ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন পরিচালক। ছেলেটা সত্যিই অসাধারণ বুদ্ধিমান। আর অভিনয় যেন সে মায়ের পেট থেকেই শিখে এসেছে, একেবারে স্বাভাবিক, বাস্তব হাসি, কথাবার্তা। পরিচালক যা যা করতে বলেন, ঠিক তা-ই করে। সংলাপ মুখস্থ করায়ও জুড়ি নেই মোটুরামের। একবার বলে দিলেই যেন মগজে গেঁথে যায়, একটি শব্দও ভুল করে না।
শুধু কিশোরের জন্যেই সাংঘাতিক নাম করেছিলো পাগলসংঘ।
টিভিতে অনেক অভিনয় করেছে কিশোর। সিনেমাতেও করতো, যদি না তার বাবা-মা হঠাৎ মোটর দুর্ঘটনায় মারা যেতেন। হয়তো অভিনেতাই হতে হতো তাকে জীবনে।
বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তাকে বাঁচালেন যেন নিঃসন্তান মেরিচাচী। নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আর ছবিতে অভিনয় করবি, কিশোর?
না, সরাসরি জবাব দিলো কিশোর।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে, স্টুডিওতে গিয়ে ঘাড়ে, মুখে, গলায়, রঙ মাখতে তার আপত্তি নেই। ক্যামেরা আর উজ্জ্বল চোখ ধাধানো আলোর সামনে দাঁড়িয়ে ঘামতেও রাজি আছে সে। ক্যামেরার সামনে বসে জটিল ধাধা মেলাতে আর অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়ার অভিনয় করতে খুব আগ্রহ তার। তোতলাতে পারে, জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতে পারে, পরিচালক যা করতে বলেন সব পারে, পারে না শুধু তার সহ-অভিনেতাদের সহ্য করতে।
কিশোর বোঝে কোনটা অভিনয়, আর কোনটা নয়। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় হয়েও মাথামোটা হবার দলের যেন সেটুকু বোঝার বুদ্ধি নেই। ছবিতে যেমন তাকে খেপায়, হবির বাইরেও খেপায়। অভিনয় করতে করতে যেন ওদের ধারণা হয়ে গেছে এটাই স্বাভাবিক। তাই টিফিনের সময় স্টুডিওর ক্যাফেটেরিয়ায় বসেও তার আইসক্রীমে মরিচের গুঁড়ো ঢেলে দেয়। মেকাপ রুমে তার চেয়ারে আঠা মাখিয়ে রাখে। তার ফারমার ওভারঅলের বোতামগুলো কেটে রাখে। আর সব চেয়ে বেশিদুঃখ লাগে, যখন তাকে ওরা মোটুরাম বলে ডাকে। সব সময় ডাকে। ওদের গোবর পোরা। মাথাগুলোয় যেন কিছুতেই ঢুকতে চায় না বাস্তব জীবনে সে মোটেই মোটুরাম নয়কিশোর পাশা।
কাজেই মেরিচাচী যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন পাগল সংঘ ছবিতে আর অভিনয় করবে কিনা, একটা মুহূর্ত দেরি না করে জবাব দিয়ে দিয়েছে সে, না। তার মনে হলো যেন খাঁচায় বদ্ধ একগাদা খেপা বানরের মাঝখান থেকে তাকে মুক্তি দিতে এসেছেন চাচী। ওই মহিলাকে যে সে এতো ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, যা বলেন মুখ বুজে শোনে, এটা তার একটা বড় কারণ। তার মা-ও যেটা করেননি। তাই করেছেন ওই মহিলা, তাকে ওই বয়েসেই মতামতের স্বাধীনতা দিয়েছেন, যা পাওয়ার জন্যে সে আকুল হয়ে ছিলো।
কাজেই যেদিন তার কন্ট্রাক্টের সময়সীমা শেষ হলো, সেদিনই পাগল সংঘকে অকূল সাগরে ভাসিয়ে চলে এলো কিশোর। আর কোনোদিন যায়নি ওই ছবিতে অভিনয় করার জন্যে। তার বদলে মন দিলো পড়ালেখায়।
ভালোই কাটছিলো দিন। তারপর বহু বছর পরে হঠাৎ এলো একটা প্রচণ্ড আঘাত। ঝড়ের কবলে-পড়া গাছের মতো নাড়িয়ে দিলো যেন কিশোরকে। টিভির পুরনো অনুষ্ঠান দেখানোর তালিকায় নাম উঠলো পাগল সংঘের।
কিশোর জানতো না যে দেখানো হচ্ছে। জানলো প্রথম, যেদিন তার এক সহপাঠি তার অটোগ্রাফ চেয়ে বসলো। হাসিমুখে দিয়ে দিলো কিশোর, ভাবলো, সে গোয়েন্দা হিসেবে ভালো নাম কামিয়েছে বলেই বুঝি অটোগ্রাফ চেয়েছে ছেলেটা। কিন্তু নাম সই করার পর যখন নিচে লিখলো গোয়েন্দাপ্রধান তখন আপত্তি জানালো ছেলেটা। মাথা নেড়ে বললো, না না, ওটা নয়, মোটুাম সেখো।
চমকে গেল কিশোর।
তারপর গত তিনটে হপ্তা ধরে এই এক জ্বালাতন। ইস্কুলের এমন কোনো ছেলেমেয়ে নেই যারা পাগল সংঘ না দেখেছে। সবাই এখন তাকে মোটুরাম বলে খেপায়। যে মেয়েগুলোকে দেখতে পারে না সে, পাত্তা দেয় না, ওরা পেয়েছে ভারি মজা। কিশোরকে দেখলেই মুচকি হেসে বলে, না না, পীত, আমাকে ধেরে দাও, কাতুকুতু দিও না, প্রীত!
ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে কিশোরের দিবারাত্রি। তা-ও গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হওয়ায় কিছুটা রক্ষে। ইস্কুলে যেতে হয় না, সবার খেপানোও শুনতে হয় না। কিন্তু আজ কোনো কুক্ষণে যে হেডকোয়ার্টারে ঢুকে টেলিভিশন অন করেছিলো। আর করামাত্রই দেখলো পাগল সংঘ চলছে। বন্ধ করে দিয়েছিলো সে সঙ্গে সঙ্গে, জোর করে মুসা গিয়ে আবার খুলেছে।
পর্দার দিকে তাকিয়ে হাসে মুসা আর রনি। মুখ আর গলায় বসন্ত আঁকা শেষ করে এখন শরীরে আঁকার জন্যে মোটুরামের ওভারঅল খোলার চেষ্টা করছে মড়ার খুলি। এই সময় ঝটকা দিয়ে খুলে গেল রান্নাঘরের দরজা। ঘরে ঢুকলো নয় বছরের সুন্দরী একটা মেয়ে, পাগল সংঘে কিশোরের উদ্ধারকারিণী। ছবিতে ওর নাম বটি সুন্দরী।
ছেড়ে দাও ওকে, মড়ার খুলিকে ধমক দিয়ে বললো নেলি।
হা হা, থেরে দাও, হাসিমুখে বললো মোটুরাম। কিন্তু হাড়ার কোনো লক্ষণই নেই মড়ার খুলির। জোর করে নেলিকে নিয়ে গিয়ে আলমারিতে ভরে রাখতে চাইলো। নেলির পক্ষ নিলে নিগ্রো হেলেটা, ওর নাম জিকো, ছবির উপাধি শজারুকাঁটা। চুলের জন্যেই ওরকম নামকরণ। আরও ছেলে আছে। ওরা সবাই গেল মড়ার খুলির পক্ষে। নিমিষে মারপিট আর হৈ-চৈ করে এক এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেললো। একজন তাক থেকে একটা কেক তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো নেলিকে সই করে। সে মাথা সরিয়ে নিতে সেটা এসে পড়লো মোটুরামের মুখে। দুঃখ পাওয়ার চেয়ে বরং খুশি হলো সে। বললো, হ্যাঁ, হুঁ এতা ভালো! বতন্তের তেয়ে অনেক ভালো। বলে নাকেমুখে লেগে থাকা মাখন মুছে নিয়ে খেতে শুরু করলো।