খাইছে! বলে উঠলো মুসা। এখনও আছে!
কি করে থাকে? রবিনের জিজ্ঞাসা।
দেখো, বললেন প্রফেসর। অনেক রিসার্চ করেছি আমি, অনেক খোঁজখবর করেছি হেনরি ফিগারোর। অনেক কিছু জেনেছি। তার মধ্যে ভুল তথ্যও অনেক আছে। এই যেমন ধরো, ওর যতো পুরনো ছবি আছে, সবগুলোতে দেখা যায়। পিস্তলের খাপ কোমরের ডান দিকে ঝোলানো, অথচ আমি শিওর সে বাইয়া।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকালো কিশোর। কিংবদন্তীতে অনেক সময়ই ভুল। তথ্য থাকে। বিশেষ করে এধরনের বিখ্যাত মানুষদের সম্পর্কে।
ঠিক বলেছো, তর্জনী নাচালেন প্রফেসর। অফিশিয়াল রেকর্ড বলে, পালানোর দিনই রাতে গুহার ভেতরে মারা গিয়েছে হেনরি। ভালোমতো খুঁটিয়ে পড়েছি আমি সমস্ত রেকর্ড, গবেষণা করেছি। পরিষ্কার বুঝেছি গুলির আঘাত মারাত্মক ছিলো না। তখন তার বয়েস ছিলো আঠারো বছর। কাজেই, এখনও তার বেঁচে থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়!
.
০৪.
কি বাজে বকছো! প্রায় ফেটে পড়লেন মিস্টার হারভে। তারমানে একশোর কাছাকাছি তার বয়েস। ওরকম বয়সের একজন লোক ওভাবে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ায় কি করে?
পারে, পারে, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন প্রফেসর। শুনলে অবাক হবে, রাশিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলে, ককেসাস পর্বতমালার উপজাতীয় লোকেরা একশো বছর বয়েসেও ঘোড়ায় চড়ে, লড়াই করে।
তা ঠিক, স্যার,বললো কিশোর।
কিংবা এমনও হতে পারে, বললেন প্রফেসর। হেনরির কোনো বংশধর আছে। ছেলে, কিংবা নাতি। হেনরির ইচ্ছা পূরণ করতে এসেছে।
কিছুটা বিমনা মনে হলো মিস্টার হারভেকে। হ্যাঁ, তা হতে পারে। আমাদের। আগে যারা ছিলো, তারা মোনিং ভ্যালির কাছে যেতো না। কিন্তু আমি ঠিক করেছি ওখানে একটা কোরাল বানাবো। হয়তো হেনরির ছেলে বা নাতি চায় না গুহার ঐতিহ্য নষ্ট হোক।
হ্যাঁ, এটাই জবাব! চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস হারভে। রক, মনে আছে, র্যাঞ্চের পুরনো কয়েকজন মেকসিকান শ্রমিক বিরক্ত হয়েছিলো? কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। তারা চায়নি; মোনিং ভ্যালিতে কোরাল উঠুক। তারপর থেকেই তো, শুরু হলো গোঙানি।
মনে আছে। ওরাই প্রথম গেছে। কালই দেখা করবো আমি শেরিফের সাথে। হেনরির কোনো বংশধর আছে কিনা খোঁজখবর নিতে বলবো।
একটা ছবি দেখাচ্ছি, পকেট থেকে ছোট একটা ফটোগ্রাফ বের করে দিলেন। প্রফেসর।
হাতে হাতে ঘুরতে লাগলো ছবিটা। ছিপছিপে এক তরুণের ছবি। কালো চোখের তারায় যেন আগুনের ঝিলিক, গর্বিত মুখ। চওড়া কানা আর উঁচু চূড়ওয়ালা, কালো ভ্যাকুয়েরো সমব্রেরো হ্যাট মাথায়। গায়ে খাটো কালো। জ্যাকেটের নিচে কালো উঁচু কলারের শার্ট, পরনে কালো আঁটো প্যান্ট, নিচের দিকটা ছড়ানো। পায়ে কালো চকচকে পয়েন্টেড বুট। ক্যামেরায় তোলা জীবন্ত হেনরির ছবি নয়, একটা পেইন্টিঙের ফটোগ্রাফ।
সব সময়ই কি কালো পরতো? জানতে চাইলো রবিন।
সব সময়, জবাব দিলেন প্রফেসর। শোকের চিহ্ন। তার পরিবার আর দেশের জন্যে শোক করতো।
চোরের আবার দেশপ্রেম! সাধারণ একটা ডাকাত ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। ব্যাটা, ক্ষোভ ঢেকে রাখতে পারলেন না আমেরিকান র্যাঞ্চার। বলেই বুঝলেন, কথাটা খারাপ হয়ে গেছে। হেসে সামাল দিলেন। বসে বসে কিচ্ছা শুনলে র্যাঞ্চ চলবে না, অনেক কাজ আছে আমার। আজ রাতেই সেগুলো সারতে হবে। ছেলেদের দিকে তাকালেন। তোমরা নিশ্চয় খুব টায়ারড। কাল খাটাবো তোমাদেরকে। মুসার বাবা বলে দিয়েছে, কি করে র্যাঞ্চ চালাতে হয় তার ছেলেকে যেন শিখিয়ে দিই।
মোটেই টায়ারড নই আমি, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। তোমরা?
আমিও না, রবিন বললো।
আমিও না, প্রতিধ্বনি করলো যেন মুসা।
সবে তো সন্ধ্যা হয়েছে, বললো কিশোর। আকাশও ভালো। সুন্দর রাত। র্যাঞ্চের আশপাশে ঘুরে দেখতে চাই। রাতের বেলা নাকি এখানকার সৈকতে নানা রকম সামুদ্রিক জীব উঠে আসে। দেখার সুযোগ কে ছাড়ে?
রাতের বেলা…, মিসেস হারভে ঠিক মেনে নিতে পারছেন না।
নিশ্চয়ই, তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন মিস্টার হারভে। দেখতে এসেছে, দেখবে। ঘুমিয়ে কাটানোর জন্যে তো নিজের বাড়িই আছে, র্যাঞ্চে কেন?
বেশ, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন মিসেস হারভে। তবে দশটার বেশি দেরি। করবে না। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি আমরা এখানে।
আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না ওখানে তিন গোয়েন্দা। বেরিয়ে এলো।
বাইরে বেরিয়েই নির্দেশ দিলো কিশোর, মুসা, গোলাঘর থেকে এক বাণ্ডিল দড়ি নিয়ে এসো। রবিন, তুমি গিয়ে আমাদের চক আর টর্চ আনো। আমি সাইকেলগুলো পরীক্ষা করে দেখি, কোনো গোলমাল আছে কিনা।
গুহায় যাচ্ছি নাকি আমরা? জিজ্ঞেস করলো রবিন।
হ্যাঁ। গোঙানির রহস্য ভেদ করতে হলে গোঙানি উপত্যকায়ই যেতে হবে।
গুহায় ঢুকবে? শুকনো গলায় বললো মুসা। এই রাতে না গিয়ে দিনে গেলে হতো না?
না। রাতের বেলায়ই গোঙানি শোনা যায়। আর গুহার ভেতরে দিন-রাতের তফাৎ কি? সব সময়ই অন্ধকার, এক রকম। আজ গোঙাতে শুরু করেছে গুহাটা, কাল হয়তো থেমে যাবে। তারপর আবার কয় দিন অপেক্ষা করতে হবে ঠিক আছে? যাও।
কয়েক মিনিট পর সাইকেল চালিয়ে র্যাঞ্চের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলো তিন কিশোর। মুসার সাইকেলের ক্যারিয়ারে দড়ির বাণ্ডিল। সরু একটা কাঁচা রাস্তা ধরে চললো ওরা।
র্যাঞ্চটা সাগরের কিনারে বটে, কিন্তু বেরোলেই সাগর চোখে পড়ে না। কয়েক মাইল পর্যন্ত আড়াল করে রেখেছে উপকূলের পাহাড়। চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নায় নীরব প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন পাথুরে পাহাড়ের উঁচু চূড়াগুলো। সবুজ ওক গাছগুলোকে এখন দেখাচ্ছে ফ্যাকাশে শাদা, কেমন যেন। ভূতুড়ে। সাইকেল চালাতে চালাতে ছেলেদের কানে এলো বিচিত্র শব্দ, চারণক্ষেত্রে অস্থির হয়ে উঠেছে গরুর পাল। নাক দিয়ে শব্দ করছে ঘোড়া, চঞ্চল।