পালিয়েছে, হতাশ হয়ে বললো মুসা।
আগেই বোঝা উচিত ছিলো আমাদের। তাহলে একজন পেছন দিয়ে যেতে পারতাম, আরেকজন সামনে দিয়ে।
চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে। এখন আর ভেবে লাভ নেই। চলো, তোমার রিসার্চ সেরে নাও।
আবার লাইব্রেরিতে ঢুকলো দুজনে। লাইব্রেরিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো রবিন, লোকাল হিস্টরির বইগুলো কোনখানে পাওয়া যাবে। হলের পাশের ছোট একটা ঘর দেখিয়ে দিলেন মহিলা। জানালেন, ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসের ওপর স্পেশাল কিছু বইও আছে ওখানে।
ছোট ঘরটায় সবে ঢুকেছে দুজনে, একটা হাত পড়লো মুসার কাঁধে। বাহ, আমাদের গোয়েন্দারা দেখছি!
পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর হারকসন। ভারি পাওয়ারের কাঁচের ওপাশে একটা চোখ টিপলেন। বিশেষ কিছু জানতে এসেছো?
হ্যাঁ, স্যার, জবাব দিলো মুসা। মোনিং ভ্যালি সম্পর্কে।
গুড, গুড, উৎসাহ দিলেন প্রফেসর। আমিও সেজন্যেই এসেছি। সুবিধে হলো না। সত্যিকার ইতিহাস বলতে কিছু নেই, অধিকাংশই উপকথা, রূপকথা কিংবা কিংবদন্তী। …তারপর, ফিয়েসতায় গিয়েছিলে?
গিয়েছিলাম! যা সুন্দর সুন্দর ঘোড়া না?
অতি চমৎকার একটা উৎসব।…যাই। এখানে বসে থেকে আর লাভ নেই। তা, যাচ্ছ কিভাবে?
সাইকেল নিয়ে এসেছি, স্যার, রবিন জানালো।
বেশ। দেখা হবে, চলি, বলে ঘুরলেন প্রফেসর।
স্যার? এক মুহূর্ত দ্বিধা করে জিজ্ঞেসই করে ফেললো রবিন, একটা লোককে দেখেছেন? চোখে কালো পট্টি?
মাথা নাড়লেন প্রফেসর। না তো। কাল রাতে যাকে দেখেছিলে?
হ্যাঁ, মুসা বললো।
এখানে, এই শহরে? চিন্তিত মনে হলো প্রফেসরকে। না, দেখিনি।
প্রফেসর বেরিয়ে গেলে, কাজে বসলো দুই গোয়েন্দা। গোটা চারেক বই পেলো, যেগুলোতে মোনিং ভ্যালির উল্লেখ আছে। তবে নতুন কিছু জানা গেল না। শেষে ছোট আরেকটা বই খুঁজে পেলো রবিন। পাতাগুলো, হলদে হয়ে এসেছে, কুঁচকানো। তাতে রয়েছে উপত্যকাটার পুরো ইতিহাস, একেবারে ১৯৪১ সাল। পর্যন্ত। ভুল তাকে ভুল জায়গায় ছিলো বইটা, সে-কারণেই বোধহয় খুঁজে পাননি প্রফেসর।
মিসেস হারভের কার্ড দেখিয়ে বইটা ধার নিলো রবিন। বাইরে বিকেলের রোদ তখনও বেশ চড়া, প্যারেড মাত্র. শেষ হয়েছে। এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে লোকেরা। মোম, বই আর হ্যাঁটের প্যাকেট সাইকেলের ক্যারিয়ারে রেখে চড়ে বসলো দুই গোয়েন্দা। র্যাঞ্চে ফিরে চললো।
নামার সময় তো আরামেই নেমেছে, ওঠার সময় কষ্ট হলো। শেষে গিরিপথের কাছাকাছি এসে আর পারলো না। সাইকেল থেকে নেমে ঠেলে নিয়ে উঠতে লাগলো।
কিছুদূর উঠে বিশ্রাম নিতে বসলো। তাকালো চ্যানেল আইল্যাণ্ডস-এর দিকে। আলো কম। দূরে এখন আবছা দেখা যাচ্ছে দ্বীপগুলো।
ইস, যদি যেতে পারতাম ওখানে! মুসা বললো।
শুনেছি, ওখানেও তৃণভূমি আছে। কাউবয়েরা গরু চরায়।
দ্বীপের কিনারে নোঙর করে আছে নেভির নৌ-বহর।
সানতা কারলার দিক থেকে একটা গাড়ি আসছে। শব্দ কানে এলো ছেলেদের, ফিরলো না, ওরা তাকিয়ে রয়েছে সাগরের দিকে। হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠলো। প্রচণ্ড গতিতে আসছে গাড়িটা।
লাফিয়ে উঠে চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলো দুজনে। গাড়ির দুই চাকা রাস্তায়, দুই চাকা রাস্তার বাইরে। সোজা তাদের দিকেই আসছে।
এক ধাক্কায় রবিনকে সরিয়ে দিয়ে নিজেও সরে গেল মুসা। ধাঁ করে তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল গাড়িটা, নাক ঘুরিয়ে উঠে পড়লো রাস্তায়। চলে যাচ্ছে।
গা বাঁচাতে গিয়ে বেশি সরে গেছে দুজনে। ঢালের কিনারে। তাল সামলাতে পারলো না। পিছলে, গড়িয়ে পড়তে লাগলো ঢাল বেয়ে। নিচে গভীর খাদ।
.
১০.
গড়িয়ে পড়ছে মুসা। চোখা পাথর আর কাঁটাগাছে লেগে কেটেছিলে যাচ্ছে চামড়া। পাগলের মতো থাবা মারছে, আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে গাছের গোড়া, পাথর। হাত পিছলে যাচ্ছে। গাছ যেটাও বা ধরতে পারছে, তার ভর রাখার মতো শক্ত নয়, উপড়ে যাচ্ছে। আর ফুট চারেক পরেই ঢাল শেষ, তার পরে শূন্যতা। বাঁকা হয়ে থাকা বড় একটা গাছের ওপর আছড়ে পড়লো সে, সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো গাছের কাণ্ড। হউফ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত গাছ ধরে ঝুলে রইলো সে। জোরে জোরে শ্বাস নিলো। তারপর লক্ষ্য করলো, সে একা। চেঁচিয়ে ডাকলো, রবিন!
সাড়া নেই। নিচে নিঃসীম কালো খাদ হাঁ করে রয়েছে।
রবিন! আরও জোরে ডাকলো।
বাঁয়ে মৃদু নড়াচড়া। ঘন ঝোপের ভেতর থেকে উঁকি দিলো রবিনের মুখ। আমি..আমি ভালোই আছি। দুর্বল কণ্ঠস্বর। কার্নিশের মতো বেরিয়ে আছে…কিন্তু পা নাড়াতে পারছি না!
চেষ্টা করো। খুব আস্তে।
অপেক্ষা করছে মুসা।
নড়ছে ঝোপটা। আবার শোনা গেল রবিনের কণ্ঠ, হ্যাঁ, পারছি এবার। ভাঙেনি। গায়ের নিচে বেকায়দা ভাবে চাপা পড়েছিলো। ব্যথা করছে খুব।
ক্রল করে উঠতে পারবে?
জানি না। ওপর দিকে তাকাতেই ভয় লাগছে, যা খাড়া!
পড়লে একেবারে… কেঁপে উঠলো মুসার গলা, কথাটা শেষ হলো না।
চেঁচালে কেমন হয়? কেউ না কেউ শুনতে পাবে।
শুরু করো। কিন্তু চিৎকার, বেরোলো না মুসার গলা দিয়ে, শুধু খসখস শব্দ। আসলে চিৎকার করলোই না। সবে মুখ খুলেছে, এই সময় ওপরে ঢালের কিনারে দেখতে পেলো একটা মুখ। নিচে উঁকি মারছে। গালে কাটা দাগ, চোখে পট্টি।
পুরো দশ সেকেণ্ড চোখে চোখে তাকিয়ে রইলো দুজনে। তারপর সরে গেল। মুখটা। দৌড়ে যাওয়া পদশব্দ, গাড়ির এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার আওয়াজ, মেটাল। বাধানো পথে টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। চলে গেল গাড়িটা।