মুসাও অনুসরণ করতে যাবে, এই সময় পেছনে শুনতে পেলো পায়ের। আওয়াজ। কিশোর…? বলেই চুপ হয়ে গেল।
পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে হালকা-পাতলা একজন মানুষ। কালো জ্বলন্ত মে। কালো সমব্রেরো, কালো জ্যাকেট, কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো জুতো পোশাক পরা ঠিক এই তরুণটির ছবিই সেদিন দেখিয়েছিলেন প্রফেসর হারকসন।
হেনরি ফিগারো! বাঁ হাতে পিস্তল।
.
১২.
মুসার দিকে পিস্তল উদ্যত রেখে বাঁ হাতে বাতাসে থাবা মারলো যেন ফিগারো।
চুপ থাকতে বলছে আমাদেরকে, কাঁপা কণ্ঠে বললো কিশোর।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো লোকটা। ওর তরুণ চেহারায় কোনো ভাবান্তর। নেই। পিস্তল নেড়ে ইশারা করলো ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্যে, খানিক আগে ওরা যেদিক থেকে এসেছে তার উল্টো দিকে।
উপায় নেই। আদেশ মানতে বাধ্য হলো দুই গোয়েন্দা। আরেকটা গুহায় এসে, ঢুকলো। ডানে যাওয়ার ইঙ্গিত করলো ফিগাররা।
হাঁটছে তো হাঁটছেই। এই সুড়ঙ্গ থেকে সেই সুড়ঙ্গে, তারপর আরেক সুড়ঙ্গে, মাঝে মাঝে গুহা। মনে হলো যুগ যুগ পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ হাতঘড়িতে দেখলো মুসা, মাত্র পাঁচ মিনিট পেরিয়েছে।
থামো! পেছন থেকে বললো ফিগারো। এই প্রথম মুখ খুললল সে। কেমন যেন, ভোঁতা, শূন্য কণ্ঠস্বর। আরেকটা গুহায় ঢুকেছে ওরা।
থামলো ছেলেরা। যতোগুলো গুহায় ঢুকেছে, তার মধ্যে সব চেয়ে ছোট এটা। বাতাস ভ্যাপসা।
ওদিকে! দেয়ালের খুব সরু একটা সুড়ঙ্গমুখ দেখিয়ে বললো লোকটা।
বিষণ্ণ দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকালো দুই গোয়েন্দা। কিছুই করার নেই। ঢুকলো সুড়ঙ্গে। পেছনে ফিগারো। দশ কদম এগিয়ে দেখলো সামনে পাথর পড়ে পথ রুদ্ধ। ফিরে তাকালো দুজনে।
পাথরে তৈরি যেন ফিগারোর মুখ, কোনো পরিবর্তন নেই। পিস্তল নেড়ে, বাঁয়ের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলো ওদেরকে। তারপর ঝুঁকে ইস্পাতের একটা ডাণ্ডা তুলে নিয়ে চাড় দিয়ে বড় একটা পাথর ঠেলে সরালো। ডাকলো, এসো!
ফোকরের কাছে এসে ওপাশে উঁকি দিলো মুসা। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো, না। টর্চ জ্বালতে যাবে, এই সময় পেছন থেকে প্রচণ্ড এক ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে এসে পড়লো ফোকরের ভেতরে, পাথুরে মেঝেতে। তার গায়ের ওপর এসে পড়লো আরেকটা দেহ। পেছনে পাথর লাগিয়ে আবার বন্ধ করে দেয়া হলো ফোকর। ঘন কালো অন্ধকারে হতভম্ব হয়ে গেল সে।
মুসা? পাশ থেকে ডাকলো কিশোর।
আছি। তবে না থাকলেই খুশি হতাম।
কবর দিয়ে গেল আমাদেরকে।
দিলো। এখন মরবো, আর কী!
.
মোনিং ভ্যালির ধার ঘেঁষে র্যাঞ্চের দিকে এগিয়ে চলেছে রবিন। পেছনে, যেন তাকে টিটকারি মারতেই গুঙিয়ে চলেছে গুহাটা।
কিশোরের ফন্দি কাজে লেগেছে, ভাবলো সে। এতোক্ষণে গুহায় ঢুকে গেছে। ওরা, অথচ আওয়াজ বন্ধ হয়নি। তবে খুশি হতে পারছে না রবিন। বইটা পড়ার পর থেকেই দুশ্চিন্তা হচ্ছে, সফল হতে পারবে না কিশোর। ওই গোঙানির সঙ্গে মারটিন আর বেইরির কোনো সম্পর্ক থাকলে বিপদে পড়বে কিশোর-মুসা।
তারপর রয়েছে সেই লোকটা, যার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নেভাডায়। কে সে? লোকটা চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছে রবিন, কিন্তু সে ফেরেনি। কিশোর আর মুসার বিপদের ভাবনা না থাকলে আরও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো।
মোনিং ভ্যালিকে অনেক পেছনে ফেলে এসে তারপর পথে ওঠার ঝুঁকি নিলো রবিন। পথ ভালো হওয়ায় চলার গতিও বাড়াতে পারলো। যতোই আগে বাড়ছে, পেছনে কমে আসছে গোঙানি। তারপর কানে এলো এঞ্জিনের শব্দ।
কাছেই একটা ঝোপ দেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে ওটার ভেতরে লুকালো রবিন।
সামনে দিয়ে ছুটে চলে গেল গাড়িটা। চালকের মুখ দেখতে পেলো না, স্টিয়ারিং হুইলের ওপর নামিয়ে রেখেছে। তবে মাথার সমব্রেরো চিনতে পারলো। আর গাড়ির নম্বর প্লেট, নেভাডার।
ব্যাপার কি? এতো তাড়াহুড়ো কেন লোকটার? পাহাড়ের ভেতরে কি করে এসেছে? একটা অশুভ চিন্তা বার বার মাথা তুলতে চাইছে, জোর করে দাবিয়ে। রাখছে ওটাকে রবিন। ঝোপ থেকে বেরিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতেই দৌড় দিলো র্যাঞ্চের দিকে।
লোকটাকে দেখতে পেলো না। পাশ থেকে হঠাৎ করেই এসে দাঁড়িয়েছে পথে! তার গায়ের ওপর দিয়ে পড়লো রবিন। আঁউক করে উঠলো। কঠিন হাত কাধ চেপে ধরলো তার।
মুখ তুললো রবিন। সেই লোকটা! গালে কাটা দাগ। চোখের ওপর পট্টি।
.
অন্ধকারে বসে রয়েছে মুসা আর কিশোর। মাঝে মাঝে এখনও কানে আসছে। গোঙানি, দূর থেকে, মৃদু।
দেখছো কিছু? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো মুসা।
কিচ্ছু না। আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি…, পাগলের মতোই হা হা করে হেসে উঠলো কিশোর।
হাসির কি দেখলে?
হাসবো না? বদ্ধ জায়গায় বসে আছি, অথচ কেউ শুনে ফেলবে সেই ভয়ে ফিসফিস করে কথা বলছি। সঙ্গে টর্চ রয়েছে, জ্বালছি না। মাথা খারাপ হয়নি তো কি?
টর্চ জ্বেলে একে অন্যের দিকে চেয়ে হাসলো। কেমন বোকা বোকা, দেখালো দুজনের হাসিই। তারপর দেয়ালে আলো ফেললো মুসা।
বেরোবে কিভাবে? প্রশ্ন করলো সে।
ঠেলেঠুলে দেখবো প্রথমে পাথরটা সরানো যায় কিন্না, সহজে হাল ছাড়ে না। কিশোর। ফিগারোকে দেখে তো মনে হলো না তার গায়ে তেমন জোর আছে। অথচ সহজেই সরালো।
ঠেলা দিয়ে দেখলো মুসা। নড়লো না পাথর। কিশোরও হাত লাগালো। গায়ের জোরে ঠেলা দিলো দুজনে। নড়লো না পাথরটা। হাঁপাতে হাঁপাতে সরে এলো ওরা।