কয়েক ফুট দূরের একটা টেবিলে আলো ফেলে বললো সে, বাক্সটা হয়তো ওটার ওপরেই রাখা ছিলো। কিন্তু আমরা রান্নাঘরে থাকার সময় একবারও ভোলা হয়নি এই দরজা, শুধু বাক্স নিয়ে অ্যানি ঢোকার সময় ছাড়া। ওয়েইটার, ক্যামেরাম্যান সবাই রান্নাঘরে ঢুকেছে সেটের খোলা অংশ দিয়ে, আমরা যেদিক দিয়ে ঢুকেছি। তাছাড়া সারাক্ষণ লোক ছিলো ওখানে, কর্মীরা। সুতরাং, রবিন আর মুসার দিকে ঘুরলো সে, তোমাদের কি মনে হয়?
কাপগুলো যে-ই চুরি করুক, রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে লুকাতে পারেনি, মুসা বললো। তা করতে হলে ওগুলো নিয়ে সবার সামনে এই দরজা দিয়ে বেরোতে হতো, যেটা করা সত্ব ছিলো না।
হ্যাঁ। মাথা ঝাঁকালো কিশোর। ধরা যাক, আমি চোর। ক্যানভাসে তৈরি রান্নাঘরের দেয়াল ঘুরে খোলা জায়গায় চলে এলো সে, যেখানে লাঞ্চের সময় কর্মীরা দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি এখানে ছিলাম, এবং আমাকে ঘিরে ছিলো অনেক লোক। কিন্তু যদি বাক্সটা নিয়ে আমি ওদিকে ওই টেবিলের দিকে চলে যাই, আমাকে কেউ দেখবে। সামনের দিকে টর্চের আলো ফেললো সে। তারপর এগিয়ে গেল টেবিলটার দিকে।
রান্নাঘরের দরজা তখন লাগানো। কাজেই এখানে হুট করে কারও চলে আসার। ভানা ছিলো না। কাজেই বাক্স খুলে কাপগুলো বের করে আবার ওটা সোনালি কাগজে মুড়ে রাখার যথেষ্ট সময় আমি পেয়ে যেতাম। সঙ্গে করে একটা চটের বস্তাটস্তা কিছু নিয়ে এলে ওগুলো ভরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু সবার চোখের ওপর দিয়ে ওটা বের করে নিয়ে যেতে পারতাম না, কাজেই…
কাজেই এখানেই কোথাও লুকিয়ে রাখতে হতো, কথাটা শেষ করে দিলো রবিন। ওর টর্চ বের করে জ্বাললো। আলো ফেলতে লাগলো কতগুলো তারের কুণ্ডলী, কিছু রঙের টিন, নানারকম মালপত্রের একটা দুই ফুট চওড়া, চার ফুট লম্বা স্তূপের ওপর। সব শেষে আলো ফেললো পাশের একটা ভারি কাঠের বাক্সের ওপর।
ওটার ওপর আলো ধরে রাখলো কিশোর। তার দুই সহকারী এগিয়ে গেল বাক্সের দিকে। ভেতরে ছুতোর মিস্ত্রীর কয়েকটা যন্ত্রপাতি ছাড়া আর কিছু নেই। মালপত্রের স্তূপ আর রঙের টিনের ভেতরেও কিছু পাওয়া গেল না।
ফিরে তাকালো রবিন আর মুসা। কিন্তু কিশোর ওদের দিকে তাকিয়ে নেই। সে গিয়ে দাঁড়িয়েছে একটা আর্ক লাইটের ধাতব স্ট্যান্ডের কাছে। হাত দিয়েই খোলালাগানো যায় এরকম বড় বড় গুলো পরীক্ষা করছে।
হঠাৎ স্থির হয়ে গেল সে। ঝট করে চোখ তুলে তাকালো কয়েক ফুট ওপরের কালো বড় বাক্সটার দিকে, যেটাতে রিফ্লেক্টর ভরা থাকে।
এই এদিকে এসো, সাহায্য করো আমাকে।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলো দুই সহকারী। ক্রুগুলো ঢিল করে বাক্সটা নিচে নামাতে সাহায্য করলো কিশোরকে। বারের হুড়কো খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলো গোয়েন্দাপ্রধান।
হঠাৎ যেন রাতের আকাশে সূর্য উঠলো। দপ করে জ্বলে উঠলো হাজার ভোল্টের অসংখ্য বাতি, অন্ধকারের চিহ্নমাত্র রইলো না সেটের কোথাও। আলোর বন্যায় ভেসে গেল সমস্ত রান্না।
৫
আর্ক লাইটের আলোয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। ধাতব দণ্ডটায় এখনও হাত রয়ে গেছে মুসা আর রবিনের। কিশোরের হাত রিফ্রেক্টর বক্সের ভেতরে।
যেখানে আহো, দাঁড়িয়ে থাকো, আদেশ দিলো একটা কণ্ঠ।
দাঁড়িয়ে রইলো হেলেরা। আলো জ্বালানোর মাস্টার কন্ট্রোল সুইচ বক্সের কাছ থেকে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন পাগল সংঘের পরিচালক রাফায়েল সাইনাস। তাকিয়ে আছেন কিশোরের দিকে। বের করে আনার দরকার নেই আর। উজ্জ্বল আলোয় এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বাক্সের ভেতরে রিফ্রেক্টরের পাশে পাঁচটা রূপার কাপ।
তাহলে ওখানেই লুকিয়েছে, সাইনাস বললেন। বিকেলে দেখা গিয়েছিলো বিধ্বস্ত এক বৃদ্ধ, এখন অন্য রকম হয়ে গেছে কণ্ঠস্বর। বহু বছর আগের সেই ধার
আবার ফিরে এসেছে অনেকখানি।
দুহাজার ডলার খরচা হয়েছে স্টুডিওর ওগুলো কিনতে, বললেন পরিচালক। চুরি করেছে তোমরা। সবাই চলে যাওয়ার পর এখন এসেছে রে করে নিতে।
না, কিশোর বললো। আমরা লুকাইনি। খুঁজে ব্রে করেছি। এক এক করে বাক্সের ভেতর থেকে বের করে তুলে দিতে লাগলো পরিচালকের হাতে।
কে বিশ্বাস করবে তোমার কথা? পরিচালক বললেন। যে লুকিয়েছে, তারই শুধু এতো সহজে ওগুলো খুঁজে পাওয়ার কথা।
আমি চুরি করিনি! গলা সামান্য চড়ালো কিশোর। ভেবে বের করেছি কোথায় ওগুলো লুকিয়ে রাখতে পারে চোর। হেডকোয়ার্টারে বসে আলোচনা করেছি আমরা…
হেডকোয়ার্টার! তীক্ষ্ণ হলো পরিচালকের দৃষ্টি। কি বলতে চাইছো?
আমাদের অফিস। যখন কোনো কেস হাতে পাই, ওখানে বসে আলোচনা করি আমরা। গবেষণা করি।
কিসের কেস? সাইনাসও গলা চড়ালেন। এরপর হয়তো বলে বসবে, তোমরা পুলিশের লোক। গোয়েন্দা।
গোয়েন্দাই আমরা, তবে পুলিশের লোক নই। আম্র শব্বে গোয়েন্দা। পকেট থেকে কার্ড বের করে দিলো কিশোর।
শূন্য দৃষ্টিতে কাউটার দিকে তাকালেন পরিচালক। তাতে কিছু প্রমাণ হয় না, গলার স্বরে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না তার। যে কেউ ওরকম ছেপে নিতে পারে। যদি ছেপে নাও তুমি এই স্টুডিওর প্রেসিডেন্ট, তাহলেই কি প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবে? এটা কোনো প্রমাণ না যে তুমি কাপ চুরি করোনি।
কিন্তু আমরা করিনি, জোর দিয়ে বললো রবিন। এখানে এসে পাওয়ার আগে জানতামই না কোথায় লুকানো আছে।