মনে হয় আরেকটা পাথর ধস? কিশোর বলুলো।
বড় ধস।
ধসটা নতুন।
কুপিয়ে চলেছে বুড়ো। তার শক্তি দেখে অবাক হতে হয়। এই বয়েসের একজন মানুষের এতো ক্ষমতা! কিছুক্ষণ কুপিয়ে গাইতি ফেলে আবার বেলচা তুলে নিলো সে।
কিশোর! ওর চোখ দেখলে?
দেখেছে কিশোরও। কেমন যেন বুনো দৃষ্টি। আগের রাতে বুড়ো মানুষটার কথা বলার সময়ও ওর চোখ ওরকম হয়ে গিয়েছিলো।
স্বর্ণ-জ্বর!
কি বললে? বুঝতে পারলো না মুসা।
গোল্ড ফিভার। কিংবা এক্ষেত্রে বলতে পারো ডায়মণ্ড ফিভার। বইয়ে পড়েছি, প্রসপেক্টররা ওরকমই হয়ে যায় মাঝে মাঝে, যখন মনে করে কাছেই রয়েছে মূল্যবান ধাতু কিংবা পাথর। ওই সময় কোনো বাধাকেই বাধা মনে করে না ওরা।
খাইছে!
বেলচা দিয়ে খোঁড়া পার্থর আর মাটি সরিয়ে কোপানোর জন্যে আবার গাইতি তুলে নিলো মারটিন। তারপর আবার বেলচা, আবার গাইতি। মাঝেসাঝে থেমে কি যেন দেখছে, হেসে উঠছে আপনমনে। কেমন যেন বন্য হাসি। বাইরে বেরিয়ে লোকের সামনে ওরকম করে হাসলে ধরে নিয়ে গিয়ে সোজা পাগলা গারদে ভরে দেবে।
বেলচা থামিয়ে বসে পড়লো আবার মারটিন। আলগা পাথর আর মাটিতে আঙুল চালালো। শক্ত হয়ে গেল শরীর। কি যেন একটা হাতে নিয়ে দেখলো। লণ্ঠনের আলোয়। চকচক করে উঠলো চোখ। মাটিতে ফেলে রাখা একটা চামড়ার। ব্যাগ তুলে নিয়ে তাতে ভরে ফেললো জিনিসটা।
হীরা? মুসা বললো।
মনে হয়।
ফিসফিসিয়ে কথা বলছে দুজনে। এতই ব্যস্ত বুড়ো, ওদের কথা কানেই। যাচ্ছে না।
হীরার খনি পেলো শেষতক?
পাথরের ধসটার দিকে চেয়ে রয়েছে কিশোর। ভাবছে। দেখে তো সে-রকমই লাগছে। কিন্তু… কি আর কোনো কিন্তু নেই। হীরার খনিই পেয়েছে। আইনতঃ ওগুলোর মালিক এখন মিস্টার হারভে। তাই চুরি করে টৈাকে বুড়ো। রাতে আসে, কাউকে জানাতে চায় না। ভয় দেখিয়ে দূরে রাখে সবাইকে।
হয়তো। এখন আমি জানতে চাই, গুহাটা গোঙায় কেন?
হা। এবং কেন বন্ধ হয়ে যায়।
মিস্টার হারভে আর শেরিফ নিশ্চয় এই শ্যাফট দেখেছেন। শুধু দেখেননি বুড়ো মারটিনকে মাটি খুঁড়তে।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতে যাবে মুসা এই সময় গুহার ভেতরে ঘন্টা বাজতে শুরু করলো।
বিদ্যুৎ খেলে যেন মারটিনের শরীরে হাত থেকে বেলচা ফেলে লাফ দিয়ে, লণ্ঠনটার কাছে চলে এলো। বাতির পাশে ছোট একটা বাক্স। ঝুঁকে কি যেন করলো সে। বন্ধ হয়ে গেল ঘন্টাধ্বনি। তারপর লণ্ঠন আর চামড়ার ব্যাগটা তুলে নিয়ে ছুটে এলো শ্যাফট দিয়ে।
কুইক! পালাও! বলে উঠলো কিশোর।
শ্যাফটের গোড়ায় জমে থাকা মাটি আর পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো ওরা। বাইরে বেরোলো মারটিন। সুড়ঙ্গমুখের কাছে লণ্ঠন আর, ব্যাগটা নামিয়ে, রাখলো।
আবার শুরু হলো গোঙানি।
তবে শেষ হতে পারলো না। মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গেল। বিশাল একটা পাথর গড়িয়ে এনে শ্যাফটের মুখে ফেললো মারটিন। দেখে মনে হবে এখন, বহুদিন ধরে পাথরটা ওখানে ওভাবেই রয়েছে। ওটা সুড়ঙ্গমুখে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল; গোঙানি।
পাথর দিয়েই… ফিসফিস করলো মুসাণ
হ্যাঁ। গোঙায় বাতাসের কারণে। শ্যাফটের মুখে পাথর চাপা দিলেই বন্ধ হয়ে যায়। আর ঘন্টাটা সঙ্কেত। চূড়ায় বসে যে চোখ রাখছে সে বাজিয়েছে। মনে হয়। কেউ গুহায় ঢুকতে আসছে।
অস্থির ভাবে সুড়ঙ্গে পায়চারি শুরু করলো বুড়ো। বিড়বিড় করছে। ছেলেরা যেখানে লুকিয়ে রয়েছে, সেদিকে চোখ তুলে তাকালো না একবারও। হঠাৎ করেই নিভিয়ে দিলো বাতিটা। মুহূর্তের জন্যে নীরব হয়ে গেল অন্ধকার সুড়ঙ্গ। তারপর। শুরু হলো বিড়বিড়ানি। আবার পায়চারি শুরু করেছে মারটিন।
অনেক প্রশ্ন ভিড় করছে মুসার মনে। নকল ফিগারো আসলে কে? এই রহস্যে কোথায় ফিট করছে সে? কিশোর কি তখন…
মুসা? কানের কাছে মুখ, ঠেকিয়ে বললো কিশোর। কে জানি আসছে!
ভাবনায় ডুবে না থাকলে কিশোরের আগেই শব্দটা কানে আসতো মুসার। শুনতে পেলো এখন। খানিক পরেই দেখলো নেচে নেচে এগিয়ে আসছে আলো।
কার্ল? মারটিন জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাঁ, জবাব এলো আলোর পেছন থেকে। দুজন আসছে গুহায় ঢুকতে। চলো, ভাগি।
লণ্ঠন জ্বাললো মারটিন।
স্কুপের আড়ালে গুটিশুটি হয়ে বসে রইলো ছেলেরা। পারলে পাথরের সঙ্গে এক হয়ে যেতে চায়। মাত্র দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে লোক দুজন।
গুহায় ঢুকবে কি করে বুঝলে? মারটিন বললো।
ঢুকবে। দুদিন ধরে গুহাটার কাছে বড় বেশি ঘোরাঘুরি করছে লোকে।
আর দুচার দিন সময় পেলেই হতো। কাজ শেষ করে ফেলতে পারতাম। খুব। হুঁশিয়ার থাকতে হবে। তীরে এসে তরী ডোবাতে চাই না। চলো, বেরিয়ে যাই।
হ্যাঁ, চলো।
বোঝা গেল, কার্ল বেইরিই চূড়ায় বসে পাহারা দিচ্ছেলো। ঘন্টা বাজিয়ে সঙ্কেত দিয়ে কোনো গোপন পথে দ্রুত নেমে চলে এসেছে।
সূড়ঙ্গমুখ থেকে পাথর সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল দুজনে, ভেতর থেকে আবার টেনে জায়গামতো লাগিয়ে দিলো পাথরটা। এরপর শুধু স্তব্ধ নীরবতা, আর গাঢ় অন্ধকার।
গেল কোন দিক দিয়ে? মুসার প্রশ্ন।
নিশ্চয় গুহা থেকে কোনো পথ পর্বতের বাইরে বেরিয়েছে। থাকতেই হবে। নইলে বাতাস ঢুকে শব্দ করতে পারতো না। হয়তো পুরনো কোনো শ্যাফট, বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো, নতুন করে খোলা হয়েছে। ওই দুই প্রসপেক্টরের কাজ।
তাহলে মিস্টার হারভে আর শেরিফ জানেন না কেন? কেন বুঝতে পারলেন না?