সন্দেহ জাগলো রবিনের। কল্পনা করেছে। বেশি নার্ভাস হলে হয় এরকম। আলাদা হওয়া উচিত হয়নি আমাদের।
দেয়ালটার কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। নিচু হয়ে কি দেখলো। মুসা ভুল দেখেনি, রবিন। দেখে যাও।
দ্রুত এগিয়ে গেল রবিন আর মুসা। পাথুরে মেঝেতে বড় বড় দুটো দাগ। পায়ের ছাপ। টর্চের আলোয় চকচক করছে।
কি…, কেঁপে গেল রবিনের গলা। কি ওগুলো, কিশোর?
ভেজা ভেজা লাগছে, জবাব দিলো কিশোর। পানি।
খাইছে! জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজালো মুসা।
সমস্ত মেঝেটায় আলো ফেলে ফেলে দেখলো কিশোর। আর ছাপ নেই। ছাতে আলো ফেললো। খটখটে শুকনো।
পানির চিহ্নও তো দেখছি না। এলো কোত্থেকে? বললো সে। মুসা ঠিকই বলেছে। কিছু একটা দাঁড়িয়ে ছিলো ওখানে। ভেজা ছাপ রেখে গেছে।
এতো বড়? রবিন বললো। দু-তিন ফুটের কম লম্বা হবে না।
বড়, ভেজা, চকচকে। দেখে মনে হয়…
দানবের! কিশোরকে কথা শেষ করতে দিলো না মুসা।
বুড়ো মানুষটা! বললো রবিন।
পরস্পরের দিকে তাকালো ওরা। চোখে অস্বস্তি। দানবে বিশ্বাস করে না, কিন্তু তাহলে ছাপগুলো কার?
তীব্র আলো এসে পড়লো তিনজনের গায়ে। পাথরের মূর্তি হয়ে গেল যেন ওরা।
আলোর পেছনে থেকে শোনা গেল খসখসে কণ্ঠ, কি, হচ্ছে কি এখানে?
ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো একটা মূর্তি। সামান্য কুঁজো, বাঁকা পিঠ। শাদা। ধবধবে লম্বা চুল-দাড়ি, উসকো-খুসকো, বহুদিন ওগুলোতে চিরুনি কিংবা নাপিতের কাঁচি লাগেনি।
হাতে লম্বা নলওয়ালা পুরনো আমলের রাইফেল।
০৬.
কালো সুড়ঙ্গমুখগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলো বুড়ো মানুষটা।
অনেক ভেতরে ঢুকেছে ওগুলো, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর। সহজেই হারিয়ে যাবে ওর মধ্যে ঢুকলে।
দুষ্টুমি করে একটা লাল চোখ টিপলো বুড়ো। চিনি তো জায়গাগুলো, ভালো করেই চিনি। পঞ্চাশ বছর ধরে আছি, মুণ্ডু কাটা যায়নি একবারও। শত্রুর সঙ্গে কতো লড়াই করলাম।
মুণ্ডু কাটা যায়নি? চোখ মিটমিট করলো মুসা। ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়াই, করেছেন? এখানে?
রাইফেলটা নাড়লো বুড়ো। ইনজুনস! ইনজুনসদের অনেক গল্প শোনাতে পারি তোমাদেরকে। সারা জীবন ওদের সাথে এখানে কাটালাম। লোক ভালো ওরা, তবে খুব খারাপ শত্রু। দুবার মুৎ প্রায় গিয়েছিলো আমার। ইউটি আর অ্যাপাচিদের দেশে গিয়ে। ভীষণ পাজি ওই অ্যাপাচিরা। কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছি।
এখন আর এখানে কোনো ইনডিয়ান নেই, স্যার, ভদ্রভাবে বললো কিশোর। আর আমরাও সুড়ঙ্গে ঢুকে হারাবো না।
কিশোরের ওপর স্থির হলো বুড়োর দৃষ্টি, যেন এই প্রথম তার ওপর চোখ পড়লো। এখন? না, এখন আর ইনজুনসরা নেই। তা তোমরা কি পাগল? এই গুহায় ঢুকতে সাহস করেছো? নতুন নাকি? কণ্ঠস্বর অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। চোখের বন্য দৃষ্টিও কোমল হয়েছে।
রবিন জবাব দিলো, হ্যাঁ, স্যার, রকি বীচ থেকে।
মিস্টার হারভের র্যাঞ্চে উঠেছি, মিস্টার..? জিজ্ঞাসু চোখে লোকটার দিকে। তাকালো কিশোর।
ডিন মারটিন, নাম বললো বুড়ো। ডিন বলে ডাকবে আমাকে। তো, হারভের ওখানে, আঁ? ভালো লোক ওরা। বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চিৎকার। শুনলাম। তোমাদেরই কেউ?
হ্যাঁ, স্যার, বললো কিশোর। তবে হারিয়ে গিয়ে সাহায্যের জন্যে চেঁচাইনি। নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন দেয়ালে, দাগ দিতে দিতে এসেছি।
তাই? বুদ্ধি আছে। আরও একশো বছর আগে জন্মানো উচিত ছিলো। তোমাদের, আরামে কাটাতে পারতে। তা এখানে কি করছো?
কিসে গোঙায় দেখতে এসেছি, রবিন বললো।
আমরা ঢুকতেই থেমে গেল, বললো মুসা।
হঠাৎ কুঁকড়ে গেল লোকটা। চোখে ভয় ফুটলো ৭ পরিবর্তনটা এতোই প্রকট, ছেলেদের মনে হলো অন্য একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে এখন। আগের বুড়ো নয়। গোঙানি, না? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে কণ্ঠস্বর। লোকে বলে, হেনরি ফিগারো ফিরে এসেছে। আমি বিশ্বাস করি না। গোঙান ওই ভদ্রলোক, বুড়ো মানুষটা। বুঝেছো? থামলো এক মুহূর্ত। ভয়ে ভয়ে তাকালো এদিক-ওদিক। শ্বেতাঙ্গরা এই এলাকায় আসার আগে থেকেই আছেন তিনি। সময়, বা বয়েস তাঁর কাছে কিছুই নয়। তিনি আছেন, থাকবেন। বাঁচতে চাইলে, তাঁকে রাগাতে না চাইলে আর কক্ষণো এখানে ঢুকো না। আমি ঢুকি বটে, কিন্তু গোঙানির কারণ। জানার চেষ্টা করি না। শেরিফ আর তার লোকেরাও তাঁকে ভয় পেতো। ওদের সবাইকেই ধরেছেন তিনি! ঢুকতে বারণ করে দেবে। এখানকার শেরিফও যেন না ঢোকে। ঢুকলে সবাইকে ধরবেন তিনি, কাউকে ছাড়বেন না।
ভীত চোখে কিশোরের দিকে তাকালো রবিন আর মুসা। কিন্তু সে তাকালো। না। চেয়ে আছে বুড়োর দিকে। ভাবছে কি যেন। তাঁকে আপনি কখনও দেখেছেন, মিস্টার মারটিন? বুড়ো মানুষটাকে? এই গুহায়?
তাঁকে? দ্রুত চারপাশে তাকালো মারটিন। এসো আমার সঙ্গে, বাইরে দিয়ে আসি। খবরদার, এখানে ঢুকে আর কখনও চিল্লাবে না। তিনি সহ্য করবেন না।
মাথা কাত করলো কিশোর হা, বেরোনো যায় এখন কি অনেক কিছুই দেখলাম। আপনি ঠিকই বলেছেন। এখানে সহজেই হারিয়ে যাওয়া যায়।
বৈদ্যুতিক লণ্ঠনটা তুলে নিলো বুড়ো। ছেলেদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো গুহার বাইরে, উপত্যকায়। সঙ্গে সঙ্গে চললো, একেবারে সাইকেলের কাছে পৌঁছে দেবে। কান খাড়া রেখেছে কিশোর। কিন্তু গোঙানি আর শোনা গেল না।
ডিন মারটিনকে ধন্যবাদ দিলো ছেলেরা, গুড নাইট জানালো।
তোমরা খুব ভালো ছেলে, চালাক, বললো মারটিন। তবে বুড়ো মানুষটা তোমাদের চেয়ে, চালাক, সবার চেয়েই চালাক। তোমরা সাবধানে থাকবে। হারভেকেও হুঁশিয়ার করে দেবে। বলবে, বুড়ো মানুষটা সবার ওপরই চোখ রাখছেন। খনখনে হাসি হাসলো সে।