চুপকরে অপেক্ষা করতে লাগলো কিশোর।
কাল রাতে সাউন্ড স্টেজ থেকে বেরোনোর সময় দেখলাম একটা লোক দৌড়ে যাচ্ছে দরজার দিকে। আমার পায়ের শব্দে চমকে গিয়ে নিশ্চয় দৌড় দিয়েছিলো। বাইরে তখন অন্ধকার, তবু কিছু কিছু দেখা যাচ্ছিলো। দেখলাম তরুণ বয়েসী একটা লোক ছুটে যাচ্ছে স্টুডিওর গেটের দিকে।
এবারও কিছু বললো না কিশোর।
ওর চেহারা দেখতে পাইনি, সাইনাস কললেন, তবে ওর চলাফেরাটা আমার কাছে বেশ পরিচিত লাগলো। পা নাড়ে অনেকটা চার্লি চ্যাপলিনের মতো। সেই ছেলেটা, যে চ্যাপলিনের অনুকরণ করতো, পাগল সংঘের ভারিপদ।
কাপগুলো রে করে নিতে এসেছিলো ভাবছেন? প্রথম প্রশ্নটা করলো কিশোর।
মাথা ঝাঁকালেন পরিচালক। তাছাড়া আর কি? আর তো কোনো কারণ থাকতে পারে না।
আর কোনো কারণের কথা কিশোরও ভাবতে পারলো না। কিন্তু তার দৌড়ে পালানোই প্রমাণ করে না যে ভারিপদই চোর।
তা করে না, তবে সন্দেহ করতে দোষ নেই, আবার আগের কণ্ঠস্বর পুরোপুরি ফিরে পেয়েছেন পরিচালক। সোজা হয়ে গেছে কাঁধ। একটা অনধিকার চর্চা করেছি। আমি জানি, আজ শনিবার, সাউন্ড স্টেজে শুটিং হবে না। কালও বন্ধ। সোমবারের আগে খুলছে না। এটা ভেবেই দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে এসেছি আমি।
পকেট থেকে একটা চাবি বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন তিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভারিপদই একাজ করেছে। আবার ফিরে যাবে স্টেজে, কাপগুলোর জন্যে। ও এখনও জানে না যে কাপগুলো যেখানে লুকিয়েছে সেখানে নেই।
ঠিক কাজই করেছেন আপনি, কিশোর বললো।
কর্তৃপক্ষ কড়া নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে, ব্যাপারটা যাতে গোপন রাখা হয়। চাবিটা কিশোরের দিকে ঠেলে দিলেন তিনি। নাও। ভারিপদের ওপর চোখ রাখবে। হয়তো ওকে ফাঁদে ফেলার একটা বুদ্ধি বের করে ফেলতে পারবে। যা ভালো বোঝো করো। তো, এখন আমাকে তো মাপ করতে হয়। কিছু জরুরী কাজ সারার আছে।
চাবিটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো কিশোর।
সে বেরিয়ে আসার সময় আবার বললেন সাইনাস, ভারিপদর ওপর কড়া নজর রাখবে।
করিডরে বেরিয়ে ঘড়ি দেখলো কিশোর। শো শুরু হতে এখনও ঘন্টা দুই বাকি। লিফটে করে লবিতে নেমে এলো আবার সে। কোণের একটা সোফায় আরাম করে বসলো। রাস্তার দিকের দরজা খুলে লোক আসছে, যাচ্ছে। ঢুকে বেশির ভাগই এগিয়ে যাচ্ছে লিফটের দিকে, রিসিপশন ডেস্কের কাছে থামছে কেউ কেউ।
হঠাৎ সামনে ঢুকে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো কিশোর। যার ওপর চোখ রাখতে বলা হয়েছে তাকে, সে ঢুকলো। লিফটের দিকে হেঁটে চলে গেল ভারিপদ।
ভরিপদ উঠলো। বন্ধ হলো লিফটের দরজা। উঠে গিয়ে নির্দেশক বাতির দিকে তাকিয়ে রইলো কিশোর। কোন্ কোন্ তলায় থামছে লিফট, কতোক্ষণের জন্যে, বাতিই বলে দিচ্ছে পরিষ্কার।
কয়েকবার থামলো লিফট। বোঝার উপায় নেই, ভারিপদ নামলো কোন তলায়। ফিরে এসে আবার আগের জায়গায় বসলো কিশোর।
একটা কথা অবশ্য জেনেছে কিশোর, সতেরো তলায় কুইজ শো-এর শুটিং হওয়ার কথা, কিন্তু সেই তলায় থামেনি লিফট। স্টুডিওতে ঢোকেনি ভারিপদ, তারমানে এই বিল্ডিঙেই অন্য কারও সঙ্গে দেখা করতে গেছে সে। বলা যায় না, আবার ফিরে আসতে পারে লবিতে। কিশোর যেমন এসেছে।
যেখানে আছে সেখানেই বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো কিশোর। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট পাচেক পরেই ফিরে এলো ভারিপদ। হেঁটে গেল তার সামনে দিয়ে। হাতে একটা খাম। বেরিয়ে গেল সে।
পিহু নিলো কিশোর। চতুরে বেরিয়ে দেখলো, একটা মোটর সাইকেলে উঠে স্টার্ট দিলো ভরিপদ। রওনা হলো ভাইন স্ট্রীট যেদিকে রয়েছে সেদিকে।
ট্যাক্সির আশায় এদিক ওদিক তাকালো কিশোর। কয়েক গজ দূরে একটা ট্যাক্সি থেকে নামছেন এক বৃদ্ধা মহিলা।
মহিলার ভাড়া মিটিয়ে দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো কিশোর, তারপর লাফ দিয়ে উঠে পড়লো পেহরে সীটে।
কোথায় যাবো? জিজ্ঞেস করলো ড্রাইভার।
সামনে ঝুঁকে আছে কিশোর, দ্রুত ভাবনা চলছে মাথায় ভারিপদ যদি স্টুডিওতে যায়ই, তাকে ওখানে অনুসরণ করে গিয়ে লাভ নেই। বরং তার আগেই গিয়ে যদি সাউড স্টেজের ভেতরে লুকিয়ে থাকতে পারে, তাহলে…
ড্রাইভারকে স্টুডিওর ঠিকানা বললো সে। মোটর সাইকেলটা এঞ্জিন খুব একটা জোরালো নয়, জোরে চালালে ওটার আগেই ভাইন স্ট্রীটে পৌঁছে যাবে ট্যাক্সি।
ঠিকই আন্দাজ করেছে সে। যাওয়ার পথে দ্বিতীয় ট্রাফিক সিগন্যালের কাছেই মোটর সাইকেলটাকে পেছনে ফেললো ট্যাক্সি। মাত্র দুই মাইল দূরে স্টুডিও, হলিউড বুলভারের পরেই।
স্টুডিওর গেটে নেমে ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে দিলো কিশোর। গার্ডকে পাস দেখাতেই পথ ছেড়ে দিলো। দ্রুত নয় নম্বর স্টেজের নির্জন বাড়িটার কাছে এসে দাঁড়ালো সে। চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো।
পুরোপুরি অন্ধকার এখন বিশাল ঘরটা। সাথে টর্চ থাকলে ভালো হতো, তবে আফসোস করে নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। যে কোনো মুহূর্তে এখানে পৌঁছে যেতে পারে ভারিপদ, যদি এখানেই আসার উদ্দেশ্য থাকে তার।
দরজাটা সামান্য ফাঁক করে রাখলো কিশোর, কিছুটা আলো যাতে আসতে পারে সেজন্যে। তবে খুব একটা সুবিধে হলো না। অনুমানে রান্নাঘরের দিকে এগোলো সে। বড় জোর মিটার দশেক এগিয়েছে, এই সময় দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হলো। ফিরে তাকিয়ে দেখলো, ফাঁক বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো আলোই আসছে না এখন। বাইরে থেকে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।