চাঁদের আলোয় কাঁচা সড়ক ধরে সাইকেল চালিয়ে চলেছে তিন গোয়েন্দা। এখনও যেন কানে বাজছে বুড়োর হাসি। হঠাৎ থেমে গেল কিশোর।
ধাঁই করে হ্যাণ্ডেল আরেক দিকে ঘুরিয়ে দিলো মুসা, অল্পের জন্যে কিশোরের সাইকেলের ওপর পড়লো না।
রবিনও ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো। কি ব্যাপার?
কাজ শেষ হয়নি এখনও, বলতে বলতেই আবার সাইকেল ঘোরালো কিশোর।
র্যাঞ্চে ফিরে গেলেই ভালো, বললো রবিন।
আমিও তাই বলি, তাড়াতাড়ি বললো মুসা।
কোনো কাজে হাত দিলে শেষ না করে ছাড়ে না তিন গোয়েন্দা, ঘোষণা করলো যেন কিশোর।
কিন্তু ভোটে হেরে যাবে, রবিন বললো। দুজন আর একজন।।
ঠেকানো গেল না কিশোরকে। প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করেছে।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে রইলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। তারপর নীরবে অনুসরণ করলো। জোরে জোরে প্যাডেল করে চলে এলো কিশোরের পাশে।
পথের মোড়ে ছায়ায় এসে থামলো কিশোর। ভালো করে দেখে বললো, অল ক্লীয়ার। এসো।
এবার কি করতে হবে? জিজ্ঞেস করলো রবিন।
আপাতত সাইকেলগুলো লুকাতে হবে। তারপর হেঁটে যাবো। চুপে চুপে।
চুপে চুপে হেঁটে কোথায় যাবো? জানতে চাইলো মুসা।
একটু আগে দেখলাম, এই পথটা ডেভিল মাউনটেইনের পাশ ঘুরে সাগরের দিকে গেছে। সাগরের দিক থেকে ঢোকার আর কোনো পথ আছে কিনা দেখবো।
পাহাড়ের ছায়া পথের ওপর। কিশোরের পিছু পিছু চললো রবিন আর মুসা। চাঁদের আলোয় পাহাড় আর পাথরের বিচিত্র সব ছায়া পড়েছে উপত্যকায়, দেখলে কেমন যেন গা ছমছম করে। পথের ধারে কখনও গাছপালা, কখনও পাথরের চাঁই। কখনও বা সরু গিরিপথের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে পথটা।
তিনটা প্রশ্ন, হাঁটতে হাঁটতে বললো কিশোর। আমরা ঢোকার পরই কেন বন্ধ হয়ে গেল গোঙানি? বাতাস তো আগাগোড়া একই রকম বইছে। তারমানে শুধু বাতাসের কারণে হয় না শব্দ।
অন্য কিছু? রবিন বললো।
হ্যাঁ।
কী? জানতে চাইলো মুসা।
আমাদের ওপর চোখ রেখেছে এমন কিছু কিংবা কেউ। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ডিন মারটিন আমাদেরকে গুহা থেকে বের করে দেয়ার জন্যে এতো ব্যস্ত হলো কেন?
বার বার তার বদলে যাওয়া ভালো লাগেনি। শেষ দিকে কেঁপে গেল রবিনের গলা।
হ্যাঁ,আনমনা হয়ে গেল কিশোর, ক্ষণিকের জন্যে। এক আজব বুড়ো! মনে হলো, দুজন ভিন্ন লোক ভিন্ন সময়ে বাস করছে। অভিনয়ই করলো কিনা কে জানে!
আমাদের ভালোই হয়তো চেয়েছে, তাই বের করে দিয়েছে, মুসা বললো। দেখলে না, বুড়ো মানুষের কথা বলার সময় কেমন ভয় ফুটলো চোখে। দানবটাকে দেখেছেও বোধহয়।
হয়তো। তিন নম্বর প্রশ্নটা হলো, কালো চকচকে যে জিনিসটা তুমি দেখলে। কি দেখেছো? কোনো সন্দেহ নেই আমার, পানিতে ভিজে ছিলো বলেই ছাপগুলো পড়েছে। পর্বতের ভেতরে কোথাও হ্রদ-টদ কিংবা খাড়ি যেমন থাকতে পারে, তেমনি পারে সাগর থেকে গুহায় ঢোকার কোনো গোপন পথ। সেটাই দেখতে চলেছি।
আর কিছু দূর এগোতেই সামনে লোহার গেট চোখে পড়লো। পথটা ওখানে। শেষ। তার পরে পাহাড়ের প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে ডানে-বাঁয়ে নেমে গেছে দুটো সরু পথ। অনেক নিচে ঢেউয়ের ফেনা শাদা রেখা সৃষ্টি করেছে চাঁদের আলোয়। গেট ডিঙিয়ে এসে পাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালো ছেলেরা।
ডালে যাবো, গুহাটা ওদিকেই, বললো কিশোর। পর্বতারোহীদের মতো। কোমরে দড়ি বেঁধে নেবো।-মুসা, তুমি আগে যাবে, আমি থাকবো পেছনে। সারি দিয়ে এগোবো। পথ যেখানে বেশি খারাপ একজন একজন করে পেরোবো। প্ল পিছলালেও অন্য দুজনে যাতে তাকে টেনে তুলতে পারি।
দ্রুতহাতে কোমরে দড়ি বেঁধে নিলো ওরা। সরু পথ ধরে আগে আগে চললো মুসা। নিচে বড় বড় পাথরে আছড়ে ভাঙছে ঢেউ। কালো, পাথরগুলো রুপোলি দেখাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। মাঝে মাঝে পথ এতো নিচে নেমে যাচ্ছে, আছড়ে ভাঙা ঢেউয়ের পানির ছিটে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদেরকে। তিনবার থামতে হলো। পথ এতো খারাপ ওসব জায়গায়, একজন একজন করে পেরোতে হলো।
শেষ দিকে প্রায় খাড়া ভাবে সোজাসুজি নেমে গেছে পথটা। নিচে ছোট এক টুকরো সৈকত, ঝকঝকে শাদা বালি। এখন নির্জন। তবে লোকজন যে আসে, সাঁতার কাটে, পিকনিক করে, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিয়ারের খালি টিন, ফান্টা-কোকাকোলার বোতল, খাবারের বাক্স পড়ে আছে এদিক-ওদিক।
ভালোমতো চোখ রাখবে, বললো কিশোর। ফোকর-টোকর থাকতে পারে।
ঢালের গোড়ার কাছটায় ঘন হয়ে জন্মে আছে ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে বড় জাতের গাছ, কোনো কারণে বেড়ে ওঠা ব্যাহত হয়েছে ওগুলোর। ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় পাথরের চাই।
টর্চের আলো ফেলে দেখছে ওরা। বিশেষ করে চাঁইগুলোর পেছনে।
আমার মনে হয় না এখানে কিছু আছে, মুসা বললো।
তাহলে কোথায় আছে? প্রশ্ন করলো রবিন।
কি জানি! কেউ তো বলেনি, এদিকেও সুড়ঙ্গমুখ আছে। আমরা আন্দাজ করছি। থেকে থাকলেও খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
থাকলে কাছাকাছিই কোথাও আছে। কারণ, পথটা শেষ হয়েছে এখানেই। ৪. ঠিকই বলেছো, মুখ খুললো কিশোর। রবিন, তুমি আমার সাথে এসো। ডান দিকে খুঁজবো। মুসা, তুমি বয়ে যাও।
পানির কিনারের পাথরগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে শ্যাওলায়। তাতে কামড়ে রয়েছে অসংখ্য শামুক-গুগলি। ওগুলোর ওপর দিয়ে হাঁটার সময় খুব সাবধান হতে হচ্ছে রবিন আর কিশোরকে।
অবশেষে এমন একটা জায়গায় এসে থামলো, আর এগোনোর উপায় নেই। তাহলে পানিতে নামতে হবে। হতাশ হয়ে ঘুরতে যাবে এই সময় শোনা গেল মুসার চিৎকার। এই, পেয়েছি!