একটা দাঁড় তুলে নিয়ে রাফিয়ানকে শাসালো ডেনার। তা-ও আসছে দেখে শেষে বন্দুক তুলে নিলো।
চেঁচিয়ে বললো জিনা, এই রাফি, যা যা, চলে যা!
চাঁদের আলোয় চোখ দেখা যাচ্ছে কুকুরটার। বিষণ্ণ দৃষ্টি। থেমে গেল।
পানি এলো জিনার চোখে। অথচ সহজে কাঁদতে দেখা যায় না তাকে।
হাত বাঁধা না থাকলে এই মুহূর্তে বন্দুক কেন, কামান দেখিয়েও ঠেকানো যেতো না মুসাকে। ঝাঁপিয়ে পড়ে টুটি টিপে ধরতো ডজের। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেললো সে, প্রতিশোধ নেবো আমি, উজ! তোকেও যদি না চুবাই, তো আমার নাম মুসা আমান নয়!
টকার কাঁদছে।
রবিন চুপ।
কিশোরও চুপ, পাথরের মতো নিথর। বোঝাই যায়, ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে তার ক্ষুরধার মস্তিষ্কে।
কিছুক্ষণ পর দ্বীপের কিনারে এসে ভিড়লো বোট। জিনার রহস্যময় হাসির কারণ বোঝা গেল। দ্বীপটা গোবেল দ্বীপ, বন্দিদের অতি পরিচিত, টকার ছাড়া। জিনা হেসেছিলো, সে বুঝতে পেরেছিলো এই দ্বীপেই নিয়ে আসা হবে তাদ্দেরকে। আশপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে আর কোনো দ্বীপ নেই, যেটা মূল ভূখণ্ড থেকে দেখা যায়।
বন্দিদের নামার আদেশ দিলো ডেনার। নিয়ে আসা হলো ভাঙা দুর্গের চত্বরে। সেখানে বন্দুক ধরে বসে রইলো ডেনার। ডজ গেল মাটির নিচে ঘর-টর আছে কিনা দেখতে।
প্রায় আধ ঘন্টা পর ফিরে এলো ডজ। ঘর পেয়েছে।
দুর্গের নিচে ডানজনে নিয়ে আসা হলো বন্দিদের। যে ঘরটায় আনলো, সেখানে এর আগেই একাধিকবার এসেছে জিনা আর তিন গোয়েন্দা।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টর্চের আলো ফেলে ঘরটা দেখলো ডেনার। সন্তুষ্ট হয়ে বললো, চমৎকার জায়গা। থাকো এখানেই দুদিন। অন্ধকারে শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিতে পারবে। গলা ফাটিয়ে চিল্লালেও কেউ শুনবে না, কেউ দেখতে আসবে না। তাতে শিক্ষা হবে। অন্যের ব্যাপারে নাক গলাবে না জীবনে…
নাক তো তোরা গলাচ্ছিস, শয়তানের বাচ্চা! আবার গলি দিয়ে উঠলো, জিনা।
দুদিন খেতে না পেলেই এই তেজ চলে যাবে, শান্তকণ্ঠে বললো ডেনার। ডজ, চলো। আবার আসতে হবে এখানে।
নতুন কোনো আইডিয়া
হ্যাঁ। এই ছেলেগুলো যখন খুঁজে পেয়েছে, ভালোমতো খুঁজলে শেরিফও পেয়ে যেতে পারে। লিয়ারিকে ফোন করে এসেছি বটে, কিন্তু বলা যায় না কি ঘটবে। পারকার ফোন করতে পারে লিয়ারির কাছে, ছেলেমেয়েরা কেমন আছে জানার জন্যে। গোলমাল শুরু হবে তখন। বাক্সটা কুয়ায় রাখা আর ঠিক না। তার। চেয়ে এই দ্বীপ অনেক বেশি নিরাপদ, এখানেই এনে রাখবো। তারপর লিংকার এলে তুলে নিয়ে চলে যাবো।
.
১৫.
বেরিয়ে গেল দুই শয়তান।
গাধা, ব্যাটারা! হেসে উঠলো মুসা। রাফিয়ানের চিল্লানী থামিয়েছে, অথচ আমাদেরকে বললো গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে। আরে হারামজাদারা, পাঁচজনের চিৎকার তো একটা কুকুরের চেয়ে অনেক বেশি হবে। যাকগে, ভালোই হয়েছে। আর এতোই আত্মবিশ্বাস, সব আলোচনা করেছে আমাদের সামনে। বাক্সটা যে এনে রাখবে, সে-কথাও।
ওরা জানে, আমরা এখান থেকে বেরোতে পারবো না, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো টকার। যখন বেরোবো তখন ওরা পগার পার। ইস্, এতো শক্ত করে বেঁধেছে, হাত ঝিমঝিম করছে, আমার।
জিনার রাগ কমেনি। বসে বসে ফুঁসছে। কে বললো বেরোতে পারবো না? রাফিয়ানকে ফেলে দিয়ে মনে করেছে বেঁচে গেল। ব্যাটারা জানেই না, আরামসে সাঁতরে গিয়ে তীরে উঠবে রাফি। আর এই দ্বীপটা যে আমার, তা-ও জানে না।,
কিশোর কোনো কথা বললো না। চুপচাপ উঠে চলে গেল দেয়ালের কাছে। বেরিয়ে থাকা একটা চোখা পাথরে ঘষতে শুরু করলো হাতের দড়ি। চামড়া ছিললো, রক্ত বেরোলো, তবু থামলো না। বাঁধন-মুক্ত হতেই হবে।
দেখাদেখি অন্যেরা উঠে এসে একই ভাবে পাথরে দড়ি ঘষতে লাগলো।
কতোক্ষণ লাগলো বলতে পারবে না, তবে, অবশেষে সফল হলো ওরা। প্রায়। একই সঙ্গে কিশোর আর মুসার দড়ি ছিঁড়ে গেল। তারপর অন্যদের বাঁধন খুলে দেয়াটা কিছুই না।
ডানজন থেকে বোরোনোর পথ ভালোমতোই জানা আছে ওদের। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো। বড় একটা পাথর চাপা দিয়ে সিঁড়ির মুখ বন্ধ, ওভাবেই বন্ধ করার ব্যবস্থা, জানে ওরা। কয়েকবার ওই পাথর সরিয়ে ঢুকেছে, বেরিয়েছে। নিচে থেকে সবাই মিলে ঠেলে সরাতে অসুবিধে হলো না।
বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। খোলা আকাশের নিচে।
পূর্ব দিগন্তে আলো ফুটেছে। জেগে উঠেছে দাঁড়কাকের দল। তাদের কর্কশ চিৎকারে কান ঝালাপালা। এতোক্ষণে হাসি ফুটলো জিনার মুখে। ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সে। হাততালি দিয়ে বললো, আরে, দেখো দেখো, রাফি! ঠিক বুঝে গেছে কোথায় আছি আমরা।
বেশ দূরে রয়েছে এখনও রাফিয়ান। ঢেউয়ের ওঠানামার ফাঁকে ফাঁকে শুধু তার মাথাটা দেখা যাচ্ছে। একা নয়। পিঠে বসে আছে নটি। দেখে, আনন্দে ধেইধেই করে নাচতে আরম্ভ করলো টকার।
সূর্য উঠলো। ভোরের কাঁচা রোদে ঝিলমিল করে উঠলো সাগর, পানি তো নয়, যেন তরল সোনা।
তীরে পৌঁছলো রাফিয়ান।
হুল্লোড় করে ছুটে গেল ছেলেমেয়েরা।
ঝাড়া দিয়ে গা থেকে পানি ঝাড়ছে রাফিয়ান আর নটি। কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরলো জিনা। টকার কোলে তুলে নিলো বানরটাকে।
রাফি, আদর করতে করতে বললো জিনা। কিছু ভাবিস না। তোকে কষ্ট দিয়েছে তো, ভেবেছে পার পেয়ে যাবে। ব্যাটারা আসবে আবার। যতো খুশি। কামড়াস তখন, কিছু বলবো না।
টকার বললো নটিকে, হ্যাঁ, চুল ছিঁড়ে দিস। কামড়ে কান কেটে ফেলিস। আমিও মানা করবো না।