ওদের কথাবার্তা শুনে হাসতে শুরু করলো মুসা। তার হাসি সংক্রামিত হলো সবার মাঝে। হো হো করে হাসলো সবাই। কাছেই বসে কৌতূহলী চোখে দেখছিলো একটা কাক। সম্মিলিত হাসির শব্দে চমকে উড়ে গেল কা-কা করে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল তুমুল কা কা। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসতে লাগলো কাকেরা।
এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, কিশোর বললো। বাক্সটা খুঁজে বের করতে হবে। চলো, দেখি।
বেশি খুঁজতে হলো না। চত্বরের একধারের মাটিতে দাগ দেখতে পেলো রবিন। সদ্য খোঁড়া হয়েছে। রাফি আর নটিকে লাগিয়ে দিতেই খুঁড়ে বের করে ফেললো বাক্সটা। আধ হাত মাটির তলায় লুকিয়েই নিশ্চিন্তে ফিরে গেছে ডেনার আর তার ভাইপো। গর্তের কিনারে একটা কাঠিও পুঁতে রেখে গেছে, চিহ্ন, যাতে পরে এসে চিনতে পারে।
চলো, নিচে ভাঁড়ারে লুকিয়ে ফেলি, বললো কিশোর।
ডানজনের পাশেই ছোট একটা ঘরকে ভাড়ার বানিয়ে নিয়েছে জিনা। কিছু টিনের খাবার, চিনি, লবণ আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব সময় জমা রাখে। ওখানে। যাতে দ্বীপে এলে দরকারের সময় কাজে লাগে। ওখানেই এনে গুপ্তধনগুলো লুকিয়ে রাখলো ওরা।
তুরুপের তাস এখন ছেলেদের হাতে। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে। গুপ্তধনগুলো আবার উদ্ধার করেছে। আর রয়েছেও ধরতে গেলে একেবারে নিজেদের বাড়িতে। ইচ্ছে করলেই যে কোনো সময় তীরে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু আপাতত যাওয়ার ইচ্ছে নেই।
কিশোর, ব্যাটাদের শায়েস্তা করা দরকার, জিনা বললো। কিভাবে করা যায়?
সেটা পরেও আলোচনা করতে পারবো, বলে উঠলো মুসা। পেটের মধ্যে ছুঁচো নাচছে। আগে ওটাকে দাঁড়িয়ে নিই।
ভাঁড়ারের আলমারি থেকে দুধ, চকোলেট, কোকা বের করা হলো। রুটি নেই, তবে বিস্কুট আছে অনেক। স্টোভ বের করলো রবিন। বললো, মুসা, টকার, দৌড়ে গিয়ে পানি নিয়ে এসো।
নাস্তা ভালোই হলো। বিস্কুট আর চকোলেটের সঙ্গে গরম গরম কোকা মেশানো দুধ। খেয়েদেয়ে শান্ত হয়ে এরপর আলোচনায় বসলো ওরা।
দ্বীপে থাকাটা কিছু না, বললো রবিন। দুই তিন দিন সহজেই কাটিয়ে দিতে পারবো। তবে, কেরি আন্টিকে একটা খবর দেয়া দরকার, যে আমরা ভালোই আছি।
সেটাও কোনো সমস্যা নয়, জিনা বললো। সিঁতরে চলে যেতে পারবো।
আরে কি বলো? বুকে চাপড় দিয়ে বললো গোয়েন্দাসহকারী। এই মুসা আমান থাকতে তুমি কষ্ট করবে কেন? আমিই যাবো।
আর খবর না দিলেই বা কি? মুচকি হাসলো কিশোর। ব্যাটাদের আগে শিক্ষা দিয়ে নিই। তারপর একবারেই সকলে মিলে যাবো দ্বীপে।
মানে? চকচক করছে টকারের চোখ। ভয়-ডর সব চলে গেছে। বরং মজা পাচ্ছে এখন।
মানে হলো, ডেনার, ডজ আর তাদের দোস্ত লিংকার এখানে এলে দেখবে, তাদের জন্যে ফাঁদ পাতা রয়েছে। এরকম কিছু ঘটতে পারে, আশাঁই করবে না। ওরা, তাই সোজা এসে আমাদের ফাঁদে পা দেবে। এখন আমাদের ভাবতে হবে, ফাঁদটা কী হবে।
হেসে উঠলো মুসা। উরুতে চাপড় দিয়ে বললো, দারুণ আইডিয়া। খুব ভালো হবে। ব্যাটাদের চেহারাটা তখন যা দেখতে লাগবে না!
হ্যাঁ, একেবারে চমকে যাবে, বললো রবিন। কল্পনাও করবে না, আমরা ছাড়া পেয়ে গেছি। খেয়েদেয়ে রীতিমতো আরামেই আছি…
আর রাফি আর নুটিও বেঁচে আছে, যোগ করলো টকার।
সেই সঙ্গে গুপ্তধন গায়েব, আনন্দে দাঁত বের করে হাসলো জিনা।
এখন একটা ছক করে ফেলা দরকার, কিশোর বললো। কড়া নজর রাখবো আমরা, পালা করে। ওরা যেন আগে আমাদেরকে দেখে না ফেলে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
কিভাবে কি করবে, ঠিক করা হলো। আরও কিছু কাজ করলো, তাতেই যেন। উড়ে চলে গেল সকালটা। লাঞ্চের আয়োজন করলো রবিন আর জিনা। টিনজাত সেদ্ধ সীম আর ভাজা মাংস আছে। ওগুলো বের করে গরম করলো। টিনের সংরক্ষিত কিছু ফলও বের করলো। এক প্যাকেট লেমোনেড ক্রিস্টাল আছে। ওগুলো থেকে কিছু নিয়ে ঝর্নার পানিতে মেশাতেই তৈরি হয়ে গেল লেমোনেড। পেটে হাত বোলাতে বোলাতে মুসা বললো, জিনা, কসম খোদার, এরপর ঝগড়া লেগে, যদি তুমি আমার মাথার চুল সব ছিঁড়ে ফেলো, কোনোদিন কিছু বলবো না।
তোমার চুল থাকলে তো ছিড়বো? সব তো কোঁকড়া তার, খুলি কামড়ে রয়েছে।
তাহলে অন্য কিছু করো। এই যেমন, চিমটি কাটা, কিল মারা। চাইলে হাত কামড়েও দিতে পারো
আমি কি রাফি নাকি, যে কামড়াবো?
রাফি না হও, ওর ঘনিষ্ঠ দোস্ত তো… দোস্ত তো তুমিও…
বাকযুদ্ধে কিছুতেই জিনাকে ঘায়েল করতে পারলো না মুসা। হাসলো সবাই। টকার বেশি হাসছে। এ-রকম রোমাঞ্চের স্বাদ জীবনে এই প্রথম পাচ্ছে। এ-রকম। অ্যাডভেঞ্চারও কপালে জোটেনি কখনও। খুব ভালো লাগছে তার। গাড়ি হওয়ার কথা ভুলেই গেছে। ওটা এখন তার কাছে মনে হচ্ছে ফালতু।
খাওয়ার পর একটা, উঁচু জায়গা বেছে নিয়ে পাহারায় বসলো ওরা। ওখান থেকে সাগরের অনেকখানি দেখা যায়। কেউ এলে ওদের চোখ এড়িয়ে আসতে। পারবে না।
সাঁঝ হলো। নামলো অন্ধকার রাত। বেশ কিছু কম্বলও রাখা আছে, পলিথিন দিয়ে মুড়ে রেখেছে জিনা। খুলে নিয়ে আসা হলো ওগুলো। আকাশে মেঘ নেই, কিন্তু বাতাস কনকনে ঠাণ্ডা। দুর্গের যে একটিমাত্র ঘর আছে, যেটার ওপরে ছাত, তাতে ঢুকে শুয়ে পড়লো. সবাই, একজন বাদে। সে পাহারায় রইলো উঁচু জায়গাটায়। কয়েক ঘন্টা পাহারা দিয়ে এসে আরেকজনকে তুলে দেবে ঘুম থেকে।
প্রথম পাহারায় রয়েছে জিনা। পাশে রাফিয়ান। যেখানে বসেছে, তার খানিক দূর দিয়ে সরু পথ নেমে গেছে দ্বীপের ছোট সৈকতে।