তার পরদিন থেকে শুরু হলো বৃষ্টি। বাইরে বেরোতে পারে না টকার। ঘরের ভতরেই গাড়ি চালাতে শুরু করলো। প্রায় পাগল করে তুললো ঘরের সবাইকে।
দেখো, বিশ বারের মাথায় আর সইতে না পেরে ধমক দিলো আইলিন। তুমি মরিস মাইনর, স্টিন, কনসাল, নাকি রোলস, কিছু শুনতে চাই না আমি। আর রান্নাঘরে ঢুকবে না, ব্যস। রোলস রয়েসের মতো গাড়ির লজ্জা করে না, রুটি চুরি করে?
রোলসের কি দোষ? প্রতিবাদ করলো টকার। পেট্রল পায় না, কিছু খেয়ে। তো বাঁচতে হবে তাকে? চলতে তো হবে? আর খালি আমাকে বকেন কেন? নটি আপেল চুরি করছে, তাকে যে কিছু বলেন না?
আবার ঢুকেছে নাকি? আঁতকে উঠে দৌড় দিলো আইলিন। বলি, দরজাটা কে খুলেছে? কে?
রাফিয়ান, নির্দ্বিধায় বলে দিলো টকার।
এই, এই শয়তান, বেরো বেরো! ভাঁড়ারে ঢুকে চেঁচাতে লাগলো আইলিন। বানরটাকে বের করে দিয়ে বেরিয়ে এলো। রাফি খোলেনি। ও খুব ভালো, তোমার বানরটার মতো চোর না।
নটিও খুব ভালো।
ভালো, না? রাফি ওকে ধরতে পারলে দেখাবে মজা। আজ যা একখান কাজ করে এসেছে নানটি। রাফি খুব রেগে আছে।
কি করেছে, নটি?
কি করেছে? রাফির বাসন থেকে হাড় চুরি করে ফেলে দিয়েছে। ঘাউ করে তেড়ে এসেছিলো রাফি। ধরতে পারেনি, তাই বেঁচে গেছে বানরটা। আরেকটু হলেই আজ লেজ হারাতে হতো। কামড়ে ছিঁড়ে নিতে রাফি।
শঙ্কিত হলো টকার। কণ্ঠস্বর নরম করে বললো, আপনারা কেউ ওকে দেখতে পারেন না। অথচ নটি কতো ভালো। দেখেন না, কেমন বেজার হয়ে বসে আছে?
এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ছোট্ট বানরটা। এক হাত মাথায় রেখে আরেক হাতে মুখ ঢেকেছে। বাদামী একটা চোখ চেয়ে রয়েছে আঙুলের ফাঁক দিয়ে, বিষণ্ণ, যেন নীরবে কাঁদছে।
আরে, আবার ন্যাকামিও জানে! হেসে ফেললো আইলিন। এই নে, একটা। বিস্কুট নে। খবরদার, আর কখনও চুরি করবি না।
চোখের পলকে বিষণ্ণতা দূর হয়ে গেল বানরটার। লাফ দিয়ে এসে ছোঁ মেরে প্রায় কেড়ে নিলো বিস্কুটটা। ছুটে গেল দরজার দিকে।
দরজা বন্ধ। এগিয়ে গিয়ে খুলে দিলো টকার। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকলো রাফিয়ান। নাক উঁচু। চুলায় চড়ানো গরম স্যুপের মিষ্টি গন্ধ শুকছে।
তড়াক করে এক লাফে গিয়ে একটা চেয়ারের ওপর উঠলো নটি। ভয়ে গুঙিয়ে উঠলো। যেন বিশাল কুকুরটার কাছে মাপ চাইছে।
এক কান খাড়া করলো রাফিয়ান, নাড়লো। বানরটার ভাষা যেন বুঝতে পারছে। ফিরে তাকালো।
এক অদ্ভুত কাণ্ড করলো বানরটা। আইলিনকে সাংঘাতিক অবাক করে দিয়ে বিস্কুটটা বাড়িয়ে ধরলো রাফিয়ানের দিকে। নিচু স্বরে কিচমিচ করছে।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো কুকুরটা। তারপর এগিয়ে গিয়ে মুখে নিলো বিস্কুটটা। দুই চিবান দিয়েই কোৎ করে গিলে ফেললো।
আশ্চর্য! আনমনে বিড়বিড় করলো আইলিন। কি বুদ্ধি! সকাল বেলা হাড় চুরি করেছে। অপরাধ করে ফেলেছে। বিস্কুট দিয়ে এখন মাপ চেয়ে নিচ্ছে।
লম্বা জিভ বের করে ঠোঁট চাটলো রাফিয়ান। তারপর হঠাৎ আগ বাড়িয়ে নটির খুদে, নাকটা চেটে দিলো। হয়ে গেল ভাব।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না আইলিন। জিনাকে খবরটা জানানোর জন্যে দোতলায় ছুটলো।
শুনে জিনা বিশ্বাসই করতে চাইলো না। আইলিনের চাপাচাপিতে শেষে নিচে নেমে এলো।
নটি তখন রাফিয়ানের পিঠে উঠে ঘোড়া চড়ছে। আর আনন্দে হাততালি দিয়ে চেঁচাচ্ছে টকার। আরো, আরো জোরে হাঁট, রাফি। রেসের ঘোড়ার মতো ছুটতে পারিস না…
না-আ! চিৎকার করে উঠলো জিনা। এই রাফি, থাম! বানরটাকে নামা পিঠ থেকে। গাধা হয়ে গেছিস নাকি?
পিঠ থেকে নেমে রাফিয়ানের পায়ের ফাঁকে গিয়ে ঢুকলো বানরটা। ভয়ে ভয়ে তাকালো জিনার দিকে।
রাফিয়ান বুঝতে পারলো, তার মনিব রেগে গেছে। জিনার দিকে চেয়ে বিচিত্র মুখভঙ্গি করলো, যেন হাসলো। তারপর আলতো করে চেটে দিলো বানরটার মাথা। যেন বলতে চাইছে, ভয় নেইরে! আমার মনিবকে বাইরে থেকেই ভয় লাগে। ভেতরটা ওর বড় ভালো।
চোখে পানি এসে গেল আইলিনের। তার মনে হলো, রাফিয়ানের মতো ভালো কুকুর আর দুনিয়ায় নেই। বললো, দেখলে, জিনা, কতো বড় হৃদয় ওর! বানরটার সঙ্গে দোস্তি করেছে বলে ওকে আর কিছু বোলো না।
বলবো, কে বললো আপনাকে? সত্যি সত্যি অবাক মনে হলো জিনাকে। রাফির মতো ভালো কুকুর সারা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এগিয়ে গিয়ে হাত। বুলিয়ে দিতে লাগলো ওটার মাথায়।
জিনার হাত চেটে দিলো রাফিয়ান। নটির দিকে তাকালো। মনের ভাব, আর ভয় নেই। এবার সবাই আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।
এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, টকার। জিনার ভয়ে। কিন্তু কুকুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেখে ভয় কাটলো তার, হাসলো। এতো জোরে লরির
এঞ্জিনের মতো গর্জে উঠলো, চমকে গেল সবাই। ভেঁপু বাজালো জোরে। অর্থাৎঃ. সরো, সরো, আমি এখন ছুটতে শুরু করবো।
আরে থামো, থামো! তাড়াতাড়ি বাধা দিলো আইলিন।
চুপ, বোকা ছেলে, বললো জিনা।
হুফ! রাফিয়ান বললো।
এভাবে ভেঁপু বাজালে এখুনি এসে হাজির হবেন দুই প্রফেসর, আইলিন। বললো। এই ছেলে, শান্ত কিছু হতে পারো না? এই যেমন ধরো, সাইকেল?
কথাটা মনে ধরলো টকারের। সাইকেলের চাকার মৃদু হিসহিস আওয়াজ তুলে রান্নাঘর থেকে ছুটে হলে বেরোলো। তারপর বেল বাজালো টিংটিং করে। শব্দটা এতোই নিখুঁত আর বাস্তব মনে হলো, মিসেস পারকার ভাবলেন, কেউ বুঝি। এসেছে। কে এসেছে, দেখার জন্যে বেরিয়ে এলেন তিনি।