তা তো বুঝলাম, টকারকে থামিয়ে দিয়ে বললেন মিসেস পারকার। খুব ভালো জায়গা। কিন্তু ওটা লণ্ডনে, এখন যেতে পারবে না। আমাদের সমস্যার। সমাধান হচ্ছে না।
আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে, মা, আবদার ধরলো জিনা। বাবাকে বলেই। দেখো না।
বললেই হবে নাকি? এখানেই আবহাওয়া খারাপ, ওখানে নিশ্চয় আরও বেশি খারাপ। তাছাড়া প্রফেসর কারসওয়েল চলে এসেছেন এখানে, তিনি বাড়িতে থাকলে না হয় এক কথা ছিলো…পরে কোনো এক সময় যাস। আপাততঃ এখানেই কোথাও ব্যবস্থা করতে হবে…
একটা জায়গা আছে, বলে উঠলো আইলিন। অবশ্য যদি এখন খালি পাওয়া যায়।
সব কটা চোখ ঘুরে গেল তার দিকে।
মিসেস লিয়ারি এলমস-এর কটেজ, আবার বললো আইলিন। ভাড়া দেয়। খাবারও ভালো।
হু, নাম শুনেছি, বললেন মিসেস পারকার। কাছেই কোথায় যেন। যাইনি। কখনও।
হা। বড় জোর দুই কিলোমিটার এখান থেকে।
যোগাযোগ করতে হবে কিভাবে?
ফোন নম্বর জানি আমি।
তাহলে একটা রিঙ করো না, প্লীজ। দেখো, খালি আছে কিনা।
টেলিফোন করলো আইলিন। টুরিস্ট সীজন নয়, খালিই আছে কটেজ। ভাড়া করে ফেলা হলো।
ফিরে এসে বসতে বসতে বললো আইলিন, ভালো জায়গা। তোমাদের খুব পছন্দ হবে। ওটার আশপাশে পুরনো অনেক ভাঙা দুর্গ আছে…
তাই নাকি! লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো টকার। দুর্গ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। পুরনো হলে তো আরও বেশি। সেই আনন্দেই সে একটা রেসিং-কার হয়ে গেল, ছুটতে শুরু করলো তীব্র গতিতে, সেই সঙ্গে এঞ্জিনের বিকট শব্দ।
ঘুমিয়ে পড়েছিলো, চমকে জেগে উঠে টেবিলের নিচ থেকে বেরিয়ে ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিলো রাফিয়ান। বানরটাও তীক্ষ্ণ কিচির-মিচির শুরু করলো।
আরে থামো, থামো! তাড়াতাড়ি উঠে টকারকে থামাতে ছুটে গেলেন, মিসেস পারকার। তোমার এঞ্জিন বন্ধ করো। নইলে এখুনি আবার বেরিয়ে আসবে ওরা!
০৫.
দুই কিলোমিটার, সাইকেলে করে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। লিয়ারির কটেজটা খুব সুন্দর। শাদা রঙ বাড়িটার, জানালার পাল্লা সবুজ। গাছপালা, ফুলের বাগান, আর ঝোপঝাড়ে ঘেরা। বাগানটা ছাড়া বাকি সব গাছপালাকে বুনো মনে হয়, নিয়মিত সাফ না করায় জঙ্গল হয়ে গেছে। না, জায়গাটা ভালো, ছেলেমেয়েদের পছন্দ হলো।
তাছাড়া খুব নীরব, বললো রবিন। ভালো লাগে। পড়ালেখার জন্যে এরচে। ভালো জায়গা আর হয় না।
শুব্দ শুনে দরজায় এসে দাঁড়ালো মোটাসোটা, মাঝবয়েসী এক মহিলা, মুখে হাসি।এই যে, এসে পড়েছো তোমরা। এসো এসো, চা তৈরিই করে রেখেছি। ভাবলাম, সাইকেলে করে আসছো, নিশ্চয় খিদে লাগবে।– বাহ্, এই তো চাই! ভাবলো মুসা। না চাইতেই যদি এভাবে খাবার পাওয়া যায়…হেসে বললো সে, আসছি, এক মিনিট। সাইকেলগুলো রেখে আসি। এ হাতমুখ ধুয়ে, চা খেয়ে মালপত্র খুলে গোছাতে চললো ওরা। মাল বেশি নেই। সাইকেলের ক্যারিয়ারে করে যা যা আনতে পেরেছে। খুলে গোছাতে সময় লাগলো না। কাজ শেষ করে বাগানে বেরোলো ওরা। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।
ভালোই লাগবে এখানে, জিনা বললো। জংলা জায়গা। তাছাড়া আমাদের বাড়িও কাছে। ইচ্ছে করলেই গিয়ে নৌকা বের করে নিয়ে দ্বীপে চলে যেতে পিরবো।
ঠিক বলেছো, মুসা একমত হলো। আবহাওয়া ভালো থাকলে সাগরে গিয়ে সাঁতারও কাটা যাবে।
আর মিসেস লিয়ারিকেও আমার পছন্দ হয়েছে। নরম মেজাজ। আমার বাবার মতো বদমেজাজী নয়। এখানে শান্তিতেই থাকতে পারবো আমরা।
খোলা জায়গা পেয়ে টকারেরও সুবিধে হলো। ইচ্ছেমতো গাড়ি চালাতে শুরু করলো সে। যাত্রী হলো নটি। মজা পেয়ে পেছন পেছন ছুটে বেড়াতে লাগলো। রাফিয়ান।
সেদিন বিকেলে ঘরে বসে আলোচনা করে ঠিক করলো ওরা, পরের কয়েকটা দিন কি কি করবে।
পরের দিন থেকে সাঁতার কাটলো ওরা, আশপাশের নির্জন এলাকায় পিকনিক করলো, বাগানে খেললো, যার যা খুশি ইচ্ছে মতো করলো। সবাই খুশি, একমাত্র কিশোর ছাড়া। তার মনের মতো কাজ পায়নি। আশা করেছিলো, যে-রকম জায়গা, একটা না একটা রহস্য পেয়ে যাবেই। চুটিয়ে মাথা খাটাতে পারবে। নিরাশ হতে হয়েছে তাকে। এখন পর্যন্ত কিছুই পায়নি। দিন দুই পরে আরও খারাপ হলো অবস্থা। নামলো মন-খারাপ-করে-দেয়া বৃষ্টি। ঝমঝম ঝমঝম ঝরছে তো ঝরছেই। থামার আর নাম নেই। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা ঝড়ো বাতাস যেন হাড় কাঁপিয়ে দেয়।
ঘরের মধ্যে আর কি খেলা যায়? ইনডোর গেম যা যা আছে, দাবা, কেরম, কোনোটাই ভালো লাগে না ওদের। টকারেরও না। সে গাড়ি হতে পারলে খুশি। কিন্তু জায়গা কম। ছোট বারান্দায় যতোটা ছোটাছুটি করতে পারলো করলো, তারপর বিরক্ত হয়ে সে-ও এসে বসে পড়লো ঘরে।
ঘরের কোণে আগুনের কাছে পড়ে পড়ে ঘুমায় রাফিয়ান, বানরটা মাঝে মাঝে গিয়ে তার লেজ থেকে উকুণ বেছে দেয়। কখনও সিলিং ফ্যান ধরে দোল খায়, কখনও বা চুপটি করে জানালার ধারে বসে থাকে, গালে হাত দিয়ে গম্ভীর হয়ে।
কিশোরও বেশির ভাগ সময়ই জানালার ধারে বসে থাকে। বাইরের বৃষ্টি দেখে। মাঝেসাঝে ভারি গলায় কবিতা আবৃত্তি করে।
সেদিনও করছিলোঃ গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা, কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা…
পাশে বসে আছে রবিন আর মুসৗ। ওরা এখন বাংলা অনেকটা বোঝে, বলতেও পারে কিছু কিছু।
কিসের নাহি ভরসা কিশোর মিয়া? ভুরু নাচিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলো মুসা।
আর কিসের? জবাবটা দিলো রবিন। রহস্যের।…আরে, এতো মন খারাপ করছো কেন? পাবে, পাবে, নিশ্চয় পেয়ে যাবে এই দুনিয়ায় রহস্যের অভাব নেই।