হঠাৎ উজ্জ্বল নীল আলোয় আলোকিত হয়ে গেল দশদিক। ছাউনির নিচে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এলো ছেলেরা। আলোর প্রায় পর পরই বাজ পড়লো। এতো জোরে আওয়াজ হলো, মনে হলো কানের পর্দা ফেটে গেল ওদের, থরথর করে কেঁপে উঠলো মাটি। চেঁচালো রাফেয়ান। চি-চি করলো বানরটা।
কটেজের ওপর পড়েছে! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে টকারের। হায় হায়, বেচারি লিয়ারি…
চুপ! থামিয়ে দিলো তাকে কিশোর। কটেজে নয়। ওই দেখো, ওক গাছটা…দেখেছো?
ঘন বৃষ্টির মাঝ দিয়েও দেখা গেল। দেখলো সবাই। একটু আগের সুন্দর ওঁক গাছটা আর নেই, দাঁড়িয়ে আছে শুধু ওটার পোড়া কালো কাণ্ড, ধোয়া বেরোচ্ছে।
আল্লাহরে! কি সর্বনাশ! আঁতকে উঠে বললো মুসা। কয়েক মিনিট আগে…
নটি ছিলো ওটার ডালে…, বললো টকার।
আর আমরা সবাই ছিলাম ওটার তলায়! জিনা শেষ করলো কথাটা।
.
০৭.
ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল বাজের শব্দ। বিদ্যুতের ঝিলিকও কমলো। থেমে আসছে ঝড়।
শোনা গেল লিয়ারির ভয়ার্ত ডাক, কিশোর! জিনা! কোথায় তোমরা?
আমরা ভালোই আছি, চেঁচিয়ে জবাব দিলো কিশোর। আপনি বেরোবেন। না। আমি আসছি। অন্যদেরকে ছাউনিতে থাকতে বলে বেরিয়ে গেল সে। এক ছুটে গিয়ে ঢুকলো কটেজে।
দশ মিনিট পর ফিরে এলো আবার। প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে শুকনো সোয়েটার। নিয়ে এসেছে সবার জন্যে। আর এনেছে বড় একটা ঝুড়ি। তাতে স্যাণ্ডউইচের প্যাকেট, মস্ত এক চকোলেট কেক, বড় এক ফ্লাস্ক কোকা।
এই না হলে তুমি আমার ভাই! বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে হেসে বললো মুসা।
হয়েছে হয়েছে, এসো এখন শেষ করে ফেলা যাক। খুব খিদে পেয়েছে।
তোমারই যখন খিদে, আমার অবস্থা বোঝো!
হেসে উঠলো সবাই।
দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সমস্ত খাবার। একটা কণাও অবশিষ্ট থাকলো না। এমনকি মাটিতে যা পড়লো, তা-ও না। চেটেপুটে শেষ করলো রাফিয়ান আর নটি।
বৃষ্টি থেমেছে।
রবিন বললো, চলো তো, কাছে গিয়ে দেখি গাছটার অবস্থা।
ছাউনি থেকে বেরোলো সবাই। হঠাৎ করেই দেখা দিলো সূর্য। মেঘ তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে ঝড়ো বাতাস।
ইস, এতো সুন্দর গাছটা গেল? আফসোস করে বললো জিনা।
হ্যাঁ, আনমনে বিড়বিড় করলো কিশোর। লিয়ারি বললো না সেদিন, গাছটা অনেক পুরনো। হামফ্রে ওয়ালটার যখন এসেছিলো, তখনও ছিলো।
আরও কাছে এগিয়ে গেল ওরা। গাছটার চারপাশের গোড়ার মাটি যেন খুবলে তুলে ফেলেছে কোনো দানব। গর্ত হয়ে গেছে। একটা পরিখার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। রয়েছে যেন এখন পোড়া কাণ্ডটা।
কাণ্ড দেখেছো, কতো বড় গর্ত? টকার বললো। বাজের এতো জোর!
খেলাচ্ছলে লাফ দিয়ে গর্তে নামলো নটি। কি একটা জিনিস কৌতূহল জাগিয়েছে তার। সরু সরু আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। দেখাদেখি রাফিয়ানও গিয়ে নামলো, মাটি খোঁড়ায় সাহায্য করলো বানরটাকে।
পোকা খুঁজছে, হেসে বললো টকার।
ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে কিশোর। গম্ভীর। আরও ভালোমতো দেখার জন্যে গর্তের কিনারে গিয়ে কুঁকলো। কঠিন কিছু একটাতে কুকুরটার নখ লেগে শব্দ হয়েছে। কি ওটা? বললো, এই রাফি, খোড়। আরও খোড়।
হঠাৎ প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো সবাই। বেরিয়ে পড়েছে রঙচটা, মরচে পড়া একটা ধাতব বাক্স।
কি ওটা? মুসার প্রশ্ন।
হয়তো গুপ্তধন, রসিকতা করে হাসলো রবিন।
হু, গুপ্তধন পাওয়া এতোই সহজ! জিনা বললো।
কিশোর ততোক্ষণে নেমে পড়েছে গর্তে। মাটি সরিয়ে বাক্সটা তুলে আনার চেষ্টা করছে।
ওভাবে পারবে না, মুসা বললো। দাঁড়াও, খন্তা-টন্তা কিছু একটা নিয়ে। আসি। এক দৌড়ে গিয়ে কটেজ থেকে একটা শাবল নিয়ে এলো সে। দুজুনে মিলে খুঁড়ে তুলে আনলো বাক্সটা।
তালা আছে, কিন্তু এতো পুরনো, মরচে পড়ে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। শাবল দিয়ে এক বাড়ি মারলো মুসা। হুক ভেঙে তালাটা খুলে,ড়ে গেল।
ডালা তুললো কিশোর।
হাঁ হয়ে গেল সবাই।
সত্যি গুপ্তধন! সোনার মোহর আর নানারকম অলংকার।
চোখ ডলো কেউ, কেউ চিমটি কাটলো নিজের হাতে। না, জেগেই তো আছে, স্বপ্ন দেখছে না। তারমানে আসলেই গুপ্তধন পেয়েছে। গুপ্তধন পাওয়া নতুন। কোনো ব্যাপার নয় ওদের জন্যে, আগেও অনেক বার পেয়েছে। তবে এভাবে নয়, অনেক খুঁজতে হয়েছে। এই
বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও আমার, বিড়বিড় করলো রবিন।
অনেক কিছুই ঘটে এই পৃথিবীতে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে বললো কিশোর, যার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না।…্যাকগে, পেয়েছি এ-তো আর মিছে। কথা নয়। চলো, এগুলো কটেজে নিয়ে যাই। কার জিনিস, হয়তো লিয়ারি বলতে পারবে।
বাক্সটা নিয়ে এলো ওরা। রান্নাঘরের টেবিলে রেখে খুললো।
একবার অকিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল লিয়ারি। অনেকক্ষণ পর কথা ফুটলো মুখে, গুজব তাহলে মিথ্যে নয়! সত্যিই গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গেছে হামফ্রে ওয়ালটার।
সেদিন তো বললেনই লুকিয়েছে, কিশোর বললো।
বলেছিলামঃ লোকে বলে। বিশ্বাস করতাম না। এখন তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি…
কিন্তু লুকালো কেন?
স্বভাব, জবাবটা দিলো রবিন। জলদস্যুরা ধনরত্ন লুকাতে অভ্যস্ত ছিলো, হয়তো সে-কারণেই নিরাপদ জায়গায় এসেও নিশ্চিত হতে পারেনি হামফ্রে। ওয়ালটার। কিছুটা লুকিয়ে রেখেছিলো ওই ওক গাছের তলায়।
কি জানি। হতেও পারে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিশোর।
এসো না, কি কি আছে দেখি? একটা লিস্ট তৈরি করে ফেলি, প্রস্তাব দিলো টকার। গুপ্তধনের গল্প শুধু বইয়েই পড়েছে এতোদিন, চোখে দেখেনি।