একটা টিনের ছাউনির নিচে রয়েছে এই ওয়ার্কবেঞ্চ। বেঞ্চটার একধারে পড়ে আছে কয়েকটা পুরনো ভাঙা ক্যারো। কিনে নিয়ে এসেছিলেন রাশেদ পাশা। ওগুলোর কোনোটার লেন্স, কোনোটার শাটার আর নানারকম পার্টস খুলে নিয়ে একটা বিশেষ ধরনের ক্যারো তৈরি করার ইচ্ছে কিশোরের। খুব ছোট জিনিস। জ্যাকেটের নিচে লুকিয়ে রেখে বোতরে ফুটো দিয়ে চোখ বের করেই যেটার সাহায্যে ছবি তোলা যাবে। পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে নতুন ধরনের কিছু তৈরি করে ফেলা তার হবি।
কয়েক মিনিট কাজ করার পরই হঠাৎ সোজা হয়ে মুখ তুললো সে, নামিয়ে রাখলো হাতের যন্ত্রপাতি। মাথার ওপরের লাল বাতিটা জ্বলছে-নিভছে। তারমানে ফোন বাজছে হেডকোয়ার্টারে।
দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে ট্রেলারে ঢুকে রিসিভার তুলে নিলো সে। হ্যালো, কিশোর পাশা কলছি।
হ্যালো, রাফায়েল সাইনাস বলছি। আমি ফোন করায় আশা করি কিছু মনে করোনি।
অবাক হয়ে ভাবলো কিশোর, কিভাবে খানিক পর পরই বদলে যায় সাইনাসের কণ্ঠস্বর। কাল রাতে কথা বলার সময় পুরনো কণ্ঠ ফিরে পেয়েছিলেন, এখন আবার মনে হচ্ছে পরাজিত, বিধ্বস্ত।
মোটেই না, জবাব দিলো কিশোর। বরং খুশি হয়েছি। জানতে ইচ্ছে করছে কাপ চোরকে ধরতে পেরেছেন কিনা।
না। পুরোপুরি পারিনি এখনও। সে-ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি। আবার পুরনো সুর খানিকটা ফিরে এলো। সাইনাসের কণ্ঠে। ফোনে এতো কথা গুছিয়ে বলা যাবে না। তুমি যদি দুপুরে একটু আগে আগে চলে আসে, তাহলে বলতে পারি।
আসবো। কটায় আসতে বলেন?
এই এগারোটা। রিসিপশন ডেস্কে আমার নাম বললেই হবে। একটু থামলেন। তোমার বন্ধুরাও আসছে?
না। একাই আসতে হবে আমাকে।
রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে খারাপই লাগলো কিশোরের, রবিন আর মুসাকে সঙ্গে নিতে পারছে না বলে। দুপুরে হলে পারতো, কিন্তু এগারোটায় নেয়া যাবে না। ওরা বাড়ি নেই। সৈকতে গেছে সাঁতার কাটতে। কিশোরকেও যেতে অনুরোধ করেছিলো। সে রাজি হয়নি। অনেক পথ সাইকেল চালিয়ে গিয়ে সাঁতার কেটে এসে ক্লান্ত হয়ে যাবে, শো-এর সময় অসুবিধে হবে।
রবিনের মাকে ফোন করলো সে। বলে দিলো, সে যথাসময়ে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে, রবিন আর মুসাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। রবিনকে যেন বলে দেন তিনি। বিশেষ কারণে তাকে আগেই চলে যেতে হচ্ছে।
তারপর অ্যালউড হোফারকে ফোন করলো। ফোন ধরলো হোফারই। বললো তিরিশ মিনিটের মধ্যেই ইয়ার্ডে পৌঁছে যাবে।
গাঢ় রঙের স্যুট, সাদা শার্ট আর সুন্দর একটা টাই পরে এসে ইয়ার্ডের গেটে দাঁড়ালো কিশোর। গাড়ি এলো।
নীরবে চললো ওরা হলিউডের দিকে। একটা কথাও বললেন না হোফার। কিন্তু টেলিভিশন নেটওয়ার্ক অফিসের বিরাট বিন্ডিংটার সামনে গাড়ি রেখে যখন কিশোরের নামার জন্যে পেছনের দরজা খুলে দিলো সে, কিশোরের মনে হলো শোফার কিছু বলতে চায়। চত্বরে চুপ করে দাঁড়ালো সে, শোনার জন্যে।
কুইজ শের শুটিং দেখিনি কখনও, হোফার বললো। অনেক দর্শক উপস্থিত থাকে ওখানে, না?
হ্যাঁ, জবাব দিলো কিশোর। অন্তত শদুয়েক লোক তো থাকবেই।
দেখাটা নিশ্চয় খুব মজার, এক পা থেকে আরেক পায়ে শরীরের ভার সরালো হোফার। দ্বিধা করে বললো, বাড়তি টিকেট কি আছে আর?
আছে। চারটে টিকেট দিয়েছে বেকার, যদি পরিবারের কাউকে আনতে চায় কিশোর, সেজন্যে। রবিন আর মুসাকে দুটো দেয়ার পরেও আরও দুটো রয়ে গেছে তার কাছে, মেরিচাচী আর রাশেদ পাশার। তারা আসেননি। একটা রে করে দিলো সে।
অনেক ধন্যবাদ, বলে খুব আগ্ৰয়ে সঙ্গে টিকেটটা নিলো হোফার। আপনার বন্ধুদেরকে আগে নিয়ে আসি, তারপর শো দেখবে।
বাড়িটায় ঢুকলো কিশোর। মুখে চিন্তার ছাপ। ক্রমেই অবাক করছে তাকে অ্যালিউড হোফার। তার বয়েসী একজন লোক একদল, প্রাক্তন শিশু শিল্পীর বকবকানি শুনে কি মজা পাবে? কি জানি, কার যে কোন জিনিস কখন ভালো লাগবে, বলা যায় না। হোফরের ডানা আপাতত মন থেকে বিদায় করলো সে।
সোজা সাইনাসের অফিসে কিশোরকে পাঠিয়ে দিলো ডেস্কের রিসিপশনিস্ট। দরজার ওপরে লেখা রয়েছে গেস্ট ডিরেক্টরস। তাকে দেখে খুশি হলেন পরিচালক। ডেস্কে তাঁর মুখোমুখি বসলো কিশোর।
কাল রাতে ভিকটর সাইমন অনেক প্রশংসা করলেন তোমার,ঝলতে শুরু করলেন সাইনাস। যদি শুধু কিশোর বলে ডাকি তোমাকে কিছু মনে করবে?
আপনার বয়েসী অনেকেই আমাকে কিশোর বলে ডাকে, মনে করবো কেন?
গুড। সাইমন বললেন গোয়েন্দা হিসেবে তুমি নাকি অসাধারণ। অনেকগুলো জটিল রহস্যের সমাধান নাকি করেছে তুমি আর তোমার দুই বন্ধু মিলে।
মাথা ঝাঁকালে কিশোর।
সেজন্যেই আমার হঠাৎ মনে হলে, থেমে গেলেন পরিচালক। ওই কাপ চুরির ব্যাপারটা জানাজানি করতে চায় না স্টুডিও কর্তৃপক্ষ, সেজন্যেই পুলিশকে জানায়নি। আবার দ্বিধা করলেন তিনি। কাল রাতেই আমি ভেবেছি, এটা তোমাদের জন্যে একটা চমৎকার রহস্য হতে পারে। যদি চোটাকে ধরে দিতে পারে ছোটখাটো একটা পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করতে পারি হয়তো।
তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিশোর বললো, পুরস্কারের চেয়ে কেসের ব্যাপারেই আমরা বেশি আগ্রহী।
গুড, সাদা পাতলা চুলে আঙুল চালালেন সাইনাস। কাউকে বলে দেবে না, শুধু এই বিশ্বাসের ওপর তোমাকে আমি বলছি, কিশোর, কাপগুলো কে চুরি করেছে, আমি জানি। যদিও এটা আমার সন্দেহ, তবে খুব জোরালো সন্দেহ।