এগিয়ে এসে হাত মেলালেন মিস্টার পারকার। আমার কাছেও আছে। চিঠি। পেয়েই চলে এসেছো, খুব খুশি হয়েছি।
এই যে আমার ছেলে… এতো জোরে ছেলের পিঠে থাবা মারলেন প্রফেসর, আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো ছেলেটা। নামটা যেন কি? খালি ভুলে যাই। থাক, বিরক্ত হয়ে হাত নাড়লেন কারসওয়েল। ডাক নামটাই বলি। টকার। মোটরকারের মা আর ট-এর পরে র-টা বাদ দিয়ে দিয়েছি। নিজেকে সারাক্ষণ মোটর গাড়ি ভাবে সে, আর বেশি কথা বলে, সে-জন্যেই এই নাম রেখেছি। হাহ হাহ হা!…আরে, নটি গেল কোথায়? দুষ্ট, দুষ্ট, ভীষণ দুষ্ট, তাই। টকারই ওর নাম রেখেছে টি। আরে গেল কোথায় বানরটা?
বোবা হয়ে গেছেন যেন মিসেস পারকার। একনাগাড়ে কথা বলে চলেছেন। প্রফেসর কারসওয়েল। কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছেন না। বানরটাকে দেখা গেল একটা স্ট্যাণ্ডের উপর হ্যাট রাখার স্ট্যাণ্ড–আগায় চড়ে বসে প্রাণপণে দোলাচ্ছে; যেন প্রতিজ্ঞা করেছে সবগুলো হ্যাট মাটিতে না ফেলে ছাড়বে না।
এ-তো সার্কাস বানিয়ে ফেলবে!..হতাশ হয়ে ভাবলেন মিসেস পারকার– আমি এখন কি যে করি! ঘরগুলোও পরিষ্কার হয়নি ঠিকমতো। দুপুরের খাবারেরই বা কি হবে? ইতিমধ্যে ছেলেমেয়েগুলোও যদি এসে যায়…আর বানরটা যা শুরু করেছে! হ্যাটগুলো ফেলে এখন গিয়ে বসেছে হলের বড় আয়নাটার সামনে। নিজেকেই মুখ ভেঙচাচ্ছে।
সবার সঙ্গে কিভাবে যে লিভিংরুমে ঢুকলেন মিসেস পারকার, বলতে পারবেন, না মিস্টার পারকার ছুটে গিয়ে স্টাডি থেকে একগাদা কাগজ এনে টেবিলে বিছিয়ে বসে পড়লেন ওখানেই। আলোচনার জন্যে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করতে চান না।
এখানে নয়! এতোক্ষণে মুখ খুললেন মিসেস পারকার, কঠিন কণ্ঠে বললেন, তোমার স্টাডিতে যাও।…আইলিন, প্রফেসর সাহেবের মালপত্রগুলো গেস্টরুমে। দিয়ে এসো। ছেলেটা এঘরেই থাকবে, সোফায় শোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাও, জলদি রেখে এসো।
বানরটার কি হবে? আড়চোখে ওটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো আইলিন। ওটারও কি বিছানা…
ও আমার সঙ্গেই থাকবে, বয়েস আর শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক জোরালো কণ্ঠ ছেলেটার। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে সিঁড়ির দিকে দিলো দৌড়। বিচিত্র শব্দ করছে।
অবাক হয়ে বললেন মিসেস পারকার, কি হলো? পেট ব্যথা?
না না, বললেন তার বাবা। ওসব কিছু না। বললাম না, মোটরগাড়ির পাগল। নিজেকে মোটরগাড়ি ভাবে। দৌড়ায় আর এঞ্জিনের শব্দ করে।
আমি একটা গাড়ি, জাগুয়ার কার। সিঁড়ির মাথা থেকে চেঁচিয়ে জবাব দিলো। টকার। এঞ্জিনের শব্দ শুনছেন না? হি-র-র-র-র-র!…এই নটি, জলদি আয়। গাড়িতে চড়বি না?
প্রায় চোখের পলকে সিঁড়ি পেরিয়ে লাফ দিয়ে গিয়ে মনিবের কাঁধে চড়ে চুল খামচে ধরলো নটি। তীক্ষ্ণ কিচমিচ করে উঠলো। ছুটলো জাগুয়ার। প্রচণ্ড গতিতে বেডরুমের ভেতর থেকে ঘুরে এলো একবার, মাঝে মাঝে বিকট শব্দে হর্ন দিচ্ছে।
সব সময় ওরকম করে? প্রফেসরের দিকে চেয়ে বললেন মিসেস পারকার। কাজ করেন কিভাবে?
না, অসুবিধে হয় না, জানালেন প্রফেসর। বাগানে একটা সাউণ্ডপ্রফ ঘর বানিয়ে নিয়েছি। হ্যারি, তোমার স্টাডিও সাউণ্ড প্রুফ, না?
না, ভাই, জাগুয়ারের শব্দ সইতে না পেরে কানে আঙুল দিলেন মিস্টার পারকার। ছেলে একখান কারসওয়েলের! দুই মিনিটে পাগল করে দেবে সুস্থ মানুষকে! এক হপ্তা কাটবে কি করে? তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, স্টাডিতে চলো।
স্টাডিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন দুই বিজ্ঞানী। কিন্তু বৃথা। এ-বাড়ির এমন কোনো দরজা নেই, যা ওই হর্নের শব্দ ঠেকাতে পারে।
ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে কুলাতে পারছে না আইলিন। সারা বছরের জন্যে যেন চলে এসেছেন প্রফেসর, এতো মালপত্র এনেছেন। কোনো হোটেলে গিয়ে উঠলো না কেন?–সেগুলোর দিকে চেয়ে থেকে ভাবছেন মিসেস পারকার। জিনারাও এলো বলে। আর সঙ্গে রাফিয়ানকে না নিয়ে আসবে না জিনা। এতগুলো প্রাণী থাকার জায়গা কোথায় করবেন তিনি?
.
০২.
বাস থেকে নেমেই চারটে সাইকেল ভাড়া করলো জিনা। এক হপ্তা থাকবে। বাড়িতে। ততোদিন ঘোরাঘুরির জন্যে সাইকেল দরকার। ক্যারিয়ারে মালপত্র তুলে নিয়ে সাইকেলে চেপে গোবেল ভিলার উদ্দেশে চললো চারজনে। পাশে পাশে। দৌড়ে চললো রাফিয়ান।
দারুণ হবে, না! প্যাড়াল ঘোরাতে ঘোরাতে বললো মুসা। দোতলার জানালা দিয়ে সাগরের দিকে চেয়ে থাকা, খোলা সাগর, খোলা আকাশ! জিনা, এবারও কি তোমার দ্বীপে পিকনিক করতে যাবে?
দেখি, বললো জিনা। এখন গিয়ে বোধহয় সুবিধে হবে না, বৃষ্টির দিন তো। যখন তখন নামবে, দ্বীপে আরাম পাবো না।
বাড়িতেই বা মন্দ কি? রবিন বললো। আর ক্যারোলিন আন্টিও যা ভালো …বেশি হৈ-চৈ করবো না আমরা, আংকেলকে ডিস্টার্ব না করলেই হবে। তাহলেই আর চটবেন না।
আমার মনে হয় না বাবার হাতে এখন কোনো জরুরী কাজ আছে, বললো জিনা।
থাকতেও পারে, বললো কিশোর। চুপচাপ বসে থাকতে হলেই মরেছি। কিছু একটা কাজ না পেলে শুধু সাগর আর আকাশ দেখে কি করে কাটাবো?
কি কাজের কথা বলছে কিশোর, বুঝতে পারলো অন্য তিনজন। রহস্য কিংবা অ্যাডভেঞ্চার। কিশোর পাশার নেশা।
এগিয়ে চলেছে ওরা।
একপাশে সাগর, ঘন নীল একটা বিশাল আয়না যেন, চকচক করছে উজ্জ্বল রোদে।
সত্যি তুমি লাকি, জিনা, সেদিকে চেয়ে মুসা বললো। এতো সুন্দর জায়গায় বাড়ি…