জিনার পরে পাহারা দিলো মুসা। তারপর কিশোর। সব শেষে রবিন। কিন্তু চোরেরা এলো না।
পরের দিনও সারাটা দিন সাগরের দিকে চোখ রাখলো ওরা।
সেদিন সন্ধ্যার পর প্রথম পাহারায় বসলো টকার। বয়েস কম, এধরনের কাজে অভিজ্ঞতা নেই, তাই প্রথমে রাজি হতে চায়নি কিশোর। কিন্তু মুখ কালো করে যখন টকার বললো-ছোট বলে আমাকে অবহেলা করছে–আর রাজি না। হয়ে পারলো না গোয়েন্দাপ্রধান। বললো, বেশ থাকো। তবে চোখ খোলা রাখবে। খবরদার, ঘুমোবে না।
ঘুমালো না টকার। তার সঙ্গে রয়েছে নটি আর রাফিয়ান। বিপদের গন্ধ পেলে সাবধান করে দেবে তাকে।
আটটা বাজলো, নটা। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো টকার, এই, জলদি এসো! একটা মোটর বোট!
ছুটে এলো সবাই। দেখল।
হু, ওরাই, বললো কিশোর। গুড!
এসো দোস্তরা, এসো, হাত নেড়ে ডাকলো মুসা। এসে দেখো, ধান-দুর্বা সাজিয়ে রেখেছি তোমাদের জন্যে।
.
১৬.
হ্যাঁ, ডেনার আর ডজই। সঙ্গে আরেকজন লোক, মোটা, বেঁটে, নিশ্চয় লিংকার। পাহাড়ের চূড়ায় উপুড় হয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেরা। চাঁদ উঠছে, ফিকে হয়ে আসছে অন্ধকার, ফলে দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না ওদের।
ভালো জায়গাতেই লুকিয়েছো দেখা যাচ্ছে, কর্কশ কণ্ঠে বললো লিংকার, ওর। গলাটা খসখসে। চট করে বের করে ফেলো। নিয়ে কেটে পড়ি।
আমি যাচ্ছি, ডজের হাতে টর্চ। চাচা, ছেলেমেয়েগুলোকে কি করবো? দুদিন অন্ধকারে থেকে, না খেয়ে, আমার মনে হয় কাবু হয়ে গেছে।
ওদেরকে? গুরত্বই দিলো না ডেনার। থাকুক। আমরা নিরাপদে বেরিয়ে যাই আগে। তারপর একটা ফোন করে দেবো মেয়েটার বাপের কাছে। আরও কিছুক্ষণ থাকুক, শিক্ষা হোক কিছুটা। অনেক উৎপাত করেছে।
উৎপাত তো কিছুই করিনি, উৎপাত দেখবে এখন, মনে মনে বললো মুসা। এই শুরু হলো। ছোট একটা পাথর তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো। নিখুঁত নিশানা। ডেনারের মাথায় গিয়ে পড়লো পাথরটা।
উফ! করে উঠে চাঁদিতে হাত রাখলো ডেনার। কি পড়লো?
ও কিছু না, ছোট পাথর, বললো তার ভাতিজা। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়েছে। খামোকা চিল্লাচ্ছো।
কয়েক পা এগিয়েই দড়াম করে আছাড় খেলো সে। পাথরে বাড়ি লেগে চুরমার হয়ে গেল টর্চের কাঁচ।
কি হলো? চেঁচিয়ে বললো তার চাচা।
কিসে যেন পা পড়লো। পিছলে গেল।
দেখে চলতে পারো না? কিসে পিছলালো?
কি জানি!
কিসে পিছলেছে বলে দিতে ইচ্ছে হলো মুসার। কুকর্মটা সে-ই করেছে। পাথুরে পথের ওপর রান্নার তেল ঢেলে পিছলা করে দিয়েছে। তাতে পা পড়লেই দড়াম।
উঠে এগোলো আবার ডজ। পেছনে এলো তার চাচা। ওই জায়গাটাতে আসতেই ভাতিজার চেয়ে জোরে আছাড় খেলো। তাকে তুলতে এসে ডেনারের গায়ের ওপরই পড়লো লিংকার।
জোরে জোরে হাসলো ডজ। অন্যকে বলার বেলায় তো খুব তোমরা দেখে। চলতে পারো না?
গালাগাল করতে করতে উঠে দাঁড়ালো দুজনে। খাড়াই বেয়ে উঠে আসতে লাগলো আবার।
তেলের ওপর পা পড়ে আরেক জায়গায় আবার আছাড় খেলো ডজ। তার চাচাও। কিছু দূর এগিয়ে আবার।
হাসতে হাসতে দুর্গের ঘরে ফিরে এলো ছেলেরা।
চত্বরে পৌঁছলো তিন চোর।
ওই যে, ওখানে, সদ্য খোঁড়া গর্তের ধারে কাঠিটা দেখিয়ে বললো ডেনার। ডজ, খোড়ো।
খালি হাতেই ওপরের আলগা মাটি খুঁড়ে সরিয়ে ফেললো ডজ। এই যে, বলতে বলতে টেনে তুললো একটা প্রাস্টিকের ব্যাগ। ভেতর থেকে বের করলো ভারি বাক্সটা.। লিংকারের দিকে বাড়িয়ে দিলো, এই যে, নিন।
বাক্সটা মাটিতে রেখে বসে পড়লো লিংকার। ডালা তুলে চেঁচিয়ে উঠলো। সোনার মোহর আর অলঙ্কার কোথায়? এ তো মস্ত এক সী-গালের কঙ্কাল, আর পাথর! রাগে গর্জে উঠলো, এই তোমাদের গুপ্তধন!
টর্চের আলোয় বাক্সের জিনিসগুলোর দিকে বোবা হয়ে চেয়ে আছে ডেনার। ডজও হাঁ হয়ে গেছে।
ঠিক এই সময় লাফ দিয়ে ডেনারের কাঁধে নামলো ছোট একটা জীব। দোল খেয়ে বাহুতে নেমে ছোঁ মেরে টর্চটা কেড়ে নিয়েই দিলো দৌড়।
কী ওটা? চিৎকার করে বললো ডেনার। বানর না? এখানে বানর এলো কোত্থেকে…আরে ডজ, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? ধর না!
বানরটার পেছনে দৌড় দিলো ডজ।
কিছুদূর এগিয়ে থেমে ফিরে তাকালো নটি। যেন ডজের কাছে আসার অপেক্ষা করছে। তারপর ঘুরে আবার ছুটলো। উজকে টেনে নিয়ে চললো ভাঙা দুর্গের ধ্বংসস্তূপের দিকে। ঢুকে পড়লো একটা দরজা দিয়ে।
সোজা তার পেছনে ছুটে এলো ডজ। দরজায় পেতে রাখা ফাঁদ দেখতে পেলো না। আড়াআড়ি ভাবে একটা শক্ত দড়ি বেঁধে রাখা হয়েছে। তাতে পা বেধে উড়ে গিয়ে ধুডুস করে পড়লো। কাদায় পড়া মাছের মতো কঠিন মেঝেতে পিছলে গেল দেহটা। বিশাল এক পাথরে বাড়ি লাগলো মাথা। প্রচণ্ড আঘাতে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালো সে।
নিঃশব্দে তাকে তুলে নিয়ে একটা অন্ধকার কোণে সরে গেল ছেলেরা। দ্রুত হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখলো একটা দেয়ালের আড়ালে।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ডেনার আর লিংকার। অবাক হয়ে ভাবছে, ডজ এখনও আসছে না কেন? হঠাৎ ডজের বিকৃত জোরালো চিৎকার কানে এলো, চাচা, চাচা, মেরে ফেললো। বাঁচাও, চাচা!
পাকা অভিনেতা কিশোরের কণ্ঠস্বর ধরতেই পারলো না ডেনার, ভাবলো, ডজই বুঝি চিৎকার করছে। লিংকারকে বললো, তুমি দাঁড়াও এখানে। আমি দেখি কি হয়েছে?
দৌড়ে এলো ডেনার। ভাতিজার মতোই দড়িতে পা বেধে খেলো আছাড়। ভারি শরীর ময়দার বস্তার মতো পড়লো। একটা পা বেকায়দা ভাবে মুচড়ে গিয়ে। পড়লো পেটের তলায়। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, গেছিরে, মরে গেছি! হায় হায় রে, আমার পা শেষ। এক্কেবারে ভেঙে গেছে!