ভেজা পাথরগুলো কোনোমতে পেরিয়ে এসে সৈকতে নেমেই দৌড় দিলো রবিন আর কিশোর। বাঁ দিকের প্রায় শেষ মাথায় চ্যাপ্টা বড় একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মুসা। মস্ত দুটো পাথরের চাঁইয়ের মাঝে টর্চের আলো ফেলেছে। ছোট একটা মুখ, পানি থেকে বড়জোর ফুট খানেক ওপরে।
এই, শুনছো? কান পাতলো মুসা। আবার শুরু হয়েছে।
অন্য দুজনও শুনলো।
গোঙানিটা আসছে খোলা সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে। মৃদু শব্দ, যেন পর্বতের অনেক, গভীর থেকে আসছে।
আরেকটু এগিয়ে মুখের ভেতরে আলো ফেললো মুসা। কালো, ভেজা, সরু পথ। সোজা চলে গেছে সুড়ঙ্গ, শেষ কোথায় বোঝা যাচ্ছে না।
.
০৭.
খাইছে রে! কি অন্ধকার! বললো মুসা।
কিছু দূর গিয়েই বোধহয় শেষ হয়ে গেছে, রবিন অনুমান করলো।
না দৃঢ় কণ্ঠে বললো কিশোর। নিশ্চয় ওই গুহায় যাওয়া যায় এটা দিয়ে। নইলে গোঙানি শুনতে পেতাম না।
দেখে কিন্তু তা মনে হয় না, মুসার কণ্ঠে সন্দেহ।
ঝুঁকে ভেতরে তাকালো কিশোর। ঢোকা যাবে। সাবধান থাকতে হবে। আরকি। রবিন, তুমি যাও। যে রকম সরু ওটা, তোমার জন্যেই সহজ। কোমরে। দড়ি বেঁধে নামো, আমরা দড়ি ধরে রাখছি।
আমি? একা! তিনজনে একসাথে যাওয়া যায় না?
বোকামি হবে। এরকম অচেনা সুড়ঙ্গে একলা গেলেই ভালো। আমরা বাইরে থাকছি। তুমি কোনো বিপদে পড়লে দড়ি ধরে টেনে বের করে আনতে পারবো। তিনজন একসাথে বিপদে পড়লে তিনজনেই মরবো।
হ্যাঁ, সিনেমায় দেখেছি, মুসা বললো। ওই যে, জেলখানা থেকে পালায়, ওসব ছবিতে। অচেনা সুড়ঙ্গে আগে একজনকে পাঠায়। ও গিয়ে দড়িতে একবার হ্যাঁচকা টান দিলে বাইরের ওরা বোঝে, বিপদে পড়েছে, কিংবা নিরাপদ নয়; তাড়াতাড়ি দড়ি ট্রেনে লোকটাকে বের করে নিয়ে আসে।
তুমিও একবারই টেনো, রবিনকে বললো কিশোর। টেনে বের করে নিয়ে আসবো।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোমরে শক্ত করে দড়ি বেঁধে নেমে পড়লো রবিন। হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো।
ভেতরে খুব ঠাণ্ডা। অন্ধকার তো বটেই। ছাত এতো নিচু, উঠে দাঁড়াতে পারবে না। দেয়াল ভেজা, সবুজ শ্যাওলায় পিচ্ছিল। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে একটা জন্তুর মতো এগিয়ে চললো সে, সাবধানে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে। অনেক কাকড়া আছে ভেতরে। টর্চের আলো পড়লেই বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়া নেড়ে তাড়াহুড়ো করে গিয়ে ঢুকছে ভেজা পাথরের আড়ালে।
তিরিশ ফুট মতো এগিয়ে হঠাৎ ওপরে উঠে গেছে ছাত। উঠে দাঁড়ালো রবিন। সামনে এখনও ভোলা সুড়ঙ্গ। বাধা নেই। ছাত উঁচু হয়েছে, দেয়াল দুদিকে সরে গিয়ে মাঝখানটা চওড়া হয়েছে, কোণাকুণি উঠে গেছে পথটা। ভেজা, নয় আর, শুকনো।
কিশোর! মুসা! চেঁচিয়ে বললো সে। ঠিকই আছে সব। এসো।
ওরা দুজনও তার পাশে এসে দাঁড়ালো।
বেশ শুকনো তো এখানে, বললো মুসা।
জোয়ারের পানি উঠতে পারে না, তাই, কিশোর বললো।
এগিয়ে চললো ওরা। প্রতি দশ ফুট পর পর চিহ্ন আঁকছে কিশোর। চল্লিশ ফুট পর, বড় একটা গুহা পাওয়া গেল। দেয়ালে এতো বেশি ফোকর, যেন মৌমাছির বিরাট এক বাসা। কোনটা দিয়ে ঢুকবে?
পরস্পরের দিকে তাকালো ওরা।
আবার সেই সমস্যা, মুসা বললো।
পাহাড়টার তলায় সুড়ঙ্গ ছাড়া যেন আর কিছু নেই, নিরাশ হয়ে মাথা নাড়লো রবিন। কোনটায় ঢুকবো?
গুহা, কিংবা ফোকরগুলোর দিকে বিশেষ নজর নেই কিশোরের। কান পেতে রয়েছে। শব্দ কই?
তাই তো! মুসার দিকে চেয়ে ভুরু নাচালো রবিন। নেই!
না, নেই! মুসাও মাথা নাড়লো।
আমি সুড়ঙ্গে ঢোকার পর থেকেই কিন্তু শুনিনি, রবিন বললো।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকালো কিশোর। আমরা ঢুকলেই বন্ধ হয়ে যায়। আশ্চর্য! একবার নয়, দুবার ঘটলো একই ঘটনা। কাকতালীয় আর বলা যায় না।
কি বলতে চাইছো? অবাক মনে হলো মুসাকে। আমরা ঢুকলেই কিছু একটা গড়বড় হয়ে যাচ্ছে? তাতে থেমে যাচ্ছে গোঙানি?
হতে পারে।
আরও একটা ব্যাপার হতে পারে, বললো রবিন। ফুকলেই আমাদের কাউকে দেখে ফেলছে। নিজেই প্রশ্ন তুললো আবার, কিন্তু কিভাবে?
মাথা নাড়লো কিশোর। বুঝতে পারছি না। হয়তো…
শোনা গেল শব্দটা। মৃদু, বহুদূর থেকে আসছে। ঘোড়ার খুরের খটাখট।
ঘোড়া! চেঁচিয়ে উঠলো রবিন।
মাথা ঘুরিয়ে শুনছে কিশোর। গুহার দেয়ালের ভেতর দিয়ে যেন আসছে শব্দটা। মনে হচ্ছে…পর্বতের অনেক গভীর থেকে আসছে!
রবিন বললো, হেনরি ফিগারোর গুহা থেকে…
উঁহু! ওটা এখন আমাদের বাঁয়ে। সোজাসুজি ঢুকেছি আমরা, পাহাড়ের দিকে মুখ করে আছি। তুমি যেদিকের কথা বলছো, সেদিকে কোনো সুড়ঙ্গ নেই, দেখো।
সব চেয়ে ভালো হয়, এখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলে, মুসা বলে উঠলো।
চলো, বেরিয়েই যাই। সেই ভালো।
পেছন ফিরে প্রায় দৌড়ে চললো ওরা। সুড়ঙ্গের সরু মাথাটার কাছে আগে পৌঁছলো মুসা। হামাগুড়ি দিয়ে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এগোলো। পেছনে রবিন আর কিশোর।
বেরিয়ে এলো সুড়ঙ্গ থেকে।
এখন কি করবো? জিজ্ঞেস করলো রবিন।
এক রাতে যথেষ্ট হয়েছে, জবাব দিলো কিশোর। র্যাঞ্চে ফিরে যাবো।
দুই সহকারীর মনের কথা বলেছে গোয়েন্দাপ্রধান। সানন্দে ফিরে চললো ওরা। কোমড়ে দড়ি বেঁধে উঠে চললো বিপজ্জনক পাহাড়ী পথ বেয়ে। নিরাপদেই উঠে এলো ওপরে।
আগে রয়েছে কিশোর। গেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো কিশোর। তার পিঠের ওপর এসে পড়লো মুসা। কি ব্যাপার?
জবাব দিলো না কিশোর। চেয়ে রয়েছে ডেভিল মাউনটেইনের দুই চূড়ার দিকে, একই রকম দেখতে চূড়া দুটো, যেন জমজ।