আবার কুমিরের ডিম খেতে হবে। গুঙিয়ে উঠল রবিন।
তা নাহয় খেলাম। আমার ভয়, জংলী হারামীদের তীর খেয়ে না মরি, মুসা। বলল।
দেখো, গম্ভীর হয়ে বললেন মিস্টার আমান, ভয় পেলে কিংবা খুঁতখুঁত করলে অ্যাডভেঞ্চার হয় না। আরাম চাইলে বাড়িতে বসে থাকলেই পারতে। এখনও সময় আছে, ইচ্ছে করলে জোনসের সঙ্গে ফিরে যেতে পারো। …
ম্যাজিকের মত কাজ করল তার কথা। ডজন ডজন কুমিরের ডিম খেতেও আপত্তি রইল না রবিনের। জংলীদের তীর কেন, বল্লমের খোঁচায় মোরব্বা হতে রাজি আছে মুসা, তবু কাপুরুষ দুর্নাম নিয়ে রকি বীচে ফিরে যাবে না।
প্রায় সারাদিনই খায় এখানকার জিভারোরা।
কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আবার এল খাবার। তবে এবার আর কুমিরের ডিম। নয়। লালচে-সাদা মাংসের বেশ বড় বড় টুকরো।. খুব নরম। আশটে গন্ধ, অনেকটা মাছের মত, তবে স্বাদটা মুরগীর। মুখে দিয়ে ভাল লাগল রবিনের, জিজ্ঞেস। করল না কিসের মাংস। জানলেই যাবে অরুচি হয়ে।
কিন্তু মুসা জিজ্ঞেস করে বসল।
বোয়া কনসট্রিকটর, জানাল জোনস। এক জাতের মস্ত অজগর।
ব্যাটারা সাপও বাদ দেয় না, বিড়বিড় করল রবিন। চিবানো থামাল না, কিন্তু। বিস্বাদ হয়ে গেল খাবার। কোত করে গিলে ফেলল। বকা শুনতে আর রাজি নয়।
তার অবস্থাটা বুঝলেন মিস্টার আমান। হেসে বললেন, খেলে ক্ষতিটা কি বলো? যদি হজম হয় আর স্বাদ খারাপ না হয়? কেন, সভ্য ফরাসীরা শামুক খায় না, চীনারা পাখির বাসা খায় না, জাপানীরা আগাছা খায় না? আর আমরাও তো সী সাইডের রেস্টুরেন্টগুলোতে গিয়ে পিচ্ছিল ঝিনুক খেয়ে আসি হরহামেশা। তুমিও তো অনেক খেয়েছ। ধর্মের কারণে আমরা শুয়োর খাই না, তোমরা তো খাও। তোমার আমার মাঝেই তো খাবারের ফারাক। আসল কথা হলো, মানুষ যেখানে যেভাবে থাকে, প্রকৃতি তাকে যে খাবার সাপ্লাই করে, তাই খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়। কারও কাছে সেটা অমৃত, কারও কাছে কিলবিলে শুয়োপোকা
কিন্তু লেকচারে কি আর কাজ হয়? অভ্যাস বড় বাজে জিনিস। খাওয়াটা আর ফেলল না বটে রবিন, তবে রুচিও হলো না, জোর করেই গিলতে লাগল।
বিকেলে কুইটোতে ফিরে চলল জোনস।
বিষণ্ণ মুখে তাকে বিদায় জানাল অভিযাত্রীরা। দিগন্তে হারিয়ে গেল প্লেন। তাদের মনে হলো, সভ্যতার শেষ ছোঁয়াটুকুও যেন মুছে গেল।
সাঁঝ হতেই আশপাশের বনে শুরু হলো নানারকম গর্জন, চিৎকার, কাশি– দিনের শব্দগুলোর সঙ্গে ওগুলোর মিল নেই।
সারারাত ভাল ঘুম হলো না কিশোরের। খালি এপাশ ওপাশ করল মাদুরের। ওপর বিছানো কম্বলে শুয়ে। একটা ব্যাপারে শিওর হয়ে গেল, ঠিক জায়গায়ই এসেছে ওরা, ঠিক জায়গাতেই চলেছে দুর্লভ জন্তু ধরার জন্যে। জন্তু-জানোয়ারের স্বর্গ এই অঞ্চল।
শেষ রাতের দিকে সামান্য তন্দ্রামত এসেছিল। স্বপ্ন দেখল, তাদের তাড়া করছে ভীষণ চেহারার নরমুণ্ড শিকারী জংলীরা।
টুটে গেল তন্দ্রা। ঘেমে গেছে সারা শরীর। জংলীদের ভয়াবহ চেহারা ভাসছে এখন্ও চোখের সামনে। তাদের মাঝেই ধীরে ধীরে উঁকি দিল আরেকটা চেহারা, জংলীদের চেয়ে কম কুৎসিত নয়। সেই লোকটা, কুইটোতে সেরাতে যে পিছু। নিয়েছিল।
জোর করে মন থেকে চেহারাটা দূর করার চেষ্টা করল কিশোর। নিজেকে বোঝাল, কুইটো থেকে অনেক দূরে দুর্গম জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে ওরা, এখানে। আসতে পারবে না সেই লোক।
কিন্তু বুঝ মানল না মন।
০৫.
পর দিন খুব ভোরে উঠল অভিযাত্রীরা।
ভাল একটা নৌকা দিয়েছে সর্দার। ওদেরই তৈরি একটা ক্যানূ।ফুট পঁচিশেক লম্বা, পেটের কাছের সবচেয়ে চওড়া জায়গাটার মাপ দুই ফুট। চার-পাঁচ জন মানুষ আর প্রয়োজনীয় মালপত্র বহন করার উপযোগী।
আস্ত গাছ কেটে তৈরি, নৌকাটা না দেখলে কারিগরের দক্ষতা আচ করা যায়। কুঁদে কুঁদে ফেলে দেয়া হয়েছে ভেতরের সমস্ত কাঠ, এক ইঞ্চি পরিমাণ রেখে। নৌকাটার যেখানেই হাত দেয়া যাক, এক ইঞ্চি পুরু। কাঁচা লোহায় তৈরি হাতুড়ি বাটালে কাজ করেছে কারিগর; শুধু হাতের আন্দাজে কি করে মাপ ঠিক রাখল। কোথাও কম বেশি হলো না, কিংবা ছিদ্র হলো না, ভাবলে অবাক হতে হয়। নৌকা। তৈরির পর তার ভেতরে-বাইরে দু-দিকেই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। না, পোড়ানো হয়েছে বললে ভুল হবে, বরং বলা যায় ভালমত আগুনের ছ্যাঁকা দেয়া হয়েছে। আলকাতরা তো আর নেই ইনডিয়ানদের, তাই পানি যাতে না লাগে তার জন্যে এই ব্যবস্থা।
হাঁসের পিঠে পানি পড়লে যেভাবে গড়িয়ে পড়ে যায়, চিহ্ন থাকে না, নৌকাটার অবস্থাও তা-ই। তবে একটা দোষ আছে, পানিতে দু-পাশে গড়ায় খুব বেশি। ভারসাম্য ঠিক রাখা কঠিন। ইনডিয়ানদের অভ্যাস হয়ে গেছে। স্বচ্ছন্দে চালিয়ে নিয়ে যায় ওরা, সব চেয়ে খরস্রোতা নদীতে উথাল-পাথাল ঢেউয়েও কাত হয় না নৌকা, দিব্যি তরতর করে ছুটে যায়।
আমরাও অভ্যাস করে নেব, মুসা বলল। নৌকা বাওয়ার ওস্তাদ সে। রকি বীচে যখন ফিরে যাব, বুকে থাবা মেরে হাত নাড়ল, আচার আচরণে খাওয়া দাওয়ায় আমরা তখন পুরোদস্তুর জিভারো ইনডিয়ান।
কথা বাদ দিয়ে কাজ করো, তাড়া দিলেন তার বাবা। জিনিসপত্রগুলো তোলা দরকার।
ছোট ছোট পোটলা করে বাঁধা হলো সমস্ত মাল। খুব সাবধানে সাজিয়ে রাখা হলো নৌকার তলায়। ওজন কোথাও কম বেশি হলে ভারসাম্য নষ্ট হবে। একটা পোটলার ওপর আরেকটা এমন ভাবে রাখা হলো, প্রয়োজনরে সময় যাতে ওগুলো। টপকে কিংবা ওগুলোর ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়া যায়। যাত্রী-কাম-মাল্লারা বসে দাঁড় বাওয়ার জন্যে মালের ফাঁকে ফাঁকে অনেকখানি করে জায়গা ছাড়া। হলো। ওসব ইনডিয়ান ক্যানূতে পাটাতন থাকে না, তাই পাটাতন বসানোর জন্যে। আড়াআড়ি তক্তা লাগানোরও দরকার পড়ে না। নিজেদের সুবিধের জন্যে কয়েকটা তক্তা লাগিয়ে নিল অভিযাত্রীরা। সেগুলোর সঙ্গে শক্ত করে বাধল বন্দুক আর ভারি। জিনিসপত্র। কোন কারণে নৌকা উল্টে গেলেও জিনিসগুলো পানিতে হারাবে না।