আমিও শুনতে চাই, কিশোর বললো।
চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন প্রফেসর। শোনালেন হেনরি ফিগারোর বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চকর কাহিনীঃ
ক্যালিফোর্নিয়ার শুরুতে আজকের এই হারভে র্যাঞ্চছিলো র্যাঞ্চো ফিগারোর একটা অংশ। স্প্যানিশ সেটলাররা তখন সবে আসতে শুরু করেছে এই অঞ্চলে। সবার আগে এসেছিলো ফিগারো পরিবার, স্পেনের রাজার কাছ থেকে জমির দখল সত্ত্ব নিয়ে। বিশাল এলাকা জুড়ে বসেছিলো তারা। আমেরিকার পূর্বাঞ্চলে তখন ইংরেজদের ভিড়, দলে দলে এসে উপনিবেশ গড়ছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় স্প্যানিশরা তেমন করে দল বেঁধে আসেনি; আসতো একজন, দুজন করে। ফলে কয়েক পুরুষ ধরে র্যাঞ্চো ফিগারোর সীমানার কোনো রদবদল হলো না।
তারপর হঠাৎ করেই পুব থেকে সেটলাররা দলে দলে আসতে শুরু করলো ক্যালিফোর্নিয়ায়। আস্তে আস্তে হাতছাড়া হতে লাগলো ফিগারোদের জমি, জবর দখল হয়ে যেতে লাগলো। মেকসিকো যুদ্ধের পর ক্যালিফোর্নিয়া যোগ হয়ে গেল যুক্তরাজ্যের সঙ্গে। তখন আরও বেশি আমেরিকান সেটলার চলে এলো এই এলাকায়, বিশেষ করে ১৮৪৯ সালের ঐতিহাসিক গোল্ড রাশ-এর পর। ১৯০০ সাল নাগাদ ফিগারোদের প্রায় সমস্ত জমিই হাতছাড়া হয়ে গেল, শুধু ছোট একটা অংশ বাদে, তার মধ্যে পড়লো হারভে র্যাঞ্চ আর ওই অভিশপ্ত মোনিং ভ্যালি।
ফিগারোদের শেষ বংশধরের নাম হেনরি ফিগারো। দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী, বেপরোয়া এক তরুণ, আমেরিকানদের দুচোখে দেখতে পারতো না। তাদেরকে চোর-ডাকাত মনে করতো। ফিগারোদের টাকার গরমও আর নেই তখন, ক্ষমতাও শেষ। প্রতিশোধের আগুন সব সময় দাউদাউ করে জ্বলতো তরুণ, হেনরির মনে। ভাবতো, যে করেই হোক আবার তার পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি নিজের দখলে। আনবে। বেশ কিছু পুরনো স্প্যানিশ আর মেকসিকান পরিবার তখনও ছিলো ক্যালিফোর্নিয়ায়, তাদেরকে দলে টানার চেষ্টা করলো সে.। আমেরিকানদের বিরোধিতা করে হয়ে গেল আউট-ল, পর্বতের গভীরে ঘাঁটি করলো। স্প্যানিশদের কাছে হয়ে গেল এক নতুন রবিন হুড, আর আমেরিকানদের কাছে ডাকাত।
তাকে ধরার জন্যে অনেক চেষ্টা করলো আমেরিকানরা, পারলো না। এই অঞ্চলের পাহাড়-পর্বত সব চেনা হেনরির, কোথায় কখন লুকিয়ে থাকে বুঝতেই পারলো না কেউ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগঃ করের টাকা চুরি, ট্যাক্স কালেকটরদের ভয় দেখিয়ে মেরে-পিটে তাড়িয়ে দেয়া, আমেরিকান সরকারের বিভিন্ন অফিসে চড়াও হয়ে তাদের টাকা লুটপাট, স্প্যানিশ-ভাষী ক্যালিফোর্নিয়ানদের সাহায্য করা আর আমেরিকানদের আতঙ্কিত করে রাখা।
তবে, বছর দুই পরে ১৯০৮ সালে সানতা কারলার শেরিফের হাতে ধরা পড়ে গেল সে। বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে আদালতে। বিচারে ফাসীর আদেশ হলো। তার। স্প্যানিশ-ভাষীরা বলে বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। যা-ই হোক, ফাঁসীর দুই দিন আগে কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় দিনের আলোয় সবার চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে গেল হেনরি। আদালতের ছাতে উঠে, লাফিয়ে পাশের আরেকটা ছাতে গিয়ে পড়লো। সেখান থেকে লাফ দিয়ে নামলো তার বিখ্যাত কালো ঘোড়ার। পিঠে-ঘোড়াটাকে তার জন্যেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিলো সেখানে।
পালানোর সময় গুলিতে আহত হলো হেনরি। পেছনে তাড়া করে এলো শেরিফ আর তার দলবল। সোজা পর্বতের দিকে ছুটলো হেনরি, মোনিং ভ্যালিতে গিয়ে ঢুকে পড়লো একটা গুহায়। শেরিফের জানামতে যতোগুলো সুড়ঙ্গমুখ ছিলো, ওই গুহা থেকে বেরোনোর, সব বন্ধ করে দেয়া হলো। ভেতরে ঢুকলো না কেউ, কিংবা ঢোকার সাহস করলো না। বাইরে পাহারায় রইলো। শেরিফ মনে করলো, হেনরি আহত, ক্ষতের যন্ত্রণা তো আছেই, তার ওপর ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাহিল হয়ে এক সময় না এক সময় নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে।
দিনের পর দিন বসে রইলো ওরা, হেনরি বেরোলো না। সারাক্ষণ গুহার ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত গোঙানি কানে এসেছে ওদের। অবশেষে তার লোকদের গুহায় ঢোকার আদেশ দিলো শেরিফ। নিজেও ঢুকলো। গুহা আর যতোগুলো সুড়ঙ্গ চোখে পড়লো সবগুলোতে খুঁজলো, চার দিন ধরে, হেনরিকে পেলো না। বেরিয়ে এসে আশপাশের এলাকায় তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কিন্তু কিছুই পেলো না। না জীবন্ত হেনরি, না তার লাশ, না তার কাপড়-চোপড়। ঘোড়া, পিস্তল, টাকা, কিচ্ছু পেলো না।
এরপর আর কেউ দেখেনি হেনরিকে। কেউ কেউ বলে, তাকে পালাতে সাহায্য করেছিলো তার প্রেমিকা নোরিটা। গোপন সুড়ঙ্গ পথে গুহায় ঢুকে বের করে নিয়ে এসেছিলো আহত মানুষটাকে। দুজনেই পালিয়ে চলে গেছে দক্ষিণ আমেরিকায়। আবার কেউ বলে, তার স্প্যানিশ-ভাষী বন্ধুরা তাকে বের করে এনে। বছরের পর বছর ধরে তাদের র্যাঞ্চে লুকিয়ে রেখেছিলো, আজি এখানে কাল ওখানে করে করে।
তবে বেশির ভাগেরই ধারণা, গুহা থেকে বেরোয়নি হেনরি। এমন জায়গায় লুকিয়েছিলো, আমেরিকানরা খুঁজেই পায়নি। তারপর থেকে অনেক বছর পর্যন্ত, ওই এলাকায় কোনো চুরি-ডাকাতি বা খুনখারাপ হলে আর আসামী ধরা না পড়লে সব দোষ চাপিয়ে দেয়া হতো হেনরির ঘাড়ে। অন্ধকার রাতে নাকি তার কালো ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে বেরোয় সে। যে গুহাটায় থাকতো, সব সময় সেটার ভেতর থেকে শোনা যেতো বিচিত্র গোঙানির আওয়াজ।
তারপর, উপসংহার টানলেন প্রফেসর। হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে গেল, গোঙানি। স্প্যানিশ-ভাষীরা বলে, এখনও নাকি ওই গুহার ভেতরেই রয়েছে হেনরি ফিগারো। তাদের বিশেষ প্রয়োজনের সময় নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে।