দ্বিতীয়বার বলতে হলো না রবিন আর মুসাকে। পেছনে, পাহাড়ের নিচে রেখে এসেছে সাইকেল, সেদিকে রওনা হলো।
হঠাৎ, উপত্যকার এক প্রান্ত থেকে শোনা গেল.পাথর পড়ার ভারি শব্দ, সেই সাথে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।
.
০২.
শব্দটা মিলিয়ে গেল গোঙানি উপত্যকার-মোনিং ভ্যালির বাংলা নাম রেখেছে কিশোর– ওপর দিয়ে।
ওটা তো গুহা থেকে আসেনি! বলে উঠলো মুসা।
না। একমত হলো কিশোর। মানুষের চিৎকার!
বিপদে পড়েছে, যোগ করলো রবিন। চলো তো দেখি।
তটরেখা আর পর্বতের মাঝের উপত্যকা থেকে এসেছে শব্দটা। পর্বতের নাম ডেভিল মাউনটেইন, কারণ, দুদিকের দুটো চূড়া দূর থেকে দেখায় কল্পিত শয়তানের শিঙের মতো।
দৌড় দিলো তিন গোয়েন্দা। ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে অনেকগুলো পাথর। জমা হয়েছে পাহাড়ের গোড়ায়, ধুলো উড়ছে এখনও।
আআহ! যন্ত্রণায় কাতরালো কেউ।
সবার আগে লোকটার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো মুসা। ধূসর চুল মানুষটার, কোমরের নিচের অংশ পাথরের তলায়। ব্যথায় মুখ বিকৃত। চুপ করে। শুয়ে থাকুন, বলে কিশোরের দিকে ফিরলো মুসা। মনে হচ্ছে পা-টা ভেঙেছে।
লোকটার পরনে পুরনো কাউবয় পোশাক। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে। কোনোমতে বললো, আ-আমি হারভে র্যাঞ্চে কাজ করি। মিস্টার হারভেকে গিয়ে বলো, কাউকে এখানে পাঠিয়ে দিতে। প্লীজ!
হতবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকালো তিন গোয়েন্দা। আরেকটা দুর্ঘটনা! আহত হলো মিস্টার হারভের আরেকজন শ্রমিক!
.
হারভে দম্পতির সঙ্গে দুই হপ্তার ছুটি কাটাতে র্যাঞ্চে এসেছিলো মুসা। র্যাঞ্চটার নতুন মালিক মিস্টার হারভে। বিখ্যাত একজন রোডিয়ো-রাইডার, মুসার বাবা। মিস্টার রাফাত আমানের সঙ্গে অনেকগুলো ওয়েস্টার্ন ছবিতে কাজ করেছেন। জন্তুজানোয়ার, বিশেষ করে ঘোড়ার খেলা দেখাতেন। সেই কাজ ছেড়ে জমানো টাকা দিয়ে কিছুদিন আগে এই র্যাঞ্চ কিনে শেষ জীবনটা কাটাতে এসেছেন এখানে। নষ্ট হয়ে যাওয়া পুরনো র্যাঞ্চটার মেরামত সবে শেষ করে এনেছেন, এই সময় শুরু হলো গণ্ডগোল।
মোনিং ভ্যালির নামকরণ হয়েছে প্রাচীন ইণ্ডিয়ানদের একটা রোমাঞ্চকর লোককাহিনী আর পুরনো স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকদের নিষ্ঠুরতার ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে। গুজব রটতে শুরু করেছে এখনঃ পঞ্চাশ বছর নীরব থাকার পর আবার জেগে উঠেছে মোনিং ভ্যালি, গোঙাতে আরম্ভ করেছে। র্যাঞ্চ শ্রমিকদের তাড়ানোর জন্যে যেন গোঙানিই যথেষ্ট নয়, তাই ঘটতে শুরু করেছে দুর্ঘটনা।
প্রথম দুর্ঘটনাটা ঘটে কিছু দিন আগে। দুজন শ্রমিক ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলো মোনিং ভ্যালির কাছ দিয়ে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হঠাৎ এক অদ্ভুত গোঙানি শুনে চমকে উঠলো তাদের ঘোড়া, ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে দিলো দৌড়। এর জন্যে তৈরি ছিলো না লোক দুজন। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল। একজনের হাত ভাঙলো, আরেকজনের হাড়গোড় ঠিক থাকলেও শরীরের নানা জায়গা ছিলেছুলে গেল। দুজনেই র্যাঞ্চে ফিরে এলো। জানালো, ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে। উপত্যকায়। তার কয়েকদিন পরে, কোনো কারণ ছাড়াই রাত দুপুরে উন্মাদ হয়ে গেল যেন র্যাঞ্চের গরুর পাল। নানারকম অঘটন ঘটিয়ে ছাড়লো। তারপর এক সন্ধ্যায় উপত্যকার ওদিকে বেড়াতে গিয়ে নাকি বিরাট এক দানব দেখে এলো আরেক শ্রমিক। কসম খেয়ে বললো, ডেভিল মাউনটেইনের গোড়ায় হেনরি ফিগারোর গুহা থেকে বেরিয়েছে দানবটা। তার দিন কয়েক পরে, কাউকে কিছু না। জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল দুজন শ্রমিক। খোঁজ নিয়ে এসে শেরিফ জানালেন, তাদেরকে সানতা কারলায় দেখা গেছে, কিন্তু অনেক শ্রমিকই বিশ্বাস করলো না। তার কথা।
দিন কয়েক র্যাঞ্চে থেকেই মুসা বুঝে গেল, ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। হারভে দম্পতি। ফিগারোর গুহায় অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে, রহস্যময় কিছুই পাওয়া যায়নি, রহস্যেরও সমাধান হয়নি। ইণ্ডিয়ান লোককাহিনী আর ভূতের পেছনে তাড়া করার উপায় নেই, কাজেই কোনো সাহায্য করতে পারলেন না। শেরিফ। তিনি, এবং হারভে দুজনেই বিশ্বাস করেন, ভূত-ফুত সব বাজে কথা, নিশ্চয় কোনো সহজ ব্যাখ্যা আছে এসবের। কিন্তু বুঝতে পারছেন না, সেটা কী।
কিশোরকে ছাড়া হবে না, বুঝে, হারভে দম্পতির অনুমতি নিয়ে তাকে আর রবিনকে আসার জন্যে খবর পাঠালো মুসা। বাড়িতে জরুরি কাজ ফেলে ছুটে এসেছে দুজনে। এরকম একটা রহস্যের কথা শোনার পর কি আর স্বস্তিতে কাজ করা যায়? অন্তত কিশোর পাশার পক্ষে সম্ভব নয়। আর মুসা নেই, কিশোর থাকবে না, একলা কি আর মন টেকে রবিনের? গোল্লায় যাক জরুরি কাজ, বলে সোজা। রওনা হয়ে পড়লো দুজনে।
ক্যালিফোরনিয়া উপকূলে রকি বীচ থেকে একশো মাইল উত্তরে, আর। আধুনিক হলিডে রিসোর্ট সানতা কারলার মাইল দশেক দূরে এই হারভে র্যাঞ্চ। পার্বত্য অঞ্চল। বড় বড় পাহাড়-পর্বত, গুহা, গভীর গিরিখাত, অসংখ্য উপত্যকা আর একধারে প্রশান্ত মহাসাগর এখানে। মুসা এসেছিলো চুটিয়ে ঘোড়ায় চড়তে, সাঁতার কাটতে আর মাছ ধরতে কোনোটাই করা হলো না। জড়িয়ে পড়লো। জটিল রহস্যে, দুই দোস্তকেও ডেকে আনলো।
ভূতের আসর হয়েছে এই উপত্যকায়, বিড়বিড় করলো আহত লোকটা। আসাই উচিত হয়নি…ওই গোঙানি, গোঙানিই যতো নষ্টের মূল!