হঠাৎ, কোনো রকম জানান না দিয়েই শুরু হলো গোঙানি, ছড়িয়ে পড়লো সারা উপত্যকায়।
চমকে উঠলো রবিন আর মুসা।
গুড, বললো কিশোর। থামেনি। আজ চলবে মনে হচ্ছে।
নীরবে সাইকেল থেকে নামলো তিনজনে, স্ট্যাণ্ডে তুললো। উঁচু শৈলশিরায় উঠে তাকালো চন্দ্রালোকিত উপত্যকার ওধারে হেনরি ফিগারোর কালো গুহামুখের দিকে।
কিশোর, বলে উঠলো রবিন। কি যেন নড়ছে!
আমি খুটখাট শুনছি, মুসা বললো।
হ্যাঁ, মাথা দোলালো কিশোর। আসলে কল্পনা করছে। এরকম জায়গায় এই পরিবেশে স্বাভাবিক জিনিসকেও অস্বাভাবিক লাগাটা স্বাভাবিক, শুরু হলো তার লেকচার। অতি সাধারণ জিনিসও চমকে দেবে। আতঙ্কিত করে তুলবে। ওসব আলোচনা এখন থাক। রবিন, টর্চগুলো আরেকবার পরীক্ষা করো।
পরীক্ষা করলো রবিন। দড়ির বাণ্ডিলে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কাঁধে ঝোলালো মুসা। যার যার চক নিয়ে পকেটে ভরলো। কিশোরের শাদা চক, মুসার নীল, রবিনের সবুজ।
এসব এলাকার পুরনো গুহাগুলো খুব বিপজ্জনক, বললো কিশোর। সুড়ঙ্গের কোথায় যে চোরাখাদ লুকিয়ে থাকে বোঝা মুশকিল। পা ফেলেছে কি ধপাস, এক্কেবারে তলায়। দড়ি ছাড়া তোলা প্রায় অসম্ভব। সেজন্যেই দড়ি নিয়েছি।
চক দিয়ে চিহ্ন আঁকতে আঁকতে যাবো? জিজ্ঞেস করলো রবিন।
নিশ্চয়।
চলো। গেলে আর দেরি করে লাভ নেই।
হ্যাঁ, চলো।
ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলো ওরা, উপত্যকায়।
আবার সেই অদ্ভুত গোঙানি ঢেউ তুললো যেন রাতের শান্ত নীরবতায়।
গুহার কাছাকাছি চলে এলো ওরা। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে গায়ে। লাগলো। হাঁ করে থাকা কালো সুড়ঙ্গমুখের কাছে এসে টর্চ জ্বাললো কিশোর, ঠিক এই সময় কানে এলো চাপা শব্দ।
কিসের? চেঁচিয়ে উঠলো রবিন।
বাড়ছে শব্দটা, জোরালো হচ্ছে। উপত্যকার চারপাশেই ঘিরে আছে পাহাড়, সেগুলোতে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুললো। ফলে বোঝা গেল না ঠিক কোনখান থেকে আসছে। মনে হচ্ছে, চার পাশ থেকেই হচ্ছে শব্দ।
ওই দেখো! ওপর দিকে হাত তুলে জোরে চিৎকার করে উঠলো মুলা।
ডেভিল মাউনটেইনের ওপর থেকে ঢাল বেয়ে নেমে আসছে বিশাল এক পাথর, ওটার ধাক্কায় ঝুরঝুর করে বৃষ্টির মতো ঝরতে আরম্ভ করেছে অসংখ্য ছোট পাথর।
সরো! আবার চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
পাথরটা ওদের ওপরই পড়বে মনে হচ্ছে। এক লাফে পাশে সরে গেল রবিন।
কিশোর দাঁড়িয়েই রইলো, যেন জমে গেছে। চেয়ে রয়েছে পাথরটার দিকে। তার ওপরেই এসে পড়বে।
.
০৫.
ঝাঁপ দিলো মুসা। কিশোরকে নিয়ে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। ধুড়ুম করে পড়লো। পাথরটা। গুহামুখের কাছ থেকে সরতে আর এক মুহূর্ত দেরি হলেই ভর্তা হয়ে যেতো গোয়েন্দাপ্রধান।
এই, এই তোমাদের কিছু হয়েছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো রবিন।
না, আমার কিছু হয়নি, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জবাব দিলো মুসা। কিশোর?
খুব ধীরে ধীরে উঠলো কিশোর। কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়লো। চোখ দেখে মনে হচ্ছে যেন এ-জগতে নেই সে। গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে। নড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম বিড়বিড় করে বললো। হয় এরকম। আশ্চর্য এক মানসিক প্রতিক্রিয়া। সাময়িক ভাবে পঙ্গু করে দেয় শরীরকে। শিকার ধরার আগে ছোট ছোট জানোয়ারকে এভাবেই সম্মোহিত করে ফেলে বিশাল সাপ…
আরে ধ্যাত্তোর! রাখো তোমার লেকচার! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মুসা। বলি, ঠিকঠাক আছে? না ভেঙেছে কিছু?
ফিরেও তাকালো না কিশোর। চাঁদের আলোয় আলোকিত ডেভিল মাউনটেইনের ওপর দিকে চেয়ে রয়েছে, চোখে পলক পড়ছে না। দেখে মনে হচ্ছে অনেক আলগা পাথর আছে ওখানে, আনমনে বললো সে। পাহাড়ের ঢালও খটখটে শুকনো। এখানে ওভাবে পাথর গড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। বহু জায়গার পাথরই বোধহয় আলগা করে দিয়েছে নেভির কামান।
তিনজনেই এগোলো বিশাল পাথরটার দিকে। সুড়ঙ্গমুখের কয়েক গজ দূরে। মাটিতে বসে গেছে।
দেখো, দাগ; পাথরটা দেখিয়ে বললো রবিন। কিশোর, কেউ ঠেলে ফেলেনি তো?
কিছু দাগ আছে, ভালোমতো পাথরটা দেখে সোজা হলো কিশোর। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
পড়ার সময় ঘষা খেয়েছে, মুসা বললো। দাগ তো হবেই।
ওপরে কিন্তু কাউকে দেখিনি আমরা, বললো রবিন।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। দেখিনি। দেখা দিতে চায়নি বলেই হয়তো। দেখিনি।
ফিরে গিয়ে দেখবো নাকি আবার? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
না। আরও সাবধান থাকতে হবে আমাদের। গুহার ভেতরে অবশ্য সে-ভয় নেই। অন্তত মাথার ওপর পাথর খসে পড়বে না।
গুহায় ঢুকলো তিনজনে। কিশোর আগে আগে রয়েছে। দেয়ালে আশ্চর্যবোধক আর একটা তীর চিহ্ন আঁকলো রবিন। সুড়ঙ্গমুখের কাছেই।
টর্চের আলোয় দেখা গেল, লম্বা অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গ সোজা ঢুকে গেছে। ডেভিল মাউনটেইনের গভীরে। মসৃণ দেয়াল। ছাত মুসার মাথার চেয়ে সামান্য উঁচুতে। কিশোর আর রবিন তার চেয়ে বেঁটে, ফলে হাঁটতে অসুবিধে হলো না কারোই।
চল্লিশ ফুট মতো সোজা এগিয়ে গেল পথটা। শেষ মাথায় বিরাট এক গুহা।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলে দেখলো ছেলেরা। যেমন বড় ঘর, তেমনি উঁচু তার ছাত। আবছা দেখা যাচ্ছে ওপাশের দেয়াল।
আরিব্বাবা! বললো রবিন। এতো বড় গুহা আর দেখিনি। কেমন যেন শূন্য, দূরাগত শোনালো তার কথাগুলো।
হাল্লো! চেঁচিয়ে বললো মুসা।
হাল্লো.. হাল্লো…হাল্লো-ও-ও-ও-ও-ও! প্রতিধ্বনি হলো।
হেসে উঠলো মুসা। রবিনও। মজা পেয়ে দুজনেই হাল্লো হাল্লো শুরু করলো। গুহাটাও যেন রসিকতা শুরু করলো তাদের সঙ্গে।