করা! কপাল চাপড়ালো কিশোর। দেখি, খেদানো যায় কিনা।
বিরাট গাড়ি। ফরাসী সিত্রো। সামনের অংশটা দেখতে অনেকটা তিমির মাথার মতো। গাড়ি থেকে নেমে তিন গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে আসা লোকটাও তার গাড়ির মতোই বড়, বিলাসী। প্রথমেই লোকটার দাঁত দৃষ্টি আকর্ষণ করলো কিশোরের। বড় বড় সাদা দাঁতগুলো লোকটার রোদে পোড়া চামড়ার পটভূমিতে যেন চাঁদের মতো ঝলমল করছে। যখনই হাসে তখনই চমকায়।
কিশোর পাশা, আরও চওড়া হাসি উপহার দিয়ে বললো লোকটা, আমার নাম হ্যারিস বেকার। মুভি স্টুডিওর বিজ্ঞাপন ম্যানেজার।
মুসা আর রবিনের মাঝখানে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিশোর। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে বেকারের দিকে।
তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে এসেছি, আশা করি পছন্দ হবে তোমার, এমনভাবে কথা বলে লোকটা মনে হয় তার কণ্ঠস্বরও হাসে। পাগল সংঘের সমস্ত অভিনেতাকে স্টুডিওতে আসার দাওয়াত করেছি। ওখানেই লাঞ্চ খাবে। লাঞ্চের পর…
থ্যাংক ইউ, আমার কোনো আগ্রহ নেই, বলে যাবার জন্যে ঘুরলো কিশোর।
পুরনো বন্ধুদের সাথে আবার দেখা হোক, এটা চাও না? বিশাল একটা থাবা কিশোরের কাঁধে ফেলে তাকে আটকালো বেকার। মড়ার খুলি, শিকারী কুকুর,
ভারিপদ, আর…।
না, থ্যাংক ইউ, বলে কাঁধ থেকে লোকটার হাত সরানোর চেষ্টা করলো কিশোর। কিন্তু লোকটার ভালুক-থাবা শক্ত হলো আরও। ওই বোকাগুলোর সঙ্গে জীবনে আর কোনোদিন দেখা করতে চাই না আমি…
আরও চওড়া হলো বেকারের হাসি। আমিও এটাই আশা করেছিলাম।
কি বললেন? কিশোর আশা করেনি লোকটা এরকম কথা কলবে।
তোমাকে অনেক বিরক্ত করেছে ওরা, তাই না? জ্বালাতন করেছে। মোটুরাম বলে খেপিয়েছে। ওদেরকে ঘৃণা তো করবেই।
মানুষকে ঘৃণা করি না আমি, শীতল গলায় বললো কিশোর। তবে ওদের পছন্দ করি না, এটা ঠিক। অপছন্দ আর ঘৃণাকে নিশ্চয় এক বলবেন না আপনি?
ওয়ান্ডারফুল! বেকারের রোদেপোড়া মুখে চাঁদের হাসি উজ্জল হলো আরও। চমৎকার গুছিয়ে কথা বলো তুমি। ওদের কাছে যাওয়ার একটা সুযোগ করে দিচ্ছি আমি তোমাকে। যাতে ওদের বুঝিয়ে দিতে পারো, সেই ছোটবেলা থেকেই ওদেরকে গাধা মনে করে এসেছো তুমি, এবং আসলেই ওরা গাধা। কি, সেটা প্রমাণ করতে চাও না?
কিভাবে? এই প্রথম আগ্রহ ঝিলিক দিলো কিশোরের চোখে।
কিশোরের কথার সরাসরি জবাব দিলো না বেকার। ঘুরিয়ে বললো, সারা দেশের লোকের সামনে প্রমাণ করবে ওরা বোকা। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে সেকথা। দুটো কুইজ শো-এর বন্দোবস্ত করেছে টিভি। পাগল সংঘের সবাই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করবে। আমার বিশ্বাস, কিশোর, তুমিই জিতবে। তোমার ব্যাপারে শুনেছি আমি। ওগুলোর সবকটার মাথায় ঘোল ঢেলে দিতে পারবে।
কিশোরে মনের পর্দায় মড়ার খুলির ডিমের মতো মাথাটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। গাধাটার বোকার মতো হাসি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অযথাই হাত মুচড়ে দিচ্ছে মোটুরামের। তার টিফিন সঁটিয়ে, বাক্সে মরা ইঁদুর রেখে দিয়ে ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে।
হারিস বেকারের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবছে কিশোর।
ফাস্ট প্রাইজটা তুমিই পাবে, কিশোর, আগুনে যেন ঘি ঢাললো অসাধারণ ধূর্ত লোকটা। আর পুরস্কারের অঙ্কটা জানো কতো? বিশ হাজার ডলার।
২
হলিউডের ভাইন স্ট্রীট গেটের সামনে লিমুজিনটাকে থামতেই হলো। শোফারকে চেনে ইউনিফর্ম পরা গার্ড, তবু থামালো। গাড়ির পেছন দিকে এসে পেহুনের সীটে বসা তিন কিশোরকে দেখলো, হাতে একটা লিস্ট। নাম-ঠিকানা মিলিয়ে নেয়ার জন্যে ওদের নাম জিজ্ঞেস করলো।
কিশোর পাশা, বললো কিশোর। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, মোটুরাম শব্দটা শুধু উচ্চারণ করলেই গার্ডের সঙ্গে তর্ক বাধিয়ে দেবে।