প্রায় একই সময়ে খুলে গেল স্টাডির দরজা। বেরিয়ে এলেন দুই বিজ্ঞানী। টকারকে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন কারসওয়েল। পকেট থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে মেঝেতে পড়লো দুটো পেন্সিল।
চেঁচাতে লাগলো টকার। গলা ফাটিয়ে। আর তার গলার যা জোর!
চেঁচামেচি শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো জিনা। চিলেকোঠা থেকে তিন। গোয়েন্দা। আইলিনও বেরোলো, আরেকটু হলেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়ানো মিসেস পারকারকে।
ব্যাপার দেখে আর হাসি চাপতে পারলো না জিনা। তার রাগ যেমন বেশি, হাসিও বেশি। হাসতে শুরু করলে থামতে চায় না। হো হো করে হাসছে।
কিন্তু জিনার মতো মজা পেলেন না দুই প্রফেসর। বরং বিরক্তিতে কুঁচকে গেল ভুরু।
এই মেয়ে! রাগে জ্বলছে মিস্টার পারকারের চোখ। কি হয়েছে? এতো হাসির কি হয়েছে, শুনি? ছেলেটাকে আরও আসকারা দিচ্ছো? পেয়েছে কি? জানো না, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছি আমরা? দুনিয়ার মানুষের কতো উপকার হবে, আমরা সফল হলে! ক্যারোলিন, বের করো ওদের। আর সহ্য করবো না। যেখানে খুশি যাক। শুনেছো? যেখানে খুশি!
গটগট করে হেঁটে গিয়ে স্টাডিতে ঢুকলেন তিনি।
টকারকে ছেড়ে কারসওয়েলও তাঁর পিছু নিলেন।
দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
.
০৪.
ঘটনার আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গেছেন মিসেস পারকার। কি করবেন এখন? ওই বিজ্ঞানীগুলো যে কি! সারা দুনিয়ার মানুষের শান্তির জন্যে, সুখের জন্যে, ওদের চোখে ঘুম নেই, দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, অথচ নিজের ঘরের লোকের সুখের কথা একবারও যদি ভাবে!
জিনার গোমড়া মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন তিনি। হাত ধরে টানলেন, আয়, লিভিংরুমে। একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। এভাবে চলতে পারে না। তোর বাবা সত্যি একটা জরুরী কাজে ব্যস্ত, এ-সময় তাকে ডিসটার্ব করা ঠিক হচ্ছে না।
ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে লিভিংরুমে ঢুকলেন তিনি। আইলিন সঙ্গে এলো। রাফিয়ানও এলো পিছু পিছু। নটিকে দেখা যাচ্ছে না। ভয় পেয়ে গিয়ে কোথাও লুকিয়েছে।
সোফায় বুসলো সবাই। রাফিয়ান গিয়ে ঢুকলো একটা টেবিলের তলায়, সামনের দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর থুতনি রাখলো।
আলোচনা শুরু হলো।
মা, জিনা বললো। এটা আমাদের বাড়ি। কেন এখান থেকে যাবো…
হয়েছে হয়েছে, হাত তুললেন মা। তুইও যেমন, তোর বাপও তেমন। কথায় কথায় রেগে যাস, আবার ঠাণ্ডা হতেও সময় লাগে না। আমার হয়েছে যতো জ্বালা..যাকগে, এখন একটা উপায় বের করা দরকার।
আসলে, এখান থেকে আমাদের এখন চলে যাওয়া উচিত, বললো। কিশোর।
এক কাজ করলেই পারি, মুসা বললো। গোবেল দ্বীপে…
হা, গোবেল দ্বীপ, রবিনও সায় জানালো।
কিন্তু মিসেস পারকার মাথা নাড়লেন। না, এখন আবহাওয়া ভালো না। বৃষ্টির যা মতিগতি, চলতেই থাকবে। ঝড়ও আসতে পারে। এই সময় দ্বীপে গিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে শেষে অসুখ বাধাবে।
তাহলে তোমার কি পরামর্শ? জিনার রাগ যাচ্ছে না।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। ওই বানরটা কি শুরু করেছে? থামাও না ওকে।
কি দরকার? টকার বললো। আগুন খোঁচাচ্ছে, খোঁচাক। ঠাণ্ডা লাগছে হয়তো ওর।
আবার একটা ঝামেলা বাধাবে, দ্রুত গিয়ে বানরটার হাত থেকে আগুন খোঁচানোর লোহার দণ্ডটা কেড়ে নিলো আইলিন। এই নটি, ঘরে আগুন লাগাতে। চাস? যা, সর।
এই জন্যেই নাম হয়েছে বান্দর, বিমল হাসিতে ঝকঝকে শাদা দাঁত বেরিয়ে গেল মুসার।
বেশ, আবার শুরু করলো জিনা। দ্বীপে যেতে মানা করছে। এখানেও থাকতে দেবে না। যাবো কোথায়? আমি কোনো হোটেলে-টোটেলে যেতে পারবো না বাপু, আগেই বলে দিলাম।
নীরবতা। সমস্যাটা কঠিন।
আমি জানি, কোথায় যাবো! চেঁচিয়ে উঠলো টকার।
বেহেশতটা কোথায় শুনি? ভুরু নাচালো জিনা।
লাইট-হাউস, সবাইকে অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে মাথা ঝোঁকালো টকার। হ্যাঁ, আমার লাইট-হাউস। এমন করে তাকাচ্ছো কেন? লাইট হাউস চেনো না নাকি?
দেখো, টকার, শান্তকণ্ঠে রবিন বললো, এটা মজা করার সময় নয়।
মজা করছি না। বিশ্বাস না হলে বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখো।
কিন্তু টকার, মিসেস পারকার হাসলেন। তোমার বয়েসী কেউ লাইট হাউসের মালিক হতে পারে না, তাই না?
আমি হয়েছি, রেগে উঠলো টকার। শান্তিতে কাজ করার জন্যে বাবা ওটা কিনেছিলো। কিছুদিন কাজও করেছিলো। আমি গিয়েছিলাম সঙ্গে। আহ, কি সুন্দর জায়গা! বাতাস আর বাতাস, আর সারাক্ষণ ঢেউ!
সেটা তো তোমার বাবার, কিশোর বললো। তোমার না।
কেন নয়? আমি চাইলে কেন দেবে না? তার আর দরকার নেই ওটা। কারও কাছে বিক্রিও করতে পারেনি। আমিও ওটা নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে গেলাম। ব্যস, দিয়ে দিলো।
খাইছে! জিনার আছে দ্বীপ, টকারের লাইট-হাউস। ভাবছি, আমার একটা আগ্নেয়গিরি কিংবা মরুভূমি থাকলে ভালো হতো।
মুসার কথায় হেসে উঠলো সবাই।
জিনার রাগ শেষ। চোখ চকচক করছে। তোমার লাইট-হাউসটা কোথায়?
আমাদের বাড়ি থেকে দশ মাইল দূরে, পশ্চিমে। বিশাল, জানো? পুরনো ল্যাম্পটা এখনও আছে, তবে এখন আর জ্বালানো হয় না।
কেন হয় না? প্রশ্ন করলো মুসা।
ওই লাইট-হাউস বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ভালো জায়গায় নুতন. আরেকটা বানানো হয়েছে, আধুনিক, ওটাই এখন জাহাজকে সাবধান করে দেয়। পুরনোটা বেচে দেয়া হয়েছে সে-জন্যেই। বাবার জন্যে জায়গাটা চমৎকার। কেউ ডিসটার্ব করতে পারে না। তবু রেগে গেছে বাবা, সী-গালদের ওপর। পাখিগুলো নাকি বেশি শব্দ করে। আমার কিন্তু খুব ভালো লাগে। বাবা বলে, সী-গালেরা। বেড়ালের মতো মিউমিউ করে, তার কাজের ক্ষতি করে…