তবে বাড়ি আর মারতে হলো না তাকে। হয় এদিকে তাকালোই না ডেনার, কিংবা তাকালেও বুঝলো না যে কেউ লুকিয়ে রয়েছে।
থেমে গেল পায়ের শব্দ। নিশ্চয় পাল্লার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ডেনার। আপন, মনেই কথা বললো, বুদ্ধি ছিলো হামফ্রে ব্যাটার। এমনভাবে লাগিয়েছে, বোঝার উপায় নেই। হা-হাহ!
ক্লিক করে শব্দ হলো। ছেলেরা বুঝলো, দরজা খুলছে ডেনার। কিচকিচ আওয়াজ হলো, খুব সামান্য। কজাগুলোয় তেল দিয়ে রেখেছে হয়তো ডেনার।
আস্তে করে বস্তার একটা কোণ তুলে তাকালো কিশোর। এদিকে পেছন করে রয়েছে কেয়ারটেকার। পাল্লা খুলে গেছে। লণ্ঠন হাতে সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে গেল লোকটা।
এবার কি করবো? ফিসফিসিয়ে বললো মুসা। উঠে দৌড় দেবো?
না, নিষেধ করলো কিশোর। কাছেই রয়েছে ডেনার। শুনে ফেলবে। কান। পেতে শুনলো এক মুহূর্ত। আমার মনে হয়, গুপ্তধনগুলো দেখতে গেছে সে। দেখে চলে যাবে। তখন আমরা গিয়ে খুঁজে বের করে ফেলবো।
কিন্তু ডেনার আর আসে না।
ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে ওরা। পুরনো বস্তা, ধুলোময়লার নিচে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। সময় যেন আর কাটতে চাইছে না। দুত্তোর! বলে উঠে পড়তে যাচ্ছিলো। মুসা, এই সময় শোনা গেল পাল্লা খোলার শব্দ।
নিজে নিজে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো ডেনার। হাহ হা, কি চমৎকার! সোনার মোহর! বড় লোক হয়ে যাবে তুমি, মিস্টার ডেনার। হোহ হহ!!
ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল তার পায়ের আওয়াজ।
আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলো কিশোর। তারপর বস্তা সরিয়ে উঠে বসলো। শুনলে তো কি বললো? সোনার মোহর। এখানেই কোথাও লুকিয়েছে।
বস্তার নিচ থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। মুখে কাপড়ে লেগে থাকা ধুলো ঝাড়লো। বার কয়েক লাফঝাঁপ দিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে নিলো। রাফিয়ান। বানরটাও নাচলো তার সঙ্গে।
এই, থামাও ওকে, টকারকে বললো কিশোর। বেশি শব্দ করছে। কোত্থেকে আবার শুনে ফেলে ডেনার…হ্যাঁ, যা বলছিলাম, এখানেই আছি। ওটার ভেতরে, পাল্লাটা দেখালো সে। লেভার-টেভার কিছু নিশ্চয় আছে।
খুঁজতে শুরু করলো সবাই।
রবিনের আঙুলে লাগলো জিনিসটা। গোল একটা বোতামের মতো, পাল্লার পাশেই। জোরে চাপ দিতেই কিচকিচ করে খুলে গেল পাল্লাটা।
পাল্লার পরে সুড়ঙ্গ আর বেশি নেই। শেষ মাথায় খোলা। না, ঠিক খোলাও বলা চলে না। গোল মুখটা শেষ হয়েছে একটা কুয়ার দেয়ালে। বোধহয় মাঝামাঝি জায়গায়। ওপরের দিকে অনেক খানি উঠে গেছে সিলিণ্ডারের মতো গোল দেয়াল, নিচেও নেমে গেছে। কয়েক ফুট নিচে পানি।
কুয়া আর পাল্লার মাঝেই কোথাও লুকিয়েছে, মুসা বললো। এসো, খুঁজি।
নিরাশ হতে হলো। যদিও সুড়ঙ্গের কোনো গর্ত, খাজ, ফাটল বাদ দিলো না। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না গুপ্তধনের বাক্সটা।;
কোথায় রাখলো? বিড়বিড় করলো রবিন। দেখবো নাকি আরেকবার খুঁজে?
খোঁজা হলো আরেকবার। পাওয়া তো গেলই না, বরং একটা বিপদ বাধিয়ে বসলো টকার। হোঁচট খেয়ে গিয়ে পড়লো; পাল্লার ওপর। ধাক্কা লেগে বন্ধ হয়ে গেল ওটা। এহহে, দিলাম তো সর্বনাশ করে!
গুপ্তধন খোঁজা বাদ দিয়ে এখন পাল্লা খোলা নিয়েই ব্যস্ত হলো সবাই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এপাশে কোনো বোতাম বা লেভার পাওয়া গেল না। নেইই। বোধহয়। শিক ধরে জোরে টানাটানি করে দেখলো। নড়লোও না মজবুত পাল্লা। শিরের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলো মুসা–তার হাত আর সবার চেয়ে লম্বা পাল্লার পাশের বোতামটা ধরার চেষ্টা করলো। নাগাল পেলো না। শেষে শিকের ফাঁক দিয়ে নটিকে ওপাশে ঠেলে বের করে দিলো টকার। ইশারায় বোঝালো, কি করে বোতামটা টিপতে হবে।
নির্দেশ মতোই কাজ করলো বানরটা। কিন্তু তার শক্তিতে কুলালো না। টিপে নামাতে পারলো না বোতাম।
আরেকবার শিক ধরে টানা হলো, ঝাঁকি দিয়ে দেখা হলো, বৃথা চেষ্টা। বন্ধই রইলো পাল্লা।
হয়েছে, আর, শক্তি খরচ করে লাভ নেই, অবশেষে বললো কিশোর। খুলবে।
ভালো জায়গায়ই আটকা পড়লাম! বললো মুসা। কেউ জানে না আমরা। এখানে আছি। সাহায্য করতে পারবে না।
নিচের ঠোঁটে জোরে জোরে কয়েকবার চিমটি কাটলো কিশোর। তারপর ঘুরে এগিয়ে চললো কুয়ার দিকে। সুড়ঙ্গের মুখে এসে থামলো। ঝুঁকে টর্চের আলো ফেললো পানিতে। কালো পানি। বোঝা গেল না, কতোখানি গভীর। যতোখানিই হোক, ওখান দিয়ে বেরোনোর পথ নিশ্চয় নেই। ওপর দিকে টর্চের মুখ ঘোরালো। দেখা গেল না কিছু। শেষ মাথায় পৌঁছলোই না ছোট টর্চের আলোকরশ্মি। নিভিয়ে দিলো টর্চ। দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। চোখে অন্ধকার সয়ে এলে দেখলো, অনেক ওপরে আবছামতো আলো দেখা যাচ্ছে।
গুড, বললো সে। কুয়ার মাথায় ঢাকনা, ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। উঠে যেতে পারলে, হয়তো ঠেলে সরিয়ে ফেলা যাবে।
কিভাবে উঠবো? গলা কাঁপছে টকারের। ভীষণ ভয় পেয়েছে। জীবনে এরকম অবস্থায় আর পড়েনি। নিজেকে দোষারোপ করছে মনে মনে।
কিভাবে যাবো? বলতে বলতেই আবার টর্চ জ্বাললো কিশোর। কুয়ার দেয়ালে আলো ফেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। ওই যে, লোহার আঙটা লাগানো, রয়েছে। ওঠানামা করার জন্যেই। একধরনের মই। বেয়ে উঠে যাবো।
যদি খসে পড়ে যায়? জিনা বললো।
পানিতে পড়বো। তাতে মরবো না। এখানে বসে থেকে তো লাভ নেই। চেষ্টা করা দরকার।
দাঁড়াও, মুসা বললো। আমি আগে দেখি। আমার ভার সইলে সবারই সইবে। একটা আঙটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো সে। কিছু হলো না। ঝুলে পড়লো। তাতেও কিছু হলো না। খুব শক্ত করে গাঁথা হয়েছে পাথরের দেয়ালে।