যা জঙ্গল, আর পোড়ো বাড়ি আছে আশপাশে, মুসা বললো। গুপ্তধনের খোঁজ পেয়ে গেলেও হতো। অন্তত একটা ম্যাপ-ট্যাপ…
চেষ্টা করলে হয়তো গুপ্তধনই পেতে পারো, পেছন থেকে বলে উঠলো লিয়ারি।
ফিরে তাকালো তিন গোয়েন্দা।
মিটিমিটি হাসছে মহিলা। বললো, দাঁড়াও, চা নিয়ে আসি। তারপর বলবো।
সেইদিন লিয়ারির আরেক পরিচয় পেলো ছেলেরা। মহিলা বর্ন স্টোরি টেলার, একেবারে জাত গল্প বলিয়ে। এতো সুন্দর করে গুছিয়ে বলে, না শুনে। উপায় নেই।
একঘেয়ে ভাব অনেকটা কাটলো ছেলেমেয়েদের। খাওয়ার সময় খায়, আর বাকি সময় বসে বসে গল্প শোনে।
বাইরে বৃষ্টির থামাথামি নেই। পড়েই চলেছে। কখনও অঝোর বর্ষণ, কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি। মাঝেমাঝে ধেয়ে আসে ঝড়ো হাওয়া, টালির চালের ফাঁকে ঢুকে বিচিত্র শব্দ তোলে।
জানালার ধারে বসে সোয়েটার বুনতে বুনতে গল্প করছে সেদিন লিয়ারি। হঠাৎ বাইরে চেয়ে কি দেখলো। মুখ ফিরিয়ে হেসে বললো, যাক, আর ঘরে বসে থাকতে হবে না। বেরোতে পারবে। মেঘ কাটছে। বৃষ্টি থামলে কোথায় ঘুরতে গেলে ভালো হবে, সেটাও বলে দিতে পারি। রহস্যময় হাসি ফুটলো তার মুখে।
.
০৬.
আরে তাই তো! আকাশের দিকে চেয়ে বললো কিশোর। খেয়ালই করিনি।…তা মিসেস এলমস, কোথায় গেলে ভালো হবে?
কয়েক দিনে কিশোরের স্বভাব অনেকখানিই জানা হয়ে গেছে লিয়ারির। বুঝে গেছে, ছেলেটা কি চায়? ওই যে সেদিন গুপ্তধনের কথা আলোচনা করছিলে, ওয়ালটার ম্যানরের কথা বললাম। ওখানেই যাও। রাস্তায় নেমে বাঁয়ে মোড় নেবে। ছোট একটা পাহাড়ের ওপর…
হা হা, দেখেছি, বলে উঠলো রবিন। আসার দিন
হ্যাঁ, ওটাই।
সেদিন কিন্তু সব কথা বলেননি, কিশোর ধরলো। খালি গুপ্তধনের গুজবের কথাই বলেছেন। ওই দুর্গ কাদের, ওয়ালটাররা কে ছিলো, কিছুই বলেননি।
তাহলে তো চা দরকার। বসো, নিয়ে আসি।
দাঁড়ান, আমিও আসছি, উঠে দাঁড়ালো রবিন। আপনাকে সাহায্য করবো।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো দুজনে। লিয়ারির হাতে চায়ের সরঞ্জাম। রবিনের হাতে ইয়া বড় এক কেক।
খাবারের গন্ধে চোখ মেললো রাফিয়ান। উঠে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো।
ফ্যানের একটা পাখা ধরে ঝুলছিলো নটি, ঝুপ করে লাফ দিয়ে পড়লো ঠিক কুকুরটার পিঠে।
ওদের দিকে দুই টুকরো কেক ছুঁড়ে দিলো লিয়ারি। চায়ের কাপে ঘনঘন চুমুক দিলো কয়েকবার। তারপর কাপটা প্লেটে নামিয়ে রেখে বললো, হ্যাঁ, ওয়ালটার দের শরীরে রয়েছে জলদস্যুর রক্ত…
এই এক কথায়ই শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে ফেললো লিয়ারি। ওদেরকে আগ্রহী করে বসিয়ে রেখে কাপের বাকি চা-টুকু শেষ করলো। বললো, তোমরা খাচ্ছো না কেন? খাও খাও, আমি বলিহামফ্রে ডেভিড ওয়ালটার ছিলো দুর্ধর্ষ জলদস্যু। সে-ই বানিয়েছিলো ওই দুর্গ। লোকটা ছিলো ওলন্দাজ। তার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন রাজা। শেষে বিশাল এক নৌবাহিনী পাঠালেন। হামফ্রেকে ধরার জন্যে। মাঝ সাগরে প্রচণ্ড লড়াই হলো। একে একে ধ্বংস করে। দেয়া হলো হামফ্রের সমস্ত জাহাজ। তার বেশির ভাগ সঙ্গীসাথীই মারা পড়লো। কিন্তু তাকে ধরতে পারলো না নেভি। একটা জাহাজ নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে বাঁচলো সে, সোজা চলে এলো আমেরিকায়। ওই একটা জাহাজেও ধনরত্ন কম। ছিলো না। ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে বিরাট এক দুর্গ বানিয়ে বাস করতে লাগলো হামফ্রে। নিরাপদেই কাটিয়ে গেল জীবনের শেষ কটা দিন। ও হ্যাঁ, এখানে এসে বিয়ে করেছিলো সে। তাদেরই বংশধর এখানকার ডেভিড ওয়ালটার, ডাক্তার। হয়েছে। ডাক্তারের বউ বিদেশী, এক আইরিশ মহিলা, নরিলি। ছেলেপুলে হয়নি। ডাক্তারের বড় এক ভাই ছিলো, মারা গেছে, এক ছেলে রেখে গেছে। নাম, ড্যানি। ওই ছেলেই একদিন এতোবড় সম্পত্তির মালিক হবে। ড্যানির বাবা ছিলো। আর্কিটেক্ট, লণ্ডনে বিরাট বাড়ি করেছে, অনেক টাকার মালিক। ড্যানি আর তার চাচা-চাচী, ওখানেই থাকে বেশি, এখানে প্রায় আসেই না। এলেও দুচারদিন থেকে আবার চলে যায়। দেশ তো আসলে ওদের ওটা-ই।
এলে কি ওই পোড়ো বাড়িতেই থাকে নাকি? জিজ্ঞেস করলো জিনা।
আরে না না, ওখানে থাকবে কি? দুৰ্গটার একটা ঘরের ছাতও অবশিষ্ট নেই, সব ভেঙে পড়েছে। কাছেই আরেকটা সুন্দর বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে ডাক্তার, চমৎকার একটা পার্কের কাছে। বাংলোটার নাম দিয়েছেঃ ওয়ালটার লজ।
ও, দেখেছি তো সেদিন বাড়িটা, মুসা বললো। দুর্গের কাছে গেলেই দেখা যায়।
হ্যাঁ। ওয়ালটার ম্যানর, ওয়ালটার লজ, পার্ক, ওয়ালটার উড, আর ওদিককার প্রায় সমস্ত জায়গাই ওদের। আমার এই কটেজটাও…
কি বললেন? ভুরু কোচকালো কিশোর। আপনার মানে লিয়ারি কটেজও ওয়ালটারদের জায়গার মাঝেই?
আগে ছিলো। এখন আলাদা। আমার স্বামীর দাদা, মানে আমার দাদা-শ্বশুর চাকরি করতো ওয়ালটারদের এস্টেটে। এই জায়গাটা তাকে দান করে দিয়েছে ডাক্তারের দাদা।
ভাঙা দুর্গ দেখার ইচ্ছে নেই আমার, জিনা বললো। ওরকম দুর্গ আমার নিজেরই একটা আছে, এক্কেবারে আস্ত এক দ্বীপ সহ। ভাঙা দেয়াল ছাড়া দেখার আর কি আছে?
পাহাড়ে চড়লেই সাগর দেখতে পাবে। তোমরা যেদিকে সাঁতার কাটতে গেছে, তার উল্টো দিকে। ওখানে সৈকত নেই, সাঁতার কাটতে পারবে না। নামতেই পারবে না। খাড়া পাহাড়, নিচে পাথরের ছড়াছড়ি, ঢেউ আছড়ে পড়ে। মাথা ঘুরে যদি নিচে পড়ো, ছাতু হয়ে যাবে। কাজেই, হুঁশিয়ার থাকবে।