অন্যদেরও মনে ধরলো কথাটা। অনেকদিন পর একটা নতুন ধরনের কাজ পাওয়া গেছে।
বাক্সে রয়েছেঃ ছয়শো সোনার মোহর, পান্না খচিত এক সেট গহনা, হীরা আর নীলকান্ত মণি বসানো একটা ব্রেসলেট, বিশাল একটা রুবি পাথর, একটা টায়রা, একটা হীরার লকেট, অনেকগুলো আঙটি আর কানের দুল,–প্রায় সবগুলোতেই মূল্যবান পাথর বসানো। বড় বড় মুক্তো আছে অনেকগুলো, গোটা তিনেক সোনার ব্রেসলেট, তিনটে সোনার চেন, দুটো সোনার ঘড়ি (বন্ধ হয়ে আছে), চারটে সোনার বড় বড় মেডেল। আর আছে হাতির দাঁতে খোদাই করা দুটো প্রতিকৃতিঃ একটা পুরুষের, আরেকটা মহিলার। পুরুষেরটার নিচে নাম লেখা রয়েছে হামফ্রে ডেভিড ওয়ালটার। আর মহিলাটার নিচে টেরিলিন ওয়ালটার।
হামফ্রের স্ত্রীর নাম কি ছিলো, জানেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
টেরিলিন…
হু। তারমানে গুপ্তধন হামফ্রেই লুকিয়েছিলো। এই প্রতিকৃতি দুটোই তার প্রমাণ।
কি করবে এখন এগুলো? রবিন জানতে চাইলো।
জবাব না দিয়ে লিয়ারির দিকে তাকালো কিশোর। ডাক্তার ওয়ালটার এখন। কোথায়? এখানে, না লণ্ডনে?
ঠিক বলতে পারবো না, বৃষ্টির জন্যে বেরোতেই তো পারি না, বললো লিয়ারি। তবে সেদিন মুদির বৌ বলছিলো, এখানে নেই। দুচার দিনের মধ্যে আসবে। তারমানে আজ কিংবা কাল আসবে।
জানালার বাইরে তাকালো কিশোর। বৃষ্টি বোধহয় আর আসবে না। বন্ধুদের দিকে ফিরলো। একবার গেলে কেমন হয়? ওয়ালটার লজে? ডাক্তার থাকলে তাঁকে জানাবো খবরটা। এসে নিয়ে যাবেন। আইনতঃ জিনিসগুলো এখন তাঁরই পাওনা।
চলো, মুসা রাজি। হেঁটে, না সাইকেলে?
সাইকেল।
দ্রুত প্যাড়াল করে চললো ওরা। অনেক দিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকার পর। মুক্তির আনন্দ, তার ওপর গুপ্তধন পাওয়ার উত্তেজনা, টগবগ করে ফুটছে যেন শরীর রক্ত। টকারের সাইকেল নেই, সে বসেছে মুসার সাইকেলের ক্যারিয়ারে।
নটি চলেছে রাফিয়ানের পিঠে সওয়ার হয়ে।
অবশেষে দূর হয়ে গেছে মেঘ। কড়া রোদে ভেজা মাটি থেকে বাষ্প উঠছে। গাছপালা ঘন সবুজ, এক কণা বালি নেই, ধুয়েমুছে সব সাফ হয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে চললো ওরা।
.
০৮.
ভাঙা দুর্গের পাশ দিয়ে পথ চোখে পড়লো ওয়ালটার লজের শাদা, দেয়াল। প্রায় বর্গাকার চমৎকার একটা বাংলো। বেগুনী উইসট্যারিয়া আর অন্যান্য লতায়, ছেয়ে রয়েছে। সুন্দর ছিমছাম বাগানে নানারকম ফুলের ঝাড়, বেড, সবুজ ঘাসে ঢাকা লন।
গেটের কাছে এসে সাইকেল থেকে নামলো ওরা। পাল্লার লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকালো। বাগানে কাজ করছে একটা লোক।
গেটের পাশে লাগানো ঘন্টা বাজানোর শেকল ধরে টানলো কিশোর।
ঘন্টার শব্দে ফিরে তাকালো লোকটা। খোয়া বিছানো পথে জুতোর মচমচ শব্দ তুলে এগিয়ে এলো গেটের কাছে। মাঝবয়েসী, মাথায় পাতলা চুল, ধূসর। গোলগাল মুখে পাতলা ঠোঁটজোড়া বড় বেশি বেমানান। চেহারায় বিরক্তি। পরনে, কর্ডের প্যান্ট-ময়লা, মাটি লেগে রয়েছে। গায়ে নীল ওভারঅল। গভীর কণ্ঠে। জিজ্ঞেস করলো, কি চাই?
ডাক্তার ওয়ালটার আছেন? ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
জবাব দিলো না লোকটা। এক এক করে তাকালো পাঁচজনের মুখের দিকে। তারপর বললো, আজেবাজে ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলেন না তিনি।
কথা বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল কিশোর।
লোকটা বললো, তোমাদের মতো কেউ যাতে ঢুকতে না পারে, সেদিকে কড়া। নজর রাখতে বলা হয়েছে আমাকে।
রাগে-লাল হয়ে গেল জিনার মুখ। এমনিতেই ধৈর্য তার কম। ঝাঝালো কণ্ঠে বললো, দেখুন, বড় বড় কথা বলবেন না। আজেবাজে ছেলেমেয়ে নই আমরা। আপনাকেই বরং বাজে লোক মনে হচ্ছে আমার। যান, গিয়ে বলুন, জরুরী কথা। বলতে এসেছি তাঁর সঙ্গে।
আরও গম্ভীর হয়ে গেল কেয়ারটেকার। তারপর হঠাৎ হাসতে আরম্ভ করলো। জরুরী, না? হাহ্ হাহ্ হা! তা জরুরী ব্যাপারটা কি জানতে পারি, ম্যাডাম?
দেখুন, শীতল কণ্ঠে বললো কিশোর। ওর নাম জরজিনা পারকার। প্রফেসর হ্যারিসন পারকারের নাম নিশ্চয় শুনেছেন, বিখ্যাত বিজ্ঞানী, তাঁর মেয়ে। কাজেই বুঝতে পারছেন, আজেবাজে কেউ নই আমরা। এখন দয়া করে গিয়ে যদি ডাক্তার সাহেবকে খবর দেন, খুশি হবো।
দ্বিধা ফুটলো লোকটার চোখে।
যান, মুসা বললো। গিয়ে বলুন, জরুরী কথা আছে। তাঁরই লাভ।
হ্যাঁ, মুসার কথার পিঠে বলে উঠলো টকার। তাঁর জন্যে সুখবর। গুপ্তধন পাওয়া গেছে।
এই, তুমি চুপ করো তো! ধমক দিয়ে টকারকে থামিয়ে দিলো কিশোর।
গুপ্তধন? ভুরু কোঁচকালো কেয়ারটেকার। তারপর হা-হা করে হাসলো। এই গপ্লোই শোনাতে এসেছো নাকি? নিশ্চয় বলবে, মিস্টার হামফ্রে ওয়ালটারের গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছো তোমরা?
কড়া গলায় জিনা বললো, আপনার সঙ্গে আমাদের কোনো কথা নেই! যা বলছি করুন। ডাক্তার ওয়ালটারকে খবর দিন, চাকরিটা না খোয়াতে চাইলে। জলদি করুন।
থাকলে তো খবর দেবো, সামান্য নরম হলো কেয়ারটেকার। বাড়ি নেই। আজ সকালেই আসার কথা ছিলো। বৃষ্টির জন্যেই হয়তো আসতে পারেননি। আকাশ ভালো থাকলে রাতে চলে আসতে পারেন, কিংবা, কাল কিংবা পরশু…ঠিক নেই। আমাকেই খুলে বলো সব। এলে তাঁকে জানিয়ে দেবো।
কর্কশ ব্যবহার অনেক কোমল হয়ে গেছে লোকটার। কিন্তু তবু কেউই তাকে পছন্দ করতে পারলো না। এমনকি রাফিয়ানও না। শিকের ফাঁক দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে। তার জুতো শুকলো, তারপর মৃদু গররর করে উঠলো।