কান পতলো দুজনেই। পুরো আধ মিনিট স্তব্ধ নীরবতা। চেঁচিয়ে উঠেছে বলে মনে মনে নিজেকে বেশ কয়েকটা লাথি মারলো মুসা। তারপর আবার শোনা গেল গোঙানি, মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট।
যেটার মুখের কাছে আলো নিভেছে ওই সুড়ঙ্গ দিয়েই আসছে মনে হলো। পকেট থেকে শাদা চক বের করে সুড়ঙ্গমুখের দেয়ালের পাশে একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন আঁকলো কিশোর। টর্চ বের করে জ্বেলে ঢুকে পড়লো সুড়ঙ্গটায়।
.
ডামিগুলোর পাশে বসেই রয়েছে রবিন। পশ্চিম দিগন্তে ধীরে ধীরে সাগরের পানিতে তলিয়ে গেল যেন কমলা রঙের সূর্যটা। বেগুনী-লাল গোধূলির রঙ আকাশে, ছায়া পড়েছে সাগরে। আহত পা-টা সাবধানে নাড়লো সে।
আধ ঘন্টা যাবৎ বসে বসে নিজে নিজেই বকবক করছে। তার মনে হচ্ছে, তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কে যেন। অদ্ভুত অনুভূতি। স্রেফ কল্পনা বলে জোর করে তাড়ানোর চেষ্টা করলো অনুভূতিটা, পারলো না।
অন্য দিকে মন সরানোর জন্যে মোনিং ভ্যালির ওপরে লেখা বইটা পড়তে আরম্ভ করলো। মাইন শ্যাফট বন্ধ করে দেয়ার অংশটা পড়তে পড়তে খাড়া হয়ে গেল পিঠ। আনমনে বিড়বিড় করলো, সর্বনাশ!
ডিন মারটিন আর কার্ল বেইরির কথা লেখা রয়েছে। ডেভিল মাউনটেইনের পাশে একটা পাহাড়ের ঢালে বাসা বানিয়ে থাকে দুজনে। খনির শ্যাফট বন্ধ করে দেয়ার পরে সব শ্রমিকেরা চলে গেলেও ওরা রয়ে গেল। সোনা আর হীরা খোঁজার জন্যে।
ভুরু কোঁচকালো রবিন। তাড়াহুড়ো করে পড়েছে কিশোর, বইয়ের এখান পর্যন্ত আসেনি। তাহলে নিশ্চয় জানতো ডেভিল মাউনটেইনে হীরা আছে, একথা বিশ্বাস করে মারটিন।
ঘনায়মান অন্ধকারে উদ্বেগ বাড়লো রবিনের। ডিন মারটিন সেদিন মিথ্যে বলেছে তাদের সঙ্গে। বলেছে গুহার বাইরে দিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে আওয়াজ শুনে দেখতে এসেছে। সেটা সম্ভব নয়। দূরত্ব অনেক বেশি ছিলো। আসলে গুহার ভেতরেই কোনো একটা সুড়ঙ্গে বা অন্য কোথাও ছিলো বুড়ো।
দ্রুত মনস্থির করে নিলো রবিন। ঢালের আড়ালে নেমে এসে পড়ে থাকা বাকি কাপড়গুলো দিয়ে আরেকটা ডামি বানালো। ওটা নিয়ে ক্রল করে এগোলো। অন্য দুটোর কাছে এনে বসিয়ে দিলো ওটাকে। আশা করলো, অন্ধকারে কিছু বুঝতে পারবে না যে চোখ রেখেছে ওগুলোরে ওপর। আবার খানিক দূর নেমে ঝোপের আড়ালে আড়ালে পাড়ে উঠলো আরেক জায়গা দিয়ে। পথের অনেক দূর দিয়ে ঘুরে রওনা হলো ব্যাঞ্চের দিকে। মিস্টার হারভেকে জানাতে হবে সব কথা… ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছে কিশোর আর মুসা।
আহত পা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলেছে রবিন, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। সাইকেল বের করার ঝুঁকি নেয়নি, তাহলে চূড়ার ওপরের লোকটার চোখে পড়ে। যাওয়ার সম্ভাবনা। একশো গজও যেতে পারলো না, গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ কানে এলো। কাঁচা রাস্তা ধরে গতি কমিয়ে এগিয়ে আসছে গাড়িটা, হেডলাইট নিভানো। একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো রবিন। তার কাছ থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরে থামলো গাড়িটা।
একটা লোক নেমে প্রায় ছুটে চললো পর্বতের দিকে। পরনে কালো পোশাক। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
গুড়ি মেরে এগিয়ে গাড়ির পেছনে চলে এলো রবিন। দেখলো, নেভাডার নম্বর প্লেট লাগানো।
.
পর্বতের গভীরে গোঙানি লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছে মুসা আর কিশোর। প্রথম সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আরেকটা গুহায় ঢুকলো। আবার মোমবাতি ব্যবহার করলো। এভাবে চলে তৃতীয় গুহাটায় এসে ঢুকলো। যে কটা গুহায় ঢুকেছে এ-পর্যন্ত, তার মধ্যে এটা ছোট। এটাতে তিনটা সুড়ঙ্গ পাওয়া গেল, যেগুলো দিয়ে জোরালো বাতাস বয়। আলাদা আলাদা না গিয়ে একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো কিশোর।
প্রথম সুড়ঙ্গটা বেশ কিছু দূর এগিয়ে হঠাৎ তীক্ষ্ণ মোড় নিলো।
সাগরের দিকে গেছে, বললো মুসা। গন্ধ শুকছে বাতাসে।
তাহলে আর এগোনোর দরকার নেই। আমি শিওর, গোঙানিটা আসে উপত্যকার দিক থেকে। কম্পাস দেখলো। পুব, কিংবা উত্তর-পুবে যাওয়া উচিত।
এটা তো গেছে দক্ষিণ-পশ্চিমে।
ফিরে এসে দ্বিতীয় সুড়ঙ্গটায় ঢুকে এগোলো। কিছু দূর এগিয়েই দক্ষিণ পশ্চিমে মোড় নিলো এটাও। আবার ফিরে আসতে হলো ছোট গুহায়।
অধৈর্য হয়ে উঠেছে মুসা। কিশোর, এই গোলক-ধাঁধায় কি কেবল ঘুরেই মরবো?
মনে হয়, ঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা। যতই পুবে সরছি গোঙানি বাড়ছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তৃতীয় সুড়ঙ্গে ঢুকলো মুসা। বাতাস জোরালো, আওয়াজও বাড়ছে। সোজা পুবে এগিয়েছে পথটা। এক জায়গায় এসে থেমে গেল দুজনেই। বায়ের দেয়ালে মস্ত গোল ফোকর। এই সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে চলে গেছে আরেকটা সুড়ঙ্গ।
খাইছে! এই প্রথম একটা সাইড টানেল দেখলাম।
হ্যাঁ, আলো ফেলে দেখছে কিশোর। এটা মানুষের তৈরি। মাইন শ্যাফট। বন্ধ করা হয়নি। দেখো দেখো!
বাতাসে বাইরের দিকে কাত হয়ে যাচ্ছে তার হাতের মোমের শিখা। এর অর্থ কি? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে কণ্ঠ। সাইড টানেলটা থেকে আরেকটা সুড়ঙ্গ বেরিয়েছে। নিশ্চয় খনিতে ঢোকার পুরনো কোনো পথ নতুন করে খোলা হয়েছে।
তাহলে শেরিফ কেন খুঁজে পেলেন না? কিংবা মিস্টার হারভে?
বলতে পারবো না, মুসা, মাথা নাড়লো কিশোর। কিন্তু… হঠাৎ বড় বড় হয়ে গেল চোখ।
শব্দটা মুসার কানেও আসছে। মাটি কোপানো হচ্ছে।
এসো, ফিসফিস করে বলে পাশের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লো কিশোর।