না, দৃঢ় কণ্ঠে বললো কিশোর। নেভির ফায়ারিঙের শব্দে কেঁপে উঠে ওই পাথরের ধস নেমেছে।
আমি বলছি সেই গোঙানি!
ওসব কথা পরে হবে, বললো মুসা। কিশোর, আগে…
তার কথা শেষ হলো না। কাছেই ডেকে উঠলো ঘোড়া। ফিরে চেয়ে দেখলো ছেলেরা, তিনজন ঘোড়সওয়ার এগিয়ে আসছে। তাদের একজন রাশ ধরে টেনে আনছে চতুর্থ আরেকটা ঘোড়াকে-পিঠে আরোহী নেই; যে লোকটা পড়ে ব্যথা পেয়েছে বোধহয় তারই ঘোড়া। দলের আগে আগে রয়েছেন মিস্টার হারভে।
তোমরা এখানে? কাছে এসে ঘোড়া থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। লম্বা, ইস্পাতকঠিন দেহ, গায়ে উজ্জ্বল লাল শার্ট, পরনে রঙচটা নীল জিনসের প্যান্ট, পায়ে হাই-হীল কাউবয় বুট। রোদেপোড়া তামাটে চামড়া। চেহারায় উৎকণ্ঠার ছাপ।
আহত লোকটাকে কিভাবে পেয়েছে জানালো ছেলেরা।
বেশি ব্যথা পেয়েছো, পোরটিকো? লোকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন মিস্টার হারভে।
হাড্ডি ভেঙে গেছে! বললো পোরটিকো। সব ওই ভূতের কারবার.. গুহার ভূত! আমি আর এখানে থাকছি না!
আমার ধারণা, কিশোর বললো। ফায়ারিঙের শব্দে ধস নেমেছে।
সেটা সম্ভব, মাথা দোলালেন মিস্টার হারভে।
আহত লোকটার গায়ের ওপর থেকে পাথর সরিয়ে ফেলা হলো। দুজন লোক গিয়ে র্যাঞ্চের ট্রাক নিয়ে এলো। সাবধানে তাতে তোলা হলো পোরটিকোকে। তারপর রওনা হলো সানতা কারলায়, হাসপাতালে।
তিন গোয়েন্দা ফিরে চললো তাদের সাইকেলের কাছে।
র্যাঞ্চ হাউসে পৌঁছতে পৌঁছতে পুরোপুরি আঁধার হয়ে গেল। মোট পাঁচটা বাড়িঃ শ্রমিকদের থাকার জন্যে একটা বাংকহাউস, একটা বড় গোলাঘর, একটা ছোট গোলাঘর, একটা রান্নাঘর, আরেকটা মূল বাড়ি। ওই বাড়িটা দোতলা। কাঠের বড় বড় বীম রয়েছে, অ্যাডোব আছে, আর বাড়ি ঘিরে রয়েছে চওড়া, ছাউনিওয়ালা বারান্দা। দিনের বেলায়ও সেখানে ছায়া থাকে, ঠাণ্ডা থাকে। জানালার যেখানেই সুযোগ পেয়েছে লতিয়ে উঠেছে আঙুর লতা। বাড়ির চারপাশে রক্তলাল বোগানভিলিয়ার ছড়াছড়ি। পাঁচটা বাড়ির চারপাশে তৈরি হয়েছে বেড়া দেয়া কয়েকটা কোরাল।
রান্নাঘরের কাছে লোকের হোট ঘোট জটলা। দুর্ঘটনার কথা আলোচনা, করছে। নিচু কণ্ঠ, চেহারায়.ভয় আর রাগের মিলিত ছাপ।
মূল বাড়িতে ঢুকতে যাবে, অন্ধকার থেকে শোনা গেল ভারি, খসখসে একটা কণ্ঠ।
কোথায় ছিলে তোমরা? জানতে চাইছে র্যাঞ্চের ফোরম্যান ডেভিড কোহেন।
বারান্দায় মৃদু নড়াচড়া। আলোয় বেরিয়ে এলো কোহেন। দেহের তুলনায়। মুখটা ছোট, খাড়া নাক, রোদে পোড়া চামড়া। গেছিলে কোথায়? আবার জিজ্ঞেস করলো সে। জায়গা ভালো না। হারিয়ে যেতে যদি?
পাহাড়-পর্বত অনেক দেখা আছে আমাদের, মিস্টার কোহেন, জবাব দিলো কিশোর। ভাববেন না।
আরেক কদম এগোলো ফোরম্যান। তোমরা কি করতে গিয়েছে, শুনলাম। গোঙায় কিসে, জানতে। দেখো, জায়গাটা ভালো না। বাচ্চাদের জন্যে আরও খারাপ। ওই গুহার ধারেকাছে যাবে না।
ছেলেরা কিছু বলার আগেই বাড়ির একটা দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন ছোটখাটো একজন মহিলা। ধূসর চুল। রোদে পুড়ে তামাটে হয়েছে এককালের লালচে চামড়া। গালের গোলাপি আভাও আর নেই এখন, হাত-পায়ের মতোই। তামাটে। কি আজেবাজে বকছো, ডেভিড? ধমক দিয়ে বললেন মিসেস হারভে। ওরা বাচ্চা নয়। আমার বিশ্বাস, অনেকের চেয়ে বুদ্ধিশুদ্ধিও বেশিই রাখে।
মোনিং ভ্যালি ভালো জায়গা নয়, মিনমিন করে বললো কোহেন।
তুমিই তো বাচ্চা ছেলের মতো কথা বলছো। ভূতের ভয়ে কাবু। গুহাটাকে ভয় পাও!
ভয় পাই না আমি! আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো কোহেন। তবে সত্যকে কিছু না বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সারা জীবন এখানে কাটালাম, জানেনই। সেই ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি মোনিং ভ্যালির গল্প। তখন বিশ্বাস করতাম না, এখন করি।
যত্তোসব ফালতু কথা! কুসংস্কার! বললেন বটে মিসেস; কিন্তু গলায় জোর। নেই। বোঝা যাচ্ছে, তিনিও শিওর নন। কণ্ঠের উৎকণ্ঠা ঢাকতে পারলেন না।
কিশোর জিজ্ঞেস করলো, মিস্টার কোহেন, গোঙানির কারণটা বলতে পারবেন?
দ্বিধা করলো ফোরম্যান। না। কেউ জানে না। আমিও অনেক খুঁজেছি, কিছু পাইনি। মানে. দেখিনি! শেষ শব্দটার ওপর বিশেষ জোর দিলো সে। আবছা অন্ধকারে চকচক করে উঠলো তার চোখ। ইণ্ডিয়ানরা বলে কেউ নাকি দেখতে পায় না। ভূ…, শুধরে নিয়ে বললো। বুড়ো মানুষটাকে!
.
০৩.
ডেভিড! চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস হারভে।
পরোয়া করলো না. কোহেন। আমি ওই গল্প বিশ্বাস করি না। কিন্তু আজব ঘটনা তো ঘটছে গুহায়। অস্বীকার করতে পারেন? আবার গোঙাতে শুরু করেছে। গুহাটা, কেউ জানে না, কেন। কেউ কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছে না। বুড়ো মানুষটা না হলে আর কে?
বলে আর দাঁড়ালো না ফোরম্যান। বারান্দা থেকে নেমে সোজা বাংকহাউসের দিকে হাঁটা দিলো।
সেদিকে তাকিয়ে রইলেন মিসেস হারভে। সবার মনেই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে! ডেভিডের মতো সাহসী লোক আমি কমই দেখেছি, তারই যখন এই অবস্থা…ওরকম করে কখনও কথা বলেনি।
আমাদেরকে বুড়ো মানুষটার কথা শোনালো কেন? চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো। কিশোর।
জোর করে উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে হাসলেন মিসেস হারভে। বোধহয় ও টায়ারড। সারাদিন এতো বেশি পরিশ্রম করতে হয়.. তো, তোমাদের খিদে পায়নি? দুধ আর বিস্কুট চলবে?