ওরা বেরোতে আর সামান্য, দেরি করলেই ধরা পড়ে যেতো। ডেনারই আসছে।
ফেরার পথে ছোট একটা পশুচারণভূমিতে, একটা ওক গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে বসলো ওরা।
নিরাশ হলে চলবে না, বললো কিশোর। কাল আবার খুঁজতে যাবো। আমি শিওর, দুর্গ আর লজের তলায় আরও সুড়ঙ্গ আছে। ওরকম কোনোটাতেই গুপ্তধন লুকিয়েছে ডেনার।
পরদিন আবার গেল ওরা। ওয়ালটার লজে পাতাবাহারের বেড়া ছাঁটতে ব্যস্ত ডেনার। সেদিন আর তার কটেজে ঢুকলো না ওরা। বাগান, আর বাগানের কাছের। ছড়ানো চত্বরে খুঁজতে লাগলো। একটা ছাউনি দেখা গেল, সামনের দিকে দেয়াল নেই। খোলা। ওটা লুকানোর জায়গা নয়। তবু তার ভেতরে খুঁজে দেখা হলো।
ছাউনি থেকে বেরিয়ে আরেকটা ছোট ছাউনিমতো দেখতে পেলো। ভেতরে পাথরে তৈরি কাপড় ধোয়ার জায়গা। জায়গাটাকে ঘিরে দেয়া হয়েছে ফুটখানেক উঁচু পাথরের দেয়াল দিয়ে।
পায়ে পায়ে সেদিকে এগোলো কিশোর। প্রত্যেকটা পাথর খুঁটিয়ে দেখলো। তারপর হাত নেড়ে ডাকলো, এই দেখে যাও।
প্রায় ছুটে এলো সবাই।
এই পাথরটা সরাতে হবে।
নিচে কিছু আছে ভাবছো? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
দেখাই যাক না সরিয়ে।
সবাই হাত লাগালো। সহজেই সরিয়ে ফেললো পাথরটা। পুরনো মরচে ধরা, একটা হ্যাঁণ্ডেল দেখা গেল। ওটা ধরে টানতেই কাজ করলো পুরনো মেকানিজম, কাপড় ধোয়ার জায়গাটার ওপর থেকে সরে গেল একটা বড় পাথর। বেরিয়ে পড়লো একটা গহ্বর। আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ? নাকি কুয়া? কিন্তু কুয়ার ওপর এই বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকনা লাগাতে যাবে কেন?
নিশ্চয় সুড়ঙ্গ, অন্ধকারে গর্তটার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো কিশোর। চলো, নেমে দেখি।
দরকার পড়তে পারে। তাই টর্চ সঙ্গেই এনেছে ওরা।
হ্যাঁ, সুড়ঙ্গই। সিঁড়িও আছে। একে একে নেমে পড়লো সবাই। রাফিয়ান নামলো জিনার পেছনে। কিশোর রয়েছে আগে।
সিঁড়ির পাশে দেয়ালে একটা লেভার দেখা গেল। কিসের লেভার? ওপরের পাথরের ঢাকনাটা নিচ থেকে বন্ধ করার?–ভাবলো কিশোর। চাপ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল ওপরের ঢাকনা। উল্টো দিকে চাপ দিতেই খুলে গেল আবার।
ঠিক এই সময় শোনা গেল ভারি জুতোর আওয়াজ। এদিকেই আসছে।
তাড়াতাড়ি লেভার চেপে আবার ঢাকনা বন্ধ করে দিলো কিশোর। নিশ্চয় ডেনার। আমাদের দেখেছে বলে মনে হয় না। এখন এখানে এসে না ঢুকলেই বাঁচি।
ডেনারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো না ওরা। সে দেখে ফেলবে, আগেই লুকানোর একটা জায়গা খুঁজে বের করার জন্যে সুড়ঙ্গ ধরে আগে বড়িলো, দ্রুত।
দুরুদুরু করছে সবার বুক। কিশোরের পেছনে রয়েছে রবিন, তার পেছনে টকার আর তার কাঁধে নটি। মুসা রয়েছে তার পেছনে। সবার পেছন জিনা আর রাফিয়ান।
১৩.
অসমতল, এবড়ো-খেবড়ো মেঝে। মাঝে মাঝে চোখা পাথর বেরিয়ে আছে। সাবধানে এগোতে হচ্ছে, নইলে হোঁচট খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা।
সামনে মোড় নিয়েছে সুড়ঙ্গ। ওখানে এসে থামলো ওরা। কান পাতলো। ।
না, কিছু শোনা যাচ্ছে না, জোরে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে মুসা। নীরব সুড়ঙ্গের দেয়ালে প্রতিহত হয়ে ফিসফিসানিই হয়ে উঠলো অনেক জোরালো।
কিন্তু মুসার সঙ্গে একমত হতে পারলো না যেন রাফিয়ান। কান খাড়া করে রেখেছে। মৃদু গরগর করছে।
রাফিয়ানই ঠিক। অতি মৃদু একটা শব্দ কানে এলো ওদের।
পাথর সরাচ্ছে! বলে উঠলো টকার।
জলদি! বলেই প্রায় দৌড় দিলো কিশোর।
এখানে ডেনার তাদেরকে দেখে ফেললে কি করবে বলা যায় না। হয়তো কিছুই করবে না, কিন্তু সন্দিহান হয়ে উঠবে। তাহলেও ওদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। গুপ্তধন সরিয়ে ফেলবে ডেনার–যদি এই সুড়ঙ্গের কোথাও থেকে থাকে। হয়তো নিয়ে পালাতেও পারে আগেভাগেই।
সকলের পাশ কাটিয়ে আগে চলে এলো রাফিয়ান। মাটিতে গন্ধ শুকে এঁকে এগোলো। কোনো বিপদ থাকলে তার নাকে ধরা পড়বে।
পেছনে এগিয়ে আসছে ভারি জুতোর শব্দ। দ্রুত। এই সুড়ঙ্গ ডেনারের চেনা, কাজেই তাড়াতাড়ি চলতে তার কোনো দ্বিধা নেই। অসুবিধেও হচ্ছে না। এই হারে এগিয়ে এলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের কাছে চলে আসবে।
হঠাৎ থেমে গেল গোয়েন্দারা। ছোট গোল একটা গুহায় ঢুকেছে। মেঝেতে পাথরের ছড়াছড়ি। গুহার অন্য ধারের দেয়ালের ওপাশে আবার রয়েছে সুড়ঙ্গ। মাঝখানের পথ রুদ্ধ। লোহার পাল্লা, মোটা মোটা শিক।
পেছনে যাওয়ার উপায় নেই, সামনেও দরজা বন্ধ। ফাঁদে আটকা পড়লো ওঁরা!
গোঁ গোঁ করে উঠলো রাফিয়ান। পাগলের মতো এদিক ওদিক তাকালো টকার, জিনা আর মুসা। লুকানোর জায়গা খুঁজছে। রবিনের স্নায়ুর জোর ওদের চেয়ে বেশি। আর কিশোর একেবারে শান্ত। সহজে মাথা গরম হয় না তার। একগাদা পুরনো বস্তা অযতে ফেলে রাখা হয়েছে এককোণে, সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।
কুইক! বললো আচমকা। ওগুলোর তলায়ই লুকাতে হবে।
ছুটে গেল সবাই। রাফিয়ানকে শুইয়ে বস্তা দিয়ে ঢেকে দিলো জিনা। এক এক করে সবাই শুয়ে পড়লো, গায়ের ওপর টেনে দিলো বস্তা। চুপ করে অনড় পড়ে রইলো। পারলে নিঃশ্বাসও বন্ধ করে রাখতে চায়। টর্চ নিভিয়ে দিয়েছে। ফলে গাঢ় অন্ধকার গুহার ভেতরে।
স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ডেনারের জুতোর শব্দ। খানিক পরেই গুহায় ঢুকলো। বস্তার তলা থেকেও তার হাতের লণ্ঠনের আলো দেখতে পেলো ওরা।
এদিকে তাকাবে না তো ব্যাটা! মুসা ভাবলো। তাহলে যা থাকে কপালে, পাথর দিয়ে মারবো মাথায় বাড়ি!