ঢেউয়ের জোর আজ কম, বললো কিশোর। সাঁতরাতে সুবিধেই হবে। আমাদের।
পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না, বললো দক্ষ সাঁতারু মুসা। ডুবুরির পোশাক পরে পানির তলায় ডুব দেয়া তার ভারি পছন্দ।
আমার আরেকটু বেশি লাগতে পারে।
এখন কথা হলো, নিচ দিয়ে পুরোটা পথ যাওয়া যাবে কিনা।
অসুবিধে নেই। ভেসে উঠবো। ডিকয় সাজিয়ে দিয়ে এসেছি। এদিকে নজর রাখার কথা ভাববে না কেউ।
ব্রীদিং টিউব ঠিক করে, মুখে মাউথপীস এঁটে পানির দিকে চললো ওরা। পানিতে নেমে হারিয়ে গেল ঢেউয়ের তলায়।
১১.
কব্জিতে বাঁধা কম্পাস দেখে দেখে এগিয়ে চলেছে কিশোর। পেছনে মুসা। শুধু সাঁতরানো ছাড়া আর কিছু করতে হচ্ছে না তাকে, ফলে পাথরের খাঁজে, আশেপাশে সাগর-জীবনের ওপর নজর দিতে পারছে।
ছুটাছুটি করছে নানারকম মাছ। একটা হ্যাঁলিবাট, পাথরের রঙের সঙ্গে মিশে ছিলো। মুসা দেখতে পায়নি। প্রায় হাত দিয়ে ফেলেছে পাথরে, এই সময় ছিটকে উঠলো মাছটা, চমকে দিলো তাকে। তারপর রাজকীয় ভঙ্গিতে সাঁতরে চলে গেল।
মিনিট দুই পর থেমে মুখ ফেরালো কিশোর। ইশারায় হাতঘড়ি দেখিয়ে, গুহার দিকে দেখালো। বুঝলো মুসা। তার মানে এবার গুহার দিকে ফেরার নির্দেশ দিচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধান।
আবার আগে চললো কিশোর। তার একেবারে গায়ের কাছে রয়েছে মুসা। তাই, কিশোর যখন হঠাৎ থেমে গেল, তার পায়ের ওপর এসে ধাক্কা খেলো সে।
অবাক হয়েছে মুসা। মাউথপীসের মধ্যেই গুঙিয়ে উঠলো। কেন ওভাবে থেমে গেল কিশোর? ইশারায় বাঁয়ে দেখালো গোয়েন্দাপ্রধান।
কিশোরের হঠাৎ থেমে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলো মুসা। বড় জোর তিরিশ ফুট দূরে কালো কি যেন একটা নড়ছে। বড়, লম্বা, কালো একটা সিগারের মতো দেখতে। হাঙর হতে পারে, কিংবা খুনী তিমি।
ধক করে উঠলো মুসার বুক। তবে ঘাবড়ালো না। ড্রাইভিঙের বিশেষ ট্রেনিং রয়েছে ওদের, দক্ষ ওস্তাদের কাছে শিক্ষা নিয়েছে। হাঙর হলে কি করতে হবে জানা আছে। অস্বাভাবিক যে কোনো নড়াচড়া দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাঙরের, দেখতে ছুটে আসে। ছুরি বের করলো দুজনেই। যতোটা সম্ভব কম নড়াচড়া করে সরে যেতে লাগলো পাথরের কাছে, নিরাপদ কোনো খাজ দেখলে তার মধ্যে ঢুকে যাবে।
ছায়াটার ওপর থেকে ক্ষণিকের জন্যে চোখ সরাচ্ছে না মুসা। না, হাঙর বলে তো মনে হচ্ছে না? পেট মোচড়ানি নেই, শরীরের কোথাও সামান্যতম বাঁকা হচ্ছে না, সোজাসুজি এগিয়ে চলেছে। সাধারণ হাঙরের তুলনায় বড়। আবার খুনী তিমির চেয়ে ছোট।
মুসার কাঁধ ছুঁয়ে ইঙ্গিতে হাঙর কিনা জিজ্ঞেস করলো কিশোর। মাথা নাড়লো, মুসা। দুজনেই দেখলো, ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে ছায়াটা, মিলিয়ে গেল গভীর পানির দিকে।
আবার সাঁতরে চললো দুজনে। পানির নিচে পাথরের ছড়াছড়ি আর ঢেউই বলে দিলো ওদেরকে, পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছে গেছে। সাবধানে ভেসে উঠলো। মাত্র কয়েক ফুট দূরে সুড়ঙ্গমুখটা।
মাউথপীস খুলেই আগে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, কি ছিলো ওটা?
বুঝলাম না। হাঙর না, তিমি না, কোনো জীবের মতোই লাগলো না। কিশোর, আমার ভয় লাগছে। গিয়ে বোধহয় শেরিফকে সব জানানো উচিত।
ভয় কি? ছায়াটা তো চলেই গেছে। দুজনেই যখন দেখেছি, চোখের ভুল। হতে পারে না। আর চোখের ভুল যখন নয়, ওটা ভূতপ্রেতও কিছু নয়।
কিন্তু…, বলতে দ্বিধা করছে মুসা।
দেখো, বোঝালো কিশোর। এতোটা এসে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয়, না। দড়ি বেঁধে নিলো কোমরে। একটা মাথা মুসার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ধরে রাখো। আমি ঢুকছি।
ডুব দিলো আবার কিশোর।
সূর্য ডোবে ডোবে। গোধূলির ছায়া নামছে। দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে রইলো মুসা। দুটো হ্যাঁচকা টান পড়তেই মুখে মাউথপীস লাগিয়ে সে-ও ডুব দিয়ে এগিয়ে গেল। কালো মুখটার দিকে।
ঢেউ কম, ফলে ফেনাও কম। স্রোত নেই। ওয়াটারপ্রুফ ফ্ল্যাশলাইট জ্বাললো সে। ঢুকে পড়লো সুড়ঙ্গে। হাত-পায়ে ভর দিয়ে এগোনোর চেয়ে সাঁতরে চলা অনেক সহজ। দ্রুত কমে আসছে পানির গভীরতা। চওড়া জায়গাটায় চলে এলো, যেখান থেকে বাঁকা হয়ে উঠে গেছে সুড়ঙ্গ। কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে চলে এলো মুসা। বড় গুহাটায় ঢুকলো দুজনে।
গোঙানি শোনা গেল।
হাসি ফুটলো গোয়েন্দাপ্রধানের মুখে। গুহার ভেতরে ঢুকে গেছে ওরা, অথচ গোঙানি বন্ধ হয়নি।
খাইছে! ফিসফিস করে বললো মুসা। ফাঁকিটা ঠিকই দিয়ে দিলাম। ঢুকতে দেখেনি আমাদের।
তাই তো মনে হচ্ছে।
দ্রুতহাতে ডুবুরির পোশাক খুলে ফেললো দুজনে। পানি নিরোধক বাক্স থেকে মোম আর দেশলাই বের করে দুটো মোমবাতি ধরালো কিশোর। একটা দিলো মুসার হাতে। বললো, প্রতিটা সুড়ঙ্গের মুখের কাছে ধরবো এগুলো। শিখা যদি কাঁপে, বা কাত হয়ে যায়, বুঝবো বাতাস বইছে। আর না নড়লে বইছে না, তারমানে ওই সুড়ঙ্গ বন্ধ। সেটাতে ঢুকুবোই না। অনেক সময় বাঁচবে তাতে।
দারুণ বুদ্ধি করেছো!
একে একে সুড়ঙ্গমুখগুলো পরীক্ষা করতে লাগলো ওরা। একটা মুখের কাছে। বাতি ধরতে সামান্য কাঁপলো শিখা। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলো না কিশোর। সরে এলো আরেকটা মুখের কাছে।
হঠাৎ একটা মুখের কাছে বাতি ধরতেই টান মেরে যেন শিখাটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিতে চাইলো অদৃশ্য শক্তি, নিভেই গেল বাতিটা।
পেয়েছি, কিশোর! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
আস্তে! কাছেপিঠে কেউ থাকতে পারে।