সাগর অনেক দেখেছি। আর কি আছে?
ওয়ালটার উড়। বন। ভেতরে ঝর্না আছে একটা, অনেক বুনো ফুল আছে।
আর? জিনার মনে হলো, আসল কথাটা বলছে না মহিলা।
আর। হাসলো লিয়ারি। আর আছে একটা অনেক পুরনো কবরস্থান, একেবারে প্রাগৈতিহাসিক কালের। গুহামানবের অনেক কঙ্কাল পাওয়া গেছে। তার ওপরই নতুন কবর বানিয়ে নিয়েছিলো হামফ্রে ওয়ালটার। জলদস্যু ছিলো তো, মন-মানসিকতাই ছিলো অন্যরকম। নইলে বাপু, এতো জায়গা থাকতে পুরনো ওই কবরের ওপর আরেক কবর বানানো কেন?
টিউমিউল্যাস! বিড়বিড় করলো কিশোর।
টিউ..কী? বুঝতে পারলো না মুসা।
টিউমিউল্যাস। বুঝিয়ে বললো গোয়েন্দাপ্রধান, ওই ধরনের কবরস্থানকে বলে টিউমিউল্যাস।
.
বৃষ্টি থামলো বটে, কিন্তু মেঘ পুরোপুরি কাটেনি। আকাশের মুখ থমথমে। যে কোনো মুহূর্তে ঝরঝর করে শুরু হতে পারে আবার।
নামলে নামুক, জিনা বললো। আর বসে থাকতে পারবো না। বসে থেকে থেকে হাতে-পায়ে খিল ধরে গেছে। একটু ঝাড়া দিয়ে না এলে আর বাঁচবো না।
রেইনকোট পরে বেরোলো ওরা।
রাফিয়ান আর নটির কৃত্রিম কোট দরকার নেই, প্রাকৃতিক আসল রোমশ কোটই আছে। কাজেই পানিকে ওদের বিশেষ ভয় নেই। ভিজলে, জোরে ঝাড়া দিলেই গা থেকে ঝরে যাবে পানি।
ছেলেমেয়েরা চললো পায়ে হেঁটে, নটি চললো রাফিয়ানের পিঠে সওয়ার হয়ে। গলায় গলায় ভাব এখন দুটোতে, মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে যদিও লেগে যায় ঝগড়া।
দুর্গের কাছে চলে এলো ওরা। ভেঙেচুরে রয়েছে শত শত বছরের পুরনো দেয়াল, ছাতের চিহ্নও নেই।
দূর, মন খারাপ করে দেয়। বিড়বিড় করলো রবিন।
পুরনো দুর্গের সেলার দেখার খুব ইচ্ছে আমার, টুকার বললো। কিন্তু নামবো কোনখান দিয়ে? পথ তো দেখছি না।
শুধুই ধ্বংসস্তূপ। পুরোপুরি ঢেকে দেয়ার পায়তারা কষছে যেন ঘন ঘাস আর লতার দঙ্গল।
দেখার কিছুই নেই, মুসা বললো।
হ্যাঁ, খামোকাই এলাম। আকাশের দিকে তাকালো কিশোর। জলদি চলো৷ নামলো বলে।
কয়েক পা এগোতে না এগোতেই আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। দৌড়ে চললো ওরা। কিন্তু রেইনকোটেও মানলো না। কটেজে ফিরতে ফিরতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল সবাই।
পরের দিনও একই অবস্থা। সকাল থেকে বৃষ্টি। বিকেলের দিকে ধরে এলো। মেঘের ফাঁকে উঁকি দিলো সূর্য।
কিশোর প্রস্তাব দিলো, চলো, বেরোনো যাক।
সবাই রাজি। বেরিয়ে এলো পেছনের বাগানে। বাগানের পরে খানিকটা জংলা জায়গা। কয়েকটা আপেল গাছ আছে, আর আছে অনেক পুরনো বিশাল এক ওক গাছ। সব ভেজা। তার মধ্যেই ঘোরাঘুরি করতে লাগলো ওরা। ঘরে বসে থাকার চাইতে এটা অনেক ভালো মনে হলো।
রাফিয়ান আর নটির আনন্দের সীমা নেই। ছুটোছুটি করে খেলছে।
ভেজা ঘাস বেশিক্ষণ ভালো লাগলো না বানরটার। দুই লাফে গিয়ে উঠলো, ওকের একটা নিচু ডালে। তারপর তরতর করে উঠে গেল মগডালে।
মেঘের আড়ালে ঢুকলো আবার সূর্য।
নটি, এই নটি, নেমে আয়, ডাকলো টকার।
নামতে চাইলো না বানরটা। ওপরে থেকেই চেঁচিয়ে জবাব দিলো, ইঁক! ইঁক!
হুফ! হুফ! করে রাফিয়ানও ওকে নামার জন্যে ডাকলো।
কানেই নিলো না নটি। অনেক দিন পর ঘর থেকে ছাড়া পেয়ে গাছে চড়েছে বানর, নামতে কি আর ইচ্ছে করে? ওদিকে বৃষ্টিও প্রায় এসে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে দুবার-ঘর থেকে বেরিয়ে চা খাওয়ার জন্যে তাগাদা দিয়ে গেছে লিয়ারি।
এই নটি, নামলি না! রেগে গিয়ে ধমক দিলো টকার।
চলো, আমরা হাঁটতে শুরু করি, জিনা বললো। আপনিই নেমে আসবে।
ফোঁটা পড়তে শুরু করলো। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নামলো না বানরটা।
না নামলে থাক ওখানে, হাত নেড়ে বললো টকার। আমরা চলে যাচ্ছি…
তার কথা শেষ হলো না। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে নামলো। ঝমঝম করে বৃষ্টি।
চমকে উঠলো বানরটা। আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। নামতে শুরু করলো। ওকে ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলো টকার। লাফ দিলো নটি। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে টকারের হাতে না পড়ে পড়লো গিয়ে ভেজা ঘাসে। নিচে পানি, ওপরে পানি, এই অবস্থায় হতবুদ্ধি হয়েই বোধহয় মাথা গোঁজার জন্যে সোজা লতানো ঝোপের দিকে দৌড় দিলো ওটা।
আরে ধরো, ধরো! চেঁচিয়ে উঠলো টকার।
বৃষ্টির মাঝে বানরটাকে ধরার জন্যে পেছনে ছুটলো সবাই। রাফিয়ান ভাবলো, এটা একটা নতুন ধরনের খেলা। দৌড়ে গেল নটির কাছে। লাফ দিয়ে তার পিঠে উঠে বসলো বানরটা। আর সওয়ারির আদেশেই যেন সোজা, গিয়ে ঝোপের মধ্যে ঢুকলো কুকুরটা।
ধমক দিয়ে রাফিয়ানকে ডাকতে যাবে জিনা, এই সময় হাত তুলে দেখালো, রবিন। আমার মনে হয় ওখানে যাচ্ছে।
জংলা জায়গাটার ওধারে একটা পুরনো ছাউনি। কাজের জায়গা, কিন্তু কেউ কাজ করে না এখন ওখানে। অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে অনেকদিন।
দৌড়ে এসে ছাউনিতে ঢুকলো ওরা। রবিনের অনুমান ঠিকই। নটিকে নিয়ে ওখানেই এসেছে রাফিয়ান। কুকুরটার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে বানরটা, ঠাণ্ডায়। কিংবা ভয়ে যে কারণেই হোক, কাঁপছে। মনিবকে দেখে লাফিয়ে এসে উঠলো তার কাঁধে।
কালো আকাশটাকে চিরে দিলো যেন বিদ্যুতের শিখা। ভীষণ শব্দে বাজ পড়লো। আবার, তারপর আবার।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। ঝড়ই শুরু হলো দেখছি।
হ্যাঁ, মনে হয় একেবারে মাথার ওপর বাজ পড়ছে, বললো জিনা।
আর বাড়ছেই, কান পেতে ঝড়ের আওয়াজ শুনছে রবিন। এগিয়ে আসছে। বোধহয় সাগরের দিক থেকে…