তাকে আরেক কাপ কফি ঢেলে দিলো কিশোর। রবিন আর মুসা অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলে, হেফারের গল্প শোনার জন্যে।
অভিনয় করে যা আয় করেছিলাম, সব জমিয়ে রেখেছিলো আমার বাবা,ফোর বললো আবার। পড়ার খরচের অভাব হলো না। মাথাটাও মোটামুটি ভালো। ষোলো বছর বয়েসে ইস্কুল শেষ করে ভর্তি হলাম টীচার্স কলেজে। পাস করে এখন মন্টারি করছি।
টেবিলের ওপর দিয়ে ওপাশে বসা কিশোরের দিকে তাকালো সে। কাজটা আমার ভালো লাগে। ছাত্র সামলানো খুব কঠিন, তবে ওরা আমাকে বেশি বিরক্ত করে না। মানিয়ে ফেলেছি। ফলে অসুবিধে হচ্ছেনা।
তিক্ত হাসি হাসলো সে। যখন আবার পাগল সংঘ দেখাতে শুরু হলো, ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। যদি আমার ছাত্ররা জেনে যায় আমি শজারুকাঁটা, আমার জীবন অতিষ্ঠ কর দেবে তাহলে। বালি ভেঙাবে। মুখ ভেচে বে হয়রে কপাল, ঘরে এতে কাজ একা আমি কি করে সারবো! শজারুকাঁটার মতো সুর করে সংলাপ বললো সে। কিছুক্ষণ আগে এটাই বলেছিলো কিশোর। ওর জেনে গেলে ওই ইস্কুলে আর ঢুকতে পারবো না জীবনে।
হোফরের মনের কষ্ট বুঝতে পারছে কিশোর। গরমের ছুটির আগের তিনটে হণ্ডা তার ওপর দিয়ে যা গেছে, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে যন্ত্রণা কাকে বলে।
ভয় পেয়েছি বটে, হোফার বলতে লাগলো, পুরনো দিনের কথা ভেবে আনন্দও পেয়েছি। অবাক হয়ে ভেবেছি অন্য পাগলদের কি হলো? ওরা কি করছে? দুই বছর ধরেই ইস্কুল ছুটির সময় ইজি-রাইড কোম্পানিতে পার্ট টাইম চাকরি করি, ছুটির সময় কিছু বাড়তি আয় হয়। অনেক রকমের লোক গাড়ি ভাড়া নেয়া। এদের মধ্যে স্টুডিওর লোকও আছে। কাজেই মাঝে স্টুডিওতেও নিয়ে যেতে হয় ওদেরকে। যখন শুনলাম পাগলদের আবার একখানে করা হচ্ছে, দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আরেকজন ড্রাইভারের সঙ্গে ডিউটি বদল করে নিলাম, যাতে স্টুডিওতে ঢুকে পালদের দেখতে পারি।
স্টুডিওতে যখন যাও, কিশোর কললো, জায়গা তো তোমার চেনা। তাহলে নয় নম্বর স্টেজের কথা জিজ্ঞেস করছিলে কেন সেদিন?
অনেক বড় জায়গা, হোফার বললো। মস্ত এলাকা। সব জায়গা সবাই চেনে না। তাছাড়া সেই ছেলেবেলায় গিয়েছি নয় নম্বরে, তা-ও একা নয়, বাবা গাড়িতে করে পৌঁছে দিতো আমাকে। তারপর আর যাইনি। ভুলে গেছিলাম স্টেজটা কোনদিকে।
কফিতে চিনি মিশিয়ে আবার কিশোরের দিকে তাকালো হোফার। ভাবতে পারিনি আমাকে কেউ চিনে ফেলবে। অভিনয় ছাড়ার পর স্টুডিওর কেউ আর খোঁজ করেনি আমার, আমিও নিখোঁজ হয়ে থাকার চেষ্টা করেছি। ফলে বেকার আমাকে খুঁজে বের করতে পারেনি। জানেই না আমি কোথায় আছি, কেমন আছি।
চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে বললো সে, তবে তুমি যে এতোটা চালক হয়ে গে, ভাবতে পারিনি।
চালাক না, সৌজন্য দেখিয়ে বললো কিশোর, আসলে লাকিলি চিনে ফেলেছি তোমাকে। যদিও মনে মনে খুব ভালো করেই জানে সে, বুদ্ধির জোরেই শজারুকাঁটাকে চিনতে পেরেছে। রবিনের দেয়া সূত্র থেকেই বুঝে ফেলেছে, হেফার আর কেউ নয়, শজারুকাঁটা। সেজানে না ওটা কি গাড়ি ছিলো। কিশোরও জানে না। ওরা দুজনই একমাত্র তখন অন্য জায়গায় ছিলো, যখন গাড়িটাকে নিয়ে যায় পুলিশ। হোফার জনাব গণ্ডগোলের আসল নাম জানে, তার কারণ হ্যানসনের সঙ্গে পরিচয়, হয়েছে কুকুর চুরি করার অভিনয়ের সময়। একসাথে কাজ করেছে কয়েক দিন। সব সূত্র খাপে খাপে জোড়া লাগিয়েই নিশ্চিত হয়েছে কিশোর, অ্যালউঙ হোফার শজারুকাঁটা ছাড়া আর কেউ নয়।
আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবে? অনুরোধ করলো কিশোর।
বলো।
সেদিন রান্নাঘরে যখন আলোচনার শুটিং হচ্ছিলো, তোমাকে পেছনের আর্কলাইটগুলো কানে যেতে দেখেছি। কেন গিয়েছিলে?
ও, সেটাও দেখে ফেলেছে, হাসলে হোফার। সিনেমার টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো নিয়ে সব সময়ই একটা কৌতূহল আছে আমার। এমনকি যখন শজারুকাঁটার অভিনয় করতাম, তখনও ছিলো। ফলে লাইট আর যন্ত্রপাতিগুলো দেখে আর লোভ সামলাতে পারিনি।
হুঁ, বুঝলাম, হাসছে কিশোর। একবার তো আমি সন্দেহই করে বসেছিলাম, তুমিই কাপগুলো চুরি করে রিফ্লেকটরের বাক্সে লুকিয়েছে।
না, আমি লুকাইনি, হোফার বললো। তা এখন কি করবে আমার পরিচয় সবাইকে বলে দেবে?
মোটেই না,দুই সহকারীর দিকে তাকালো কিশোর। এরাও কিছু বলবে না। কি বলো, মূস?
মাথা খারাপ? আমিও বলবো না, কিন বললো। আপনার পরিচয়…
কিশোর যখন তুমি করে বলছে, বাধা দিয়ে বললো হোফার, তোমরাও তুমি করেই বলতে পারো। আপনি আপনি করে বন্ধুত্ব হয় না।
থ্যাংক ইউ। তোমার পরিচয় কেউ জানবে না, অন্তত আমাদের মুখ থেকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো হোফরি। যাক, বাঁচালে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিশোর বললো, তো, হোফার, আমাদের কিছু সাহায্যের প্রয়োজন যে?
নিশ্চয়ই করবো। কি করতে হবে?
চোরাই কাপগুলোর কথা খুলে বললো কিশোর। রাফায়েল সাইনাস যে তিন গোয়েন্দাকে তদন্তের ভার দিয়েছেন সেকথাও জানালো। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দেখিয়ে বললো, এই দেখো, আমরা সত্যিই গোয়েন্দা। কাপগুলো খুঁজে পেয়েছি বটে, কিন্তু সব রহস্যের মীমাংসা এখনও করতে পারিনি। না করে ছাড়বোও না।
মাথা ঝাঁকালো হোফার। তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমি কিভাবে সাহায্য করবো?
আমাদের এখন দুজনকে বেশি সন্দেহ, জানালো কিশোর। মড়ার খুলি আর ভারিপদ। ধরা যাক, ওরা দুজনে মিলে ওই কাপ সরিয়েছে। একসাথে কাজ করছে। তাহলে অনেক প্রশ্নেরই জবাব মিলে যায়। আমি এখনও জানি না, তবে গল্পটা এভাবে হতে পারেঃ আজ দুপুরের মূভি স্টুডিওতে দুজনের দেখা করার কথা। চোরাই শুনে বক্স থেকে বের করে আনার জন্যে। সাউণ্ড স্টেজে বাইরে ভারিপদর জন্যে অপেক্ষা করছিলো মড়ার খুলি। এই সময় আমাকে ঢুকতে দেখলো সে। সঙ্গে সঙ্গে এটা মত করে ফেলল। কাপগুলোর চেয়ে বাজিতে বিশ হাজার ডলার জেতা তার জন্যে বেশি জরুরী। আমাকে সরিয়ে রাখতে পারলে একজন প্রতিযোগী কমে গেল। সুতরাং আমাকে আটকে ফেললো স্টেজের ভেতর। তারপর যখন ভারিপদ এলো, তাকে আমার কথা কিছুই বললো না সে, শুধু বললো দরজায় তালা দেয়া। খোলা যাবে না। অন্য সময় এসে কাপড়গুলো নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তারপর দুজনে ফিরে গেল টেলিভিশন স্টেশনে, কুইজ শোতে যোগ দিতে।