নিশ্চয়ই, তাড়াতাড়ি বলে উঠলো মুসা।
আরামদায়ক লিভিংরুমে বসে খাচ্ছে ছেলেরা। সুদৃশ্য ইনডিয়ান কার্পেটে ঢাকা মেঝে, পুরনো আমলের আসবাবপত্র। মস্ত এক ফায়ারপ্লেস এক দিকের দেয়ালের প্রায় সবটা জুড়ে রয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে শিকার করা হরিণ, ভালুক আর পার্বত্য সিংহের মাথা।
ওই বুড়ো মানুষটা কে? মিসেস হারভেকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। আরেকটা বিস্কুট তুলে নিলো।
ও কিছু না। ইনডিয়ানদের উপকথা। অনেক আগে স্প্যানিশরা যখন এলো, তখনকার ইনডিয়ানদের মাঝে একটা গল্প চালু ছিলো। ডেভিল মাউনটেইনের গভীরে একটা খাড়িতে নাকি কালো, চকচকে, একটা দানব থাকে।
চোখ মিটমিট করলো মুসা। কোহেন যে বললো: কেউ দেখেনি? দেখেই যদি থাকবে, জানলো কি করে কালো আর চকচকে! আর দানবকে মানুষই বা বলা কেন?
তাহলেই বোঝো, হাসলেন মিসেস হারভে। কোনো যুক্তি নেই। গল্প গল্পই।
দানবকে মানুষ বলে বোধহয় শ্রদ্ধা করে, কিশোর বললো। বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাঘকে স্থানীয় লোকেরা সম্মান করে বলে বড় মিয়া। ভয়ে। তাদের বিশ্বাস, ওরকম করে ডাকলে বাঘ তাদের কিছু বলবে না! ওসব কুসংস্কার। যারা বলে তাদের কেউ কি বাঘের পেটে যায় না?
আগের কথার খেই ধরে রবিন জিজ্ঞেস করলো, স্প্যানিয়ার্ডরা কি বলতো?
অনেক আগের কথা তো, বললেন মিসেস হারভে। তখনকার। স্প্যানিয়ার্ডরাও ওই ইনডিয়ানদের চেয়ে কিছু কম ছিলো না, কুসংস্কার ছিলো ওদের মাঝেও। মুখে বলতো বিশ্বাস করে না, কিন্তু উপত্যকার ধারেকাছেও যেতো না। হেনরি ফিগারো অবশ্য ওসব পরোয়া করতো না। সে গুহার ভেতরেও ঢুকতো।
হেনরি ফিগারোর সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন? অনুরোধ করলো কিশোর।
এই সময় ঘরে ঢুকলেন মিস্টার হারভে। সঙ্গে বেঁটে, রোগাটে একজন লোক। চোখে ভারি পাওয়ারের চশমা। ছেলেরা আগেই পরিচিত হয়েছে তার সঙ্গে। প্রফেসর হারকসন। তিনিও এই র্যাঞ্চে মেহমান।
এই যে, ছেলেরা, বললেন প্রফেসর। শুনলাম রহস্যময় মোনিং ভ্যালিতে গিয়েছিলে।
রহস্য না কচু! মুখ বাঁকালেন মিস্টার হারভে। অতি সাধারণ ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দেখছে সবাই। কোনো র্যাঞ্চে কি দুর্ঘটনা ঘটে না, ওরকম হাত-পা ভাঙে না?
কথাটা তুমি ঠিকই বলেছো, প্রফেসর বললেন। আসলে, অশিক্ষিত তো ওরা। ভাবছে, না জানি কি! ভয় পেয়ে গেছে।
কারণটা জানলেই ওদের এই ভয় ভেঙে যেতো। আজকের ঘটনায় আরও লোক হারাবো, চলে যাবে। কোনো কিছুর লোভ দেখিয়েই ধরে রাখতে পারবো না। ছেলেগুলোও বুঝতে পারছে, ভূতের কাণ্ড নয়। নেভির গানফায়ারিঙের জন্যেই ধস নেমেছে। অথচ বোকা:গাধাগুলোকে বোঝানো যাচ্ছে না। আমি শিওর, সহজ কোনো ব্যাখ্যা আছে ওই গোঙানির।
সেটা কি? প্রশ্ন করলেন মিসেস হারভে।
নাক টানলেন মিস্টার হারভে। পুরনো সুড়ঙ্গগুলোর ভেতর দিয়ে জোরে বাতাস বয়ে যাওয়ার সময় ওরকম শব্দ হয়।
হাতের বিস্কুটটা খেয়ে শেষ করলো কিশোর। আপনি আর শেরিফ নাকি ঢুকেছিলেন গুহায়? ভালোমতো দেখেছিলেন?
এমাথা-ওমাথা কিছুই বাকি রাখিনি। ভূমিকম্পে ধস নেমে কিছু কিছু সুড়ঙ্গ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু যেগুলোতে ঢোকা যায়, সব কটাতে ঢুকেছি।
নতুন কোনো অদল-বদল চোখে পড়েছে?
অদল-বদল? ভ্রূকুটি করলেন মিস্টার হারভে। না তো। কি বোঝাতে চাইছো?
গোঙানি শুরু হয়েছে মাত্র এক মাস আগে থেকে। পঞ্চাশ বছর পর। বাতাসের কারণেই যদি হয়ে থাকবে, এতোদিন বন্ধ থাকলো কেন? হতে পারে, সুড়ঙ্গের ভেতরে কিছু একটা বদলে দেয়া হয়েছে, যার ফলে আবার শুরু হয়েছে শব্দ।
ভালো বলেছো তো! নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা ঠেলে পেছনে সরালেন প্রফেসর। চমৎকার যুক্তি! রক, বুদ্ধি আছে ছেলেগুলোর। মনে হচ্ছে এ রহস্যের সমাধান করেই ফেলবে।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন, আওয়াজটা সন্ধ্যায় হয় কিংবা রাতে হয়, দিনের বেলা হয় না। কেন? তারমানে শুধু বাতাস নয়, আরও কোনো ব্যাপার আছে। আরেকটা ব্যাপার, গত এক মাসে রাতে যতো দিন ঝড়ো বাতাস বয়েছে, রোজই কি ওই শব্দ শোনা গেছে?
না, যায়নি, আগ্রহী হয়ে উঠছেন মিস্টার হারভে। ঠিকই বলেছো। শুধু বাতাসের কারণে হলে, বাতাস বইলেই ওই শব্দ হতো। তা যখন হয় না, আরও কোনো কারণ নিশ্চয় আছে।
হেসে বললেন প্রফেসর, কি জানি, হয়তো হেনরি ফিগারোই এর জন্যে দায়ী। রাতে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে বেরোয়।
ঢোক গিললো মুসা। আপনিও বলছেন, স্যার? কিশোরও একথা বলেছে।
ভূত বিশ্বাস করো নাকি তুমি, ইয়াং ম্যান? কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
না, মাথা নাড়লো কিশোর।
আমিও না, বললেন প্রফেসর। অনেকের ধারণা, বিশেষ করে এখানকার স্প্যানিশদের, দরকারের সময় নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে হেনরি ফিগারো। অনেক রিসার্চ করেছি আমি। জোর গলায় বলতে পারবো না যে সে বেরোবে।
রিসার্চ?
উনি ইতিহাসের প্রফেসর, বুঝিয়ে বললেন মিসেস হারভে। সানতা কারলায় বছরখানেক যাবত আছেন, ক্যালিফৈার্নিয়ার ইতিহাস নিয়ে স্পেশাল রিসার্চ করছেন। স্বামীকে দেখিয়ে বললেন, ওর ধারণা, মোনিং ভ্যালির রহস্য ভেদ করতে পারবেন প্রফেসর।
যদিও এখনও কিছুই করতে পারিনি, স্বীকার করলেন প্রফেসর। হেনরি। ফিগারোর কথা শুনতে চাও? ওর চমকপ্রদ জীবন নিয়ে একটা বই লিখছি আমি।
শোনালে তো খুবই ভালো হয়, স্যার! সামনে ঝুঁকে বসলো রবিন।