থেমে গেলেন হারলিং। সামনে পথ বন্ধ। পাথরের স্তূপের গোড়ায় অসংখ্য পায়ের ছাপ। নিচু হয়ে বড় একটা পাথর ছুঁয়ে দেখলেন তিনি। জোরে ঠেলা দিতেই নড়ে উঠলো পাথরটা। সরাতেই বেরিয়ে পড়লো ফোকর। আর দুটো পাথর। সরাতে ঢোকার জায়গা হয়ে গেল।
হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলেন ডিটেকটিভ। তাঁর পা দুটো অদৃশ্য হয়ে গেলে বসে পড়ে ওপাশে উঁকি দিলো দুই গোয়েন্দা। ওরাও ঢুকে পড়লো ভেতরে। বেরিয়ে এলো বাইরে। খোলা আকাশের নিচে। চারপাশে ঘন ঝোপঝাড়, গাছপালা। রবিনের অনুমান ঠিকই। ডেভিল মাউনটেইনের উত্তরের শৈলশিরাই এটা।
ঝোপের ভেতরে এই ছোট্ট মুখ কারো নজরে পড়বে না, হারলিং বললেন। এসো, যাই। আমার পেছনে থাকবে তোমরা।
এক পাশে সাগর, আরেক পাশে উপত্যকা। মাঝখানে এই শৈলশিরা। ওটার ওপর দিয়ে সাবধানে এগোলো তিনজনে। খানিক পরেই ছোট একটা কুঁড়ে চোখে পড়লো, আলো আসছে ভেতর থেকে। পা টিপে টিপে জানালার কাছে এসে উঁকি দিলেন ডিটেকটিভ। রবিন আর কিশোরও মাথা তুললো।
পুরনো একটা টেবিলের দুপাশে বসে রয়েছে মারটিন আর বেইরি। টেবিলের ওপর পাথরের ছোট একটা স্তূপ।
.
১৭.
পিস্তল হাতে ভেতরে ঢুকে পড়লেন হারলিং। খবরদার, নড়বে না কেউ!
প্রায় অর্ধেক উঠে পড়েছিলো বেইরি, ধীরে ধীরে বসে পড়লো আবার চেয়ারে। জ্বলন্ত চোখে তাকালো হারলিঙের দিকে।
ছেলেদের দিকে চেয়ে মারটিন বললো, কার্ল, তোমাকে আগেই বলেছিলাম, বিচ্ছগুলোর ব্যাপারে সাবধান হওয়া দরকার, শোনোনি…
ভুলই করেছি, বিড়বিড় করলো বেইরি।
কি চাই? ডিটেকটিভের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো মারটিন। পাথরগুলো? এগুলো আমাদের। খনিটা আমরা আবিষ্কার করেছি…।
কে করতে বলেছে তোমাদের? অন্যের জায়গায় রাতে চুরি করে যে মাটি খোড়ো, সেটাই তো একটা অন্যায়। তার ওপর পাথর রাখতে চাইছে। কতোখানি। বেআইনী কাজ করেছো, বুঝতে পারছো সেটা?
না, বুঝি না, গোয়ারের মতো বললো মারটিন। বুঝি না, বোঝার চেষ্টাও করি না। বিশ বছর ধরে ওই পাহাড়ের তলায় খুঁড়েছি আমরা, মাথার ঘাম পায়ে। ফেলেছি, তার কোনো দাম নেই?
থাকতো, যদি সত্যি সত্যি খনি পেতেন আপনারা, রবিন বললো। আর খনি। থেকে পাথর তুলে আনতেন। তাহলে মিস্টার হারভে নিশ্চয় একটা ভাগ দিতেন আপনাদেরকে।
খনি পাইনি তো কি পেয়েছি? পাথরগুলো এলো কোত্থেকে তাহলে?
খনি যে নয়, খুব ভালো করেই জানেন আপনারা, মিস্টার মারটিন, এই প্রথম কথা বললো কিশোর। এতোক্ষণ ঘরের জিনিসপত্র দেখেছে। একটা ছোট রেডিও, বুককেসে কয়েকটা বই, এক কোণে কয়েকটা পুরনো খবরের কাগজ।. একটা কাগজ এখন তার হাতে।
ঝট করে কিশোরের দিকে ফিরলো চারজোড়া চোখ।
কি বলছো তুমি, কিশোর? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। কি করে বুঝলে?
ওখানে গোটা চারেক বই আছে, বুককেসটা দেখিয়ে বললো কিশোর। নতুন কেনা হয়েছে, হীরার খনির ওপর লেখা। আর এই পত্রিকাটায়, হাতের কাগজটা নাড়লো, স্যান ফ্রানসিসকো মিউজিয়মে হীরা ডাকাতির কথা লেখা আছে। এক বছরের পুরনো এটা। খবরটায় দাগ দিয়ে রেখেছে পেন্সিল দিয়ে।
মারটিন আর বেইরির দিকে চেয়ে ভুরু নাচালেন হারলিং। কী, কিছু বলবে?
কি আর বলবো? দীর্ঘশ্বাস ফেললো মারটিন। ঠিকই বলেছে ছেলেটা। জানি, ওটা হীরার খনি নয়। এ-অঞ্চলে কোথাও নেই ওরকম খনি।
দুটো পাথর পেয়েছিলাম, বেইরি জানালো। ভাবলাম বুঝি খনিই পেয়েছি। হীরার খনি সম্পর্কে ভালোমতো জানার জন্যে বইগুলো কিনে এনেছে ডিন। বই। পড়ে বুঝলাম, পাথরগুলো আফ্রিকান। তখন লাইব্রেরিতে গিয়ে খুঁজে বের করলাম পত্রিকাটা; কোথায় কবে ডাকাতি হয়েছে জানলাম। বুঝে ফেললাম, ডাকাতি করে এনে পাথরগুলো এখানে রেখে যাওয়া হয়েছে।
বেইরি থামতেই মারটিন বললো, যেহেতু চুরির মাল, ভাবলাম, পেয়েছি যখন আমরাই রেখে দেবো। চোরটা বাদে আর কেউ জানছে না এ-খবর। দুটো পাওয়ার। পর আরও খুঁড়তে লাগলাম। তারপর আর কি? দেখতেই পাচ্ছো এখানে..।
তবে খুঁড়তে গিয়ে একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল, মারটিনের কথার খেই ধরলো। বেইরি। একটা বন্ধ সুড়ঙ্গ খুলে দিলাম, আবার গোঙাতে শুরু করলো গুহাটা। ভেবেছিলাম, ভালোই হলো, ভয়ে কাছে আসবে না কেউ। নিরাপদে কাজ করতে পারবো। কিন্তু মিস্টার হারভে আর শেরিফ দেখতে এলেন। তদন্ত শুরু করলেন। বাধ্য হয়ে ঘন্টার ব্যবস্থা করলাম। ডিন যখন খুঁড়তো, পাহাড়ের চূড়ায় বসে আমি চোখ রাখতাম। কাউকে আসতে দেখলেই ঘন্টা বাজিয়ে সতর্ক করে দিতাম ডিনকে।
হাসলো মারটিন। ভালোই চলছিলো। এই ছেলেগুলোকেও ভয় দেখিয়ে একবার তাড়িয়েছি। কিন্তু আজ যে কিভাবে ঢুকে পড়লো…এই, কিভাবে ঢুকলে? কার্ল দেখলো না কেন?
জানালো কিশোর।
শুনে মুখ কালো করে ফেললো বেইরি। কিন্তু মারটিন হাসলো। চালাক ছেলে!
গম্ভীর হয়ে হারলিং বললেন, এতে হাসির কিছু নেই। চোরাই মাল চুরি করাও সমান অপরাধ।
চুরি করেছি কে বললো? খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেছি।
অ্যাক্সিডেন্টগুলো করালেন কেন? গরম হয়ে বললো রবিন। পাথর ফেলে আমাদেরকেও তো মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন।
দেখো, প্রায় সবগুলোই অ্যাক্সিডেন্ট ছিলো ওগুলো, ইচ্ছে করে ঘটানো হয়নি, বললো বেইরি। ওরকম পাথর ধসে পড়ে এখানে যখন-তখন। তাছাড়া গোঙানি শুনে নার্ভাস হয়ে যায় লোকে, অসাবধান হয়ে নিজেরাই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে। তবে, তোমাদের ওপর যেটা পড়তে যাচ্ছিলো, সেটা আমার দোষ। পাথরটা আলগা হয়ে ছিলো। তোমাদের ওপর চোখ রাখতে রাখতে এগোচ্ছিলাম। হোঁচট খেয়ে পড়লাম ওটার ওপর। ঠেলা লেগে গড়িয়ে পড়লো পাথরটা। বিশ্বাস করো, ইচ্ছে করে ফেলিনি।