কিশোর ওদের সঙ্গে যোগ দিলো না। টর্চের আলোয় গভীর মনোযোগে কি যেন দেখছে। ডাকলো, এই, দেখে যাও।
ওদের বায়ে, দেয়ালে কালো একটা ছোট ফোকর। আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ। ওরকম আরও অনেকগুলো ফোকর দেখতে পেলো ওরা। কমপক্ষে দশটা সুড়ঙ্গ ঢুকেছে গিয়ে পর্বতের ভেতরে।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। কোনটা দিয়ে যাবো?
সব কটা ফোকরই প্রায় একরকম। মুসার সমান উঁচু, চার ফুট চওড়া।
ভ্রূকুটি করলো কিশোর। মনে হচ্ছে সারা পর্বতের তলায়ই ছড়িয়ে আছে সুড়ঙ্গ।
এ-জন্যেই বোধহয় ফিগারোকে খুঁজে পায়নি শেরিফ। এতো সুড়ঙ্গ, কয়টাতে খুঁজবে? ওরা একদিকে গেলে ফিগারো আরেক দিকে সরে গেছে। লুকিয়ে থেকেছে।
হতে পারে।
এই গুহা আর সুড়ঙ্গ তৈরি হলো কিভাবে? অবাক হয়ে দেখছে মুসা।
পানি, বললো রবিন। বইয়ে পড়েছি। নানারকম পাথর দিয়ে তৈরি হয় এসব পর্বত। কিছু পাথর শক্ত, কিছু নরম। পানিতে ক্ষয় হয়ে, কিংবা গলে গিয়ে ধুয়ে চলে যায় নরম পাথরগুলো, শক্তগুলো থেকে যায়। ফাঁকগুলোতে তৈরি হয়েছে সুড়ঙ্গ। কোটি কোটি বছর লেগেছে এসব হতে। অনেক অনেক আগে এই এলাকার বেশির ভাগ অঞ্চলই পানির তলায় ছিলো।
তবে সব সুড়ঙ্গই যে প্রাকৃতিক, কিশোর বললো। তা নয়। মানুষেও বানিয়েছে কিছু। হয়তো হেনরি ফিগারোর লোকেরা।
কিংবা মাইনাররা। সোনার লোভে খুঁড়েছে।
এক ফোকর থেকে আরেক ফোকরে আলো সরাচ্ছে মুসা। কোনটা থেকে শুরু করবো?
সবগুলো দেখতে হলে তো কয়েক মাস লেগে যাবে।
কাজেই সবগুলোতে দেখা যাবে না, বললো কিশোর। শুধু যেটা থেকে গোঙানি আসে সেটায়। প্রত্যেকটা ফোকরের কাছে গিয়ে কান পাতবো। যেটা থেকে শোনা যাবে…
কিশোর! বাধা দিলো রবিন। একটা ব্যাপার খেয়াল করেনি? গুহায় ঢোকার পর থেকে আর শুনছি না!
স্থির দাঁড়িয়ে কান পেতে রইলো তিনজনে। রবিন ঠিকই বলেছে। কবরের নীরবতা গুহার মধ্যে। কোনো শব্দ নেই।
এর মানে কি? মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি।
এর পর আরও দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। গোঙানি শোনা গেল না।
পাথর পড়ার পর থেকেই আর আওয়াজটা শুনিনি, রবিন বললো।
হ্যাঁ, বললো কিশোর। এতো বেশি উত্তেজিত ছিলাম, খেয়ালই করিনি কখন থেমে গেছে।
কি করবো এখন? মুসার প্রশ্ন।
শুরু হতে পারে আবার, আশা করলো কিশোর। মিস্টার হারভে বলেছেন আওয়াজটা অনিয়মিত, নির্দিষ্ট সময় পর পর শুরু হয় না। না হোক, ইতিমধ্যে যে কটা সুড়ঙ্গ পারি দেখে ফেলি আমরা। ১৭৬
মুসা আর রবিন রাজি। এই দুঃসহ অন্ধকারে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে যা-ই হোক কিছু একটা করা ভালো। একটা সুড়ঙ্গে ঢোকার আগে চক দিয়ে দেয়ালে চিহ্ন এঁকে দিলো রবিন।
সাবধানে এগোলো ওরা। অন্ধকারের কালো চাদর ফুঁড়ে বেরোচ্ছে যৈন টর্চের আলো। তিরিশ ফুট মতো এগিয়েই শেষ হয়ে গেল সুড়ঙ্গটা। সামনে দেয়াল নয়, পাথর পড়ে বন্ধ হয়েছে।
গুহায় ফিরে এলো ওরা।
পাশাপাশি চারটে সুড়ঙ্গে ঢুকে দেখলো। ঢোকার আগে অবশ্যই মুখের কাছে চক দিয়ে চিহ্ন এঁকে রাখলো। কোনোটা দিয়েই বেশি দূরে এগোতে পারলো না। পাথর পড়ে পথ বন্ধ।
অযথা সময় নষ্ট করছি, অবশেষে বললো কিশোর। এক কাজ করা যাক। তিনজনে একসঙ্গে না ঢুকে আলাদা আলাদা সুড়ঙ্গে ঢুকি। তাতে সময় বাঁচবে, দেখাও হবে বেশি। ভোলা সুড়ঙ্গ যে-ই দেখতে পাবো, ফিরে এসে অপেক্ষা করবো। এখানে অন্য দুজনের জন্যে।
তিনজনে ঢুকে পড়লো তিনটে সুড়ঙ্গে।
কিশোর যেটাতে ঢুকলো, শুরুতে সেটা প্রাকৃতিকই মনে হলো। অল্প কিছু দূর। পর্যন্ত তারপর চোখে পড়লো কড়ি-বরগা আর থাম। মাইন শ্যাফট। খনির কাজে খোঁড়া হয়েছিলো। সাবধানে এগিয়ে গেল আরও কয়েক গজ।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো। সামনে বন্ধ। পাথরের স্তূপ। পড়ে থাকা একটা পাথর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তার। এখানকার অন্যান্য পাথরের চেয়ে আলাদা। তুলে নিয়ে ওটা পকেটে রেখে দিলো, পরে ভালোমতো দেখার জন্যে।
এই সময় শোনা গেল মুসার চিৎকার। কিশোর! রবিন! জলদি এসো!
.
সুড়ঙ্গ পেরিয়ে রবিন তখন আরেকটা গুহায় ঢুকেছে। এটাও প্রথম গুহাটার মতোই। হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে। এটাতেও প্রথমটার মতোই অসংখ্য সুড়ঙ্গমুখ। ফেরার জন্যে সবে ঘুরেছে, এই সময় কানে এলো মুসার চিৎকার। দিলো দৌড়।
কিশোরও দৌড় দিয়েছে। আচমকা অন্ধকার থেকে কি যেন একটা এসে পড়লো তার ওপর। চিত হয়ে পাথুরে মেঝেতে পড়ে গেল সে। তার গলায় খামচি মারার চেষ্টা করলো কয়েকটা আঙুল।
বাঁচাও! বাঁচাও! আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলো একটা কণ্ঠ।
রবিন! আরে আমি, কিশোর।
ঢিল হলো আঙুলগুলো। একে অন্যের ওপর টর্চের আলো ফেললো ওরা।
আমি ভাবছিলাম, কিসের গায়ে জানি পড়লাম! বললো রবিন।
আমিও তাই ভেবেছি। মুসার চিৎকারে চমকে গিয়ে…চলো, চলো।
মুসা যে-সুড়ঙ্গে ঢুকেছে সেটাতে ঢুকলো দুজনে। এ-পর্যন্ত যে-কটাতে ঢুকেছে ওরা, সবগুলোর চেয়ে এটা লম্বা মনে হলো। সামনে টর্চের আলো নাচছে। মুসার হাতে।
এই যে, আমি এখানে, ডাকলো সে।
আরেকটা বড় গুহায় এসে ঢুকলো কিশোর আর রবিন। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। চেহারা ফ্যাকাশে। টর্চের আলো ফেলেছে বা দেয়ালে।
ওখানে…ওখানে কি যেন দেখলাম! কালো! চকচকে!
রবিন আর কিশোর আলো ফেললো। কিছুই দেখলো না।
আমি শিওর দেখেছি, জোর দিয়ে বললো মুসা। ঢুকে প্রথমে আওয়াজ শুনলাম। লাইট ফেলে দেখি..ওটা! ওই দেয়ালের কাছে। বিরাট। হাত থেকে টর্চ পড়ে গিয়েছিলো আমার। আবার তুলে আলো ফেলে দেখলাম, নেই!