অন্ধকারে যতোটা দ্রুত সত্ব, দরজার কাছে ফিরে এলো কিশোর। দরজায় ঠেলা দিলো। পালা খুললো না। আরো জোরে ধাক্কা লাগলো সে। অনড় রইলো পাল্লা। বাইরে খিল লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্ধকার, শব্দনিরোধক এই বাড়িতে আটকা পড়েছে সে। হাজার চিৎকার করলেও এখান থেকে বাইরে শব্দ যাবে না, সে-রকম করেই তৈরি করা হয়েছে এটা। সোমবার সকালের আগে স্টুডিওর কোনো কর্মীও ঢুকবে না এখানে।
এবং আর দেড় ঘন্টার মধ্যেই কুইজ শোর শুটিং শুরু হবে।
পুরো একটা মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবলো কিশোর। দ্রুত চলহে মগজ, তবে আতঙ্কে নয়। মনে মনে পরিকল্পনা তৈরি করফেমুক্তির।
প্রথমেই দরকার, আলো।
আগের দিন বিকেলের কথা মনে পড়লো তার। আর্ক লাইটগুলো জ্বলে ওঠার পর মাস্টার কন্ট্রোলের কাছ থেকে সরে আসতে দেখা গিয়েছিলো সাইনাসকে। কিশোররা যখন কাপগুলো খুঁজে পেয়েছে।
রান্নাঘরটা কোনদিকে আহে, অনুমান করে দেয়ালের ধার ঘেঁষে সেদিকে এগুলো সে। রান্নাঘরের সেটের শেষ মাথায়ই আছে মাস্টার কন্ট্রোল। অন্ধকারে হাতড়াতে লাগলো। মনে হলো, দীর্ঘ এক যুগ পর হাতে লাগলো ধাতব সুইচ বক্সটা। হুড়কো খুলে ডালা মেললো। ভেতরে আঙুল ঢোকাতেই হাতে লাগলো সুইচ হ্যান্ডেল। ধরে নামিয়ে দিলো নিচের দিকে।
আলোয় ভেসে গেল রান্নাঘর।
এখন দুই নম্বর কাজ, টেলিফোন।
মাত্র কয়েক মিটার দূরে রয়েছে ওটা। দেয়ালে ঝোলানো। এগিয়ে গিয়ে রিসিভার নামিয়ে কানে ঠেকালো সে।
মৃত। একেবারে ডেড হয়ে আছে টেলিফোন।
৭
কিন্তু তাতেও নিরাশ হলো না গোয়েন্দাপ্রধান। সে আশাও করেনি টেলিফোনটা কাজ করবে। যে লোক তাকে এখানে আটকে রেখে গেছে, সে টেলিফোন চালু রেখে যাবে এতো বোকা নিয়ে নয়।
তিন নম্বর কাজ, ফোনটা ঠিক করা, সম্ভব হলে।
কোথায় লাইনটা কাটা হয়েছে, সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। মেঝের কাছাকাছি জায়গায়। তবে যে কেটেছে সে ভালোমতোই জানে কিভাবে কি করতে হবে। শুধু কেটেই ক্ষান্ত হয়নি, অনেকখানি জায়গার তার টেনে তুলে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
রান্নাঘরের পেছনে এখনও আছে হুতোর মিস্ত্রীর যন্ত্রপাতিগুলো। ভালো শক্ত একটা প্লয়ার্স পাওয়া গেল ওখানে। আর সাউন্ড স্টেজ-ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে যেখানে কারবার, সেখানে খানিকটা ভালো তার জোগাড় করাও এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। একটা স্পটলাইট থেকেই সেটুকু তার কেটে নিয়ে এলো সে।
দ্রুত হাত চালিয়ে ফোনের লাইনের সঙ্গে তারটা জোড়া দিয়ে ফেললো। রিসিভার তুলতে গিয়ে দুপ দুপ করছে বুক। কাজ হবে তো? বলা যায় না, বিন্ডিঙের বাইরেও কাটা হয়ে থাকতে পারে তার। তাহলে সর্বনাশ।
কিন্তু রিসিভার কানে ঠেকাতেই একটা মিষ্টি শব্দ কানে এলো তার। টেলিফোনে শব্দ সাধারণত বিরক্ত করে তাকে, কিন্তু এখন ডায়াল টোনের আওয়াজ শুনে মনে হলো জীবনে যতগুলো মধুরতম আওয়াজ শুনেহে এটা তার মধ্যে একটা।
স্টুডিওর সুইচবোর্ডে ফোন করে কাউকে আসতে বলতে পারে, নিশ্চয় বাড়তি চাবি আছে ওদের কাছে। কিন্তু ওরা এলে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে, প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। এখনই সব কিছু ফাঁস করে দিতে চায় না সে। নিজেদের মধ্যে, অর্থাৎ তিন গোয়েন্দার মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ রাখতে চায় ব্যাপারটা।
নিশ্চয় এতোক্ষণে সৈকত থেকে বাড়িতে চলে এসেছে মুসা। তাকেই ফোন করলো কিশোর। দ্বিতীয়বার রিং হতেই রিসিভার তুললো স্বয়ং মু। সংক্ষেপে তাকে বুঝিয়ে বললো কিশোর, কি ঘটেছে।
তারপর বললো, এখুনি অ্যালউড হোফারকে ফোন করে বলো তোমাকে এখানে নিয়ে আসতে। আমি দরজার নিচের দিকে একটা ফুটো করার চেষ্টা করছি, ওখান দিয়ে চাবি কে করে দেবো।
কিশোর রিসিভার রাখার পর আর একটা সেকেন্ড দেরি করলো না মুসা। হোফারকে ফোন করলো। তিরিশ মিনিটের মধ্যে ওদের বাড়িতে পৌঁছে গেল শোফার। রবিনকে ফোন করে আগেই আনিয়ে রেখেছে মুসা। তাড়াহুড়ো করে দুজনে উঠে বসলো গাড়িতে।
আর কিছু করার নেই দুজনের। এখন সব দায়দায়িত্ব ফোরের, লিজিন নিয়ে কতো তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবে স্টুডিওতে। কিন্তু সে-ও যেন কিছু করতে পারছে না। শনিবারের হলিউডের রাস্তা, সাংঘাতিক ভিড়। যাই হোক, অবশেষে ভাইন স্ট্রীটে পৌঁছলো গাড়ি। দেখা গেল স্টুডিওর গেট।
গার্ড-বুদ থেকে বেরিয়ে এলো গার্ড, গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো। হাত বাড়ালো, পাস দেখি?
পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। এই কথাটা তো একবারও মনে পড়েনি! পাস রয়েছে কিশোর পাশার কাছে।
বাটালির মাথায় হাতুড়ির শেষ আঘাতটা দিয়ে থামলো কিশোর। মেঝেতে নামিয়ে রাখলো যন্ত্র দুটো, তারপর পরিষ্কার করে ফেলতে লাগলো দরজার নিচ থেকে কাঠের কাটা চিলতেওলো। ওয়ে পড়ে চোখ রাখলো কাটা জায়গার কাছে, বাইরে তাকালো।
ঠিকই আছে। চাবি বের করে দেয়া যাবে। চতুর্থ কাজটাও সমাপ্ত। এখন মুসা এসে হাজির হলেই চাবিটা ঠেলে দেবে বাইরে।
ঘড়ি দেখলো কিশোর। দুটো বাজতে সতেরো মিনিট বাকি। এতো দেরি করছে কেন মুসা? এততক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা। শোফারের সঙ্গে কোনো গোলমাল হলো? নাকি অন্য কোনো কারণে আটকে গেছে?
অ্যালউড হোফারের রহস্যজনক আচরণের কথা পড়তেই অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলো কিশোর।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে লিমুজিন।