কি বললো ব্যাটা? সেদিকে তাকিয়ে বললো মুসা।
ভিভা ফিয়েস্তা। ওই তোমরা ঈদ মোবারক বলো না, অনেকটা ওরকম। আজ বোধহয় সানতা কারলায় ফিয়েসতা হচ্ছে। ভালোই হলো। অনেক দিন থেকে দেখার শখ।
ফিয়েসতার জন্যে ওরকম পোশাক পরেছে! গুঙিয়ে উঠলো মুসা। তাদেরই বয়েসী একটা ছেলে এভাবে ভয় পাইয়ে দিয়ে গেল, মেনে নিতে পারছে না।
ফিয়েসতায় গেলে ওরকম অন্তত আরও দশটা হেনরি ফিগারোকে দেখতে পাবে, বাজি ধরে বলতে পারি।
থাকুক। কোনো কানাগলিতে ওদের সামনে পড়তে চাই না আমি।
আবার সাইকেলে চাপলো ওরা। নেমে চললো আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে। প্যাডাল ঘোরানোর দরকারই পড়লো না। তীব্র গতিতে নেমে চলে এলো শহরের কিনারে। পাহাড় ওখানে শেষ।
প্যাডাল করে চললো ওরা। দুধারে বাড়িঘর, গলফ খেলার মাঠ, বড় বড় সপিং সেন্টার।
পথে একটা লোককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, লাইব্রেরিটা শহরতলীতে। চলে এলো ওরা ওখানে। সাইকেল পার্ক করার নির্দিষ্ট জায়গা আছে। ওখানে রেখে হেঁটে এগোলো সানতা কারলার প্রধান সড়ক ইউনিয়ন স্ট্রীট ধরে। বেশি দূর যেতে পারলো না। ব্যারিয়ার দিয়ে বুক করে দিয়েছে পুলিশ, ফিয়েসতা প্যারেডের জন্যে। ব্যারিয়ারের ওধারে ইতিমধ্যেই সারি দিয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে লোকে, প্যারেডে অংশ নিতে এসেছে যারা। বেশির ভাগেরই পরনে পুরনো আমলের স্প্যানিশ পোশাক, চোখ ধাঁধানো রঙ। আনন্দঘন পরিবেশ। ও তাড়াতাড়ি কেনাকাটা সেরে নিলো দুই গোয়েন্দা। পথের ধারে ছোট একটা দোকানেই পাওয়া গেল মোম আর খড়ের তৈরি সমব্রেরো হ্যাট। তারপর ছুটে এলো আবার পথের মোড়ে, ব্যারিয়ারের কাছে, প্যারেড দেখার জন্যে।
শুরু হলো প্যারেড। ধিড়িম ধিডিম বেজে উঠলো ড্রাম, সেই সাথে পাল্লা দিলো যেন ট্রাম্পেটের কড়া, মিষ্টি চিৎকার।
ব্যাণ্ডের পর এলো ফ্লোট। ফুলে ফুলে সাজানো। সুন্দরী মেয়েরা রয়েছে তাতে, আর নানারকম বিচিত্র পোশাক পরা পুরুষ। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসের এক অসাধারণ মুহূর্ত তুলে ধরা হয়েছে ফ্লোটগুলোতে। প্রথম ফ্লোটটা তৈরি হয়েছে ফাদার জুনিপাররা সেরা-র সম্মানে। ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে পুরনো যতোগুলো চমৎকার মিশন রয়েছে, তার বেশির ভাগেরই প্রতিষ্ঠাতা এই মহৎ ফ্রানসিসকান মিশনারি। আরেকটাতে দেখানো হয়েছে, মেকসিকানদের কাছ থেকে সানতা কারলা দখলের পর সেখানে আমেরিকান পতাকা উত্তোলন করছেন জন, সি. ফ্রেমন্ট। আরেকটাতে রয়েছে হেনরি ফিগারো (এই রকম চরিত্রের একজন লোক সত্যি ছিলেন। তাঁর নাম জ্যাসপার ওরটেগা জেসাস ডি ডেলগাডো ওয়াই ক্যাবরিলো)। পাঁচজন সেজেছে হেনরি ফিগারোর সাজে, তার মাঝে সেই ছেলেটাকেও দেখতে পেলো দুই গোয়েন্দা, গিরিপথে যে তাদেরকে চমকে দিয়েছিলো।
এলো অশ্বারোহী মাউন্টেড পুলিশ বাহিনী। ঘোড়াগুলো অপূর্ব। ওরকম একটা ঘোড়ার মালিক হতে না পারায় আফসোস হলো মুসার। প্যালোমিনো জাতের, প্রায় সোনালি গায়ের রঙ, যেন তেল চুঁইয়ে পড়ছে শরীর থেকে।
তাদের পেছনে এলো পুরনো আমলের ঘোড়ায়-টানা গাড়ির বহর, ওয়াগন, স্টেজকোচ, এইসব। সব শেষের ফ্লোটটা গোল্ড রাশ (স্বর্ণ-সন্ধান) যুগের প্রতিচ্ছবি।
মুসার হাত খামচে ধরলো রবিন। দেখো দেখো।
পাশের দুজন লোককে দেখালো সে। একটা খচ্চরের পাশে হাটছে। জানোয়ারটার পিঠে চাপিয়েছে খাবার, বেলচা, গাঁইতি, আর খনি খোঁড়ার অন্যান্য সরঞ্জাম। দুজনের একজনকে চেনে ওরাঃ বুড়ো ডিন মারটিন।
আরেকজন নিশ্চয় তার দোস্ত, মুসা বললো। কার্ল বেইরি।
এই ফ্লোটটা দেখে বেশ মজা পেলো জনতা। এমনভাবে সেজেছে মারটিন আর বেইরি, একেবারে আসল প্রসপেকটরের মতো দেখাচ্ছে। খনিতে কাজ করার উপযোগী.পুরনো পোশাকে বালি লেগে রয়েছে, যেন এই মাত্র বেরিয়ে এসেছে গর্ত থেকে। মাথা উঁচু করে আগে আগে হাঁটছে মারটিন, সামান্য খোঁড়াচ্ছে, বাতাসে উড়ছে তার শাদা লম্বা দাড়ি। পেছনে বেইরি। লম্বা, রোগাটে, বয়স মারটিনের। মতোই, তবে দাড়ির বদলে তার রয়েছে শাদা মস্ত গোঁফ।
ব্যাণ্ড বাজছে, ফ্লোট চলেছে শহরের প্রধান সড়ক ধরে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে জনতা। হাসি-আনন্দে মুখর। এতোই তন্ময় হয়ে দেখছে দুই গোয়েন্দা, লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথাই ভুলে গেল। একটা লোকের ওপর চোখ পড়তে চমকে উঠলো মুসা। ফিসফিস করে বললো, রবিন!
রবিনও দেখলো। কয়েক ফুট দূরে সেই লোকটা। লম্বা, গালে কাটা দাগ, চোখের ওপর পট্টি। প্যারেডে মনোযোগ নেই তার। উসখুস করছে। তারপর যেই একটু ফাঁক পেলো, ইউনিয়ন স্ট্রীট পেরিয়ে দ্রুত চলে গেল ওপাশে।
এসো, বলেই তার পেছনে ছুটলো রবিন।
বিশ ফুট দূরে দেখা গেল লোকটাকে। দ্রুতপায়ে হাঁটছে। মাঝে মাঝে থেমে সামনের কি যেন দেখছে।
কারও কিছু নিয়েছে, রবিন বললো।
কার?
দেখছি না। তুমি দেখছো কাউকে?
চোখের ওপর হাত এনে রোদ আড়াল করে, মাথা উঁচু করে দেখলো মুসা।, কাউকে দেখছি না।
লাইব্রেরির চত্বরে পৌঁছলো লোকটা। দরজার দিকে এগোলো।
ওখানে ঢুকছে কেন? অবাক হলো রবিন।
উঁচু ডাবল ডোর দিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা। পেছনে ছুটে গেল ছেলেরা। ভেতরে ঢুকেই থেমে গেল ফিয়েসতার দিনে আজ লাইব্রেরি প্রায় নির্জন। অথচ লোকটাকে চোখে পড়লো না।
বিরাট হলঘর। অসংখ্য বুকশেলফের মাঝে মাঝে হাঁটাচলার জন্যে ফাঁক.। ওখানে সেই লোকটা। বাইরে বেরোনোর দুটো দরজা দিয়েই বেরিয়ে দেখলো ওরা। দুটো গলি, কোনোটাতেই দেখা গেল না লোকটাকে।